বিষাক্তফুলের আসক্তি পর্ব-২১+২২

0
823

#বিষাক্তফুলের আসক্তি
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্ব-২১+২২

ঝুম বৃষ্টিতে অন্ধকার রাত আরো নিকষকালো অন্ধকারে রুপ নিয়েছে। শীতকালের বৃষ্টি কারোই পছন্দ হওয়ার কথা নয়, তবে মৌয়ের ভালোই লাগছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি উপভোগ করছে সে, বাতাসের ঝাঁপটায় বৃষ্টির ছিটেফোঁটা গায়ে এসে লাগছে। পাতলা ফিনফিনে শাড়ি ভেদ করে ঢোকা ঠান্ডা বাতাসে শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। এতেও মন্দ লাগছে না। মৌ ঘুরে তাকালো রুমের দিকে। দুই বছরের ছোট্ট মেয়ে শায়িনীকে বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে শান। মৌ ভালো আছে, তার সংসার আজ পরিপূর্ণ তবু কোথাও রয়ে গেছে চাপা দীর্ঘ শ্বাস। সবার সামনের সুখী দাম্পত্য জীবনের আড়ালের এই দীর্ঘ শ্বাস কেউ দেখে না, শানও নয়। শান নিসন্দেহে একজন ভালো মানুষ, ভালো স্বামী আর ভালো বাবাও। মৌকে কখনো তার অতীত মনে করিয়ে দেয়নি বরং চেষ্টা করেছে তার ভালোবাসায় সব ভুলিয়ে দিতে। দিন শেষে মৌ মানিয়ে নিয়েছে নিয়তির সাথে। তার জীবনে তাজ নয় শানই ছিলো। তবে মাঝে তাজের আসাটা কী খুব জরুরি ছিলো ? ভাগ্য যখন শানের সাথেই জুড়ে ছিলো তাহলে তাজের জন্য মায়া কেনো তৈরি হলো মনে ? তাজের প্রতি তার ভালোবাসা কোনো আবেগ ছিলো না, সেটার প্রমাণ আজও একান্তে মৌয়ের মনে তাজের বিচরণ। মৌ জানে এটা পাপ, অন্যায় কিন্তু মন ? সেটা যে অবুঝ পাখি, খাঁচায় বন্দী রাখলেও ডানা ঝাঁপটে যন্ত্রণা দেয় আর মুক্ত করে দিলে উড়ে গিয়ে বসে নিষিদ্ধ গাছের ডালে। একান্ত সময়গুলো বড্ড যন্ত্রণায় কাটে মৌয়ের, জীবনের পূর্ণতার খাতায় একটা শূন্য অংশ সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে তাকে।

মৌ কালো মেঘে ঢাকা অন্ধকার আকাশের দিকে তাকালো, হে খোদা যার জন্য যাকে বানাও নাই তার জন্য মায়া কেনো দাও ? কেনো নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের এতো আকর্ষণ। আমি তো চাই আমার স্বামীকে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতে। কিন্তু কোথায় যেনো তবু ফাঁকা থেকে যায়।

মৌ অনুভব করলো তার চোখ ভিজে উঠেছে। আজকের চোখের জল তাজকে না পাওয়ার নয়, তাজকে ভুলে শানকে পুরোপুরি ভালোবাসতে না পারার ব্যর্থতার। যে ব্যর্থতা কিছুতেই চায় না মৌ। এখন সে চায় তার মনে কেবল শানের রাজত্ব চলুক, শুধুমাত্র শানের। গায়ে কিছু মেলে দেওয়ায় শীত অনুভব না হলে মৌ নিজের দিকে তাকালো। একটা শাল জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তার গায়ে। মুহূর্তে একজোড়া হাত পেছন থেকে জড়িয়ে নিলো তাকে।

এই শীতের মধ্যে এখানে দাঁড়িয়ে কী করছো ?

বৃষ্টি বিলাশ করছিলাম।

চমকে উঠলো শান, তোমার গলা এমন শুনাচ্ছে কেনো মৌ ?

শান মৌকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে মুখটা উঁচু করে ধরলো। মৌয়ের চোখ ভেজা দেখে বুক ধক করে উঠলো শানের। এই চোখের পানি সহ্য হয় না তার।

ব্যস্ত গলায় বললো, কী হয়েছে বউ তুমি কাঁদছো কেনো ?

মৌ কিছু না বলে শানকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো, আমি অনেক খারাপ তাই না ?

শান মুচকি হেসে নিজের বুকে জড়িয়ে নিলো মৌকে, কে বলেছে আমার বউ খারাপ কার এতবড় সাহস ?

মজা করবেন না শান।

আচ্ছা বাবা মজা করবো না। এখন বলো কী হয়েছে কাঁদছো কেনো ?

আপনি আমাকে এতো কেনো ভালোবাসেন ? আমি তো কত অপমান করেছি আপনাকে, কত অবহেলা করেছি, কষ্ট দিয়েছি।

নিজের প্রাণকে ভালো না বেছে থাকা যায় বলো ? আমি জীবনে কোনোদিন প্রেম করিনি, আমার সব ভালোবাসা আমার বউয়ের জন্য জমিয়ে রেখেছিলাম। এতো বছর ধরে যার জন্য ভালোবাসা জমিয়ে রেখেছি, তাকে ভালো না বাসলে কাকে ভালোবাসবো ?

কান্নার বেগ বাড়লো মৌয়ের, আমি যে আমার অতীত ভুলতে পারি না তবু।

দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো শান, অতীত ভুলা যায় না মৌ। প্রথম ভালোবাসা তো আরো ভুলা যায় না। কিন্তু অতীত আঁকড়ে কষ্ট পাওয়া বোকামি। আমাদের উচিত অতীতটাকে মনের এক কোণে সযত্নে লুকিয়ে রেখে বর্তমানটা উপভোগ করা। অতীত তুমি যত ভুলতে চাইবে তত বেশি মনে পড়বে। তাই সেটা ভুলতে চেষ্টা না করে বরং বর্তমানকে ভালোবাসার চেষ্টা করো মৌ।

মৌ শানকে শক্ত করে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলো শান সেভাবে কিছু সময় থেকে বললো, রুমে চলো এখানে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে শেষে মেয়েও কষ্ট করবে।

আর একটু থাকি না।

শান আর কিছু বললো না। মৌকে ভালো করে জড়িয়ে নিলো শাল দিয়ে। সেভাবেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলো দু’জন।

২৬.
প্রতি বছর এই দিনে সবাইকে নিয়ে বাংলাদেশে আসে আহান। সাতদিন এখানে থেকে ফিরে যায় নিজেদের ব্যস্ততম জীবনে। বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখে একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো আহান। এই দেশের মাটিতে মিশে আছে তার আপনজন। ধ্রুব আর পাখি খুশীতে লাফাচ্ছে। ন্যান্সি তাদের দিকে তাকিয়ে আছে মলিন মুখে। দু’টোই যে অবুঝ তারা কী জানে এখানে এসেছে আনন্দ করতে নয়। হায় কপাল যদি বুঝতে পারতো।

সবাইকে নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো আহান। এখানে আসলে তার কষ্ট হয়, পুরানো ক্ষত তাজা হয়ে উঠে।

ধ্রুব আহানের দিকে তাকিয়ে বললো, পাপা আমরা কোথায় যাচ্ছি ?

এ নিয়ে একই প্রশ্ন অনেকবার করেছে ধ্রুব কিন্তু নিরব ভূমিকা পালন করেছে আহান। আজ তার কারো সাথেই কথা বলতে ভালো লাগছে না। আহান ধ্রুবকে নিয়ে ড্রাইভারের পাশের সীটে বসেছে আর পাখি, ন্যান্সি পিছনে।

আহান ধ্রুবকে বুকে জড়িয়ে বললো, তোমার মায়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি।

ধ্রুব গোল গোল চোখে তাকালো আহানের দিকে। তার কথার মানে বুঝতে পারেনি যে।

বেশ অনেকটা জার্নি করার পর কাংখিত জায়গায় পৌঁছে গেলো সবাই। ধ্রুব ঘুমিয়ে পড়েছে আহানের বুকে। তাকে কোলে নিয়ে গাড়ি থেকে নামলো আহান। পাখিও নেমে গেছে, আশপাশটা দেখছে সে। আহানকে দেখে দৌড়ে এগিয়ে এলো এক ভদ্রলোক।

স্যার আসতে কোন অসুবিধা হয়নি তো ?

আহান শান্ত গলায় বললো, নাহ। এদিকে সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে ?

জী স্যার সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে।

আহান তাকালো বাড়ির দিকে। এখন আর বাড়িটাকে কেউ ভূতের বাড়ি বলতে পারবে না। রঙচটা বাড়ি চকচক করছে নতুন রঙে, বাড়ির আঙিনা জঙ্গলের পরিবর্তে নানা প্রজাতির ফুলে রঙিন হয়ে উঠেছে। আহান তো আর তার তুতুলকে যেখানে রেখেছে সেখানকার প্রতি উদাসীন থাকতে পারে না। আহান কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা কবরের দিকে পা বাড়ালো।

ন্যান্সির উদ্দেশ্যে বললো, পুতুলকে নিয়ে ভেতরে যাও মাম আমরা আসছি।

ন্যান্সি পাখিকে নিয়ে ভেতরে চলে গেলো। এতটা জার্নি করে পাখিও ক্লান্ত তাই সে আর কোনদিকে না তাকিয়ে ন্যান্সির সাথে চলে গেলো। আহান দিয়ে দাঁড়ালো কবরের সামনে, তার কোলে ঘুমন্ত ধ্রুব। বুকল ফুল পড়ে বিছিয়ে আছে কবরের উপর, বকুল ফুলের মিষ্টি সুবাস নাকে লাগছে।

কেমন আছিস তুতুল ? হয়তো ভালোই আছিস, ভালো থাকার জন্যই তো এভাবে চলে গেলি। আমি কিন্তু ভালো আছি, নিজের কথা রেখেছি। এই দেখ তোর ছেলে, কত বড় হয়ে গেছে। দু-হাতে আগলে বড় করছি, কখনো বাবা-মায়ের অভার বুঝতে দেয়নি আর কোনদিন দেবো না। আমি কিন্তু ধ্রুবর জীবন থেকে তোর পরিচয় মুছে দেয়নি। সবার সামনে ধ্রুব আমার ছেলে হলেও খাতা কলমে তোর ছেলে হয়েই আছে। মাম্মাম-পাপা হিসাবে আমাকে আর পাখিকে জানলেও বাবা-মা হিসাবে তোকে আর মিস্টার খানকে জানে। আহান চৌধুরীর ছেলে নয় বরং তাজওয়ার খান তাজ আর মুসকান মাহমুদ তিতিরের ছেলে তাহিয়ান খান ধ্রুব। আমি তোদের পরিচয়েই বড় করছি ওকে। কিন্তু একটা ভুল করে ফেলেছি রে। ভুলতে বসেছি ধ্রুব আমার কাছে আমানত, ওকে ফিরিয়ে দিতে হবে। ফিরিয়ে দিতে খুব কষ্ট হবে রে তিতির কিন্তু তুই চিন্তা করিস না। আমি আমার এই কথাও রাখবো যত কষ্টই হোক মিস্টার খান চাইলে দিয়ে দিবো তাকে তার ছেলে।

আহানের চোখের পানি ধ্রুবর ঘাড়ে পড়লে ঘুম ভাঙলো ধ্রুবর।

মুখ তুলে আহানের দিকে তাকিয়ে ছোট ছোট হাতে তার চোখ মুছে দেওয়ার চেষ্টা করে বললো, তোমার কী হয়েছে পাপা, তুমি কাঁদছো কেনো ?

ধ্রুবর কাজে চমকে উঠলো আহান। দ্রুত নিজের চোখ মুছে নিলো।

ধ্রুবর গালে কিস করে বললো, আমার কিছু হয়নি বাবাই। তোমার ঘুম ভেঙে গেছে পাপা সরি।

ধ্রুব আশেপাশে তাকালো, আমরা এখানে কী করছি পাপা ?

আহান ধ্রুবকে তিতিরের কবর দেখিয়ে বললো, তোমার মায়ের সাথে কথা বলতে এসেছি।

ধ্রুব কবরের দিকে একবার তাকিয়ে আহানের দিকে তাকালো, এখানে তো কেউ নেই পাপা।

আছে তো বাবাই, এখানে ঘুমিয়ে আছে তোমার মা। ঐ যে তোমাকে ছবিতে মা দেখালাম।

ধ্রুব কবরের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট গলায় বললো, মা।

বুক কেঁপে উঠলো আহানের। ধ্রুব কোন বাংলা স্পষ্ট বলতে পারে না। কিন্তু মা শব্দটা এতোটাই স্পষ্ট উচ্চারণ করলো আহানের বুক কেঁপে উঠলো শুনে।

আহান কাঁপা গলায় বললো, আবার বলো তো বাবাই, মা।

ধ্রুব আবারও বললো, মা উঠে না কেনো ? মায়ের ঘুম কখন ভাঙবে পাপা।

ধ্রুবকে বুকে জড়িয়ে চোখের পানি ছেড়ে দিলো আহান, মায়ের ঘুম আর কোনদিন ভাঙবে না বাবাই। নিজের জীবনের বিনিময়ে তোমার জীবন পেয়েছে তোমার মা, কখনো এই জীবন নষ্ট করো না বাবাই।

আহানের বড় বড় কথার মানে ধ্রুব বুঝতে পারলো না। তবে আহানের বুকের সাথে মিশে তাকিয়ে রইলো কবরের দিকে।

আহান মনে মনে বললো, ছেলের ডাকও কী শুনতে পাস না তুতুল ?

সিলেট বাংলাদেশের অন্যতম এক পর্যটন এলাকা। এখানেই একটা রিসোর্ট বানানোর পরিকল্পনা নিয়ে এসেছে তাজ। জায়গা দেখে তার মালিকের সাথে কথা বলে সব ঠিকঠাক করার জন্যই সিলেট আসা। তাছাড়া যান্ত্রিক জীবনের বাইরেও একটু সময় কাটানো হয়ে যাবে। মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে উঠে তাজ। মনে হয় ঘড়ির মতো একই নিয়মে চক্রাকারে ঘুরে চলেছে সে। এজন্যই বিজনেসটা সে প্রফেশন হিসাবে নিতে চায়নি প্রথম থেকে। দেশ বিদেশ ঘুরে শুটিং করে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করার জন্যই সব ফেলে সেটাকে প্রফেশন হিসাবে নিয়েছিল। কিন্তু সেটাই জীবনের কাল হয়ে দাঁড়ালো তাজের।

দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে প্রকৃতি দেখায় মনোযোগ দিলো তাজ। ঢাকা শহরের দালানকোঠা আর ব্যস্ততম মানুষের ছুটে চলা দেখে দেখে চোখ দু’টোও ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।

স্যার আগে হোটেলে যাবেন নাকি জমি দেখতে ?

তাজ দৃষ্টি বাইরে রেখেই বললো, আগে হোটেলে চলো। ফ্রেশ হয়ে বিকেলে প্রোপার্টির মালিকের সাথেই যাবো।

ঠিক আছে স্যার।

হোটেলে গিয়ে আগে ফ্রেশ হয়ে নিলো তাজ। দুপুরের লাঞ্চের সময় হয়েছে তাই ফোন করে খাবার রুমে দিয়ে যেতে বললো। খাবার খেয়ে লম্বা একটা ঘুম দেবে ভেবে নিলো।

ভেজা চুল মুছতে মুছতে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। ঢাকা আর সিলেট শহরের তফাৎ অনেক, ঢাকায় বড় বড় দালানকোঠার দেখা মিললেও গাছের দেখা মেলা দুষ্কর। কিন্তু সিলেট শহরে দালানকোঠার সাথে আছে সবুজ গাছের সতেজতা। গত পাঁচ বছরে রায়হানের সাথে অনেকবার দেখা করেছে তাজ শুধুমাত্র তিতিরের ঠিকানা জানার জন্য। রায়হান প্রতিবার একটু একটু করে বলেছে তাজকে, কখনো সম্পূর্ণ বলে না। হয়তো তাজকে এভাবে তড়পাতে দেখতে ভালো লাগে রায়হানের। রায়হান বলেছে তিতির সিলেটের মেয়ে, তার জন্ম এই সিলেট জেলায়, বাবা-মায়ের সাথে শৈশবও কেটেছে এখানে। কিন্তু বাবা-মা খু*ন হওয়ার পর তিতিরের জীবনটা এক ঝটকায় এলোমেলো হয়ে গেছে। তাজের কাছে এখনো অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে, তিতিরের বাবা-মা খু*ন হয়েছিলো কীভাবে ? রায়হানের বাবা-মা কোথায় ? রায়হানের বাবার শাস্তি কেনো হয়নি এখনো ? রায়হান তো সব বলে দিয়েছে সবার সামনে। তিতির এখন কোথায় আছে আর তিতিরের বাবার বাড়ি সিলেটের কোথায় ? এমন অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর এখনো পাওয়া বাকি তাজের। সিলেট আসলে তাজ নিজের অজান্তে খোঁজে তিতিরকে। যদিও জানে সেটা নেহাৎ বোকামি ছাড়া কিছু নয় কারণ গত পাঁচ বছরে গোটা সিলেট তন্নতন্ন করে খুঁজেছে তিতিরকে। সে যদি এখানে থাকতো তবে পেয়ে যেত তাজ। তাজ এটুকু বুঝতে পেরেছে তিতির আহানের কাছেই আছে কিন্তু আহানের কোনো তথ্য দেয়নি রায়হান। রুমের কলিংবেল বাজলে তাজ বুঝলো খাবার চলে এসেছে।

২৭.
সিলেটের শাহজালাল মাজার চিনে না এমন মানুষ হয়তো সারা বাংলাদেশে খোঁজে পাওয়া যাবে না। মাজারের সামনে যত অসহায় মানুষ আছে সবার হাতে খাবার তুলে দিচ্ছে ছোট্ট ধ্রুব। আহান ধ্রুবকে কোলে নিয়ে তার হাতেই সবাইকে খাবার দিচ্ছে।

আহানের চোখে ভেসে উঠলো আজ থেকে প্রায় ছয় বছর আগের দৃশ্য। তিতির যাওয়ার আগে তার বাবা-মায়ের কবর আর শাহজালালের মাজার দেখে যেতে চেয়েছিলো। আহান দুটো জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলো তিতিরকে।

মাজার থেকে বের হতেই ছোট্ট এক বাচ্চা হাত টেনে ধরলো তিতিরের।

বাচ্চাটা সিলেটের ভাষায় বললো, পেটর মাঝে যে বুক করের।

তিতির হাঁটু গেড়ে বসলো বাচ্চাটার সামনে, নাম কী তোমার ?

বাচ্চাটা কিছু না বলে তাকিয়ে আছে তিতিরের দিকে, যেনো বুঝতে পারেনি তার কথা। তিতির বাচ্চাটাকে আর কিছু না বলে সামনের একটা হোটেলে নিয়ে গেলো। নিজের ইচ্ছে মতো খাবার অর্ডার করে খাইয়ে দিলো। খাওয়া শেষে বাচ্চাটার হাতে কিছু টাকাও দিয়ে দিলো।

বাচ্চাটা হাসিমুখে চলে গেলে তিতির নিজের পেটের উপর হাত রেখে আনমনে বললো, হে আল্লাহ আমার বাচ্চাটাকে তুমি সুস্থভাবে পৃথিবীর আলো দেখাও। আমি তার প্রতি জন্মদিনে এখানকার অসহায় মানুষদের একবেলা পেট ভড়ে খাওয়াবো।

আহান তিতিরের পাশেই ছিলো তাই তিতিরের কথাটা শুনতে অসুবিধা হয়নি তার। তিতির নেই তাই তার কথা রাখতে হলেও আহান ধ্রুবর প্রতি জন্মদিনে তার হাতেই এখানকার অসহায় মানুষদের একবেলা পেট ভরে খাওয়ায়।

ক্লান্ত হয়ে সবাইকে নিয়ে বাড়ি ফিরলো আহান। ফ্রেশ হয়ে সবাই রেস্ট নিচ্ছে, আজ আর কোথাও যাবে না। আগামীকাল সবাইকে নিয়ে বেড়াতে যাবে ঠিক করেছে।

পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট করে সবাইকে নিয়ে ঘুরতে বের হলো আহান। শীতের দিন চারপাশের কুয়াশা এখনো কাটেনি, চা বাগানের মাঝ দিয়ে ধীর গতিতে গাড়ি এগিয়ে চলেছে আহানদের।

ন্যান্সি বললো, এই কুয়াশায় বাইরে গেলে ধ্রুবর ঠান্ডা লাগবে তো আহান।

আহান ধ্রুবকে মাস্ক পড়িয়ে বললো, গরম কাপড় পড়িয়ে নিয়েছি আর মুখেও মাস্ক থাকবে, কিছু হবে না।

পাখি বললো, তুমি সবসময় ধ্রুবকে কোলে নাও। আমিকে নাও না কেনো ?

কেঁশে উঠলো আহান। মেয়েটা হঠাৎ এমন এমন কথা বলে লজ্জায় পড়তে হয় আহানকে।

আহান হালকা ধমক দিয়ে বললো, তুমি কী ধ্রুবর সমান ?

ঠোঁট ফুলালো পাখি যেনো এখনই কেঁদে দিবে, আমি নাহয় ধ্রুবর থেকে একটু লম্বা তাতে কী হয়েছে ?

আহান ধমক দিয়ে বললো, তুমি চুপ করবে পুতুল
?

এবার কেঁদেই দিলো পাখি, আমাকে কেউ আদর করে না। আমি থাকবো না তোমাদের সাথে, আমাকে নামিয়ে দাও আমি থাকবো না।

আহান কপাল কুঁচকে বললো, মহা মুশকিল তো।

পাখি চেঁচামেচি করে বললো, ড্রাইভার আঙ্কেল গাড়ি থামান নাহলে আমি এমনই দরজা খোলে নেমে যাবো।

বিষম খেলো ড্রাইভার রবি। আহানের থেকেও বছর দুয়েকের ছোট হবে সে আর পাখি তাকে আঙ্কেল বলছে।

পাখি দরজা খোলার চেষ্টা করলে আহান বললো, রবি গাড়ি থামাও তো। নাহলে এই পাগল সত্যি সত্যি নেমে যাবে চলন্ত গাড়ি থেকে।

এবার ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে লাগলো পাখি, মাম দেখো আমাকে আবার পাগল বলেছে। আমি কী পাগল ?

ন্যান্সি অসহায় গলায় বললো, কী করছো মাই সান ? এভাবে ওকে ডেস্পারেট করলে সামলানো মুশকিল হবে আমাদেরই।

গাড়ি থামাও রবি।

এক সাইডে গাড়ি থামালো রবি। আহান ধ্রুবকে কোলে নিয়ে নেমে গেলো গাড়ি থেকে। পাখি দরজা খোলার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। আহান এসে দরজা খোলে দিলো আর পাখি নেমে গেলো। আহান ধ্রুবকে গাড়ির ভেতরে ন্যান্সির কোলে দিলো।

ধ্রুব এতক্ষণে বললো, মাম্মাম কাঁদে কেনো গ্রানি ?

ন্যান্সি মুচকি হেসে বললো, মাম্মাম রাগ করেছে।

মাম্মাম কেনো রাগ করেছে ?

তুমি একাই সবসময় পাপার কোলে উঠে বসে থাকো, মাম্মামকে পাপা কোলে নেয় না তাই।

আমি তো বেবি তাই পাপা কোলে নেয়। মাম্মামও কী বেবি ?

ন্যান্সি দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, হুম মাম্মামও বেবি।

আহান ধ্রুবকে গাড়ির ভেতর দিয়ে পাশে তাকিয়ে দেখলো পাখি উল্টো দিকে হাঁটছে। কুয়াশায় মিলিয়ে যেতে চলেছে। আহান দৌড়ে এসে পাখি সামনে দাঁড়ালো।

পাখি ঠোঁট ফুলিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলে আহান বললো, কী সমস্যা ?

পাখি ফুপিয়ে কেঁদে বললো, আমাকে কেউ আদর করে না, আমি থাকবো না।

আহান পাখির দুগাল ধরে নিজের দিকে করে বললো, আমার ছোট্ট বউটা বুঝি রাগ করেছে ?

পাখি মাথা উপর নিচ করে বুঝালো হ্যাঁ সে রাগ করেছে।

আহান পাখির কপালে নিজের অধর ছুঁইয়ে বললো, তুমি না ধ্রুবর মাম্মাম। নিজের ছেলের সাথে হিংসা করলে হবে ?

তুমি সমান সমান আদর করবে তাহলে আমি রাগ করবো না।

আচ্ছা ঠিক আছে, সমান সমান আদর করবো। এখন চলো আমাদের যেতে হবে।

পাখিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তাকে কোলে তুলে নিলো আহান, এবার খুশি ?

পাখি হাত তালি দিয়ে বললো, ইয়ে কী মজা ?

আহান মনে মনে বললো, আর একটু বুঝদার হলে খুব অসুবিধা হত কী ?

গাড়ির কাছাকাছি এসে পা থমকে গেলো আহানের। কুয়াশা ভেদ করে দেখতে পেলো একটা প্রাইভেট কার এলোমেলো হয়ে এদিকে এগিয়ে আসছে। দেখে মনে হচ্ছে আহানের গাড়িতে ধাক্কা মারবে।

আহান চিৎকার করে বলে উঠলো, ধ্রুব।

পাখি ভয়ে আহানের গলা জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে। গাড়িটা আহানের গাড়ি ধাক্কা দিতে গিয়েও একটুর জন্য পাশ কাটিয়ে গিয়ে রাস্তার পাশে গাছে ধাক্কা মারলো। চোখের সামনে এমন দৃশ্য দেখে আহান কিছুটা সময়ের জন্য থমকে গেলো। হুঁশ ফিরতেই পাখিকে কোল থেকে নামিয়ে দৌঁড়ে সেই গাড়ির দিকে গেলো। গাড়ির সামনের অংশ ভেঙে গুড়িয়ে গেছে। স্টিয়ারিং এর উপর মাথা রেখে পরে আছে একজন। আহান গাড়ির ভেতরে দেখলো আর কেউ আছে কিনা, না কেউ নেই। আহান স্টিয়ারিং থেকে মাথা তুলে মুখটা দেখে থমকে গেলো। এটা সে কাকে দেখছে ? কোনোদিন সামনাসামনি না দেখলেও মানুষটাকে চিনতে অসুবিধা হলো না আহানের।

বিড়বিড় করে বললো, মিস্টার খান ?

আহান যে নিজের বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। কী করবে, কী করা উচিত কিছু বুঝে উঠতে পারছে না সে ? তাজের সাথে এখানে এভাবে দেখা হবে কল্পনা করতে পারেনি আহান।

কী হয়েছে আহান ?

গাড়ি থেকে ন্যান্সি, ধ্রুব, রবি সবাই নেমে এসেছে। আহানের হুঁশ ফিরলো তাদের ডাকে। নিজেকে সামলে তাজের হাত ধরে পালস চেক করলো। না বেঁচে আছে এখনো, পালস চলছে।

রবি আমাকে হেল্প করো।

আহান আর রবি অনেক কষ্টে গাড়ি থেকে বের করলো তাজকে। পাখি কেমন অস্থির হয়ে উঠলো এতো রক্ত দেখে।

পাখি মাথা চেপে ধরে বললো, আপুনি আপুনি। আমার আপুনি, রক্ত, আপনি কাঁদে।

আহান যেনো অথৈ সাগরে পড়লো এবার। কাকে সামলাবে সে ? তাজকে দ্রুত হসপিটালে নেওয়া প্রয়োজন, এদিকে পাখি ডেস্পারেট হয়ে উঠেছে আবার। তার মনে পড়ে গেছে তিতিরের কথা। এদিকে তাজের মুখ দেখে স্তব্ধ হয়ে গেছে ন্যান্সি। সেও চিনতে পেরেছে তাজকে। যদিও হুবহু ছবির মতো নেই চেহারা, ছয় বছরে চেঞ্জ হয়েছে। কিন্তু যার ছবি বুকে নিয়ে তিতির রোজ সবার আড়ালে কাঁদতো, নিজের সন্তানের সাথে কথা বলতো যার ছবি দেখিয়ে, তাকে ন্যান্সির চিনতে অসুবিধা হলো না। তাছাড়া আহান তো প্রায় তিতির আর তাজের ছবি দেখায় ধ্রুবকে। ন্যান্সি আহানের দিকে তাকালে আহান অসহায় চোখে তাকালো তার দিকে। ন্যান্সি ধ্রুবকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে রেখেছে। ধ্রুবকে উল্টো দিকে মুখ করিয়ে কোলে নিয়েছে ন্যান্সি। বাচ্চা ছেলে রক্ত দেখে ভয় পাবে ভেবে। ধ্রুব বারবার দেখার চেষ্টা করলেও ন্যান্সি শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছে তাকে।

আহান বললো, রবি অ্যাম্বুলেন্স ডাকার মতো সময় নেই। অ্যাম্বুলেন্স আসতে আসতে অনেক দেরি হয়ে যাবে।

চিন্তা করবেন না স্যার, আমি নিয়ে যাচ্ছি।

আহান ন্যান্সির দিকে তাকিয়ে বললো, মাম আমরা বাড়ি থেকে বেশি দূরে আসিনি। আমি ফোন করে দিচ্ছি বাড়ি থেকে গাড়ি আসলে তুমি ওদের নিয়ে বাড়ি চলে যাও।

আহান তাজকে গাড়ির পেছনের সীটে শুইয়ে দিয়ে মাথায় নিজের রুমাল বেঁধে দিতে দিতে বললো। ন্যান্সি তখনো পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। আহান তাড়াহুড়ো করে সব করার চেষ্টা করছে। রবি ড্রাইভিং সীটে বসে পড়েছে।

আহান দৌড়ে এসে পাখিকে জড়িয়ে ধরে বললো, শান্ত হয়ে যাও আমার পুতুল। তোমার আপুনি ভালো আছে।

আহান কোনদিকে যাবে বুঝতে পারছে না। পাখি নিজের মাথার চুল খামচে ধরে আপুনি আপুনি করে যাচ্ছে। ন্যান্সি ধ্রুবকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ধ্রুবও কেমন ছটফট করছে কী হয়েছে দেখার জন্য। নানা প্রশ্ন করেই যাচ্ছে।

রবি বললো, স্যার লোকটা মরে যাবে এভাবে থাকলে।

আহান চিৎকার করে উঠলো, নাহ উনাকে বাঁচতে হবে। উনার অনেক কিছু জানার বাকি আছে।

আহান পাখিকে ন্যান্সির কাছে এনে দাঁড় করালো, মাম পাঁচটা মিনিট সামলে রাখো এদের।

আহান দৌড়ে গাড়িতে গিয়ে বসে তাজের মাথা নিজের কোলে তুলে নিলো। সাদা রুমাল রক্তে ভিজে উঠেছে। রবি যত দ্রুত পারছে গাড়ি চালাচ্ছে। আহান বাড়িতে ফোন দিয়ে দ্রুত গাড়ি পাঠাতে বললো আর তাজের গাড়িতে ফোন বা অন্যকিছু পাওয়া যায় কিনা দেখতে বললো। তার ফ্যামিলির সাথে যোগাযোগ করার মতো।

আহান তাকালো তাজের মুখের দিকে। ধ্রুব মায়ের অনেকটা পেলেও বাবারও কিছুটা পেয়েছে। আহান সেটা আজ বুঝতে পারলো। তাজের গায়ের সাদা শার্টটা রক্তে ভিজে গেছে। ফোনের আওয়াজ পেয়ে আহান তাজের পকেটে খুঁজতে লাগলো। কারণ এটা তার ফোনের আওয়াজ নয়।

ফোন পেয়ে বের করে দেখলো ফোন অক্ষত আছে, সবুজ নামের কেউ কল দিচ্ছে। রিসিভ করলে আহান বুঝতে পারলো সবুজ তাজের পি.এ। আহান সব খুলে বলে তাজেকে কোন হসপিটালে নিচ্ছে তার নাম বলে দিলো। এদিকে ভয়ে সবুজের গলা শুকিয়ে গেলো। ফোন কাটতেই স্কিনে তিতিরের ছবি ভেসে উঠলো। আহান অবাক হয়ে তাকালো ফোনের স্কিনে তারপর তাজের মুখের দিকে। আহান যতটা জানে তাজ ভালোবাসতো না তিতিরকে, তবে তিতিরের ছবি কেনো তার ওয়ালপেপারে এখনো ?

চলবে,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে