মিসটেক পর্ব ৩

0
1388

মিসটেক (৫ পর্বের গল্প)
পর্ব ৩
লেখা – মিশু মনি

সুমন দুলাভাইকে শাস্তি দেয়ার ব্যাপারে ভাবতে গিয়ে আমি ভেতরে ভেতরে হিংস্র হয়ে উঠলাম। খুব বেশি না, মাত্র এক সপ্তাহ ধরে খুঁজে বেড়ালাম তাকে কোন উপায়ে শাস্তি দেয়া যায়। শুধু দুলাভাই না, নাজিয়াকেও একটা ফল ভোগ করতেই হবে। কিন্তু অদ্ভুত বিষয়, আমার ভেতর থেকে একটা অমানবিক আত্মা বেরিয়ে গেলো। প্রত্যেক মানুষের ভেতরেই হয়তো পশুসুলভ কিছু লুকিয়ে থাকে। আমারও হয়তো তাই। আমি একবার সিদ্ধান্ত নিলাম, নাজিয়া আর সুমনের সঙ্গমের দৃশ্য ভিডিও ধারণ করে ভাইরাল করে দেয়া যায় কিনা। কিন্তু বিষয়টা নিজের কাছেই বিশ্রী মনে হচ্ছিলো। এতে করে আমাদের পরিবারের ও একটা সম্মানের ব্যাপার লুকিয়ে আছে। কারণ নাজিয়া তো আমারই স্ত্রী ছিলো। এটা কিছুতেই করা যায় না, তবে? সুমনকে গুম করে ফেললে কেমন হয়? একেবারে খেলা জমে যাবে। তাকে ধরে নিয়ে এসে একটা গোডাউনে আটকে রাখবো। সে না থাকলে নাজিয়া একদম একা হয়ে যাবে। ওর বাড়িতে বৃদ্ধ মা ছাড়া কেউ নেই। স্বামী নেই, বিয়ের সম্ভাবনাও নেই। নাজিয়ার জীবনটা নরকে পরিণত হবে। কথাটা ভেবে আনন্দ হচ্ছিলো আমার। মিসটেক যখন তুমিও একটা করেছো, আমিও একটা করবো। কার মাধ্যমে সুমনকে কিডন্যাপ করা যায় সেটা ভাবতে শুরু করলাম। দু একটা গুন্ডাদলের ব্যাপারে খোঁজ খবরও নিলাম। দিনরাত এক করে কিডন্যাপিংয়ের চিন্তাতেই আমি বিভোর। যেকোনো মুহুর্তে হয়তো সরাসরি কাজে নেমে পড়বো।

এরকমই একটা সময়ে, একদিন মাঝরাতে মেজো আপা কল দিলো। আমি বেশ অবাক হলাম আপার ফোন দেখে। রিসিভ করে বললাম, আপা তুই এত রাতে?
আপা মৃদুস্বরে বললো, ‘তুই কি ওদের কোনো ক্ষতি করার চিন্তাভাবনা করছিস শিহাব?’
আমি ভীষণ অবাক হলাম। আমার ভেতরের কথা আপার তো কোনোভাবেই জানার কথা নয়। তবে কি ভেবে সে এরকম ধারণা করেছে!

আমি বললাম, ‘আপা, আমি ওদের ক্ষতি করবো না।’
‘না করলেই ভালো। আমার কেন যেন মনে হচ্ছিলো তুই জেদের বশে যদি ওদের কোনো ক্ষতি করিস। দ্যাখ ভাই, আমরা তো মানুষ তাইনা? আমাদের ধর্ম আমাদেরকে ক্ষমা করতে শেখায়। মানুষ হয়ে যদি অমানুষ দের সাথে ভিড়ে অমানুষিক কাজ করি তাহলে তাদের সাথে আমাদের পার্থক্য রইলো কোথায় বল? সবকিছু ভুলে যা। জীবনটাকে নিজের মতো করে সাজিয়ে তোল। বিবেকহীন মানুষের কথা ভেবে নিজের বিবেকটাকে তো নষ্ট করা যায় না। তাইনা বল? তুই ওদের কিছু করিস না।’

আপার কথাগুলো আমাকে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় বিস্মিত করে তুললো। তার চিন্তাচেতনাকে সম্মান জানাতেই হয়। যদিও তার ধারণা করার শক্তি দেখে আমি বেশ অবাক হয়েছি। আপা অনেক্ষণ ধরে আমাকে বুঝ দিয়ে চললো। আমি ভাবলাম। ওদের ক্ষতি করে হয়তো সাময়িক আনন্দ পাবো কিন্তু সারাজীবন তো আমার সুন্দর হাসিখুশি হয়ে যাবে না। প্রতিশোধে এক ধরণের মজা আছে কিন্তু তা কখনোই সুখ এনে দিতে পারে না। নাজিয়ার বিষয়টা আমি এখানেই শেষ করে দেবো সিদ্ধান্ত নিলাম।

বললাম, ‘আপা, তুই চিন্তা করিস না। আমি ওদের কিছু করবো না। ওরা থাকুক নিজেদের মতো।’
‘অন্যকে কষ্ট দিয়ে মানুষ কখনো সুখী হয় না রে শিহাব। আল্লাহ সবাইকে তার প্রাপ্য শাস্তি নিজেই দেন। সময় হলে ওরা ঠিকই নিজের ভুল বুঝতে পারবে।’
‘হা হা, হাসালি আপা। তোর শুরুর কথাগুলো আমার ভালো লাগছে। কিন্তু লাস্ট কথাটা একদম আবেগের বশে বলে ফেললি। এতটাও আবেগী হওয়া ভালো না আপা। বুঝলি? এ জীবনে অসংখ্য মানুষ দেখছি যারা কখনো নিজের ভুল নিজে স্বীকারই করেনাই। তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে দুলাভাইকে এখনো মনে মনে পূজা করিস।’

আপা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, ‘আচ্ছা রাখি। ভালো থাকিস। নিজের যত্ন নিস।’

আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই কল কেটে গেলো। আমি আবারও কল দিলে আপা রিসিভ করলো না। দ্বিতীয়বার কল দিলে কেটে দিলো। আমার কেন যেন মনে হলো আপা কাঁদছে। তাকে শেষ কথাটা বলা আমার একদমই উচিৎ হয় নি। সত্যি বলতে খারাপ বিষয় নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমার ভেতরের একটা অমানবিক মানুষ বেরিয়ে এসেছে এটা মানতেই হবে। অবশ্য এটাকে মানুষ বলা যায় না, অমানুষ বলতে হয়।

সারা রাত ধরে ভাবলাম আমি। মনস্থির করলাম সবকিছু ঝেড়ে ফেলে দিয়ে নতুন করে বাঁচার চেষ্টা করবো। নাজিয়ার কথা আর কক্ষনো মনের ত্রিসীমানায়ও আসতে দেবো না। যে মেয়ে আমাকে খারাপভাবে অপমান করেছে, তার শাস্তির কথা ভাবতেও আমার ঘেন্না হওয়া উচিৎ। তার খারাপ দিকগুলো নিয়ে ভেবেও আর একটা মুহুর্ত নষ্ট করতে চাইনা আমি।

দীর্ঘদিন পর আজ রাতে একটা মুভি দেখতে বসলাম। আগেও বহুবার দেখেছি। আবারও দেখলাম। ‘পারসুইট অব হ্যাপিনেস’। হ্যাঁ, আমাকেও এখন একলা একা সুখের চিন্তা করতে হবে। যদিও অর্থ সম্পত্তির দিকে আমার ঝোঁক নেই। আমি শুধু চেয়েছিলাম ভালোভাবে খেয়ে পড়ে একটা সুখী সংসার সাজাতে, একটা মানুষকে ভালোবেসে অনেক সুখে থাকতে। কিন্তু সুখ কপালে নেই। হু।

রাতগুলো প্রচন্ড খারাপ কাটছে ইদানীং। ঘুম আসে না, যন্ত্রণার দাঁনা বাঁধে ভেতরে। পুরনো যন্ত্রণা আর একাকীত্বের যন্ত্রণা দুটো মিলেমিশে এক হয়ে একটা দাবানল সৃষ্টি করে। আমাদের দুই রুমের বাসা। বেডরুমে একটা খাট, একটা ড্রেসিং টেবিল, আর একটা ওয়ারড্রব আছে। ঘরে ঢুকলেই বুকের ভেতর হাহাকার করে ওঠে। এই ঘর নাজিয়াকে ছাড়া একদম অসহায়, শূন্য। নাজিয়া ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে সাজুগুজু করে, পুরো বাড়ি দৌড়ে বেড়াতো। আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখতাম। এখন যেন সব আসবাবপত্র মরে গেছে।

লিভিংরুমে কয়েকটা সোফা। নাজিয়া বলতো আমাদের সোফাগুলো এখন তার আর ভালো লাগে না। কমদামী কমদামী লাগে। অথচ সে স্বপ্ন দেখে নিজেই কত খুশিমনে কিনে এনেছিলো। আমি শুধু জোগাড় করে দিয়েছিলাম টাকা। এখন পুরো লিভিংরুম ফাঁকা। চারদিকে হাহাকার। দেখলেই ভেতর থেকে কান্না আসে, কান্নাগুলো চেপে যাই। বেরিয়ে আসে একটা দীর্ঘশ্বাস।

আমি আর এসব দেখে সহ্য করতে পারছিলাম না। সোফা, ওয়ারড্রব, খাট সহ সমস্ত আসবাবপত্র বিক্রি করে দিলাম। যে মানুষটা জন্য এতকিছু, সেই তো নেই। কি হবে আর এসব রেখে?

পুরো বাড়ি ফাঁকা। বাড়িটা ছেড়ে দেবো ভেবেছিলাম। কিন্তু এখন বাসা ছাড়লে আবার কোথায় উঠবো তাও চিন্তার বিষয়। ভালো ব্যাচেলর বাসা পাওয়াই যায় না। আমি বাসাটা ব্যাচেলর ছেলেদেরকে ভাড়া দেয়ার জন্য লিফলেট ছাপিয়ে রাস্তার দেয়ালে দেয়ালে লাগিয়ে দিলাম। রুমে কেউ থাকলে অন্তত একাকীত্ব কিছুটা হলেও কাটবে আমার।

বেশ কয়েকদিনের মধ্যেই তিনটা ছেলে যোগাযোগ করলো। কম ভাড়াতেই উঠতে বললাম তাদেরকে। আমার রুমে উঠলো একজন, বাকি দুজন পাশের রুমে। ছোট ছোট কয়েকটা ব্যাচেলর চৌকি এনে ঘর সাজিয়ে ফেললাম। নাজিয়া আর তার সংসারের সমস্ত স্মৃতি দূর করে ফেললাম ঘর থেকে। খুব ভালো হতো যদি বাসাটা ছাড়তে পারতাম।

সেই সুযোগ বাড়িওয়ালাই করে দিলেন মনে হলো। একদিন বাসায় এসে আমাকে তুমুল রাগারাগি করলেন। কেন আমি বউকে তাড়িয়ে তার বাসাটা ব্যাচেলর দিলাম, অথচ তার অনুমতি নেইনি। আগামী মাসেই যেন বাসা খালি করে দেই, নোটিশ দিয়ে তিনি চলে গেলেন। আমার দিক থেকে ভালোই হলো। এখন একটা ব্যবস্থা নিশ্চয় হবে।

অবশ্য আমাকে বাসা খুঁজতে হলো না। রুমমেট হাবিব একটা বাসা খুঁজে আমাকে উঠতে বললো। সেখানেই উঠলাম। রোজ অফিসে যাই, বাসায় ফিরে বুয়ার করা রান্না খেয়ে শুয়ে ফেসবুক চালাই। রুমমেট দের সাথে বসে সিগারেট টানি, আর মাঝেমধ্যে একটু আধটু সিনেমা দেখতে যাই। সংসার জীবনের পর ব্যাচেলর জীবন আর ভালো লাগছিলো না, তবুও বেঁচে থাকার প্রয়াসে জোর করে ভালো থাকার চেষ্টা।

এই চেষ্টায় আমি ব্যর্থ হইনি তার প্রমাণ মিহিকা। মেয়েটা আমার কলিগ। নতুন জয়েন করেছে। আমার চেম্বারের পাশেই বসে। মাঝেমধ্যে ইয়ার্কি করে জিজ্ঞেস করে, ‘শিহাব ভাই কি প্রেম টেম করেন না নাকি? কখনো ফোনে কথা বলতে দেখি না।’
আমি স্বাভাবিক গলায় বলি, ‘শিহাব ভাই ডিভোর্সি।’

মিহিকা হেসে বলে, ‘দূর মিয়া। এমন প্রেমিক প্রেমিক চেহারাটাকে ডিভোর্সি বলতে শরম করেনা আপনার? ব্রেক আপ তো হবেই মানুষের। সেজন্য কি মানুষ আজীবন সিঙ্গেল থাকে?’

কথাটা শুনে আমি মনেমনে হাসি। যাক, তাহলে আমার চেহারায় বিপত্নীক হওয়ার ছাপটুকু পড়েনি। অবশ্য আজকাল খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করি, নিয়মিত গোসল করি, নামাজ কালাম পড়ি। ধীরেধীরে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছিলাম আমার স্বাভাবিক জীবনের সাথে। চারমাস তো হয়েই গেলো। যেকোনো দুঃখ নব্বই দিনের বেশি পুষে রাখা ঠিক না।
রুমমেট হাবিব আমার জন্য পাত্রী খুঁজে বেড়াচ্ছে। মাঝেমাঝে বিভিন্ন মেয়ের ছবি দেখায়। বলে, ‘ভাই প্রেম করেন একটা। আপনি মানুষ ভালো। কয়দিন প্রেম করলেই বিয়ে করে ফেলবে।’
আমি হাসতে হাসতে বলি, ‘কয়দিন প্রেম করে বিয়ে করলে সেটাও কয়দিনই টিকবে। আমি প্রেম টেমের মধ্যে আর নাই। বিয়ের চিন্তাও আপাতত করি না। জীবনটা কতদিন এভাবে চলে, চলুক না।’

তবে আমার চেয়েও মেজো আপা দ্রুত নিজের অবস্থান পরিবর্তন করে ফেলেছে। সে চলে গেছে দেশের বাইরে। জানিনা সেখানে কেমন আছে, এখনো আবেগের কথা বলে কি না। তবে ভাগ্নীর কাছে শুনেছি আপা ফেসবুকে সুন্দর সুন্দর ছবি আপলোড করে। ভেতরে থাকা চাপা দীর্ঘশ্বাসগুলো কেউ খুঁজে পায়না সেসব ছবিতে।

আমি অফিস থেকে সবেমাত্র বাসায় ফিরেছি, এমন সময় একটা নাম্বার থেকে কল আসে। ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে আমার কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো মাত্র। সেই চিরচেনা নাম্বার, সে আমাকে কি কারণে ফোন করবে আমি উত্তর খুঁজে পেলাম না। এতদিন তাদের কোনো খোঁজ খবর নেয়ার চেষ্টাও করিনি আমি। সে বিয়ে করেছে এটা জানাতেই ফোন দিয়েছে নাকি?

আমি কল রিসিভ করলাম না। পরপর দুবার কল কেটে গেলো। খানিক্ষণ পরে টুং করে মেসেজ এলো একটা। আমি ফোন হাতে নিয়ে চোখ বুলালাম, ‘শিহাব আমার সাথে দেখা করতে পারবে? তুমি কোথায় আছো এখন? খুব জরুরি। প্লিজ। ‘নাজিয়া’।’

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে