লতাকরঞ্চ (৮)

0
683

লতাকরঞ্চ (৮)

আম্মার রুমে গিয়ে আম্মার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছি। টপ টপ করে চোখের জল পড়ছে। আম্মা আবার অতিরিক্ত ডিপ্রেসড একজন মানুষ তাই আম্মাকে কোনোভাবেই এই চোখের জল দেখানো যাবেনা। আড়াল করার বৃথা চেষ্টা করতেছি। কিন্তু কোনো ফায়দা হলোনা। আম্মা কাঁথায় সুঁচ বসাচ্ছিলো। এই ফাঁকে কখন যে দেখে নিলো আমার চোখে জল তা জানা নেই।
– কি হলো মা? কেউ কিছু বলেছে?

আমি চোখের জল মুছে বললাম,
– না আম্মা। এমনিতেই। চোখের মধ্যে কি যেন একটা পড়েছে মনে হয়..
আম্মা বললেন,
– চশমাটা খুলছিস কেন তুই? তুই না কম দেখিস? খুলে রাখিস কেন?

আম্মা কি আর জানে যে আমি শোভা নামের মেয়েটার সাথে মনের অজান্তেই পাল্লা দিয়ে আসতেছি।
গুরুতর প্রয়োজন ছাড়া চশমা পড়িইনা এখন।
কারন শোভা নামের মেয়েটা আমার চেয়েও বেশি আধুনিক; সুন্দরী ও বটে। চশমা না লাগিয়েও তো আজ কত কথা শুনায়ে দিলো উনি।
আম্মা বললেন,
– লতা?
– হুঁ।
– শোভা নামের মেয়েটাকে তোর কেমন লাগে?
– ভালো।
– প্রান্তিকের সাথে কেন আসছে এ বাড়িতে, এ ব্যাপারে কিছু জানিস? প্রান্তিক কিছু বলেছে তোকে?
– না।

– তোর বড় ফুফুতো এই মেয়েটাকে বউ করে আনার ফন্দি আঁটতেছে… জানিস?

আম্মা আরো বললেন,
-অবশ্য মেয়েটা খারাপ না।
এখনকার যুগে এরকমই হয়, ঢাকাইয়্যা তো..
তোর আব্বার কিন্তু পছন্দ হয়নি, জানিস?
তোর বড় ফুফু চাইতেছে লিমার বিয়ের সাথে সাথে প্রান্তিকের বিয়েটা ও সেরে নিতে। কিন্তু প্রান্তিক কিছুই বলছেনা। গাঁধা তো তাই। ঐ মেয়েকে কেন এ বাড়িতে নিয়ে আসছে, তা কি আমরা বুঝিনা নাকি! আমরাতো কচি খুকি না।
নিশ্চয়ই দুজন-দুজনকে পছন্দ করে, তাই ঐ মেয়েটাকে একদম বাড়িতে পর্যন্ত নিয়ে আসছে। কই এতদিন তো কাউকে আনেনি!
কিরে কথা বলছিস না যে?

আমি বাকরুদ্ধ।
অবিশ্বাস্যরকমভাবে কোনো কথাই বের হচ্ছে না মুখ দিয়ে।
আম্মা ঝাঁকুনি দিয়ে বললো,
– তোরা কেউই কি আমাকে সময় দিতে পারিস না? যার সাথেই একটু কথা বলি, সেই এরকম অন্যমনষ্ক হয়ে যায়। ওদিকে তোর আব্বাকে দেখ! উনিতো সারাবাড়িতে হৈ চৈ শুরু করে দিয়ে; সব মাথায় তুলে নিয়েছে এই এক বিয়ে-বিয়ে করে। আর লিমাতো এখনো ঘুম থেকেই উঠতে পারলোনা।

আমি বললাম,
– হুঁ। যা ইচ্ছা বলেন শুধু প্রান্তিক ভাইকে নিয়ে কিছু বলবেন না।
আম্মা বললো,
– কেন? তোর কি সমস্যা?
– ভালো লাগেনা তাই।

আম্মা অপ্রতিভ কিউরিসিটি নিয়ে বললো,
– হ্যাঁ রে লতা? একটা কথা বলি…
– হুঁ।
– তোর কিশোরকে কেমন লাগে, মা? ছেলেটা খুব ভালো.. তোর আব্বার ও ভীষণ পছন্দ হয়। আমারতো হয়ই।
আমি স্বাভাবিকভাবে বললাম,
– তো?
আম্মা অস্বাভাবিকভাবে বললেন,
– বিয়ে করবি ছেলেটাকে?

আমি কিছু বললাম না।
আম্মা তাড়া দিচ্ছে।
কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম ঠিক তখনি শুনলাম বাইরের রুম থেকে কান্নাকাটির আওয়াজ ভেসে আসতেছে।

দৌঁড়ে যেতে চাইলাম। কিন্তু আম্মার কোমরে ব্যাথা, খাট থেকে নামতে কষ্ট হয় তাই আম্মাকে নিয়েই এলাম। পাশের রুমেই অনেক মানু্ষের ভীড়। প্রান্ত ভাই ও আছে। কি হয়েছে?

তাড়াতাড়ি করে হট্টগোল ছাড়িয়ে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেলো আমার।
আব্বা হা করে, চোখ খোলা রেখে একদম সটান হয়ে শুয়ে আছে!
বমি করতেছে কিছুক্ষন পর পর।
সারা শরীর ঘেমে যাচ্ছে বার বার। মনে হয় যেন এইমাত্র কেউ পানি ঢেলে দিয়ে গিয়েছে। এদিকে মুছতেছে আবার সেই একিরকমভাবে ঘেমে ভিজে যাচ্ছে।
_____________
________

আব্বার হার্ট-এট্যাক হয়েছে।
বড় ফুফা তড়িঘড়ি করে এম্বুলেন্স খবর দিয়েছে।
হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আব্বাকে।
এম্বুলেন্সে আব্বার পাশেই আমি বসেছিলাম।
আব্বার খুব কষ্ট হচ্ছে, বুঝতে পারতেছি।

আম্মার অবস্থা ও ভালো না।
কথা ও বলেনা, কাঁদে ও না।
চুপচাপ তাকিয়ে আছে শুধু, দৃষ্টি স্থির করে।
কিন্তু আম্মাকে নিয়ে পড়ে থাকার সময় এখন কারোরই নেই। বাড়িতে আমরা অল্প ক’জন
মানুষ। সবাই পড়ে আছি আব্বাকে নিয়ে।

আমি সেদিনই প্রথম বুঝতে পারলাম যে আমি আব্বার খুব প্রিয়। আম্মার হাত, লিমা আপুর হাত কারোটাই ধরেনি।
শুধু বুকের ব্যাথাটা মারাত্বক হয়ে উঠলে আমার হাতটা ঝাপটে ধরে।
এত শক্ত করে চেপে ধরে যে আমার কষ্ট হয়ে যায়…ব্যাথা পেয়ে যাই।

আব্বা অক্সিজেন মাস্ক নাক থেকে সরিয়ে নিয়ে বললো,
– মা, আ_আ_আমিতো তোদের কিছু করে দিয়ে যেতে পারলাম নারে, মা…
আমি মাস্কটা ঠিক করে দিলাম আর বললাম,
– সব ঠিক আছে আব্বা। আপনি এত চিন্তা কইরেন না।
আমার সারা শরীর শুধু কাঁপতেছে।
ভীষণ ভালোবাসি এই মানুষটাকে।

•°•

দুই-দুইটা মেয়েকে সম্প্রদান না করেই একজন বাবার চলে যাওয়ার ব্যাপারটা যে কতটা কষ্টের হতে পারে; তা কেবল ঐ বাবারাই বলতে পারবে, যারা অসময়ে চলে গিয়েছে বা যায়..

আব্বা আবার শ্বাসকষ্ট নিয়েই মাস্ক খুলে বললেন,
– একটা কথা রাখবি?
আমি তাড়াতাড়ি বললাম,
– আপনার সব কথাই তথাস্থ আব্বা। আগে শুধু আপনি সুস্থ হয়ে উঠেন।
আব্বা আবার বললেন,
– রাখবি?
আমি বললামা,
– হ্যাঁ হ্যাঁ।

আব্বা শান্ত হয়ে আটকে আটকে বললেন,
– কিশোরকে আমি তোর পাশে দেখতে চাই মা।

কথাটা ভালো করে খেয়ালই করলাম না।
তাড়াহুড়োর মধ্যে বলে দিলাম,
– আব্বা আপনি যা চাইবেন, তাই হবে। এখন আপনাকে আল্লাহর দোহাই আপনি অক্সিজেন মাস্কটা আর খুইলেন না।
আব্বা খুশি হয়ে গিয়েছে।
চোখে জল এসে গিয়েছে সে খুশিতে।

কিছুক্ষন পর মাথায় এলো।
হায় আল্লাহ!
আমি এটা কি বলে ফেললাম!

আব্বাকে হসপিটালে ভর্তি করানোর পর দেখলাম আম্মা কেন জানিনা কোনো কথা বলতেছেনা..
কোনো সাড়া- শব্দ ও নেই।
আমি আম্মাকে ঝাঁকানি দিয়ে বললাম,
– আম্মা, আম্মা? কথা বলেন না কেন?
আম্মার কোনো সাড়া -শব্দ নেই।

প্রান্ত ভাই এই-সেই বলে কিন্তু আমি ভ্রুক্ষেপই করলাম না। ঐ লোকটার সাথে সকল দেনাপাওনা চুকে গিয়েছে আমার। সহ্যই হচ্ছেনা তাকে এই মুহূর্তে।

হঠাৎ কিশোর ভাইয়ের কন্ঠ পেলাম!
উনি এসে আমায় বললো,
– তুমি এখানে বসো শান্ত হয়ে। আমি আন্টিকে দেখতেছি।

কিশোর ভাই খবর পেয়েই চলে এসেছে।
এসেই আমার কাছে চলে এসেছে।
আমার সারা দুনিয়া অন্ধকার লাগতেছে।
আব্বাকে ভর্তি করিয়ে এসে দেখি আম্মা অসার হয়ে গিয়েছেন।

কিশোর ভাই আর প্রান্ত ভাই মিলে আম্মাকে কেবিনে নিয়ে গেলেন।

চলবে…

#ফারজানা_রহমান_তৃনা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে