মেঘে ঢাকা জোৎস্না পর্ব – ১

0
1245

#মেঘে ঢাকা জোৎস্না
লেখক – সিরাজুম মনিরা
পর্ব – ০১

একটা মানুষ যে কিনা আমার হৃদয় আঙ্গিনায় সব টুকু জুড়ে। আমার পুরো পৃথিবী যেন সে। সে আমার প্রথম ও শেষ অস্তিত্বের প্রান্ত বিন্দু। সে আমার পুরোটা জুড়ে। সে হলেন, আমার বর।

আজ সন্ধ্যায় উনি জানিয়েছেন যে, সে আজ বাড়ি ফিরবে না। কারন আজ তার বিয়ে, মানে দিত্বীয় বিয়ে। নাহ, ঠিক আমাকে ফোন করে বলেননি। ফোন করে শাশুড়ী মাকে চাইলেন। মাকে ফোনটা দেবার পর, শাশুড়ী মা কিছুক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে চোখ বড় বড় করে বললেন, অপু আজ রাতে বাড়ি ফিরবে না। সে কিছু সময় আগে বিয়ে করেছে।

শাশুড়ী মা কি খুশি হয়েছেন, নাকি অবাক কিংবা রাগ কিছুই বোঝার চেষ্টা করিনি। আমি কেবল খেয়ে উঠেছি। মা খাচ্ছেন। বাবা টেলিভিশন দেখছেন। উনার চোখে কেমন যেন স্তব্ধতা! আমি উনাকে অনুভব করতে পারি, কখনও সখনও।

নিজের রুমে এসে বেলকুনির দোলনাটায় বসলাম। নিজেকে ঠিক অনুভব করতে পারছি না। আমি কি বারান্দায় এসেছি নাকি স্বপ্ন দেখছি! জানিনা, তবে আকাশে খুব সুন্দর চাঁদ উঠেছে। চৈত্রের এই দিন গুলো কেমন যেন রুক্ষ হয়। আমি প্রচুর ঘামছি, গলা শুকিয়ে আসছে। খুব মন কেমন করা কষ্ট হচ্ছে বুকের ভেতর। আমি সহজে কাঁদতে পারি না। কান্নাটা ঠিক আমার আসে না।

আমার পাশে বাসার কাজে সাহায্যকারী মেয়েটা দাড়িয়ে কাঁদছে। ওর নাম রাবেয়া। আমার মেয়ের জন্মের পর থেকে ও আছে আমার কাছে। আমার মেয়েটা মারা যাবার পরে রাবেয়াকে চলে যেতে বলেছিলাম। মেয়েটা যায়নি। ওর যাবার কোন জায়গা নেই, এমনটা নয়। আসলে আমার মায়ায় যেতে পারেনি।

শায়লা ফোন করেছে, শায়লা আমার কলিগ। শায়লার বর অপুর খুব কাছের বন্ধু। ফোনটা ধরতে মোটেও ইচ্ছা করছে না। মেসেঞ্জারে ভয়েস রেকর্ড পাঠিয়েছে। সেটা শুনলাম, ওর কন্ঠ জড়ানো। কান্না জড়ানো কন্ঠে বলছে, অপু ভাই ফেসবুকে স্টাটাস দিয়েছে যে সে নাকি নতুন জীবন শুরু করেছে। ছবিও পেস্ট করেছে।

আমি শুনলাম, ফোনটা বন্ধ করে বসে রইলাম। রাত বাড়লে দিনের তপ্ত দাবদাহ কমে যায়। আজও তার বিপরীত হয়নি। দোলনায় বসে আকাশের চাঁদের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ঝিরঝির মিষ্টি বাতাস বইছে, ঠিক ঐ সেই আগের দিন গুলোর মতো।

আমার আমিকে চেনার মতো ক্ষমতা যেন নেই আমার। সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। ঝড় হচ্ছে, কাল বৈশাখি ঝড়। কোথায় হচ্ছে জানিনা। ঝড়ের তান্ডব আমি অনুভব করতে পারছি, কিন্তু দেখতো পাচ্ছি না। আমার পৃথিবীর সবকিছু বহু আগেই শেষ, আজ শুধু আনুষ্ঠানিকতা হলো।

বারবার মনে হচ্ছে এই তুমি কি সেই তুমি, যে আমাকে পাবার জন্যে আকাশ জমিন এক করেছিলে। দিয়েছিলে অসংখ্য পরীক্ষা। আমার অবাস্তব সকল শর্ত তোমার জন্যে ছিল অবশ্যই পালনীয়! আমি ছিলাম তোমার স্বপ্ন। যাকে বিয়ের পর আদর করে ডাকতে “সখের বৌ”বলে। লুকিয়ে নয় সবার সামনে বলতে, “সখের বৌ”। লজ্জায় লাল হলেও যে আমারও তা অসম্ভব ভালো লাগতো! তোমার বাড়ি ফেরার পথের দিকে চেয়ে বসে থাকতাম কতোক্ষন। আমার পথ চাওয়ার যেনো আজ শেষ হলো বুঝি।

চোখের সামনে যেনো কতো কিছু দেখতে পাচ্ছি। সেই সোনালী দিন গুলো। যখন সবে মাত্র এইচ,এস,সি এর গন্ডি পার করে আমি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি। মফস্বলের মেয়ে আমি। শহরে খুব কম এসেছি এর আগে। ইউনিভার্সিটি জীবনের শুরুটা ছিল কেমন ঘোর লাগা ভালোলাগার এবং কিছুটা ভয়ের। কারন বড় আপুদের কাছে অনেক গল্প শুনে বুঝে গেছি যে ইউনিভার্সিটিতে যেমন ভালো মানুষ থাকে, ঠিক তেমন খারাপ মানুষেরও অভাব নেই। তাই নিজেকে একটু গুটিয়ে নিয়ে চলতে শুরু করেছিলাম।

শহুরে জীবন, নতুন পরিবেশ, নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচয় সব মিলিয়ে ঠিক গোলকধাঁধার মতো লাগতো। ক্লাসে প্রথম দিকে পড়া ধরতে সমস্যা হলেও কিছু দিনের মধ্যে তা আতত্বস্ত করে ফেলেছিলাম। জীবনে কতো স্বপ্ন দেখেছি ছোট বেলায়। কখনও ভাবতাম ডাক্তার হবো, কখনও উকিল আবার কখনও টিচার। শেষ মেষ ইউনিভার্সিটিতে বোটানিতে চান্স পেলাম।

গ্রামে যে সমস্যা ছিল, সেই সমস্যা এখানেও শুরু হলো। ছেলেরা আমায় উত্ত্যক্ত করতো, যা গ্রামেও ছিল এখানেও শুরু হয়ে গেছে। আমি দিন দিন যেন পরিনত হতে শুরু করেছিলাম। আগে অনেক কিছু ভয় পেলেও, দিন গড়ালে সাহস বাড়তে শুরু করেছিল। বন্ধু মহলে বেশ পরিচিতি ছিল পড়া লেখা ভালো করার সুবাদে। আর চেহারা ভালো হবার কারনে একটু এক্সট্রা খাতির সব জায়গায়তো ছিলই। ততদিনে এসব একটু গা সওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু সমস্যা শুরু হলো আমার রুম মেটের কারনে। আমার রুম মেট আরশীর প্রেম ছিল। ছেলেটা অর্থাৎ রাজিব সে নাকি খুব ভালো বাসতো আরশীকে। আরশীও তেমনটাই ভালোবাসতো রাজিবকে। হঠাৎ আরশীর ভাই কেমন করে যেন সব জেনে ফেলে। ওকে কৌশলে বাড়ি নিয়ে আটকে দেয়। পরে আমাকে রাজিব অনেক করে রিকুয়েস্ট করে যে আমি যেন আরশীর বাসায় ফোন করে বলি যে হঠাৎ এসাইনমেন্ট দিয়েছে। যা কালই সাবমিট করতে হবে। আরশীর ভাই বেশ কিছু সময় আমাকে জেরা করার পর আমার কথা বিশ্বাস করে। আরশীর সাথে উনি দেখা করতে আসতেন, সে সময় উনার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল বিধায় আমাকে বিশ্বাস করে আরশীকে ইউনিভার্সিটি নিয়ে আসেন। কিন্তু আরশী ডিপার্টমেন্টের এক দিকে দিয়ে ঢুকে অন্যদিকে দিয়ে রাজিবের সাথে চলে যায়। যার আমি কিছুই জানতাম না আগে থেকে। তারপর বহু ঘটনা, কিন্তু আরশী আর রাজিব বিয়ে করে ফেলে। এক মাত্র বোন হওয়ায় আরশীর পরিবার থেকে মেনে নেয়। পরে রাজিবের পরিবারও মেনে নেয়। দুজনের পরিবার বেশ প্রভাবশালী হওয়ায় সংসার নিয়ে তাদের আর ভাবতে হয়নি। বরং মহা আনন্দে সংসার ও পড়া শোনা চালিয়ে যায়। আমরাও আড্ডা দেবার জায়গা খুঁজে পাই।

রাজিবের বন্ধু, খুব কাছের বন্ধু অপু। সব সময় ওরা একসাথেই থাকতো। আরশীর বিয়ে, মেনে নেয়া কেমন যেন স্বপ্নের মতো দ্রুত হয়ে যায়। অপুকে সেভাবে আমি খেয়াল না করলেও কিছুদিন পরে বুঝতে পারি উনি আমাকে খুব খেয়াল করেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে