মিসটেক শেষ পর্ব

0
1662

মিসটেক
শেষ পর্ব
লেখা- মিশু মনি

একটা ছেলে যখন বিয়ে করে, তার জীবনে উল্লেখ যোগ্য কিছু পরিবর্তন সাধিত হয়। আমারও হয়েছিলো। যেমন পুরনো বন্ধুবান্ধবদের সাথে একটা বড় রকমের দূরত্ব তৈরি হয়। আগে অফিস শেষ করে প্রায়ই বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিতাম। একসাথে বসে চা সিগারেট খাওয়ার ফাঁকে হাসাহাসির বিরতি দিতাম আমরা। কত রকমের আড্ডা চলতো সেখানে। মূলত নাজিয়ার চাপের কারণে বন্ধুবান্ধব দের মধ্যে প্রথম আমিই বিয়ে করি। এরপর বাড়ে দূরত্ব। প্রতিদিন তারাতাড়ি বাসায় ফেরা নিয়ে নাজিয়ার কড়া শাসন। সে সারাক্ষণ একা বাসায় থাকে, অফিস শেষ করে তাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য মনটা আমারও ছটফট করতে থাকে। বন্ধুবান্ধব দেরকে ভুলে আমি বাসায় ছুটে যেতাম। বন্ধুরা মাঝেমাঝে ফোন করে আড্ডায় ডাকতো, যাওয়ার সুযোগ হতো না। নাজিয়াকে বলার সাহসও পেতাম না। একবার দুবার সুযোগ বুঝে বলেছিলাম, ‘বন্ধুদের সাথে একটু দেখা করে আসি।’
নাজিয়া বলেছিলো, ‘ওরা কি জানেনা তোমার বউ আছে? রাত বিরাতে ডাকে কেন?’
আমি উত্তর দিয়েচজিলাম, ‘কেবল তো সন্ধ্যা। আমি রাত দশটার আগেই ফিরে আসবো। এক ঘন্টা ওদের সাথে একটু কাটালে কি তুমি রাগ করবে?’
‘না। রাগ করার কি আছে? শুধু আমাকে দেয়ার সময়টাই তোমার হয় না। তাছাড়া সবার জন্য সময় হয়।’

আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না তাছাড়া আর কাকে আমি সময় দিয়েছিলাম! কিছু বলতে যাবো তখনই নাজিয়া বললো, ‘তুমি সকাল নয়টায় অফিসে যাও। রাত আট টায় ফেরো। আমি সারাদিন বাসায় কি করি বলো? একা একা আমার ভালো লাগে? রাতের সময়টা আমাকে দেবে সেটা চাওয়াটাও কি অন্যায়?’

আমি নাজিয়াকে কি করে বোঝাই আমারও একটা লাইফ আছে। কিছু কিছু মেয়ে থাকে যারা সবকিছু বোঝে, অপর মানুষটাকে একটু সময় দেয়া দরকা,তাকেও নিজের মতো একটু ছেড়ে দেয়া দরকার সেটা তারা উপলদ্ধ্বি করে না। তারা ভাবে তাদেরই জীবন। অথচ যে ছেলেটা সারাদিন অফিসে গাঁধার মতো পরিশ্রম করে বাসায় ফেরে, তার যে বেস্ট ফ্রেন্ড থাকতে পারে, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিলে মনের খোরাক জোটে, শরীরে এনার্জি আসে, সেটা তারা বুঝবেই না। তাদের শুধু চাই সময়, সময়, আর সময়। অথচ পুরুষদেরকে সামান্য সময় ছাড় দিতেও তাদের অনীহা।

দু একবার বলেছিলাম নাজিয়া তুমি কিছু একটা করার চিন্তা ভাবনা করো। বাসায় বসে হোক বা বাইরে হোক। যাতে তোমার সময়টাও ব্যস্ততায় কাটে, কিন্তু সে বলেছিলো, আমাকে দিয়ে কিছু ই হবে না। কত মেয়ে অনলাইন বিজনেস করছে। আমি ওসব করতেই পারবো না। কত দৌড়াদৌড়ি করতে হয়।

এভাবে আমার জীবন থেকে সব বন্ধু ধীরেধীরে হারিয়ে গেছে। মাঝেমাঝে হয়তো ফোনে টুকটাক আলাপ হয়, ফেসবুকে ছবির কমেন্টে দু একটা রিপ্লাই, এই পর্যন্ত ই। আমার ডিভোর্সের পর আমি নিজে থেকেই কারো সাথে যোগাযোগ করিনি। যার জন্য বন্ধুদেরকে ছাড়লাম, সেই মানুষটা কিসের জন্য আমাকে ছেড়ে চলে গেলো এখনো ভাবি। মানুষ কতটা অকৃতজ্ঞ হতে পারে।

অথচ সেই বন্ধুরাই আমার জীবনটা গুছিয়ে দিতে এসে হাজির। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলো, সাজ্জাদ। একদিন অফিসে এলো। বিকেলবেলা। আমি কাজে ব্যস্ত ছিলাম। বললাম, কি রে তুই! সাজ্জাদ অনেক মোটা হয়ে গেছে। শুনেছি বিয়েও করেছে। শুভেচ্ছা জানালাম তাকে।

সাজ্জাদ বললো, সব কথা পরে হবে আগে বল আনফ্রেন্ড কেন করেছিস?
আমি একটা নিশ্বাস ফেলে বললাম, আনফ্রেন্ড করতে চাই নি। আসলে চেয়েছিলাম যোগাযোগ না থাকুক। আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে। তোরা টিটকারি করবি।

সাজ্জাদ আমার কাঁধে একটা জোরেসোরে মাইর বসিয়ে দিয়ে বললো, ‘তুই আজীবন এমন বিচিত্র স্বভাবের থেকে গেলি কেন? চল বাইরে চল। আজকে তোকে পানি খাওয়াবো।’
‘না রে আমার ওসব সহ্য হয় না।’
‘তোকে ফ্রেশ পানি খাওয়াবো ভাই। মদ টদ না।’
‘এই পানি এত আয়োজন করে বলার কি আছে?’

বাইরে এলে সাজ্জাদ একটা রিকশা ডেকে আমাকে রেস্টুরেন্টে নিয়ে এলো। পেট পুরে কাচ্চি খেলাম দুই বন্ধু মিলে। শুনছিলাম সাজ্জাদের বিবাহিত জীবনের গল্প। সে আমার ডিভোর্স নিয়ে কোনো প্রশ্নই করে নি। এমনভাবে মিশছিলো যেন আমার জীবনে ডিভোর্স বা সংসার নামে আদৌ কোনো অধ্যায়ই নেই। মুহুর্তের জন্য সমস্তকিছু ভুলে গেলাম আমি।

নাজিয়ার সাথে দেখা হওয়ার দশদিন কেটে গেছে। তার নাম্বার ব্লাকলিস্টেই আছে এখনো। সরানোর মানে হয় না। তবে মাঝেমাঝে সে কল দেয়, ব্লাকলিস্ট থেকে নোটিফিকেশন পেলে বুঝি। আমি ওসব নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট করতে চাই না। কিন্তু রাত বাড়লে হু হু করে কষ্ট বাড়ে। আগে শুনেছিলাম বিয়ে হলে নাকি ছেলেরা আর একা থাকতে পারে না। কথাটা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করলাম। একজন কথা বলার সঙ্গীর জন্য হলেও একটা নিজের মানুষ থাকা দরকার।

সাজ্জাদ খাওয়াদাওয়া শেষ করে বললো, ‘আমার একটা শালী আছে। হেব্বি দেখতে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেছে। শ্বশুর বলছিলো ওর জন্য পাত্র দেখতে। আমারও চোখ বন্ধ করে তোর কথা মনে হলো। এ জীবনে তোরচেয়ে সাদামাটা একটা মানুষ আর দেখিনি। আমার শালীকাও সাদামাটা। কোনোদিনো সাজতে দেখিনি। কিন্তু মেধা তুখোড়।’
আমি অবাক হলাম। সাজ্জাদ এমনভাবে শালীর কথা বললো যেন আমার আগে বিয়েই হয়নি। প্রথম বিয়ের ব্যাপারে বলছে সে আমাকে। আমি অনেক্ষণ চুপ করে রইলাম।

সাজ্জাদ বললো, ‘তুই আমার সাথে কবে যাবি বল? শুক্রবার? শনিবার? পাঞ্জাবি পরবি। পাঞ্জাবিতে তোকে দারুণ মানায়।’
আমি এবারও কোনো উত্তর দিলাম না। বিদায় নেয়ার সময় সাজ্জাদ বললো, ‘শোন দোস্ত, জীবনে কি হইছে ভুলে যা। সবকিছু নতুন করে শুরু কর। জীবনটা তোর। এটাকে অনাদরে নষ্ট করাটাও একটা মিসটেক।’

আমি ভালোভাবে বিদায় দিয়ে চলে আসি। বাসায় এসে সাজ্জাদের নাম্বারে একটা মেসেজ পাঠিয়ে দেই, ‘আমি এখন বিয়ের ব্যাপারে ভাবছি না। আগামী দু বছর একা থাকবো তারপর ভেবে দেখবো।’

মেসেজটা পাঠানোর পর দেখি নাজিয়ার নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে,, ‘শিহাব, আমি অনেক অনুতপ্ত। আমাকে মাফ করে দাও না প্লিজ। আর কক্ষনো আমি তোমাকে কষ্ট দেবো না। আর কোনোদিনও তোমার কাছে কিছু আবদার করবো না। আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি তোমাকে প্রচন্ড ভালোবাসি শিহাব।’

মেসেজটা দেখে এত রাত উঠে গেলো, ইচ্ছে করছিলো মোবাইলটা আছাড় দেই। রাগ সামলে নিলাম। নাজিয়া হঠাৎ ফিরে আসতে চাইছে কেন, বিষয়টা নিয়ে ভাবা হয়নি। ঘেন্নায় ভাবনা আসে নি। তার কি আসলেই উপলব্ধি হয়েছে? নাকি সে আমার সাথে অভিনয় করেই চলেছে?

বিষয়টা মনের ভেতর খচখচ করতে লাগলো। আমি মেজো আপাকে মেসেজে ভিডিও কলের অনুরোধ করে রাখলাম। আপা কল দিলো আধা ঘন্টা পরেই।

দীর্ঘদিন পর মেজো আপাকে ফোনের স্ক্রিনে দেখে আমি দারুণ অবাক! পুরোপুরি ভাষাহীন হয়ে পড়লাম। আপাকে ভয়ংকর রকমের সুন্দর লাগছে। বললাম, ‘তুই তো দেখি নায়িকা হয়ে গেছিস।’
‘আরে না। একটু কেয়ার করি আরকি। কি খবর তোর? প্রেম টেম করিস?’

আমি এবারও অবাক হলাম। মেজো আপা ছিলো ভীষণ লাজুক প্রকৃতির। স্বাভাবিক বিষয়গুলোই সে কারো সাথে খোলাখুলি ভাবে আলাপ করতে পারতো না। সেখানে প্রথম কথাতেই প্রেম করার কথা জিজ্ঞেস করা দেখে আমি রীতিমতো থ।

আপা বললো, ‘চিমসে গেলি কেন? প্রতিদিন চা দিয়ে মুড়ি খাস নাকি?’
‘কি?’
‘চা দিয়ে মুড়ি খাবি না। লাইফটাও চিমসে যাবে।’
‘তুই খাইছিলি নাকি?’

হেসে ফেললাম আমি। আপা বললো, ‘আমি বলদা ছিলাম। কত কি খাইছি। যাইহোক, এখানে চলে আয়। কিছুদিন ঘুরে যা। আমার কয়েকটা বান্ধবী হইছে। জোস জোস মেয়ে একেকটা। তুই দেখলেই বলবি একটারে দেশে নিয়া যাবো।’

আমি হো হো করে হেসে উঠলাম, ‘তুই ভালো থাক তাহলেই হবে আপা। আমার অফিসে কাজের চাপ অনেক। শীতকালে একবার তোকে দেখতে আসবো।’
‘আচ্ছা আসিস।’
‘আপা, দুলাভাইয়ের কোনো খবর জানিস?’

আপার মুখটা মুহুর্তেই অগ্নিশিখার ন্যায় জ্বলে উঠলো, ‘ওই শুয়োরটার নাম আমার সামনে নিবি না। আর দুলাভাই ডাকছিস কেন? ও তোর কোন বোনের জামাই?’
আমি আপার রাগ দেখে তৃতীয়বারের মতো বড়সড় রকমের অবাক হলাম। আপার আগে একটুও রাগ ছিলো না। দুলাভাইয়ের কথায় সে কেমন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো। অথচ আমি নাজিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে দুটো কঠিন কথাও বলতে পারিনি সেদিন। আমি যে একটা কি!

আপা বললো, ‘নিজের যত্ন নিবি। খাস কি আজকাল?’
‘বুয়া রান্না করে। মাঝেমাঝে নিজে রান্না করে খাই।’
‘বাইরে খাবি। কলিগ আর বন্ধুদের সাথে হ্যাং আউট করবি। এখানে ওখানে ঘুরতে যাবি। বুঝলি?’
‘হু।’
‘আর মেয়েরা আগ্রহী হলে পাত্তা দিবি। খোঁজ খবর নিবি। ফ্রেন্ডশিপ করবি। কেউ যদি ভালোবাসে তুইও বাসবি। জীবনটা যে এভাবে ভুজুংভাজুং করে কাটাচ্ছিস এটা তো তোর ঠিক না।’

আমি একটা নিশ্বাস ফেলে হাসলাম। কই খারাপ নেই তো, ভালোই আছি। শুধু একাকীত্ব চেপে বসে ভেতরে। আপা বললো, ‘আমি একটু মিটিংয়ে যাবো। একটা বিজনেস প্লান করছি বুঝলি। যদি একটা ভালো কোম্পানি স্পন্সর করতে রাজি হয়, তাহলেই দেখবি। লাইফে আর কি লাগে।’

আমি মৃদু হেসে বললাম, ‘আচ্ছা আপা। মিটিংয়ে যা। রাখি।’

আমি ফোন রেখে অনেক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলাম। একটা ধাক্কায় মানুষের জীবন কত অদ্ভুতভাবে পাল্টে যেতে পারে। অথচ আমি আগেও যা ছিলাম, এখনো তাই আছি, আর আমার মতো মানুষ গুলো হয়তো সারাজীবন একইরকম থাকে৷

শুক্রবার সকালে খুব আয়েশ করে ঘুমাচ্ছিলাম। সাজ্জাদের ডাকে ঘুম ভাঙে। ব্যাটা আমার বাসার ঠিকানা কোথায় পেলো কে জানে। পরে মনে হলো ঠিকানাটা আমিই তাকে দিয়েছিলাম। বললাম, ‘এই সকালে তুই?’
‘আজ শুক্রবার না? চল আমার সাথে যাবি।’
‘কোথায়?’
‘শ্বশুরবাড়ি।’

আমি না বলে দিলাম। সাজ্জাদ কিছুতেই ছাড়বে না। রীতিমতো জোর করেই আমাকে পাঞ্জাবি পরিয়ে গাড়িতে করে নিয়ে চললো। তার শ্বশুরবাড়ি দেখে মনে হলো কর্তা মধ্যবিত্ত পরিবারের কিন্তু বেশ সৌখিন। ওনার ছোট মেয়ে আরো বেশি সৌখিন। একটা নকশী কাঁথার ডিজাইনে কথা জামা পরনে। আমার সামনে বসতে বসতে বললো, ‘কি চা খাবেন?’
সাজ্জাদ বলে দিলো, ‘দুধ চা।’

মেয়েটা নিজে চা বানাতে গেলো না। অনেক্ষণ বসে কথাবার্তা বলছিলো। দেখি সাজ্জাদের শ্বাশুড়ি চা নিয়ে এলেন। মেয়েটা বললো, ‘আমি ভালো দুধ চা বানাতে পারি না। শুধু লেবু পানিতে টি ব্যাগ ফেলে দিতে পারি।’ সে স্মিত হাসি দিলো। আমি ভদ্রতার সাথে বসে আছি। অস্বস্তিবোধ হচ্ছে আমার।

মেয়েটা আমাকে বললো, ‘জীবনের সবচেয়ে মধুর মিসটেক কি বলুন তো?’
‘কি?’
‘বিয়ে।’

আমি হাসলাম। মেয়েটা আবারও বললো, ‘আর জীবনের সবচেয়ে হেল্পফুল মিসটেক কি জানেন?’
‘কি?’
‘ডিভোর্স।’

তারমানে সে জানে আমার ডিভোর্সের ব্যাপারে। আমি আর আগ বাড়িয়ে কিছু বললাম না। কিন্তু মেয়েটার ভাবভঙ্গি দেখে নিশ্চিত হলাম ডিভোর্স বিষয়টাকে সে খুব সহজভাবেই নিয়েছে।
আমি সাজ্জাদকে জিজ্ঞেস করলাম তার শ্বশুর আমার ডিভোর্সের ব্যাপারে জানেন কিনা? সাজ্জাদ বললো, ‘ওসব পরে হবে। আগে তোকে দেখুক, কথা বলুক। তুই একটা ভালো জিনিস সেটা বুঝুক। তারপর বললে সমস্যা নাই।’

আমি সেই সুযোগ দিলাম না। ওর শ্বশুর মশাইয়ের সামনে বসে প্রথমেই বললাম, ‘আংকেল আপনি আমার ডিভোর্সের ব্যাপারে জানেন?’
তিনি বেশ ভড়কে গেলেন। আমি বললাম, ‘আমি অনেক সাধাসিধা ভাবে জীবনযাপন করি। বিলাসিতা কিংবা অতিরিক্ত কোনোকিছুই পছন্দ করি না। আমার স্ত্রী চেয়েছিলো তার অনেক টাকাপয়সা হবে, অনেক বিলাসী ভাবে জীবনযাপন করবে। সেটা আমার হয়নি। তাই চলে গেছে। আপনার সবকিছু জানা দরকার। আমি মানুষটা অনেক নরম, সহজ প্রকৃতির। কখনো কাউকে আঘাত করি না। মানুষ সুযোগ পেয়ে আমাকেই আঘাত দিয়ে চলে যায়।’

লোকটার চেহারায় একটা সুন্দর অভিব্যক্তি ফুটে উঠলো। তিনি বললেন, ‘আমিও তোমার মতোই ছিলাম। যাইহোক, ভালোমানুষ দুনিয়াতে ভাত পায় না। তবে ভাত না পেয়েও সুখী হওয়া যায় এটা অনেকেই মানতে চায় না। আমার এগুলো নিয়ে অত চিন্তাভাবনা নেই। তুমি আমার মেয়ের সাথে কথা বলো, পরিচিত হও। তারপর তোমাদের যদি একে অপরকে ভালো লাগে আমরা আলোচনা আগাবো। অত সিরিয়াস হওয়ার মতো কিছু দেখছি না।’

লোকটার কথাগুলো আমার দারুণ ভালো লাগলো। নিজেকে নিয়ে বেশ আরাম বোধ করলাম। দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর রওনা হলাম বাসার দিকে। সাজ্জাদ ওর শালীকার নাম্বার সেভ করে দিয়েছে আমার ফোনে। নাম মুক্তি। বলেছে পরিচিত হও। যদি দুজনের দুজনকে নিজের মতো মনে হয়, তবে তোমরা যা সিদ্ধান্ত নেবে। আমি অবশ্য এ ব্যাপারে কিছু বলি নি। তবে সত্যি বলতে, মেয়েটার সাধাসিধা আচরণ আমার বেশ ভালো লেগেছে। চেহারায় লাবণ্যতা আছে কিন্তু গড়িমা নেই। স্বপ্রতিভ চাহনি। বুদ্ধিদীপ্ত মুখ।

কয়েকটা দিন পার হয়ে গেলো। মুক্তি নামে সেভ করা নাম্বারটাতে কল দেবো কি না, সে ব্যাপারে আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। তাই কল দেয়া হয়ে ওঠে নি। এরমধ্যে হঠাৎ করে নাজিয়ার এসএমএস এর সংখ্যা বেড়ে গেলো। সে নিজের অনুশোচনা নিয়ে অসংখ্য টেক্সট পাঠিয়ে রেখেছে। আমি সেগুলো এড়িয়ে গিয়েও শান্তি পাচ্ছিলাম না। রীতিমতো বিরক্তবোধ করছিলাম। এরপর খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, সুমন দুলাভাইয়ের অন্য একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক আছে। তাও বেশ গভীর। ফোনালাপ কিংবা দেখাসাক্ষাৎ খুব একটা হয় না। মেয়েটা মাঝেমাঝে ফোন করে সুমনের কাছে কিছু জিনিসপত্র দাবী করে। সুমন তার ঠিকানায় টাকা পাঠিয়ে দেয়। আর ক’দিন পরপর যখন ইচ্ছে হয় সেই মেয়ের সাথে গিয়ে রাত কাটিয়ে আসে। সুমন দুলাভাইয়ের সম্পর্কে এই কঠিন সত্যটা আমার একেবারেই কল্পনার বাইরে ছিলো। নাজিয়া যখন বুঝতে পেরেছে সুমন তাকে বিয়ে করলেও আবার ছেড়ে দিতে কতক্ষণ। কিংবা একটা মেয়ের স্বামী যদি আরেকটা মেয়ের কাছে রাত কাটাতে যায়, তাকে টাকা পয়সা পাঠায়, সেই মেয়ে নিশ্চিতভাবেই কখনো সুখী হবে না, তার স্বামীর যত ধন দৌলত আর যত বড় মন থাকুক না কেন। এ কারণেই পিছু হটে নাজিয়া। আর আবারও আমার জীবনে আসার জন্য অনুরোধ করছে।
আমি মেজো আপাকে ভিডিও কলে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সুমন একটা মেয়েকে টাকা পয়সা পাঠাতো, আবার মাঝেমাঝে দেখাও করতো। এসব তুই জানতি?’

আপা নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো, ‘ওর এরকম অনেক ছোটবোন ছিলো। ফেসবুকীয় বোন। কিন্তু তাদের যেকোনো প্রয়োজনে সুমন টাকা পয়সা দিয়ে হেল্প করতো। মেয়েরা ওকে মেসেজ দিয়ে বলতো ভাইয়া একটা বিপদে পড়েছি। অমনি সে যত টাকা দরকার পাঠিয়ে দিতো। আমাকে বলতো মানুষের উপকার করছি। কিন্তু আমি ঠিকই বুঝতাম সে মাঝেমাঝে বাইরে থেকে সেক্স করে ফিরতো। আমার কাছে স্বীকার করতো না। তবে একজনের সাথে গভীর প্রেম হয়েছিলো, আর ওকে বিয়েও করবে এরকমটা স্বীকার করেছিলো। পরে জানলাম সেটা নাজিয়া।’

আমি কিছুই খুঁজে পেলাম না বলার মতো। উচ্ছ্বসিত হয়ে বললাম, ‘তুই জিতে গেছিস আপা। তুই সারাজীবনের মতো বেঁচে গেছিস। আর নাজিয়া? হা হা, সে তো চিপায় পড়েছে। যখন জেনেছে সুমনের ক্যারেক্টর ভালো না৷ নাজিয়া আর বিয়ে করবে না তাকে। এখন আবার আমার লাইফে ফিরে আসতে চাইছে।’

আপার মুখে কোনো অভিব্যক্তি দেখলাম না। বললো, ‘যার যা ভাল্লাগে করুক। তোর কি মনেহয়? নাজিয়া তার ভুল বুঝতে পেরেছে?’

আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম, ‘হুম। আমার মনেহয় নাজিয়া অনুতপ্ত। ওর পাঠানো মেসেজ দেখে বুঝতে পারি সত্যিই সে তার ভুল বুঝতে পেরেছে। তবে তাকে আবারও গ্রহণ করে দ্বিতীয়বার ভুল আমি করবো না। কারণ কি জানিস? কারো প্রতি ভালোবাসা উঠে গেলে, সে পবিত্র হয়ে এলেও আর তাকে ভালোবাসা যায় না। ক্ষমা করা যায়, কিন্তু ভালোবাসাটা আসে না ভেতর থেকে।’

আপা কিছু বললো না। আমি ফোন রেখে দিলাম। আমার নাজিয়ার জন্য দুঃখবোধ হচ্ছে। আপার ভেতরে এত কষ্ট ছিলো, অথচ সে কারো কাছে মুখ ফুটে কিছু বলে নি। এই প্রথম মেজো আপার ব্যক্তিত্ব আমাকে দারুণভাবে প্রভাবিত করলো। মুগ্ধ না হয়ে পারছিলাম না সত্যিই।

দুই বছর পর
আমাদের একটা ফুটফুটে ছেলে হয়েছে। আমার স্ত্রী মুক্তি তার নামের সাথে মিল রেখে ছেলের নাম রেখেছে মুগ্ধ। ছেলের মুখের দিকে তাকালেই আমার শান্তি শান্তি লাগে। মনেহয় পৃথিবীতে বাবা হওয়ার চেয়ে শান্তির আর কিছু নেই।

মুক্তি দোকানে কেনাকাটা করছে। আমি মুগ্ধকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ দেখি রাস্তায় একটা রিকশা চলে যাচ্ছে। রিকশায় বসা একটা মেয়ে। পরনে সুতি থ্রি পিছ, চোখের নিচে কালো দাগ, চুল উঠে মাথাটা প্রায় টাক হয়ে গেছে, গালের চামড়ায় মেছতার মতো ছোপ ছোপ দাগ। রিকশায় পায়ের কাছে রাখা বাজারের ব্যাগ। উদাস দৃষ্টি পথের দিকে। দ্রুত পেরিয়ে গেলো রিকশাটা। আমি মনেমনে ক্ষণিকের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। একটা ভুল মানুষের জীবনকে কতটা পাল্টে দেয়। নিচে নামিয়ে দেয় তার চেয়ে হাজারগুণ। নাজিয়ার এই অনুশোচনার জীবন তারাতাড়ি শেষ হোক, সেই কামনা করি।

মুক্তি এসে বললো, ‘এই চলো বাবুর জন্য একটা দোলনা দেখবে।’

দোলনা দেখতে গিয়ে একটা চমকপ্রদ সোফার দিকে আমার নজর গেলো। বললাম, ‘এই সোফাটা কিনবে?’

মুক্তি এক পলক সোফার দিকে তাকিয়েই বললো, ‘নাহ। আমার বেতের সোফাই ভালো। নান্দনিক লাগে দেখতে। আর সোফা কিনলে বাসার জায়গা পুরোটাই দখল করে ফেলবে। বাসা ফাঁকা জায়গা থাকলেই ভালো। মুগ্ধ পুরো বাড়ি ছোটাছুটি করে খেলতে পারবে।’

আমি মুগ্ধ হয়ে অনেক্ষণ মুক্তির দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে তখন মুগ্ধকে কোলে নিয়ে দোলনা পছন্দ করতে ব্যস্ত। আর আমি ব্যস্ত দুই মা ছেলের আনন্দমুখর মুখ দেখতে। কত অল্পতেই সুখী হওয়া যায়, তা এই মেয়েকে দেখেই উপলদ্ধি করি।

সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে