মধ্যরাতের বৃষ্টি পর্ব – ৩

0
638

গল্প – মধ্যরাতের বৃষ্টি
লেখা – নাইমুল হাসান নিলয়
পর্ব- ৩

ছোট বেলা থেকে আমি আমার ব্যক্তিগত দুইটা কৌটা ব্যবহার করি। ব্যক্তিগত ডায়েরির মত। একটা কৌটা অভিযোগের আরেকটা কৌটা সুখের ৷ অভিযোগের কৌটাটা সবসময় আমি মায়ের কাছে জমা রাখতাম। এটা কেনো হলো না, ওটা কেনো হলো, এভাবে কেনো হলো না, ওভাবে কেনো হলো? এসব অভিযোগ আমি মায়ের কাছেই জমা করতাম আর মা আমার সব অভিযোগ হাসিমুখে গ্রহণ করে সমাধান করতো৷ বাবার কাছে থাকতো সুখের কৌটা৷ আমার সকল সুখ, আনন্দ, খুশীর মুহুর্ত আমি বাবার কাছে এসে জমা রাখতাম৷ আমার মনে হয় বাবা আমার সকল সুখের মুহুর্ত গুলো ওই কৌটাতে আজও বন্দি করে রেখেছে। আমার যখনই মন খারাপ হয় তখনই বাবা সেই কৌটা থেকে একটুকরো সুখ এনে আমার পুরো শরীরে মেখে দেয় আর তখন আমার হাজারটা মন খারাপ থাকলেও আমি হাসতে বাধ্য হই। মায়ের মৃত্যুতে সবচেয়ে বেশি ভেঙ্গে পড়ার কথা ছিলো বাবার কিন্তু বাবাকে দেখলাম বটগাছের ন্যায় আমার মাথার উপর ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু কে বলবে এই বটগাছের গোড়াতেই এখন আর মাটি নেই৷ বাবাকে মাঝে মাঝে খুব করে বলতে ইচ্ছে করে৷ ” আমাকে রেখে ছায়ায় তুমি পুড়লে রোদে, আমি দেখেছি একজন ফেরেস্তাকে বাবার রূপে ” কিন্তু কেনো জানি বলতে পারি না৷

বাবাকে খুব কম দেখেছি তার এই দীর্ঘ চাকরি জীবনে ছুটি নিতে৷ হঠাৎ ছুটি নেয়ায় আমি খানিকটা চিন্তায় পড়ে গেলাম। বাবার শরীর খারাপ করেনি তো? বাবাও কি তবে মায়ের প্রস্থানে ভেঙ্গে পড়েছে? আমার চিন্তা দূর করে দিয়ে বাবা আমাকে যে কথাটা বললো সেই কথা শুনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না৷ আমরা সমুদ্র বিলাশে যাচ্ছি। সমুদ্রের নোনাপানি ছুঁতে যাচ্ছি।

– বাবা হঠাৎ সমুদ্র বিলাশ কেনো?
– তোর মায়ের সারাজীবনের ইচ্ছে ছিলো তোকে আর আমাকে নিয়ে সমুদ্র দেখবে। এক সাথে সূর্যের জন্মগ্রহণ আর সূর্যের মৃত্যু দেখবে। তাই তোর আর আমার চোখ তোর মায়ের হয়ে এই সব দেখবে যা যা তোর মা দেখতে চেয়েছিলো।
– বাবা তুমি মায়ের জন্য না আমার জন্য যাচ্ছো। তুমি কি আমার অভিযোগ বাক্সে হাত দিয়েছিলে?
– তুই যে অভিযোগ বাক্সে অভিযোগ লিখিস সেটা কার টাকা দিয়ে কেনা?
– কার আবার তোমার!
– তাহলে তো হলোই। আমার সম্পত্তিতে আমি হাত দিয়েছি এতে তোর কি?
– বাবা আমি না নিষেধ করেছি তুমি কখনো আমার অভিযোগ বাক্সে হাত দিবে না? তোমার জন্য সুখের বাক্স বরাদ্দ করা আছে। এটা শুধু মায়ের জন্য৷
– তোর মা যাওয়ার আগে এই বাক্স আমার কাছে হস্তান্তর করে গেছে সুতরাং এই বাক্সে এখন আমার হক আছে।
– যা ইচ্ছে করো।
– ঠিক আছে। এখন চল সান্সক্রিম কিনতে হবে৷ সমুদ্রের পাড়ে সুন্দরী সুন্দরী নারীরা থাকবে। রোদে যদি চেহারা পুড়ে যায় তাহলে তোর এই চিরতরুণ বাবার দিকে কেউ তাকাবে না।
– সুন্দরী মেয়েরা যদি জানে তুমি আধবুড়ো হয়ে গেছে তাহলে কেউ তোমার পাশেও ঘেঁষবে না।
– ওখানে তাদের বলবে কে আমি আধবুড়ো?
– ওমা আমি আছি কি করতে?
– ছেলে হয়ে বাবার জন্য একটুও মায়া হয় না তোর?
– কেনো হবে না। মায়া হয় দেখেই তো এগুলো বলছি। আর তাছাড়া মা যাওয়ার আগে আমার কাছে তোমাকে হস্তান্তর করে গেছে ঠিক আমার অভিযোগ বাক্সের মত। সুতরাং নো হাংকিপাংকি।
– নো হাংকিপাংকি মানে কি আবার?
– সব কিছুর মানে জানতে হবে না। এখন শপিং-এ চলো।
– ওরে বাবা এখন থেকেই মায়ের ভাব ধরে ফেলেছিস।

বাবার প্রতি আমার কখনো কোনো অভিযোগ ছিলো না। শুধু ছোট বেলা থেকে এই একটাই অভিযোগ ছিলো। একবার বাবাকে তার অফিসের কাজে কক্সবাজার যেতে হয়েছিলো। সেখানে কাজ শেষ করে বাবা সমুদ্র দেখেছিলো। সেই গল্প যখন বাড়ি এসে বাবা করছিলো তখন আমি আমার মনের মধ্যে সমুদ্রের একটা চিত্র এঁকে ফেলি। তখন মা সুস্থ ছিলো। আমাদের সবার একসাথে পরের বছর সমুদ্র বিলাশে যাওয়ার কথাও ছিলো কিন্তু হঠাৎ মায়ের এক্সিডেন্টে সব উলোট পালোট হয়ে যায়। আমি সমুদ্রের কথা ভুলে যাই। এরপর হঠাৎ একদিন আবার সমুদ্রের কথা মনে পড়ে যায় আমার। আমার অভিযোগ বাক্সে প্রতিবছর একটা অভিযোগ থাকতোই। ” বাবা এখনো সমুদ্র দেখায়নি মা। বাবা কবে সমুদ্র দেখাবে বলো তো ” বাবা হয়ত এই অভিযোগের ভার আর বহন করতে পারছে না।

আমি ঠিক করেছি আমার প্রথম সমুদ্র বিলাশে আমি আমার মত করে একটা ডায়েরিতে আমার সকল অনুভূতি লিখে রাখবো। সাথে আমার অভিযোগ বাক্সটা নিয়ে যাবো। প্রবল জোছনায় যখন পুরো সমুদ্রপাড় আলোকিত হবে তখন সেই অভিযোগ বাক্স নিয়ে আমি সমুদ্রপাড়ে যাবো। এরপর যখন ঢেউ গুলো বেশ তেজ হয়ে যাবে তখন আমি আমার অভিযোগ বাক্সটা সেই তেজ ঢেউ-এ বিলীন করে দিবো আর বলবো ” বাবা তুমি আর কোনো অভিযোগে নেই। কখনো থাকবেও না। তোমাকে আমি ভালোবাসি বাবা। ঠিক যেমন সমুদ্র ভালোবাসে তার ঢেউকে। ”

বাপ বেটা মিলে শপিং করতে গেলাম শহরে। সব কিছুই ঠিকঠাক মত কেনা হলো। বাবা আর আমার মধ্যে কিছু চুক্তি স্বাক্ষর হলো। বাবা তার নিজের ব্যাগ বহন করবে আর আমি আমার ব্যাগ৷ আমি হোটেলের রুম কোনো ভাবে ময়লা করতে পারবো না। রাতে বাবা নাক ডাকতে পারবে না৷ আমি সমুদ্রের বেশি দূরে যেতে পারবো না আরও নানান চুক্তি। বাবা আর আমি চুক্তি পত্রে সই করলাম৷ দু’টো ফটোকপি করে দুইজনের ব্যাগে দুইটা রেখে দিলাম এবং অবশেষে আমাদের সমুদ্র বিলাশের যাত্রা শুরু হলো।

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে