মন শহরে তোর আগমন পর্ব -০২

0
1414

#মন শহরে তোর আগমন
#লেখনীতে – Kazi Meherin Nesa
#পর্ব – ০২

পকেট থেকে নিজের ফোনটা বের করে আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন জাফরান, আমি ভ্রুকুটি কুচকে বোঝার চেষ্টা করছি উনি কি করতে চাইছেন

“আপনি সোজা ওপরে চলে যান, আপনার মা বাবার সাথে কথা বলে নিন! রেস্ট করুন..আমি একটু আসছি”

“এতো সহজেই ফোন দিয়ে দিলেন আমার হাতে? যদি এখন পুলিশকে ফোন করে দেই ভেবেছেন কি হতে পারে?”

স্মিত হাসলেন উনি

“জানি আপনি এমন কিছুই করবেন না, নাহলে আপনার হাতে ফোন দিতাম না.. যাই হোক আপনি যান!”

“কিন্তু এখনি কেনো রুমে যাবো? আসল কাজটাই তো এখনও বাকি আছে, সেটা শেষ করবেন না?”

“মানে?”

“বা রে, যার ইচ্ছের জন্যে আপনি এতকিছু করলেন..যার দোহাই দিয়ে আমায় বিয়ে করে আনলেন.. তার সাথে দেখা করাবেন না আমায়?”

“ভদ্রভাবে কথা বলুন সুরভী! আপনি আমার বাবার সমন্ধে কথা বলছেন, সে কিন্তু আপনারও বাবার বয়সী সম্মানীয় একজন”

“বেশ! আমি কিছু বলবো না..আপনার বাবা এই বাড়িতেই তো থাকে তাইনা? বলুন উনি কোথায় আছেন? আমি একাই দেখা করে আসছি”

“আপনি ঠিক কি করতে চাইছেন বলুনতো?”

“বিশেষ কিছুই না, আপনিই তো বললেন আমি এই বাড়ির বৌমা, আপনার বাবার ছেলের বউ..তাই আমি আমার শ্বশুর আব্বার সাথে দেখা করতে চাইছি”

উনি কয়েক সেকেণ্ড নিরব রইলেন, আমি ওনাকে দেখেই রাগে ফুসছি..লোকটার প্রতি এত্তো রাগ হচ্ছে কি বলবো! মনে হচ্ছে যেনো উনি আমার শত্রুর থেকেও খারাপ!

“এখনও কিন্তু রাত ফুরিয়ে যায়নি.. বাবা এখন ঘুমাচ্ছে, আমি চাইনা তার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটুক..কাল সকালে বাবার সাথে দেখা করতে পারবেন আপনি, তার আগে অব্দি আমি আশা করবো আপনি কোনরকম সিনক্রিয়েট করবেন না”

“সিন ক্রিয়েট তো আপনি করেছেন, আমি নই তাই এসব কথা আমাকে না শুনিয়ে নিজেকে বোঝান”

“সুরভী, আস্তে কথা বলুন! বাড়ির সবাই ঘুমাচ্ছে..যা বলার যতো রাগ দেখানোর আপনি রুমে গিয়ে আমার ওপর দেখাবেন..কিন্তু এখানে একটা কথাও না”

“বাহ! আপনি তো অদ্ভুত লোক, কিডন্যাপ করেছিলেন আমায়, বিয়ে করে আনলেন তাতে ভয় পেলেন না আর এখন বাড়ির সবাই জেনে যাবে ভেবে ভয় পাচ্ছেন? আপনার কুকীর্তির কথা কি চাপা থাকবে ভেবেছেন? সব বলে দেবো ওনাদের”

“আপনাকে সে কষ্ট করতে হবে না, আমিই যা এক্সপ্লেইন করার করে দেবো”

“ওহ! সেখানেও নিশ্চয়ই একগাদা মিথ্যে বলবেন..যেভাবে বিয়ে করলেন আমায় এটা তো বলতে পারবেন না, সাহস দরকার! আপনার সেটা নেই.. অ্যাম আই রাইট?”

চোখ গরম করে তাকিয়ে রইলেন উনি, আমি চোখ সরিয়ে ফেললাম..সত্যি বলতে আমারও এভাবে কথা বলার ইচ্ছে নেই, কিন্তু এই মুহূর্তে ওনার আচরণ আর কর্মকাণ্ডে যেনো আমার হিতাহিত বোধ লোপ পেয়েছে
___________________________

ওড়না টা চাদরের মতো করে গায়ে জড়িয়ে এই মুহূর্তে জাফরানের রুমের বারান্দার দোলনায় বসে আছি আমি, একটু আগেই বাড়িতে ফোন করেছিলাম..মাকে সবটা বলেছি, কিন্তু মা কিছু বুঝে উঠতে পারেনি, অবশ্য মা কি বুঝবে আমি নিজেই তো বুঝতে পারছি না কি হচ্ছে এসব আমার সাথে.. পরে জাফরান কথা বলেছে আমার মায়ের সাথে, কাল সবাইকে এই বাড়িতে আসতে বললো..তারপর থেকেই আমরা দুজনেই চুপচাপ আছি, আমি বারান্দায় আর উনি রুমের মধ্যে পায়চারি করছেন!

“আপনি আমার মা বাবাকে এখানে আসতে বললেন কেনো? আবার কি করতে চাইছেন?”

“মেয়ের বিয়ে কোথায় হলো, কার সাথে হলো সেগুলো জানার অধিকার আছে ওনাদের তাই ডেকেছি..আপনাকে ওইসব ভাবতে হবে না”

“কিন্তু আমার মা বাবা..”

“আপনি ওইসব বাদ দিন, বাইরে অনেক ঠান্ডা..ওখানে বসে না থেকে রুমে চলে আসুন নইলে ঠান্ডা লেগে যাবে”

“আপনাকে আমার কথা ভাবতে হবে না, এসব সিম্প্যাথি অন্তত এখন দেখাবেন না প্লিজ!”

“সিম্প্যাথি দেখাচ্ছি না, দায়িত্ব পালন করছি..আপনি রেগে আছেন..নিজের ভালোমন্দের খেয়াল হয়তো আপনার নেই কিন্তু আপনি অসুস্থ হয়ে পড়লে বাবাকে আমার জবাবদিহি করতে হবে”

“সব ছেলেরা তো মামা’স বয় হয় কিন্তু আপনি দেখছি পাপা’স বয়..সবকিছুতেই বাবাকে টানার বদভ্যাস আছে নাকি?”

উনি উত্তর দিলেন না, তারপর মিনিট পাঁচেক পিনপতন নিরবতা ছিলো, তারপর নিরবতা ভেঙে আমি বললাম

“আমি আপনার রুমে থাকতে পারবো না”

কথাটা এবার একটু জোরেই বললাম, উনি সঙ্গে সঙ্গে বারান্দার দরজার সামনে এসে দাড়ালেন..

“তাহলে কোথায় থাকবেন?”

ওনার দিকে না তাকিয়েই উত্তর দিলাম

“এতো অবাক হচ্ছেন কেনো? আপনি কি ভেবেছেন বিয়ে করেছি বলেই স্ত্রীর মতো আপনার সাথে থাকবো? বাড়ির বৌমা হিসেবে বাড়িতে থাকাটা আমার জরুরি, এক রুমে থাকা নয়”

“কোথায় থাকতে চাইছেন আপনি?”

“আপনার বাড়ির কোনো একটা এক্সট্রা রুমে! আপনার সাথে একঘরে থাকতে ভালো লাগছে না আমার, আপনার উপস্থিতিতে বিরক্তবোধ করছি..পারলে এখনি অন্য কোনো রুমের একটা ব্যবস্থা করে দিন”

“আপাতত সেটা সম্ভব নয়, বিরক্ত লাগলেও আপনাকে এই ঘরেই থাকতে হবে”

ঘাড় ঘোরালাম ওনার দিকে.. কি যেনো নেই নেই লাগছিলো, পরে উপলব্ধি করলাম চশমা নেই ওনার চোখে..গত কয়েক ঘন্টায় প্রথম চশমা ছাড়া দেখছি তাই হয়তো অদ্ভুত লাগছে..আপাতত এইসব বিষয় উপেক্ষা করে বাজখাই গলায় বলে উঠলাম

“আপনার ডিমান্ড দেখছি একটু একটু বেড়েই যাচ্ছে, প্রথমে বিয়ে, এখন আবার বলছেন এই রুমে থাকতে হবে? তারপর তো বলবেন আপনার সাথে..”

“ব্যাস, আর একটা শব্দ উচ্চারণ করবেন না..এতোটা নিচু মন মানসিকতা আমার নেই সুরভী, হ্যা আপনার ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে করতে বাধ্য করেছি আপনাকে, তার মানে এই না তার সুযোগ নেবো”

তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলাম, আজকালকের যুগে ছেলেদের এইসব কথায় বিশ্বাস করাটা বোকামি! তার ওপর যদি বিবাহিতা স্ত্রী হয় তার সুযোগ নেবে না, এটা তো মানা অসম্ভব!

“বড় বড় কথা মুখে বলাটা অনেক সহজ কিন্তু করাটা কঠিন মিস্টার জাফরান! অনেক ছেলেরাই তো বলে এমন কথা কিন্তু কিছু সময় বাদে নিজেরাই নিজেদের বলা কথা ভুলে যায়..আপনিও তাই করবেন! জানা আছে”

“আপনি তখন বলেছিলেন আপনাকে যেনো বাকি লোভী মেয়েদের মতো এক পাল্লায় না মাপি, তাহলে আপনি কিভাবে আমার সম্পর্কে না জেনেই আমাকে অন্যান্য ছেলেদের সাথে এক পাল্লায় মাপছেন? এটা তো আনফেয়ার করা হলো আমার সাথে”

“আপনি ফেয়ার আনফেয়ারের কথা না বললেই খুশি হবো, এই দুটো শব্দ অন্তত আপনার মুখে মানায়না”

“আপনার যতো রাগ যতো অভিযোগ সব যেনো শুধু আমার ওপরই সীমাবদ্ধ থাকে! বাবার সামনে কোনরকম উল্টোপাল্টা কথা বলবেন না সুরভী”

“যা সত্যি তাই বলবো..আপনি আজ যে মহান কাজ করেছেন সেটার কথা অবশ্যই জানা উচিত আপনার বাবার”

জাফরান আর একটা কথা বললেন না, আমি তো অন্যদিকে তাকিয়ে ছিলাম.. পরে ওনার কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে চেয়ে দেখলাম রুমে চলে গেছেন উনি! আমিও চুপ করে বসে রইলাম.. ভোর হয়ে এসেছে, আর কিছু সময়ের অপেক্ষা..তারপর সকালে ওনার বাবাকে অনেককিছু বলার আছে আমার!
_________________________

গতরাতে ভেবেছিলাম বাড়িতে বোধহয় জাফরান আর ওনার বাবা ছাড়া কেউ নেই কিন্তু সকালবেলা জাফরানের বড় বোন, বোনের হাসবেন্ড আর দুই ফুপুকে দেখে আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়ে গেলো! সবাই আমাকে এমনভাবে ট্রিট করছে যেনো আগে থেকেই তারা জানতেন আমি আসবো এই বাড়িতে! সবাই আমার সাথে পরিচিত হলো, আমি চুপ ছিলাম..কিছু সময় বাদে দেখলাম তিনটা শাড়ি, হাল্কা কিছু গয়না হাতে ওনার বোন জিনিয়া ঘরে এসে হাজির হলো..ওনার আর জাফরানের চেহারায় কি অদ্ভুত মিল..পরে বুঝলাম ওনারা দুজন টুইনস!

“সুরভী! এর মধ্যে থেকে পছন্দ করে একটা শাড়ি পড়ে নাও, জাফরান বললো তোমার মা বাবাও আসছে একটু বাদেই”

আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি সবার আচরণ দেখে, এতো স্বাভাবিক আছে কিভাবে সবাই? বিছানার দিকে তাকিয়ে শাড়িগুলো দেখে নির্দ্বিধায় বললাম

“আমি শাড়ি পড়তে পারিনা”

“ওহ, সমস্যা নেই! এসো আমি পড়িয়ে দিচ্ছি!”

“আপনি কি জানেন আপনার ভাই কিভাবে আমাকে এই বাড়িতে এনেছে? কিভাবে আমায় বাধ্য করেছে?”

জিনিয়া আমার দিকে তাকিয়ে হ্যা সূচক মাথা নাড়লো, যা আমায় আরো বেশি অবাক করেছে!

“গত রাতেই বাড়ি ফেরার পর জাফরান আমাকে সব বলেছে, আমি তখনি ভেবেছিলাম তোমার সাথে কথা বলবো কিন্তু..”

“কি কথা বলবেন? কথা বলার মতো কিছু কি বাকি আছে আর? আপনার ভাই এত্তো বড় অন্যায় করে এসেছে তারপরও আপনারা কেউ তাকে কিছু বলছেন না? উল্টে আমাকে সাজাতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন কেনো? অন্যায় করেছে আপনার ভাই, সেটা বোঝান ওনাকে!”

ফুপিয়ে উঠলাম আমি, জিনিয়া চোখ নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে

“আপনার বাবা আমাকে নাকি পুত্রবধূ হিসেবে পছন্দ করেছিলেন, কিন্তু আমার এখন বিয়ের ইচ্ছে ছিলো না বলে না করে দিয়েছিলাম..এরকম তো আরো অনেককেই করেছি, কই তারা তো আমার সাথে এমনকিছু করেনি যেমন আপনার ভাই করলো..আর আপনারা সবাই তাতে সায় দিচ্ছেন?”

অভিযোগ মিশ্রিত স্বরে কথাগুলো বলে দিলাম, চোখে পানি টলটল করছিলো আমার..জিনিয়া আমার দিকে তাকিয়ে মলিন এক হাসি দিলেন

“অভিযোগ করার অধিকার আছে তোমার! তবে একবার বাবার সাথে দেখা করো, তাহলেই বুঝবে জাফরান কেনো তোমার সাথে এমন করেছে”

জিনিয়া ও একটা কথা বলেই আমাকে নিরব করিয়ে দিলেন, যেমনটা গতকাল জাফরান করেছিলেন..এবার তো ওনার বাবার সাথে দেখা করার জন্য আরো ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠছি..আমিও জানতে চাই কেনো সবাই ওনার বাবার কথাই বলছেন? মেরুন রঙের শাড়ি পড়িয়ে তৈরি করিয়ে দিলো জাফরানের বোন আমাকে..অন্য সময় হলে তৈরি হয়ে নিজেকে পাঁচ ছয় বার তো আয়নার সামনে দেখতাম কিন্তু আজ ইচ্ছে করছে না!

“বাহ! খুব সুন্দর লাগছে তোমায়..শাড়িটা সুন্দর মানিয়েছে তোমার গায়ে”

উত্তর দিলাম না আমি, তখনই রুমে আগমন ঘটলো জাফরানের..আয়নার সামনে দাড়িয়ে ছিলাম আমি, তো ওখানেই দেখলাম উনি তাকিয়ে আছেন আমার দিকে, সঙ্গে সঙ্গে চোখ গরম করে তাকালাম ওনার দিকে..উনি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন কিছুটা

“জেনি, ছোটো ফুপি ডাকছে তোকে”

“যাচ্ছি, তুই বরং ওকে বাবার কাছে নিয়ে যা”

জিনিয়া বেরিয়ে গেলেন, বুঝলাম সবার আজ খুব তাড়া..যেনো বাড়িতে কোনো বিশেষ আয়োজন চলছে!

“আপনার বাড়ির সবাই কি আপনার মতোই? সবাই এমন করছে যেনো জানতেন আমি এখানে আসবো? এসব প্রি – প্ল্যান্ড ছিলো?”

“নাহ! আজ সকালে জেনেছে সবাই! আপনি বলেছিলেন সবাইকে বলে দেবেন, আপনার কষ্ট কমিয়ে দিয়েছি! আমিই বলেছি সব..সবাই আমাকে অনেক বকাবকি করেছে”

“মানে? এসব কখন হলো?”

“আপনি তখন ঘুমাচ্ছিলেন”

রাগ হচ্ছে ওনার কথা শুনে, চোখের সামনে দেখতে চাইছিলাম সবটা..জাফরানকে মাথা নিচু করে সবার কথা শোনার দৃশ্যটা মিস করে গেলাম আমি! আফসোস হচ্ছে.. হঠাৎ লক্ষ্য করলাম জাফরান আমার দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে আছেন, যেনো কিছু বলতে চেয়েও বলছেন না

“এভাবে তাকাবেন না আমার দিকে, অসস্তি হয়!”

আমার ছোট্ট একটা কথাতেই ওনার তাকানোর ভঙ্গি বদলে গেলো

“আপনার মা বাবা কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবেন এখানে, আপনি তার আগে বাবার সাথে দেখা করে নিন..চলুন”

উনি আমাকে সাথে যাওয়ার ইশারা করে দরজার দিকে হাটা দিলেন, আমিও ওনার সঙ্গে সঙ্গে চললাম..হাতে ক্যানেলা লাগানো অবস্থায় বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছেন জাফরানের বাবা, জাফরানের ফুপু তাকে ওষুধ দিচ্ছিলেন! রুমের মধ্যে অক্সিজেন ও টুকটাক মেডিক্যাল সরঞ্জাম ও মজুদ আছে..আমি চমকে উঠলাম এসব দেখে, ভেবেছিলাম ওনার বাবার সামনে যখন আসবো তখন ওনার নামে অভিযোগ করবো কিন্তু এখন তো আমার মুখ থেকে একটাও কথা বের হচ্ছে না..জাফরানের বাবা দরজার দিকে তাকিয়ে আমার দিকে তাকিয়েই হাল্কা হাসলেন, ইশারায় ভেতরে আসতে বললেন কিন্তু আমি ভেতরে ঢোকার সাহস পাচ্ছি না, কেমন ভয় লাগছে..হাত পা কেমন কাপছে আমার! জাফরান ভেতরে ঢুকে গেছেন ইতিমধ্যে কিন্তু আমি নিজের জায়গায় স্থির দাড়িয়ে আছি!

“গুড মর্নিং বাবা”

ওনার বাবা আমার দিকে একবার তাকিয়ে আবার ওনার দিকে তাকালেন, ধমকের সুরে বললেন

” জাফরান, তুই একা একা ভেতরে চলে এলি কেনো? ও তো ওখানেই দাড়িয়ে আছে..ওকে নিয়ে আয়..এখন এই একা আগে চলে যাওয়ার অভ্যাসটা বদল কর”

বাবার কথা শুনে পেছনে ফিরে জাফরান আমার দিকে দেখলেন, আমি এখনও চুপ করে ওনার বাবার রুমের দিকেই দেখছি..ছোটো থেকে অসুস্থ মানুষ দেখলেই কেমন যেনো ভয় লাগে, তার ওপর ওনার বাবাকে দেখে মনে হচ্ছে গুরুতর অসুস্থ..জাফরান আমার কাছে এসে হাত ধরে এনে বসালেন ওনার বাবার সামনে..

“ওর মা বাবা এলে আমার রুমে একটু পাঠাস”

“ঠিক আছে ভাইজান”

ওনার ফুপু বেরিয়ে এলেন রুম থেকে, জাফরান স্যালাইন চেক করে নিলো যে ঠিকমতো পাস হচ্ছে কিনা, আর আমি বাচ্চাদের মতো এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছিলাম, হুট করে ওনার বাবা বলে উঠলেন

“ভয় পাচ্ছো নাকি এসব দেখে?”

আমি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম, ভয় পাচ্ছি দেখেও না সূচক মাথা নাড়লাম..জাফরানের বাবা হাসলেন, ওনার চোখমুখ আর এইসব জিনিসপত্র জানান দিচ্ছে কোনো এক কঠিন রোগে আক্রান্ত উনি!

“জাফরান, তুই এখানে দাড়িয়ে আছিস কেনো?”

“কোথায় যাবো তাহলে?”

“আমি ওর সাথে একা কথা বলতে চাই..তুই বাইরে যা, আর রুমের দরজা একটু ভেজিয়ে দিয়ে যাস”

“তোমরা যা কথা বলার বলো না, আমাকে যেতে বলছো কেনো?”

“যা বললাম সেটা কর..তোর ফুপিদের কোনো দরকার পড়তে পারে, ওগুলো দেখ..যা!”

ওনার বাবার কথা শুনে আমরা দুজনেই একে অপরের দিকে তাকালাম, জাফরানের চোখের ভাষা বুঝতে তেমন সমস্যা হয়নি আমার..ওনার ভয় আমি যেনো ওনার বাবার সাথে কোনো দুর্ব্যবহার না করে বসি! অনিচ্ছা সত্ত্বেও রুম থেকে বেরিয়ে এলো জাফরান, আমি তখনও চুপ! কি কথা বলা উচিত ওনার বাবার সাথে সেটা বুঝে উঠতে পারছিলামনা এর মাঝেই ওনার বাবা প্রশ্ন করে বসলেন

“কেমন আছো সুরভী?”

“জ.. জ্বি ভালো”

“হুমম! আমি সব শুনেছি জাফরান কি করেছে..আসলে তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে শুরু থেকেই কিন্তু তুমি না করে দিয়েছিলে..তাই আমি আমার ছেলেকে বলেছিলাম তোমার সাথে কথা বলতে.. তোমায় রাজি করাতে বিয়ের জন্যে, কিন্তু ও যে এমনকিছু করবে ভাবিনি..ওর হয়ে আমি ক্ষমা চাইছি তোমার কাছে”

জাফরানের বাবার কথা শুনে বুঝলাম উনি ছেলেকে যা বলেছিলেন ওনার ছেলে তার উল্টো কাজ করে এসেছেন, ওনার বাবার কথায বুঝলাম ছেলের কাজের জন্যে তিনিও লজ্জিত!

“নাহ আঙ্কেল, আপনি ক্ষমা চাইবেন না প্লিজ! দোষ আপনার ছেলে করেছে.. আপনি তো আমায় সোজা বিয়ে করে আনতে বলেননি কিন্তু উনি..”

“কিন্তু তোমাকে ওর স্ত্রী হিসেবে আমি দেখতে চেয়েছিলাম, আমি শুধু এইটুকু কনফার্ম হতে চেয়েছিলাম যে ভবিষ্যতে তোমাদের বিয়েটা হবে কিন্তু আমার ছেলে যে পার্মানেন্ট কনফার্মেশন নিয়ে আসবে ভাবিনি”

আমি চুপচাপ ওনার বাবার দিকে চেয়ে আছি, ওনাকে দেখে আমার কেনো যেনো নিজের বাবার কথা মনে পড়ছিলো, ওনার বাবা ক্যানেলা লাগানো হাত তুলে আমার মাথায় আস্তে আস্তে বুলিয়ে বললেন

“আমার ছেলে অপরাধ করেছে, তার জন্যে তোমার মনে ক্ষোভ তো আছেই.. তুমি যা বলবে তাই শাস্তি দেবো আমি জাফরানকে..তবে তোমাকে এখানে দেখে আজ আমি নিশ্চিন্ত.. আমার পরেও জাফরানের জন্যে চিন্তা করার, ওর খেয়াল রাখার একটা মানুষ আছে দেখে আজ অনেকটা নিশ্চিন্ত লাগছে”

জাফরানের বাবার রুমে সবাই উপস্থিত, আমার মা বাবাও এসেছে। তারা সবাই আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, যেহেতু বিয়েটা হয়ে গেছে তাই অগত্যা আমার পরিবারও মেনে নিয়েছে সবটা। জাফরানের বাবা ছেলের হয়ে আমার মা বাবার কাছে অব্দি ক্ষমা চেয়েছেন, জাফরান চুপ করে তখন তার বাবার পাশেই দাড়িয়ে ছিলো, আমি আমার মা বাবার পাশে দাড়িয়ে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। বাবাকে একটু বেশিই ভালোবাসেন উনি, তাইতো একটা মুহূর্ত কাছ ছাড়া হতে চান না। আলোচনার এই পর্যায়ে জাফরানের বাবা বললেন

“আমি নিজের ছেলের দোষের কথা অকপটে স্বীকার করলাম, ছেলে আমার আবেগী হয়ে কাজটা করে ফেলেছে শুধু আমার শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করতে। এবার আপনারাই বলুন মেয়েকে কি নিয়ে যেতে চান?”

তখন আমার বাবা বললেন

“দেখুন, আপনার ছেলে অন্যায় করেছে কিন্তু এটাও সত্যি বিয়েটা হয়েছে। দুজনেই তাতে সামিল হয়েছে, হিসাবমতে আমাদের মেয়ে এখন আপনার ছেলের স্ত্রী। ওকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া কি শোভা পাবে এখন? তাছাড়া গতকালকেই আমাদের এলাকায় রটে গেছে অনেককিছু। জানেনই তো এখনকার দিনকাল কেমন”

বাবার কথা শুনে জাফরান আমার দিকে তাকালেন, গত রাতে তো এই ভয়েই বিয়ের জন্যেই রাজি হয়েছিলাম আমি। আমার মা কিছুটা আফসোস করে বললেন

“মেয়ের বিয়ে নিয়ে সব মা বাবার স্বপ্ন থাকে, কিন্তু আমরা যে ওর বিয়েতে কিছু করতে পারলাম না, আমাদেরও তো আত্মীয় স্বজন আছে। তাদের অজান্তেই হুট করে সব হয়ে গেলো, এই সমস্যাগুলোর সামনা করতে হবে আমাদের”

“সমস্যা নেই, আপনাদের হাতে তো সময়ের অভাব নেই। আপনারা না হয় পরে ধুমধাম করে ওদের বিয়ের অনুষ্ঠানটা করিয়ে দেবেন, নিজেদের অপূরণীয় ইচ্ছেগুলো পূরণ করে নেবেন”

জাফরানের বাবার কথায় মা বাবা চুপ হয়ে গেলো, এদিকে জাফরান নীরবে সব কথা শুনে যাচ্ছেন। একটা টু শব্দ অব্দি করছেন না। আমি ভেবেছিলাম উনি হয়তো কিছু বলবেন, এখানে সবাই ওনাকে অনেক দোষ দিয়েছে কিন্তু উনি কোনো মন্তব্য করেননি। নিরব থেকে নিজের দোষ স্বীকার করে নিয়েছেন। আলোচনা শেষে জাফরানের বাবা বললেন

“যাক! বেয়াই বেয়াইন ও তো সব মেনেই নিয়েছেন। শোন জেনি, এবার জাফরান আর সুরভীর রিসিপশনের ব্যবস্থা কর তোরা সবাই”

ওনার কথা শুনে সবার মুখ কালো হয়ে গেলো, জাফরান শান্ত কণ্ঠে বললেন

“বাবা, এসবের কোনো প্রয়োজন নেই। সুরভীর সাথে আমার বিয়েটা হয়ে গেছে, এখন আর রিসিপশনের দরকার আছে বলে মনে হয় না”

“দরকার আছে জাফরান, তোর বিয়ের কথা কেউ জানবে না নাকি? বিয়ের প্রস্তুতি করতে গেলে অনেক সময় লাগবে তাই আমি শুধু তোদের রিসিপশনটা দেখতে চাই। আপনাদের কোনো আপত্তি নেই তো?”

বাবা মা আমার দিকে একনজর তাকিয়ে বললেন

“আপনি যখন নিজের ছেলে বৌমার রিসিপশন করাতে চাইছেন করুন, আমাদের আপত্তি নেই”

“জাফরানের আর জেনির মা ওদের বড় হওয়াটা দেখতে পারেনি, সেখানে আমি ওদের বড় হওয়া, বিয়ে সবটা দেখতে পারছি। এই ঢের পাওয়া”

এইটুকুতেই জাফরানের বাবা অনেক খুশি হয়ে গেলেন..ওনার বাবার সাথে কথা বলার সময় জেনেছিলাম ওনারা যখন ক্লাস টুতে পড়তেন তখন তাদের মা মারা গেছিলেন।সবকিছু যখনই ভাবছি তখনই কেমন শরীর শিউরে উঠছে আমার, যে সময়টা মা বাবাকে বেশি প্রয়োজন তখন তাদের ছাড়া বেচে থাকাটা কতটা কষ্টসাধ্য হতে পারে! জাফরানের জায়গায় নিজেকে ভাবার দুঃসাহসটাও করতে পারিনি আমি। জাফরানের ছোটো ফুপি বললেন

“কিন্তু ভাইজান, এতো তাড়াতাড়ি সবকিছু কিভাবে সম্ভব হবে? কতো আত্মীয় স্বজন আছে আমাদের, সবাই তো এতো কম সময়ে আসতে পারবে না”

“সমস্যা নেই ফুপি, আমরা সবাইকেই বলবো। যারা আসতে পারবে আসবে। বাবা যখন চাইছে তখন রিসিপশনের অনুষ্ঠান হবে”

“বেশি মানুষদের ইনভাইট করার দরকার নেই, আমাদের ক্লোজ রিলেটিভদের বলিস। আসার হলে আসবে, এতো আয়োজনের দরকার নেই”

জাফরানের কথায় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে এসবে অংশ নেবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই ওনার, শুধু বাবার জন্যে করছেন। তখন ওনার বাবা দুটো ধমক দিলেন, বাবার ধমক শুনে বাচ্চা ছেলের মতো চুপ হয়ে গেলেন উনি। এরপর আর একটা কথা বলেননি। উপস্থিত সবার সম্মতিতে ঠিক হলো আগামীকাল আমাদের রিসিপশনের অনুষ্ঠান হবে। সবকিছু এতো দ্রুত ঘটে যাচ্ছে যে কিছু বোঝার সময়ই যেনো পাচ্ছি না। কিন্তু এই তাড়াহুড়োর পেছনের কারণ কিছুক্ষণ আগেই জেনেছি আমি, জাফরানের বাবার হাতে বেশি সময় নেই বিধায় উনি যতো দ্রুত সম্ভব নিজের মনের খায়েশ পূরণ করে নিতে চাইছেন। আমার শ্বশুরের কড়া আদেশ অনুসারে আমার মা বাবাকে বেশ খাতির করা হলো, আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম সবটা। জাফরানের বাবা আমাকে এতোটা আপন করে নিলেন কিভাবে? কি এমন দেখেছেন উনি আমার মাঝে যার জন্যে নিজের ছেলের সাথে বিয়েটা দেবার জন্যে এতো উৎসুক ছিলেন? বাবা মার সাথে বাড়ির বড়রাও খাচ্ছিলেন, জিনিয়া সবাইকে সার্ভ করছে। সবাই উপস্থিত শুধু জাফরান নেই, কি একটা ভেবে আমি জাফরানের বাবার রুমের দিকে এগিয়ে আসলাম। দেখলাম জাফরান তার বাবার হাত থেকে স্যালাইন খুলে দিচ্ছেন, তারপর তার বাবাকে নিজের হাতে খাইয়ে দিচ্ছেন, গল্প করছেন বাবার সাথে। বাবা – ছেলের এমন মুহূর্ত দেখে চোখদুটো ভিজে উঠলো আমার
_________________________________

আগামীকাল রিসিপশন হবে, মোটামুটি আয়োজন করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। কুড়ি – পঁচিশ মানুষ আসবে শুনলাম, এর বেশি কাওকে ইনভাইট করতে জাফরান মানা করেছে। পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন যে উনি চাননা ওনার বাবার এই অসুস্থ অবস্থায় বাড়ি ভর্তি মেহমান দাওয়াত করতে, তাতেই সবাই সম্মতি দিয়েছেন। মা বাবা বিকেলের দিকে বাড়িতে গেছেন, অবশ্য এ বাড়ির সবাই থেকে যেতে বলেছিলেন কিন্তু তারা থাকেননি। ড্রইং রুমে বসে জাফরানের ফুপীদের সাথে টুকটাক কথা বলছিলাম, জিনিয়া ও ওখানে উপস্থিত। তখন জাফরানের ছোটো ফুপু আমার দিকে একটা জামদানি শাড়ি এগিয়ে দিলেন

“সুরভী, দেখো তো। এই শাড়িটা আপা আর আমি মিলে তোমার জন্যে পছন্দ করেছেন, ভালো লেগেছে তোমার?”

“সুন্দর হয়েছে ফুপু কিন্তু শাড়িটা ক্যারি করা একটু কষ্ট হয়ে যায় আমার জন্যে”

তখন বড় ফুপু গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন

“বিয়ের পর শাড়ি পড়াটাই ভালো, পারো না তো কি হয়েছে? পড়তে পড়তে শিখে যাবে। অভ্যাস তো করতে হবে নাকি?”

বড় ফুপুর কথা শুনে চুপ হয়ে গেলাম আমি, ওনার কথার ছন্দেই বোঝা যায় কিছুটা রগচটা মেজাজের মহিলা উনি। তখন পাশ থেকে জিনিয়া বললো

“আহা, ফুপি সবাই সবকিছু পারে নাকি? জোর করার কি দরকার? সুরভী, শুধু কালকের দিনটা একটু কষ্ট করে শাড়িটা ক্যারি করো। তারপর আর শাড়ি পড়তে হবেনা। তোমার যা ইচ্ছে পড়তে পারো”

আমি আর আপত্তি করলাম না, একটা দিনেরই তো ব্যাপার। সন্ধ্যার পর জাফরানের বাবার সাথে কিছুটা সময় কাটালাম, ওনার কথার বেশিরভাগ বিষয় ছিলো জাফরানের মা, জাফরান সম্পর্কে! মনে হচ্ছিলো যেনো উনি সবকিছু আমাকে জানিয়ে দিচ্ছেন যা ভবিষ্যতে আমার দরকার পড়তে পারে। কথার মাঝে হঠাৎ কি নিয়ে যেনো চায়ের প্রসঙ্গ উঠলো

“সুরভী, মা তুমি চা বানাতে পারো?”

“জ্বি পারি, আপনি খাবেন? বানিয়ে এনে দেবো?”

“না না, আজ থাক। আজ কিছু করতে হবে না”

“সমস্যা নেই, আপনি খেতে চাইলে বলুন। বানিয়ে আনছি এখুনি”

“নাহ, আজকে থাক। তুমি বরং পড়ে সময় করে আমাকে একটু চা করে খাইও একদম বেশি করে চিনি দিয়ে, জাফরান আবার আমার চিনি দিয়ে চা খাওয়াটা পছন্দ করেনা”

মুচকি হেসে মাথা নাড়লাম আমি, হঠাৎ আমার বাবার কথা মনে পড়ে গেলো। উনিও আমার মায়ের থেকে লুকিয়ে বেশি বেশি চিনি দিয়ে চা খান। ওখান থেকে রুমে এসে দেখলাম জাফরান কথায় ব্যস্ত, আমাকে দেখে উনি কথা শেষ করে ফোন কাটলেন। কিভাবে ওনার সাথে কথা বলা শুরু করবো বুঝতে পারছিলাম না তখন উনিই বলে উঠলেন

“ডাক্তার দু সপ্তাহ বলেছিলেন, তার মধ্যে এখন আমার বাবার হাতে খুব বেশি হলে সাত থেকে দশদিন মতো সময় বেচে আছে, তাই বাবা সবকিছুর জন্যে এতো তাড়াহুড়ো করছেন। জানি আপনি এসবের জন্যে প্রস্তুত নন বাট, আই অ্যাম সরি”

কথাগুলো জড়িয়ে যাচ্ছিলো বলার সময়, বাবার মৃত্যুর দিনক্ষণ আগে থেকেই জানা একজন সন্তানের কাছে কতোটা যন্ত্রণার হতে পারে সেটা হয়তো আমি পুরোপুরি অনুভব করতে পারবো না তবে ওনাকে দেখে কিছুটা উপলব্ধি করতে পারছি। সবটা নিজের চোখে দেখার পর ওনার ওপর দোষ দেবোই বা কিভাবে। উনিও তো কারো খুশির জন্যে এগুলো করছেন

“আজকে আশা করি একটু হলেও আপনার কাছে সব পরিষ্কার, কেনো ঐভাবে বিয়ে করেছি আমি আপনাকে! আমি কিন্তু নিজের দোষ ও মেনে নিয়েছি। এবার আর কোনো অভিযোগ নেই তো আপনার?”

আমি কিছুটা গম্ভীর স্বরে বললাম

“আপনার মনে হয় এতো সহজে অভিযোগ শেষ হয়ে যাবে? সবটা মেনে নেওয়া এতো সহজ নয় জাফরান”

মলিন হাসলেন জাফরান, টেবিলের ওপর এলোমেলো হয়ে পড়ে থাকা কাগজগুলো ফাইলের মধ্যে গুছিয়ে রাখতে রাখতে বললেন

“আমার প্রতি আপনার অভিযোগ যদি সারাজীবন স্থায়ী থাকে তবুও আফসোস থাকবে না আমার, কারণ বাবার সামনে আপনি কোনো রিয়েক্ট করেননি। আপনার এই স্বাভাবিক আচরণ দেখে বাবা অনেক খুশি হয়েছেন”

আজ ওনার কথায় কৃতজ্ঞতার ছোঁয়া বিদ্যমান, বুঝলাম বাবার খুশিতেই ছেলের খুশি

“আপনি রুমের ভেতরই থাকুন, গত রাতের মতো বারান্দায় থাকার দরকার নেই। আমি বরং আজ বাবার কাছে থেকে যাবো”

অবাক হয়ে গেলাম ওনার কথায়, ভেবেছিলাম অন্য ছেলেদের মতো উনিও জেদ করবেন আমার সাথে একি রুমে থাকার কিন্তু সেটা উনি করলেন না। আমার মাথার মধ্যে অনেককিছু ঘুরপাক খাচ্ছিলো, সেগুলো মুখ ফুটে বলেই ফেললাম

“আপনাকে দেখে ভীষণ অবাক লাগছে আমার, গতকাল অব্দি আমি ভাবতেও পারিনি আপনার জীবনে এতো কঠিন সময় চলছে। আপনি বুঝতেই দেননি। মাত্র একটা দিন হয়েছে আমি এই বাড়িতে এসেছি, সবটা দেখে আমারই কেমন দুর্বল লাগছে। আপনার বাবার সাথে কথা বলতে গেলেই হাত পা কেপে উঠছে বারবার সেখানে এতদিন ধরে নিজেকে কিভাবে সামলে রেখেছেন আপনি?”

“নিজেকে শক্ত রেখেছি, সামলে রেখেছি। বাবার সামনে আমি দুর্বল হয়ে পড়লে তো আমার চলবে না, তবে হ্যা জানিনা বাবা চলে যাওয়ার পর কি হবে। নিজেকে সামলাতে পারবো না তখন আর”

ওনার চোখে পানি টলটল করছে, উজ্জ্বল শ্যামলা বদনখানাও ফ্যাকাশে হয়ে গেলো নিমিষেই। দাড়ালেন না উনি আর আমার সামনে, একরকম ছুটে এলেন ওখান থেকে। বেরোনোর সময় চশমা খুলে চোখ মুছছিলেন উনি যা আমার নজর এড়াতে পারেনি। বড্ড অপরাধবোধ কাজ করছে, কেনো এই প্রশ্ন করতে গেলাম ওনাকে?
_______________________________

বাড়ির সবাই ঘুমাচ্ছে, শুধু আমিই ঘুমাতে পারছি না। রুমে একা থাকার অভ্যাস নেই আমার, সবসময় হয় মা নাহলে ছোটবোন সাথে থাকতো কিন্তু আজ এইরুমে সম্পূর্ন একা আমি তার ওপর অচেনা জায়গা। কেমন ভয় ভয় করছে। উঠে বসে দেখলাম জাফরান সত্যিই আসেনি রুমে, ঘুম আসছে না কিছুতেই। উঠে এক গ্লাস পানি খেয়ে দাড়ালাম বারান্দায়। দুদিন আগে অব্দি এই সময় নিজের বাড়িতে ছিলাম আমি আর আজ কোথায় আছি। সত্যিই সময় মানুষকে কখন কোথায় কিভাবে নিয়ে যায় টেরই পাওয়া যায় না। নিজেকে নিয়েই ভাবনায় ডুবে ছিলাম হঠাৎ কারো পায়ের আওয়াজ পেয়ে পেছনে ফিরেই আতকে উঠলাম আমি, জাফরান বিষয়টা বুঝতে পেরে বলে উঠলেন

“হেই রিলাক্স! ইটস মি”

আমি সস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম, ভুত এসেছে ভেবে বসেছিলাম। বারান্দা থেকে দ্রুত পায়ে এসে দাড়ালাম ওনার সামনে

“আপনি? এভাবে কেউ আসে? এমনিতেই ভয় পাচ্ছিলাম একা একা। এখুনি তো হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেতো আমার”

“সরি, কিন্তু আপনি ভয় পাচ্ছিলেন কেনো? এখানে তো ভয় পাওয়ার মতো কিছু নেই”

একা থাকতে ভয় পাই কথাটা বলতে বাঁধছিল আমার, কেমন যেনো বোকা বোকা ব্যাপার হয়ে যাবে তাই কথা ঘুরিয়ে দিলাম

“আগে আপনি বলুন এখন এখানে কি করছেন? আপনি নাকি আসবেন না এই রুমে তাহলে এতো রাতে কি দরকার পড়লো?”

“ল্যাপটপ নিতে এসেছিলাম, কিন্তু আপনি এখনও জেগে থাকবেন সেটা এক্সপেক্ট করিনি। তাহলে আসতাম না এখন”

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাত প্রায় দেড়টা বাজে। ল্যাপটপটা নিয়ে উনি বেরিয়ে আসতেই যাচ্ছিলেন তখন বলে উঠলাম

“দেড়টা বেজে গেছে। এতো রাতে কাজ করবেন? সারাদিন তো আঙ্কেলকে সময় দেন, তারপর শুনেছি অফিসেও যান। আপনার ঠিকমতো বিশ্রাম করা দরকার”

“আপনাকে কি বাবা এসব বলতে বলেছে আমায়?”

“না তো, হঠাৎ এই কথা কেনো?”

“আসলে আপনার বচনভঙ্গিতে চেঞ্জেস নোটিস করছি, গতকাল আপনার টোন আলাদা ছিলো আর আজ আলাদা। সো এই থট বাবা মে বি আপনাকে বলেছে কিছু তাই আপনি কনসার্ন দেখাচ্ছেন”

ভ্রু কুঁচকে ফেললাম আমি

“কারো শেখানো বুলি নয় এগুলো, নিজে থেকেই বলছি। মনে হলো বলা দরকার তাই বললাম”

“বাবা অসুস্থ হবার পর থেকে এভাবেই সব ম্যানেজ করছি। অভ্যাস আছে আমার, আপনি নিশ্চিন্তে শুয়ে পড়ুন। আর ডিস্টার্ব করতে আসবো না”

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে