মিসটেক পর্ব ৪

0
1317

মিসটেক (৫ পর্বের গল্প)
পর্ব ৪
লেখা- মিশু মনি

নাজিয়ার মেসেজ দেখে আমি স্তম্ভিত। মাথায় বাজ পড়া টাইপের একটা ব্যাপার ঘটছে আমার মধ্যে। ডিভোর্সের পরও ভুল করে সে একবার আমার সাথে কথা বলার প্রয়োজন বোধ করে নি। সে তার নিজের সুখের উল্লাসে মেতেছিলো। আজ কিসের দায়ে আমাকে তার স্মরণ করা? বিষয়টা ক্রমশই চিন্তিত করে তুললো আমাকে। তবে আমি ভেতরে ভেতরে ক্ষুধ্ব। তার মেসেজটা ফোন থেকে ডিলিট করে দিয়ে নাম্বার ব্লাকলিস্টে রেখে দিলাম। সে যে কারণেই ফোন করুক না কেন আমার কিচ্ছু যায় আসে না। তার প্রয়োজনে সে কল করেছে। করতেই পারে। কিন্তু কল করলেই আমাকে সাড়া দিতে হবে এমন তো কথা নেই। তার কাছে আমার কোনো প্রয়োজন নেই। সব ফুরিয়ে গিয়েছে।

আমি নিশ্চিত হয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু কেন যেন ঘুমাতে পারলাম না। বারবার মনে হচ্ছে নাজিয়া কেন ফোন করবে? কি দরকারে ফোন করবে? বারবার মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিলো বিষয়গুলো। পাত্তা না দেয়ার চেষ্টা করেছি বহুবার, তবুও মনকে সরাতে পারলাম না। তার চিন্তা আমার ভেতর জেঁকে বসলো। যার প্রতি আমার আজন্ম ঘৃণা জন্মে গেছে, তার জন্য এখনো আমার মন চিন্তা করছে এই বিষয়টাই আমাকে খুব ভাবিয়ে তুললো। তবুও ব্লাকলিস্ট থেকে নাজিয়ার নাম্বার সরালাম না।

মনের ভেতর খচখচানি নিয়ে কি আর ঘুমানো যায়? আমার কিছুতেই ঘুম আসছে না। আজ রাতে ঘুম হবেনা এও নিশ্চিত হয়ে গেলাম। রুমমেট ছেলেটা বারবার এসে জিজ্ঞেস করছে, ‘ভাই কি হইছে আপনার? এমন অস্থির হয়ে আছেন কেন?’
আমি কি করে কাউকে আমার অস্থিরতার কারণ ব্যাখ্যা করবো? যেখানে নিজের কাছেই ছোট হচ্ছি প্রতিনিয়ত।

ভোরবেলা ঘুম নেমে এলো চোখে। স্বপ্নে দেখলাম নাজিয়ার বিয়ে। একটা ছেলের সাথে। আমি পাগলের মতো ব্যস্ত হয়ে উঠেছি তাকে আমার করে নেয়ার জন্য। নাজিয়া আমাকে বিয়ে করতে চাইছে না। কিন্তু আমি বারবার বলছি, আমার নাজিয়াকেই চাই। নাজিয়াকে ছাড়া আমার পৃথিবীটা শূন্য। নাজিয়া আমার দিকে মায়াভরা চোখে তাকিয়ে আছে। সেই চোখের দিকে তাকিয়ে এক ধরণের সুক্ষ্ম অনুভূতি হলো আমার।

অদ্ভুত ব্যাপার, এ কেমন স্বপ্ন দেখলাম এতদিন পর! আর স্বপ্ন বিষয়টা এমন যে স্বপ্নে কাউকে দেখার পর যে অনুভূতি কাজ করে; সারাদিন সেটাই মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। আমারও তার ব্যতিক্রম হলো না। সারাটাদিন অস্থিরতায় কাটালাম। নাজিয়ার প্রতি এক ধরণের ফিলিংস কাজ করছিলো আমার। ঠিক রাতে দেখা স্বপ্নটার মতো।

অফিস থেকে মাত্র বের হয়েছি, এমন সময় আচমকা নাজিয়া আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। বিষয়টা এতটাই আকস্মিকভাবে ঘটে গেলো যে, আমি কিছুতেই তাকে এড়িয়ে যেতে পারলাম না। এদিক সেদিক চোখ ঘুরাচ্ছিলাম শুধু।

নাজিয়া আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। চোখ দুটো গর্তে ঢুকে গেছে। আজকাল তার রূপচর্চা ভালোই হচ্ছে মনে হচ্ছে। গালের চামড়ার রং পাল্টে গেছে, চুল হয়েছে কালো থেকে সোনালী। ভ্রুতে কাঁচির ছোঁয়া। জামাকাপড় বেশ সৌখিন। তাহলে আমার সাথে দেখা করা কিসের দুঃখে? আমি মাটির দিকে দৃষ্টিপাত করে রইলাম।

নাজিয়া বললো, ‘শিহাব তুমি আমার নাম্বার ব্লাকলিস্টে রেখে দিয়েছো। আমাকে এতটাই ঘৃণা করো এখন?’

হাস্যকর প্রশ্ন ছিলো আমার জন্য। কিন্তু বহুকষ্টে হাসি চেপে রাখলাম। মাথা তুললাম না, সে কি বলতে চায় তা বলার সুযোগ করে দিলাম।

নাজিয়া বললো, ‘আমি তোমার সাথে কিছু কথা বলতে চাই। আমাকে ইগনোর করো না প্লিজ।’

আমি মাথা তুললাম, ‘প্লিজ বলুন আপনার কি কাজে আসতে পারি?’
‘কাজে আসতে পারি বলছো কেন? আর আমাকে আপনি করেই বা বলছো কেন?’
‘আপনার সাথে এখন আমার আপনি বলার সম্পর্ক।’

নাজিয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, ‘চলো কোথাও গিয়ে বসি। জরুরি কিছু কথা বলতে চাই তোমার সাথে।’
‘কি বিষয়ে?’
‘সময় না দিলে কিভাবে বলবো কি বিষয়ে? যাবে না?’
‘হুম অবশ্যই। সবসময় ঠেকা তো আমার।’
‘শিহাব, এতদিন পর কথা বলতে এসেছি আর আজকেও তুমি ঝগড়া করবে?’
‘এমনভাবে বলছেন যেন আমি আপনার স্বামী?’

নাজিয়া অনেক্ষণ কোনো কথা খুঁজে পেলো না। আমি ততক্ষণে হাঁটা ধরেছি। অফিস থেকে দুই মিনিটের দুরুত্বে একটা ক্যাফে। সেখানেই গিয়ে বসবো। ক্যাফের ছাদে বেশ ফাঁকা জায়গা। মাথার ওপর খোলা আকাশ। কথা বলার জন্য উপযুক্ত জায়গা। নাজিয়াকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়ার জন্যও। আমার মাথায় এসব উদ্ভট চিন্তা কি করে যে আসে! মনে মনে হাসলাম আমি।

নাজিয়াকে নিয়ে ক্যাফে’র ছাদে চলে এলাম। লোকজন একদিকে। অন্যদিকের ফাঁকা জায়গাটায় এসে দাঁড়ালাম আমরা। শিরশির করে বাতাস এসে গায়ে লাগছে। আমি ছাদ থেকে তাকিয়ে রইলাম রাস্তার দিকে।

নাজিয়া কথা শুরু করলো, ‘শিহাব, আমরা তো ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম তাই না?’
‘হুম। অর্থহীন ভালোবাসা।’
‘অর্থহীন ভালোবাসা বলছো কেন?’
‘বাবা মায়ের ভালোবাসা ছাড়া কোনো ভালোবাসাই অর্থপূর্ণ নয়।’

নাজিয়া খানিকটা দমে গেলো বোধহয়। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবারও বললো, ‘এতদিন কি করেছো? কিভাবে কাটছে সময়?’
‘আমার সময়? যেরকম ফেলে গিয়েছিলে তারচেয়ে ইম্প্রুভ করেছি।’
‘রান্না কে করে?’
‘নিশ্চয় রান্নার জন্য বিয়ে করিনি। আমি নিজে রান্না করি।’
‘অফিসে যাও কখন তাহলে?’
‘অফিসের সময়ে অফিস যাই।’
‘রান্না করো তাহলে কখন?’

আমি হাসলাম। এতদিন পর সে কি সব অদ্ভুত প্রশ্ন করছে আমাকে। বাচ্চাদের মতো সব প্রশ্ন। আমি হেসে বললাম, ‘জরুরি কথাটা কি? সেটা শুরু করো। আমাকে বাসায় গিয়ে রান্না করতে হবে।’
‘আজকে বাইরে খেয়ে যেও।’
‘বাইরে? তোমার সাথে নয় তো?’
‘আমার সাথে খেলে কি পাপ হবে?’
‘পাপ হবে কিনা শিওর নই। কিন্তু হারাম হবে এটা নিশ্চিত।’

নাজিয়া বোধহয় খানিকটা অপমানিত বোধ করলো। কিছুক্ষণ ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে রইলো। আমি তাড়া দিলাম, ‘জরুরি কথাটা কি? বলা যায়? হাতে সময় নেই।’

নাজিয়া এবার আর ভণিতা না করে বললো, ‘শিহাব, আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। তোমার সাথে থেকে আমার জীবনে অনেক আনন্দ ছিলো, তুমি আমাকে অনেক ভালো রেখেছিলে। আমি জানিনা কেন শয়তানের ধোঁকায় পড়ে আমি তোমাকে ছাড়ার কথা ভেবেছিলাম।’

আমি হেসে বললাম, ‘ছাড়ার কথা ভেবেছিলাম না, বাক্যটা হবে ছেড়ে দিয়েছিলাম।’
‘শিহাব, প্লিজ আমাকে ভুল বুঝো না। আমি তোমার ভালোবাসায় অনেক ভালো ছিলাম। জানিনা কেন আমি দূরে চলে গেলাম।’
‘এখন ভুল বুঝতে পেরেছো?’
‘হুম।’

আমি কড়া একটা কথা বলে বসলাম এবার, ‘তোমার অভিযোগ ছিলো আমি শারীরিক ভাবে অক্ষম। তোমাকে সন্তুষ্ট করতে পারি না। তো, অন্য কারো সাথে শুয়ে নিশ্চয় টের পেয়েছো সে আমার মতো সুখ দিতে পারছে না। তাই নিশ্চয় ভুল ভাংলো?’

নাজিয়ার মুখটা ভয়াবহ ফ্যাকাশে হয়ে উঠলো। মনে হচ্ছে এক্ষুণি কেঁদে ফেলবে। বললো, ‘শিহাব, এসব নোংরা কথা কেন বলছো তুমি? আমি তোমাকে নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলাম। আসলে আমার কি হয়েছিলো নিজেই জানিনা। তোমাকে ছাড়তে হলে একটা কারণ দেখাতে হবে তাই ওই কারণ দেখিয়েছিলাম।’

আমি হাত তালি দিয়ে বললাম, ‘প্রশংসা করতে হয় আপনার। কত বুদ্ধিমতী আপনি! একটা ছেলেকে সবচেয়ে কঠিন অপমান করে আপনি ডিভোর্স দিয়ে চলে গেছেন। এখন বলছেন সেটা আপনার ভুল ছিলো? কি হাস্যকর।’

নাজিয়া কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে থেকে রীতিমতো কেঁদে ফেললো, ‘শিহাব। আসলে আমি টাকা পয়সা, এত দীনতা এসব মেনে নিতে পারছিলাম না। আমার বারবার শুধু মনে হচ্ছিলো কেন আমাদের অনেক টাকা নেই, কেন আমাদের এটা নেই সেটা নেই। আমি আসলে তোমাকে নিয়ে কোনো অভিযোগ করতে চাইনি।’

আমি বললাম, ‘আমার টাকা নেই, দীনতা? বিয়ের আগে এসব দেখোনি? আমার বাপের অগাধ টাকা আছে। আমি কখনো বাবার টাকায় ফুটানি করতাম না। আমার সেই স্বভাব দেখেই তো প্রেমে পড়েছিলে তাইনা?’
নাজিয়া চুপ।

আমি বললাম, ‘আমার সংসারে অভাব ছিলো কখনো? না খাইয়ে রেখেছিলাম নাকি? যাইহোক, ওসব নিয়ে এখন কথা বলার ইচ্ছে একদমই নেই আমার।’
‘শিহাব, আমি আসলে তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি।’

আমি হাসতে হাসতে বললাম, ‘ক্ষমার বিষয়টা পরে। তার আগে একটা কথা বলবে? আমার টাকা নেই বলে তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলে। তো, কার টাকা দেখে? কে তোমাকে টাকার ওপর শুইয়ে রাখার অঙ্গীকার করেছিলো?’

নাজিয়ার মুখটা আরো ফ্যাকাশে হয়ে উঠলো। কিন্তু রীতিমতো কথাটা অস্বীকার করে সে বললো, ‘কারো টাকা দেখে না। আমি এমনিই চলে গিয়েছিলাম।’
‘তাই? তো তুমি ধরেই নিয়েছিলে ডিভোর্সের পর অন্য কেউ তোমাকে টাকা দিয়ে পূজা করার জন্য বসে আছে? তার ঘাড়ে ঝুলে পড়বে?’

নাজিয়া কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘এত কঠিন ভাবে আমাকে অপমান করছো কেন তুমি? প্লিজ এভাবে অপমান কোরো না। আমি কারো টাকা দেখিনি। তুমি যা ভাবছো তা নয়। আমার কারো সাথে কোনো সম্পর্ক ছিলো না।’
‘ছিলো না?’
‘না। আমি কাউকে বিয়ে করার কথাও ভাবিনি।’

আমি অবাক হলাম। নাজিয়ার নিঁখুত অভিনয় দেখে। সে কি সত্যতার মতো মিথ্যা কথাগুলো অকপটে বলে যাচ্ছে!

নাজিয়া বললো, ‘আমাকে তুমি বিশ্বাস করছো না?’

আমি হেসে বললাম, ‘তোমাকে আমি এখন বিশ্বাস তো দূরের কথা, কি পরিমাণ ঘৃণা করি জানতে চাও? আমার ইচ্ছে করছে এই ছয় তলার ওপর থেকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেই তোমাকে। আর কিছু বলতে হবে?’

নাজিয়া তার স্তব্ধ চোখ দুটো তুলে আমার দিকে তাকালো। আমি আর কিছু বললাম না। ওয়েটারকে বললাম দুই কাপ কফি দিয়ে যেতে। নাজিয়া একটা শব্দও করলো না আর। নিঃশব্দে ক্রন্দন করে চলেছে। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না এটা ও তার কান্না নাকি শুধুই অভিনয়! সে কিভাবে স্বীকার করলো যে কারো সাথে সম্পর্ক ছিলো না? মানুষ এমন ছলনাময়ী হয় কি করে।

কফি চলে এলে আমি কফির মগ হাতে তুলে নিলাম। কয়েকবার নিঃশব্দে চুমুক দিয়ে বললাম, ‘চলে যাচ্ছি। ভবিষ্যতে অন্য কোনো প্রয়োজন হলে আমাকে স্মরণ কোরো। অন্তত আমার লাইফে আসার নাটকটা আর কোরো না।’

কফির বিল পরিশোধ করে আমি দ্রুত চলে এলাম সেখান থেকে। নাজিয়া এখন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে সেখানে। আমি জানি। আমি নাজিয়াকে অনেক বছর ধরে চিনি। তাকে কেউ কঠিন কিছু বললে সে সহ্য করতে পারে না। খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। স্তব্ধ হয়ে কাঁদতে থাকে শুধু। বাসায় যেতে পারবে কিনা এ নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়। নাজিয়ার জন্য আজ আমার দুশ্চিন্তা করার অবকাশ নেই, কিন্তু খারাপ লাগছে তার জন্য। মেয়েটা একসময় খুব বেশি ভালো ছিলো। অভিনয়টা শিখে গেলে তাকে আর ভালো বলা যায় কি না, আমি জানিনা। কিন্তু আজও কি সে ওখানে বসে বসে কাঁদবে? ভেঙে পড়বে ঠিক আগের মতোন? যখন আমি রাগ করে চলে গেলে তিন ঘন্টা পর ফিরে এসে দেখতাম নাজিয়া আগের জায়গাতেই বসে আছে।

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে