মধ্যরাতের বৃষ্টি পর্ব – ৬ (শেষ পর্ব)

0
1384

#গল্পপোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_জানুয়ারি_২০২২

গল্প- মধ্যরাতের বৃষ্টি
লেখক – নাইমুল হাসান নিলয়
শেষ পর্ব

আজ কেন জানি সারারাত বাবার সাথে কথা বলে পার করে দিতে ইচ্ছে করছে। কথা যখন শেষ হয়ে যাবে তখন বাবাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে থাকবো ঠিক ছোট বেলার মত৷ এরপর বাবা আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আমাকে শিক্ষনীয় একটা গল্প শুনাবে। আমি গল্প শুনতে শুনতেই ঘুমিয়ে পড়বো।

বাবার কাছে যাওয়ার আগেই দেখি বাবা আমার রুমের দরজায় এসে দাঁড়ালো৷

– কিরে আসবো?
– আমার রুমে ঢুকতে কি তোমার অনুমতি লাগবে?
– অবশ্যই লাগবে। শুন, একটা বয়সের পর সবারই ব্যক্তিগত একটা স্পেস থাকা প্রয়োজন।
– আচ্ছা আসো।

বাবা হাতে করে তার বালিশ নিয়ে এসেছে। বালিশ রাখতে রাখতে বললো,

– আজ তোর সাথে ঘুমাবো। কেন জানি একা ঘুমাতে ইচ্ছে করছে না।
– ঠিক আছে। তবে নাক ডাকতে পারবে না। নাক ডাকলে আমি তোমার নাক সেলাই করে দিব।
– হাহাহা ঠিক আছে ডাকবো না।
– চুল টেনে দিব তোমার?
– অবশ্যই দিবি। এটা জিজ্ঞেস করার কি আছে?
– বাবা তোমার মনে আছে ছোট বেলায় আমি তোমার চুল টেনে দিতাম। বিনিময়ে তুমি আমাকে বেড়াতে নিয়ে যেতে। এরপর আবার পাকা চুল উঠিয়ে দিলে প্রতি চুলে এক টাকা করে দিতে।
– মনে থাকবে না কেন? আর ছোট বেলা মানে কি? তুই কি এখন বড় হয়ে গেছিস?
– অবশ্যই বড় হয়েছি। একটু আগে তুমি নিজেই তো বললা আমি বড় হয়েছি। আমারও এখন স্পেস দরকার।
– বলেছিলাম নাকি? কিন্তু কথা হচ্ছে এখন তুই আমার পাকা চুল উঠাতে গেলে তো লাখপতি হয়ে যাবি। আর আমি হয়ে যাবো ফকির হাহাহা।
– আচ্ছা বাবা একটা একটা সত্যি কথা বলবে?
– হ্যাঁ বলবো?

কথা বলার আগেই হুট করে বিদ্যুৎ চলে গেল। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বৃষ্টি হবে। আমরা বাপ ছেলে মিলে সদর দরজার চৌকাঠে এসে দাঁড়ালাম। আকাশে চাঁদ আজ তার সম্পূর্ণ রুপ নিয়ে ঠাঁই হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভরা পূর্ণিমায় আমি কখনো বৃষ্টি দেখিনি। ছোট বেলায় বাবার সাথে বৃষ্টিতে ভেজার পর এমন কত বৃষ্টির রাত চলে গেল কিন্তু আমাদের আর একসাথে ভেজা হলো না। বলতে না বলতেই বৃষ্টি শুরু হলো। বাবা শব্দহীন ভাবে পা টিপে টিপে উঠোনে গেল। যেন মা’কে লুকিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে যাচ্ছে। উঠোনের মাঝখানে গিয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কি যেন বললো। আমিও বাবার সাথে গিয়ে যোগ হলাম উঠোনে। আমরা দু’জন চুপচাপ দাঁড়িয়ে বৃষ্টির অঝোর কান্না দেখছি। বাবা হঠাৎ বসে পড়লো৷ আমিও বাবার সাথে সাথে বসলাম। বৃষ্টি তার কান্না আস্তে আস্তে কমাচ্ছে। বাবা বললো,

– এসব বৃষ্টির রাত মানুষ একজীবনে খুব কম পায়৷ সারাজীবন ধরে এমন একটা রাতের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এই সময়টায় তোর মা পাশে থাকলে মন্দ হতো না।
– এই রাতটা এত স্পেশাল কেন?
– জোছনার আলোয় বৃষ্টি খুব কম হয়। বিধাতার সব থেকে সুন্দর সৃষ্টি হচ্ছে ” জোছনা আর বৃষ্টি ” তাই বিধাতা এই সৃষ্টিকে খুব কম একসাথ করে। কারণ বিধাতার এত সুন্দর সৃষ্টি মানুষ হজম করতে পারবে না।
– বাবা?
– বল?
– মা’কে তুমি মিস করো?
– প্রতিনিয়তই করি।
– মা’কে ছাড়া শূন্য শূন্য লাগে না?
– একটা মানুষের প্রস্থানে তার ওই শূন্যস্থান পূরণ হয় না কখনো। কিন্তু আমাদের শূন্যস্থানের ওই লাইনটা অসমাপ্ত রেখে পরের লাইন শুরু করতে হয়।

আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরে চোখে কোণে চলে আসা অনাকাঙ্ক্ষিত জল গুলোকে বৃষ্টির জলে বিসর্জন করলাম। প্রায় অনেকক্ষণ আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরে রাখলাম। বাবা কোন কথা বলছে না৷ আস্তে আস্তে বাবাকে বুক থেকে সরিয়ে দেখলাম আমার বাবা আর নেই। বাবা তার জীবনের ইতি টানলো আমার বুকে। আমি বাবাকে আমার কোলে শোয়ালাম। বাবার মুখ হাসি হাসি কিন্তু চোখে জল। হয়ত সারাজীবনের অপেক্ষার অবসান ঘটার আনন্দে বাবা কেঁদেছিল। হয়ত শূন্যস্থান পূরণ হয়ে যাওয়ার খবর পেয়ে বাবা খুশীতে হেসেছিল।

বাবা মা’য়ের রেখে যাওয়া লক্ষ কোটি স্মৃতি আমাকে এই ঘরে থাকতে দিচ্ছিলো না। তাই লক্ষ কোটি স্মৃতি থেকে বাঁচতে শহরে চলে গেলাম। কিন্তু স্মৃতি আর পিছু ছাড়লো কই?

আমি ফুরিয়ে যাচ্ছি। নির্বোধের মত দেখে যাচ্ছি আমার চোখে আমারই সর্বনাশ। তাই এখন আর তাড়া নেই কিছুতে। কাল তুষার বলেছিলো ” যত যা-ই হোক ভেঙ্গে পড়বি না ” আমিও তুষারের হ্যাঁ তে হ্যাঁ মিলিয়ে বলেছিলাম, ঠিক বন্ধু! কিন্তু সেই আমিই আজ নুইয়ে পড়ে গেলাম। মাত্র ক’টা দিনের ব্যবধানে আমি নুইয়ে পড়ে গেলাম। পায়ের তলায় মাটি নেই, যেটুকু ছিল সেটুকুতে পানি দেয়ার মানুষটাও আর নেই। আমাকে কেউ এখন আর শুনে না, আমার সাথে গল্পও কেউ করে না। আমার এখন আর কোনো মুগ্ধ শ্রোতাও নেই। ধরণীর নিষ্ঠুরতায় ক্লান্ত আমিকে পথ দেখাবার মানুষ হয়ত আছে কিন্তু হাতের ইশারায় ক’জনই বা ভালো মত পথটা চিনতে পারে?

মাঝে মাঝে আমি একা একাই রাস্তায় হাঁটি। চোখের সামনে যখন বড় বড় দালান গুলো পড়ে তখন ব্যস্ত হয়ে পড়ি সেই দালান গুলোর তালা গুনতে। গুনা শেষ হওয়ার পর মনের মধ্যে একধরনের শান্তি অনুভব হয়। আমি অল্পতেই খুশী হই। আমি খুব বেখেয়ালি ধরনের মানুষ। রাস্তায় যখন হাঁটি তখন ঠিকঠাক ভাবে রাস্তা মনে রাখতে পারি না। কারণ মনের মধ্যে এখনো একটা বিশ্বাস পুষে রাখি। রাস্তা হারালে বাবা তো আছে। কিন্তু পরোক্ষণেই আবার সেই বৃষ্টির রাতের কথা মনে পড়ে। তারপর আসে পাশে কি হচ্ছে না হচ্ছে কিছুই আর খেয়াল করতে পারি না। এক বন্ধুর সাথে সেদিন হাঁটতে হাঁটতে একটা ডাস্টবিনের সামনে এসে থমকে গেলাম। একটা লাশ উলটে পড়ে আছে। আমি লাশটার মুখ দেখতে গিয়ে থমকে গেলাম৷ লাশটা আমারই৷ আমি বন্ধুকে আমার মরদেহ দেখিয়ে বললাম, ” তবে কি আমি ফুরিয়ে যাচ্ছি? ” আমার বন্ধু তার গোটা গাল জুড়ে রহস্যময় হাসি এনে বললো, ” আমরা সবাই ফুরিয়ে যাচ্ছি এবং একদিন ফুরিয়ে যাবো কিন্তু মজার ব্যাপার হলো এটা আমরা সবাই জানি কিন্তু কেউ মানি না ”

সমাপ্তি ❤️

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে