বিষাক্তফুলের আসক্তি পর্ব-১৯+২০

0
903

#বিষাক্তফুলের আসক্তি
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্ব-১৯+২০

বিশাল দুতলা বাড়ির দক্ষিণপাশে পুকুরের ওপারে বকুল গাছের নিচে ঘুমিয়ে আছে তিতির। এপারে পুকুরের সিঁড়িতে বসে আছে আহান। তিতিরপাখিকে নিয়ে লন্ডন যাওয়ার আগেও একবার এই বাড়িতে এসেছিলো তারা। রঙচটা বাড়িটা যেনো ভূতের বাড়িতে রূপ নিয়েছে। একসময় কত হাসিখুশিতে ভরপুর থাকতো এই বাড়িটা, আজ চারদিকে কেবল নিস্তব্ধতা। বাড়িতে গুটিকয়েক কাজের লোক ছাড়া কেউ নেই। বাড়ির আঙিনায় কতশত স্মৃতি আহু আর তুতুলের। আহান চোখ মুছে পকেট থেকে ফোনটা বের করলো। এটা আট মাস আগে বাংলাদেশে এসে কিনেছিলো সেই ফোন। আহান সব প্রমাণ পুলিশকে দিয়ে ফোন থেকে সেই যে সিম খুলে ফেলেছিলো আর সিম লাগায়নি। তিতিরের মৃত্যুর পর এই কয়েকদিনে অনেকবার চেয়েছে তাজের সাথে যোগাযোগ করে সবটা জানাতে। কিন্তু বারবার ব্যর্থ হয়েছে, যেখানে তিতির ইচ্ছে করে তাজকে কিছু জানায়নি সেখানে সে কীভাবে জানাবে ? তিতির তো বলে গেছে তাজ যদি কোনোদিন ধ্রুবর খোঁজে আসে তবে ডায়েরিটা তাকে দিতে কিন্তু আহানকে বলেনি তাজকে খুঁজতে। আহান ফোনটা আবার রেখে দিলো পকেটে। তাজকে সে দেখেছে তিতির ফোনে ছবিতে এছাড়া চিনে না। মাত্র নয় বছর বয়সে এই দেশ ছেড়েছে, এখন খুব একটা ধারণা নেই এই দেশ সম্পর্কে। আহান উঠে দাঁড়ালো সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে একটা পদ্মফুল ছিঁড়ে নিলো, হাতে কাঁটাও ফুটলো। কাঁটা দেখে মুচকি হাসলো, ছোটবেলায় তুতুল কত বায়না ধরতো এই ফুল এনে দিতে কিন্তু আহান কাঁটার ভয়ে আসতো না। ফুলটা হাতে নিয়ে কবরের দিকে এগিয়ে গেলো, শ্যাওলা ধরা পাথরে বাঁধানো দু’টো পুরানো কবরের পাশে একটা নতুন বাঁধানো কবর। আহান ফুলটা তুতুলের কবরের মাথার দিকে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।

আহান মুচকি হেসে বললো, তোর মনে আছে তুতুল, ছোটবেলায় দুপুরবেলা তুই যখন মামির পাশে এভাবে শুইয়ে ঘুমিয়ে থাকতি। আমি পা টিপেটিপে এসে তোকে তুলে নিয়ে খেলতে চলে যেতাম দু’জনে। আজ আর আমার সেই সাধ্য নেই রে। তুই বরং ছোটবেলার মতো বাবা-মার রাজকন্যা হয়ে এখানেই শান্তিতে ঘুমা আমি বরং আসি। কত দায়িত্ব দিয়ে গেছিস আমাকে, সেসব পালন করতে হবে তো নাকি ? ভালো থাকিস তুই, আমিও অনেক ভালো থাকবো দেখিস।

মুখে মুচকি হাসি আর চোখের কোণে নোনাজল আহানের। চোখ মুছে কবর জেয়ারত করে লম্বা কদমে চলে এলো সেখান থেকে। সোজা নিজের গাড়িতে গিয়ে বসলো, গাড়িতে বসে একবার কবরের দিকে তাকিয়ে জানলায় কাঁচ তুলে দিলো। ড্রাইভারকে বললো এয়ারপোর্টের দিকে যেতে। একবার মনে হয়েছিলো রায়হানের সাথে দেখা করে জানতে চাইবে কী লাভ হলো এতো পাপ করে ? কিন্তু পরক্ষণে ইচ্ছেটা মরে গেছে, তাই সোজা লন্ডন ফিরছে আহান। সেখানে ন্যান্সি একা আছে পাখি আর ধ্রুবর সাথে। সিলেটের সবুজ সৌন্দর্য দেখতে দেখতে আহান চললো এয়ারপোর্টের দিকে। সবুজের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলো,

“যদি আপন না হবে প্রিয় তবে স্বপ্ন কেন দেখাও,
যদি ছেড়েই চলে যাবে তবে মায়া কেন বাড়াও।”

২৪.
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রায়হানের সাথে দেখা করতে এসেছে তাজ। তাজের সাথে করা অন্যায় আর হসপিটালের অসহায় রোগীদের স্বল্প টাকায় অপারেশনের নামে দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ (যেমনঃ চোখ, কিডনি) এসব বের করে নিয়ে বিদেশে পাচার করার জন্য যাবত জীবন কারাদণ্ড হয়েছে তার। ডার্ক ডেভিল নামে আন্ডারওয়ার্ল্ডের সাথে সংযুক্ত ছিলো সে। অনেক ইনফরমেশন রায়হানের থেকে উদ্ধার করেছে র‌্যাব। তবে কয়েকদিন ধরে তাজের সাথে সে দেখা করতে চাইছে কিন্তু তাজ যায়নি। কিন্তু লাস্টবার বলেছে তিতিরের খোঁজ চাইলে যেনো তার সাথে দেখা করে। তাজ যাওয়ার কিছুক্ষণ পর দেখা হলো রায়হানের সাথে। জেলের ওপারে রায়হান আর এপারে তাজ। চুল, গোঁফ, দাঁড়িতে রায়হানকে চিনতে কষ্ট হচ্ছে তাজের। তবে তার চোখেমুখে কোনো অনুশোচনা দেখা গেলো না।

তাজ উত্তেজিত হয়ে বললো, বল তিতির কোথায় ?

রায়হান মুচকি হেসে বললো, তুই মুক্ত হয়ে সারা পৃথিবীতে ঘুরে জানিস না তিতির কোথায় আর আমি ঐ চারদেয়ালে বন্দী থেকে কীভাবে জানবো তিতির কোথায় ?

রেগে গেলো তাজ, তাহলে আসতে বলেছিস কেনো ?

রায়হান কিছু না বলে হা হা করে হাসতে লাগলো, তোকে দেখে বড্ড করুণা হচ্ছে আমার তাজ। যদিও সেটা তোর হওয়া উচিত আমার জন্য বাট উল্টোটা হচ্ছে।

তাজ বিরক্ত হলো রায়হানের কথায়। এর এসব ফা*ল*তু কথা শোনার ইচ্ছে নেই তাজের তাই চলে যেতে নিলে রায়হান পেছন থেকে ডাকলো, আরে শুনে তো যা কেনো আসতে বলেছি।

তাজ ঘুরে তাকিয়ে বললো, তোর বা*জে বকবক শোনার ইচ্ছে নেই আমার। তবে হ্যাঁ তোকে একটা গুড নিউজ দেওয়ার আছে। বিয়ে হয়েছে মৌয়ের, নাহ্ আমার সাথে নয়, তোদের কলিগ শানের সাথে।

রায়হান মুচকি হেসে বললো, তোর সাথে তো হয়নি আমি এতেই খুশি।

তাজ তেড়ে এলো রায়হানের দিকে, লোহার রডের ফাঁকে হাত গলিয়ে রায়হানের কলার চেপে ধরলো।

আসলে তুই মৌকে কখনো ভালোই বাসিসনি। তোর শুধু হিংসা ছিলো আমার উপর।

রায়হান তাজের হাত ছাড়িয়ে নিলো নিজের কলার থেকে, একদম ঠিক ধরেছিস তুই। ভালোবাসা থাকলেও একসময় সেটা জেদে পরিণত হয়েছিলো। তোর থেকে আমি তো কোনোদিকে কম ছিলাম না, তবু মৌ আমার ভালোবাসা পায়ে পিষে বারবার তোর পিছনে ঘুরঘুর করেছে। তাই ঠিক করে নিয়েছিলাম আমি মৌকে পাই আর না পাই তোকে পেতে দিবো না।

তাজ রাগে ফোঁস ফোঁস করে বললো, তুই একটা সাইকো রায়হান।

তাজ রেগে বের হতে গেলে রায়হান পেছন থেকে সেই সুরে শিস বাজাতে লাগলো। তাজ থেমে গেলো, আটমাস আগে রায়হান আসার সময়ও এই সুরে শিস বাজিয়েছে। কিছু তো রহস্য আছে এই সুরে। তাজ আবার ঘুরে তাকালো রায়হানের দিকে।

রায়হান মুচকি হেসে বললো, আসল কথা না জেনেই চলে যাচ্ছিস তুই।

তাজ ভ্রু কুঁচকে তাকালো রায়হানের দিকে রায়হান এবার গেয়ে উঠলো,
ওরে খোকা তুই আমার দু’চোখের মণি
কষ্ট ভুলে যাই ‘বাবা’ ডাকিস যখনই।
দেখে তোর হাসি, আমি সুখে ভাসি-
দুঃখরা ঝরে যায় তখনই…
খোকা, আয় তুই বুকে এখনই খোকা,
আয় তুই বুকে এখনই।

সেই সুরের গানের কলিটা গেয়ে উঠলো রায়হান। তাজ কিছু বুঝতে না পেরে শুধু তাকিয়ে আছে রায়হানের দিকে। কী বুঝাতে চাইছে রায়হান সেটা বুঝার চেষ্টা করছে।

রায়হান তাজের দিকে তাকিয়ে আবার হা হা করে হেসে বললো, তোর মস্তিষ্কে জং ধরেছে তাজ।

তাজ বিরক্ত গলায় বললো, মানে কী এসবের ?

রায়হান জেলের রড ধরে ফিসফিস করে বললো, তোর মতো হতভাগ্য বাবা এই পৃথিবীতে দু’টো নেই রে তাজ। যে নিজের সন্তানের আগমনের কথাই জানে না। যে নিজের সন্তানের মুখে বাবা ডাক শুনে সুখে ভাসতে পারবে না।

শরীরের রক্ত হিম হয়ে গেলো তাজের। রায়হান এসব কী বলছে ? অজানা অনুভূতিতে বুক ঢিপঢিপ করছে, হাত-পা কাঁপছে, চোখে পানির কণা চিকচিক করছে।

রায়হান আয়েশ করে বলতে লাগলো, তিতিরকে যে রাতে তুই ওর ফ্ল্যাটে দিয়ে এসেছিলি সে রাতেই আমার লোক ফোন করে জানায় আহান পাখিকে নিয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছে। আহান আমার ভাই যার কাছে আমি তিতিরের বোন পাখিকে রেখেছিলাম। বিয়ের খুশিতে কারো খবর নেয়নি তেমন। কিন্তু সেই ফোন পেয়ে প্রথমে ফোন দেই যে তিতিরের উপর নজর রাখে তার কাছে। সে জানায় তিতির আজ একটা হসপিটালে গিয়েছিলো কোনো কারণে, সেখান থেকে বেড়িয়ে সামনের রাস্তায় বসে কাঁদতে থাকে আর সেখান থেকে তুই গিয়ে তাকে তার ফ্ল্যাটে রেখে এসেছিস। একটু খটকা লাগে আমার, তখনই হসপিটালে আমার থাকা লোকের মাধ্যমে জানতে পারি তিতির প্রেগনেন্ট। বুঝেছিস তাজ, এতোদিনে তোর সন্তান পৃথিবীর আলো দেখেছে হয়তো। কিন্তু তুই বাবা হয়ে সেটা জানতেই পারিসনি।

তাজ কাঁপা গলায় বললো, এজন্য সেদিন বলেছিলি তিতির যাওয়ার আগে আবার আমার থেকে কিছু কেঁড়ে নিয়ে গেছে।

যাক এতক্ষণে তোর মাথায় বুদ্ধির উদয় হয়েছে। তিতির একা যায়নি সাথে নিয়ে গেছে তোর সন্তানকেও।

তাজ নিজের ধৈর্য হারালো, ছুটে গিয়ে রায়হানের কলার চেপে ধরলো আবার।

বল তিতির কোথায়, আমার স,,সন্তান কোথায় ?

রায়হান অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। তাজের হাত নিজের কলার থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না। তাজের শরীরে যেনো অসীম শক্তি ভড় করেছে।

বল ওরা কোথায় আছে ? আমি জানি তুই সব জানিস।

তাজের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে কারারক্ষী এগিয়ে এলো। রায়হানের থেকে তাজকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করলো। রায়হানের কলার ছেড়ে দিলেও রড শক্ত করে ধরে রাখলো তাজ আর বারবার তিতিরের কথা জানতে চাইলো। অনেক কষ্টে কয়েকজন কারারক্ষী মিলে একটু দূরে আনলো রায়হানের থেকে। রায়হান তখনো অট্ট হাসিতে ফেটে পড়ছে।

রায়হান হঠাৎ থেমে গিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো, এই রিয়াকশনটা দেখার জন্যই আজ সত্যিটা তোকে জানালাম আমি। আমি এই চার দেয়ালে বন্দী থাকবো আর তোরা শান্তিতে বাঁচবি সেটা কীভাবে হয়। গত আটমাস হন্যে হয়ে তিতিরকে খুঁজেছিস, এটা ভেবে অস্থির হয়েছিস তিতির কী কেঁড়ে নিয়েছে আবার তোর থেকে ? আর আজ থেকে দু’জনকে খুঁজবি তুই। নিজের সন্তানকে একবার ছুঁয়ে দেখার জন্য ছটফট করবি। আমি তো সেটাই চেয়েছিলাম।

কথাগুলো বলে রায়হান চলে গেলো ভেতরে, তাজ নিজের ভাড় ছেড়ে দিলো। হাঁটু গেড়ে ধপ করে বসে পড়লো ফ্লোরে। কারারক্ষীরা ছেড়ে দিলো তাকে।

তাজের চোখ থেকে টপটপ পানি পড়ছে শুকনো ফ্লোরে, এটা কেনো করলে তিতির ? আমার তো অধিকার ছিলো নিজের সন্তানের কথা জানার।

তাজ উঠে দাঁড়ালো কোনোমতে। টলমলে পায়ে বের হয়ে গেলো। দিকবিদিকশুন্য হয়ে গাড়ি ছুটালো। বেশ কয়েকবার এক্সিডেন্ট হতে হতে বেঁচে গেলো।

ইকবাল অনেকটা সুস্থ এখন তাই বাড়িতে আনা হয়েছে। ড্রয়িংরুমে বসে ছিলো ইরিনা আর ইকবাল। কোনোদিকে না তাকিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো তাজ, সেদিকে একবার তাকিয়ে নিজের মতো রইলো ইকবাল আর ইরিনা। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে পারলো না, উপরে বিকট আওয়াজ পেয়ে কেঁপে উঠলো।

ইকবাল উপরের দিকে তাকিয়ে বললো, দেখো তো ইরি কী হলো ?

ইরিনা সম্মতি জানিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো। তাজের দরজার সামনে দাঁড়াতেই একটা ফুলদানি তার পায়ের কয়েক ইঞ্চি দূরে পরে ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো। ভয়ে দু’কদম পিছিয়ে গেলো ইরিনা।

এসব কী তাজ ?

তাজের কানে সে কথা পৌঁছালো না, রুমের জিনিসপত্র এদিক ওদিক ছুঁড়ে ফেলতে লাগলো। ইরিনাও আগাতে পারছে না, শেষে কোনটা এসে শরীরে লাগে। সব ভাঙা শেষ হয়ে গেলে চুল খামচে ধরে ফ্লোরে বসে পড়লো তাজ। জোরে জোরে চিৎকার করতে লাগলো। ইরিনা সাবধানে পা ফেলে তাজের কাছে এসে কাঁধে হাত রাখলো।

কী হয়েছে আমার বাবার ?

তাজ নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলো না। বসা অবস্থায় মাকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। ইরিনা তাজের পাশে বসলে তাজ মায়ের কোলে মাথা রেখে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলো। ইরিনা সময় দিলো তাজকে, এখন জিজ্ঞেস করলে কিছু বলতে পারবে না ছেলেটা। অনেকটা সময় পর ঠান্ডা হলো তাজ, চুপচাপ শুয়ে আছ। ততক্ষণে দরজায় এসে দাঁড়ালো ইকবার।

ইরিনা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, এবার বল কী হয়েছে বাবা ?

তাজ ভেজা গলায় বললে, সবাই আমার সাথেই কেনো এমন করলো মা ? আমি তো কারো সাথে কোনো অন্যায় করিনি। রায়হান বন্ধু হয়ে এভাবে পিঠে ছুরি বসালো। আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করলো বন্ধুত্ব, মৌকে তো আমি বলিনি রায়হানকে বাদ দিয়ে আমাকে ভালোবাসতে। এ কেমন ভালোবাসা মা ? যে ভালোবাসা কেঁড়ে নিতে শেখায়। আর তিতির, তাকে তো আমি আমার জীবনে জোর করে আনিনি, সে নিজের ইচ্ছায় জোর করে এসেছে আমার জীবনে। আমি মানছি রাগের বশে একটা ভুল করে ফেলেছি, অন্যায় করে ফেলেছি তার সাথে। তাই বলে সে আমাকে না জানিয়ে আমার সন্তানকে আমার থেকে লুকিয়ে চলে যাবে ? আমার তো অধিকার আছে আমার সন্তানের উপর, তাই না মা ? যতটা অধিকার তিতিরের আছে, ঠিক ততটা অধিকার আমারও আছে।

স্তব্ধ হয়ে আছে ইরিনা আর ইকবাল। তাজের কথায় মাথা হ্যাং হয়ে গেছে তাদের। ইরিনার মনে পরলো শেষের কিছুদিন তিতিরের অসুস্থতা। সে এমন কিছুই সন্দেহ করেছিলো কিন্তু যখন তাজ আর তিতিরের মধ্যকার সম্পর্কের অবস্থা মনে হয় তখন সে ইগনোর করে যায় ব্যাপারটা। ইকবাল এখনো বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না ব্যাপারটা।

গম্ভীর গলায় বললো, বাচ্চার কথা তুমি কীভাবে জানলে ?

রায়হান বলেছে সব, তাজ একে একে সব খুলে বললো রায়হান যা যা বলেছে।

ইকবাল বললো, হয়তো এবারও সব মিথ্যে বলছে রায়হান।

না এবার আর কিছুই মিথ্যা নয়। রায়হানের থেকে সব শুনে আমি সেখানেই গিয়েছিলাম তিতিরকে যেখানে বসে কাঁদতে দেখেছি। এটা সত্যি না হলে ঐ হসপিটালের বাইরে বসে কেনো কেঁদেছিলো তিতির। তার আশেপাশে ঐ একটাই হসপিটাল ছিলো সেখানে খোঁজ নিয়েছি আমি। তিতির সেখানেই ডক্টর সাবিত্রী দেবীর কাছে গিয়েছিলো, রিপোর্টও ফেলেই চলে এসেছিলো। সেই ফাইল আমাকে দেখিয়েছে ডক্টর সাবিত্রী। অনেক কমপ্লিকেশন ছিলো তিতিরের প্রেগনেন্সিতে, সেসব বলেছে আমায়, লাইফ রিস্কও ছিলো। ডক্টর সাবিত্রী তিতিরকে এবরশন করাতে বলেছিলো তার তিতির ভাবার জন্য সময় চেয়ে বের হয়ে আসে। তাই হয়তো ওভাবে কাঁদছিলো।

ইকবাল দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, তিতির যা স্বার্থপর মেয়ে দেখো এবরশন করে কবেই শেষ করে দিয়েছে তার অস্তিত্ব।

তাজ যেনো ধপ করে জ্বলে উঠলো, বাবা।

তাজের মনে ভয় ঢোকে গেলো। বেঁচে আছে তো তার সন্তান, আর তিতির সেই বা কেমন আছে ? কীভাবে খোঁজে পাবে তাদের ?

আবারও সাদা বরফে ঢাকা পড়েছে আভিজাত্যের শহর লন্ডন। বরফের ছোট ছোট বল বানিয়ে বছর পাঁচের ছোট ছেলে ছুঁড়ে মারছে বছর একুশে’র এক তরুণীকে। সেই তরুণী খিলখিল করে হাসছে তাতে, নিজেও বরফের বল বানিয়ে ছুঁড়ছে বাচ্চাটার দিকে।

ধ্রুব, পাখি অনেক হয়েছে তোমাদের খেলা এবার বাসায় চলো। আহান বাসায় ফিরলে দু্’টোকে বকবে কিন্তু।

ধ্রুব আর পাখি সামনে তাকিয়ে দেখতে পেলো পঞ্চাশোর্ধ ন্যান্সি কোমরে দু’হাত রেখে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। ধ্রুব আর পাখি একে অপরের দিকে তাকিয়ে ইশারায় কিছু বুঝাপড়া করে নিলো। তারপর দু’জনে একসাথে ন্যান্সির দিকে বরফের বল ছুঁড়তে লাগলো আর খিলখিল করে হাসতে লাগলো।

পাখি হাসি বজায় রেখে বললো, মাম তুমিও আমাদের সাথে খেলো।

মাম ভালো হবে না কিন্তু, এভাবে বল মেরো না। আহান চলে এলে তোমাদের বকবে।

গম্ভীর গলায় কেউ বলে উঠলো, কী হচ্ছে এখানে ?

পাখি আর ধ্রুবর হাত থেমে গেলো। ভয়ে ভয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখলো বয়স ত্রিশের সুদর্শন আহান দাঁড়িয়ে আছে। চশমার নিচে গভীর চোখের দৃষ্টি ধ্রুব আর পাখির দিকে।

ধ্রুব চট করে ভাঙা বাংলায় বললো, আমি কিছু করিনি পাপা সব মাম্মাম করেছে।

আহান তাকালো পাখির দিকে, ধ্রুব কী বলছে পুতুল ?

পাখি হুট করে নিচ থেকে বরফের একটা বল তুলে আহানের দিকে ছুঁড়ে দিলো, হ্যাঁ আমি করেছি কী করবে তুমি ?

আহান নিজের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলো, তবে রে।

আহান পাখির দিকে দৌড় দিলে পাখি উল্টোদিকে ছুট লাগালো আর খিলখিল করে হাসতে লাগলো, আমাকে ধরতে পারে না।

বরফের জন্য বেশি দৌড়াতে পারলো না পাখি ধরে ফেললো আহান তাকে। ধাক্কা দিয়ে বরফে ফেলে ইচ্ছে মতো বরফ দিয়ে ঢেকে দিলো। ধ্রুব লাফাচ্ছে আর হাত তালি দিচ্ছে।

আহান বললো, আরো দুষ্টুমি করবে ?

পাখি মুখ ফুলিয়ে বললো, না।

আহান উঠে দাঁড়িয়ে পাখিকে টেনে তুললো, অনেক খেলা হয়েছে এবার বাসায় চলো।

আহান এগিয়ে এসে ধ্রুবকে কোলে তুলে নিলো। সারা মুখে চুমু খেয়ে বুকে জড়িয়ে নিলো। ধ্রুবর মুখের দিকে তাকালে তার তুতুলকে দেখতে পায় আহান। ধ্রুবর মুখের আদুল একদম তিতিরের মতো। তিতিরের সাথে পাখির মিল থাকলেও ধ্রুব যেনো মায়ের কপি হয়েছে। আহান ভুলতে বসেছে ধ্রুব তার কাছে আমানত, যেকোনো সময় ফিরিয়ে দিতে হতে পারে। ভালোবাসায় আগলে রেখেছে তিতিররে রেখে যাওয়া দু’টো ভালোবাসাকে। তিতির চলে যাওয়ার দু’বছর পর পুতুলের যখন আঠারো হয়েছে তখনই পুতুলকে বিয়ে করেছে আহান। নিজের মনে অন্য কাউকে জায়গা দিতে পারবে না আহান। তাই তিতিরের কথা রাখতে, পাখিকে সারাজীবন আগলে রাখতেই বিয়ে করেছে। তবে পাখির জন্য ধীরে ধীরে মনে একটা জায়গা তৈরি হয়ে আহানের। তিতিরকে ভুলে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়, তবে পাখিকে ছাড়া থাকার কথা চিন্তাও করতে পারে না। এদিকে পাখি ভুলতে বসেছে তার আপুনিকে, এইদিক থেকে পাখি অবুঝ হওয়ায় ভালোই হয়েছে। প্রথমদিকে পাখি যেমন পাগলামি করতো সারাজীবন তেমন করলে আহান সামলাতে পারতো না। তিতিরের রক্তাক্ত অবস্থা দেখে পাখির মানসিক অবস্থার আরো অবনতি হয়েছিলো। ন্যান্সি ছিলো বলে আহান দু’দিক সামলে উঠতে পেরেছে। তবে এখনো মনে পড়লে খোঁজে তার আপুনিকে। ন্যান্সির উপকার কোনোদিন ভুলতে পারবে না আহান। সেও এখন ন্যান্সিকে মাম বলেই ডাকে।

বাসায় ফিরে ধ্রুবর পোশাক বদলে দিলো আহান। তারপর নিজেও ফ্রেশ হয়ে এলো। ড্রয়িংরুমে এসে দেখলো পাখি তখনো চেঞ্জ না করে বসে আছে।

আহান ধ্রুবকে সোফায় বসিয়ে পাখিকে বললো, তুমি এখনো চেঞ্জ না করে বসে আছো কেনো ?

পাখি গাল ফুলিয়ে বললো, তুমি ধ্রুবকে চেঞ্জ করিয়ে দিয়েছো আমাকে দাওনি, আমিও একা করবো না।

আহান বিষম খেতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো। পাখি মাঝে মাঝেই এমন উদ্ভট আবদার করে বসে। আহান আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো ন্যান্সি নেই, তাতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। মেয়েটা মাঝে মাঝে ন্যান্সির সামনে লজ্জায় ফেলে দেয় আহানকে।

আহান অসহায় গলায় বললো, একা করে নাও না রে বাবা।

পাখি আগের মতোই বললো, আমি যাবো না।

আহান হতাশ হয়ে ধ্রুবর হাতে একটা রুবিকস কিউব দিয়ে কপালে চুমু খেয়ে বললো, বাবাই এটা মেলাও পাপা এখনই আসছে। এখান থেকে কোথাও যাবে না, ওকে ?

ধ্রুব শান্ত হয়ে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। ধ্রুব অনেক শান্ত বাচ্চা, হয়তো মায়ের কথা রাখতেই শান্ত হয়েছে। আহান ফিরে না আসা পর্যন্ত এখানেই বসে থাকবে। আহান পাখিকে নিয়ে নিজেদের রুমে চলে গেলো চেঞ্জ করিয়ে দিতে। পাখিটা মাঝে মাঝে বড্ড জ্বালায় আহানকে।

সন্ধ্যার নাশতা খাওয়ার সময় আহান বললো, মাম আগামীকাল কী মনে আছে তো ?

ন্যান্সি দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, বাকি জীবনে কোনোদিন হয়তো ভুলতে পারবো না এই দিনটা।

আহানও চাপা শ্বাস ছেড়ে বললো, আগামীকাল আমরা বাংলাদেশে যাচ্ছি সব গুছিয়ে রেখেছো তো।

আমি সব গুছিয়ে রেখেছি মাই সান।

হঠাৎ ধ্রুব ভাঙা বাংলায় বললো, গ্রানি আমি পানি খাবো।

ধ্রুব বাংলার থেকে ইংলিশ ভালো বলতে পারে। তবে বুঝতে পারে দু’টোই। বাংলাটা এখনো শিখছে। আহান সময় কম পায় তাই শেখাতেও পারে কম। ন্যান্সি তো আর বাংলা শেখাতে পারে না আর পাখি, সে তো সেই। ন্যান্সি মুচকি হেসে চলে গেলো ধ্রুবর জন্য পানি আনতে। আহান ধ্রুবর গালে চুমু খেয়ে টিভির দিকে তাকালো।

পাখি বললো, আমাকে হামি দিলে না কেনো ?

আহান নিজের মাথা চাঁড়াল, তবে কিছু না বলে পাখির গালেও একটা কিস করলো। সোজা হয়ে বসার আগেই পাখিও আহানের গালে কিস করলো। আহান মুচকি হেসে টিভি দেখায় মনোযোগ দিলো।

২৫.
অফিসে মনোযোগ দিয়ে ফাইল দেখছে তাজ। ইকবাল খান অফিস থেকে পুরোপুরি অবসরে গিয়েছেন বলা চলে। সম্পূর্ণ দায়িত্ব এখন তাজ পালন করে। একসময়ের হাসিখুশি অভিনেতা এখন গম্ভীর বিজনেসম্যান। শেষ কবে গান গেয়েছিলো সেটা হিসেব করতে বসতে হবে। তাজ বদলে গেছে, পুরোপুরি বদলে গেছে। প্রয়োজন ছাড়া কথা বললে যেনো অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। কেনো এমন হয়ে গেলো তাজ ? তিতির তো তাকে মুক্ত করে দিয়ে গেছে ভালো থাকতে, তবে কেনো ভালো নেই সে ? সারাদিন কাজে ডুবে থাকে, শুধুমাত্র নিজের করা একটা ভুলের অনুশোচনা ভুলে থাকতে। কাজের ফাঁকে জীবনের তাগিদে ছুটে চলা মানুষের ভীড়ে তাজ খুঁজে চলে তিতিরকে, তার সন্তানকে। আচ্ছা তাজ যে সন্তানকে ফিরে পাওয়ার জন্য এতো উতলা হয়ে আছে, সেই সন্তান ফিরে পেলে তার চোখে চোখ রাখতে পারবে তো ? সে যে তাজের ভালোবাসার নয় অন্যায়ের প্রমাণ। এমন হাজারো প্রশ্নের বেড়াজালে বন্দী তাজ। এমন হাজারো প্রশ্নের উত্তর পেতে মরিয়া হয়ে আছে সে।

অন্ধকার অনেক আগেই গ্রাস করেছে আশপাশটা, অফিসে হয়তো আর একজনও খোঁজে পাওয়া যাবে না। তাজ উঠে দাঁড়ালো, চেয়ারে ঝুলানো ব্লেজার হাতে নিয়ে এক হাত পকেটে ঢুকিয়ে লম্বা কদমে বের হলো কেবিন থেকে।

স্যার গাড়ি বার করতে বলবো ?

তাজ পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখলো তার পি.এ সবুজ দাঁড়িয়ে আছে।

তাজ সামনে হাঁটতে হাঁটতে বললো, তোমাকে না বললাম বাসায় চলে যেতে।

সবুজ মাথা নিচু করে বললো, স্যার আপনাকে একা ফেলে যেতে ইচ্ছে করেনি।

আগামীকাল দু’দিনের জন্য সিলেট যাচ্ছি আমরা। পরিবারের সাথে একটু সময় কাটাতে বাসায় যেতে বলেছিলাম তোমাকে।

সবুজ তাকালো তাজের দিকে। এতো গম্ভীর মানুষটার মন কতটা ভালো সেটা সবুজ প্রমাণ পেয়েছে বারবার। তাজ গম্ভীর, কথা কম বলে কিন্তু কাউকে ধমক দিয়ে কথা বলে না। কাউকে শাসানোর হলেও খুব ঠান্ডা মাথায় আর শান্ত গলায় শাসায়। এতেই সামনের মানুষের ঘাম ছুটে যায়। পাঁচ বছর ধরে সবুজ আছে তাজের সাথে। তবে এখন পর্যন্ত তাকে একটা ধমকও দেয়নি তাজ, শুধু শান্ত নজরে একবার তাকালেই সবুজের ঘাম ছুটে যায় ভয়ে। ভয় দেখানোর জন্য সবসময় চেঁচামেচি করাটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, সবুজ সেটা তাজকে দেখে শিখেছে। তাজ আর সবুজ দু’জনে চুপচাপ হাঁটতে হাঁটতে লিফটের কাছে চলে এলো।

সবুজ অনেকটা সাহস নিয়ে বললো, স্যার সিলেট থেকে এসে আমার দু’দিনের ছুটি লাগবে।

মুলত এটা বলার জন্যই সবুজ অপেক্ষা করছিলো তাজের। কারণ কাজের সময় অন্য কথা পছন্দ করে না তাজ।

তাজ বেশ ঠান্ডা গলায় বললো, কেনো ?

স্যার চারদিন পর আমার ছেলের জন্মদিন। ছেলে অনেকদিন ধরে জেদ ধরছে এবার জন্মদিনে সে সমুদ্র দেখতে যাবে।

তাজ এবার তাকালো সবুজের দিকে। “আমার ছেলে” শব্দটা তাজের বুকে বিঁধল।

বিড়বিড় করে আওড়ালো, “আমার ছেলে।”

একটা ভুলের জন্য সে হারিয়েছে এই শব্দ বলার সুযোগ। আচ্ছা তার ছেলে হয়েছে না মেয়ে ? সে তাজের কাছে থাকলে সেও এমন জেদ ধরতো ? তাজ ভালো সন্তান, ভালো স্বামী কিংবা ভালো মানুষ হয়তো হতে পারেনি কিন্তু নিজের সন্তানকে কাছে পেলে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা ঠিক হয়ে যেত। আচ্ছা তার সন্তান বেঁচে আছে তো আর তিতির সে বা কেমন আছে ?

স্যার ?

সবুজের ডাকে হুঁশ ফিরলো তাজের। না এসব ভাবতে চায় না তাজ। সে মন ভড়ে দোয়া করে তিতির আর তার সন্তান যেখানেই থাকুক, যেনো ভালো থাকে। তাজ নিজের করা সব পাপের জন্য প্রতি ওয়াক্তে নামাজ পড়ে মাফ চায় আল্লাহর কাছে। ফিরে চায় নিজের সন্তান আর তিতিরকে। ওদের ফিরে পেলে তাজ আর কোথাও যেতে দিবে না তাদের। তিতির তাজের কাছে থাকতে না চাইলে তাজ নিজেকে বদলে তিতিরের মনের মতো করে গড়ে তুলবে। তবু তাজ ফিরে চায় নিজের পরিবারকে। তাজ তাকিয়ে দেখলো সবুজের দিকে, সে আশা নিয়ে উত্তরের অপেক্ষা করছে।

কাজটা ভালোভাবে কমপ্লিট হয়ে গেলে তোমাকে পাঁচদিনের ছুটি দেবো।

খুশীতে চকচক করে উঠলো সবুজের মুখ। সে জানতো তাজ তাকে হতাশ করবে না। পাঁচ বছর ধরে চিনেছে তো।

বাড়িতে পৌঁছে কলিংবেল বাজালে দরজা খোলে দিলো ইরিনা।

ফ্রেশ হয়ে আয় আমি খাবার দিচ্ছি।

তাজ ছোট করে হুম বলে উপরে চলে গেলো নিজের রুমের দিকে। ইরিনা তাজের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে খাবার টেবিলের দিকে গেলো। খাবার সাজিয়ে ইকবালকেও ডেকে পাঠালো। আধঘন্টা পরে তাজ ভেজা চুলে উপস্থিত হলো ডাইনিং টেবিলে। কোনদিকে না তাকিয়ে খাবারে মনোযোগ দিলো।

ইরিনা আর ইকবাল একে অপরের দিকে তাকিয়ে উশখুশ করছে৷ দু’জন কিছু বলতে চাইছে তাজকে কিন্তু কেউ বলতে পারছে না। একজন আরেকজনকে বলতে ইশারা করছে।

হঠাৎ তাজ বলে উঠলো, কিছু বলতে চাইছো তোমরা ?

চমকে উঠলো ইরিনা আর ইকবাল। তবে ইকবাল নিজেকে সামলে বলে উঠলো, এভাবে আর কতদিন চলবে তাজ ?

তাজ স্বাভাবিক গলায় বললো, কীভাবে ?

তুমি বুঝতে পারছো আমি কী বলতে চাইছি তবু হেয়ালি করছো কেনো ? বয়স তো কম হয়নি আর কত এভাবে থাকবে ? ছত্রিশ চলছে তোমার আর কত ? এমন তো নয় তুমি তিতিরকে ভালোবাসতে, তার বিরহে এমন দেবদাস হয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দিবে।

তাজ তাকালো নিজের বাবার দিকে, পাঁচ বছর আগেই তোমাকে বলেছিলাম। নিজের ছেলেকে চোখের সামনে দেখতে চাও নাকি চিরদিনের জন্য হারাতে ? আবার যদি এই কথা উঠে সারা বিশ্ব তন্নতন্ন করে খোঁজেও ছেলের হদিস পাবে না। মনে রেখো যে নিজে থেকে হারিয়ে যায় তাকে খোঁজে পাওয়া যায় না, তার প্রমাণ তিতির আর রইলো দেবদাস হওয়ার কথা। আমাকে মদ গিলে কোথায় পরে থাকতে দেখেছো ? তিতির তিতির বলে মুখে ফেনা তুলতে দেখেছো কবে ? আমার সামনে এসব ফা*ল*তু কথা দ্বিতীয়বার শুনতে চাই না।

ইরিনা বললো, তুমি কী চাও তোমার বাবা-মা তোমার চিন্তায় মারা যাক।

তাজ এবারও স্বাভাবিক রইলো, জন্ম মৃত্যু সবই আল্লাহর ইচ্ছে। আমার চাওয়া না চাওয়ায় কিছু যায় আসে না। পৃথিবীতে যার যতদিন আয়ু আছে, সে ততদিনের এক সেকেন্ড বেশি সময় থাকতে পারবে না।

তাজ খাওয়া ফেলে নিজের রুমের দিকে চলে গেলো হনহনিয়ে। কোনো বাবা-মা একমাত্র ছেলের এমন জীবন মেনে নিতে পারবে ? তাজ বরাবরই প্রেম, ভালোবাসা, সংসার এসবে উদাসীন ছিলো, এখন আরো উদাসীন হয়ে গেছে। কিন্তু তার এমন ফেকাসে জীবন মেনে নিতে পারছে না ইরিনা আর ইকবাল। এখন মনে হচ্ছে তিতিরকে খোঁজে পেলে ছেলের সংসারটা অন্তত হত। সেটাও হচ্ছে না আর অন্য কিছু করারও সুযোগ নেই, কিছু বলতে গেলেও চলে যাওয়ার হুমকি দেয়।

তাজ রুমে গিয়ে থম মেরে বসলো, সত্যি কী সে একটুও ভালোবাসেনি তিতিরকে ? গত প্রায় ছয় বছর ধরে প্রতিটা সেকেন্ড তার কথা চিন্তা করে একটুও ভালোবেসে ফেলেনি ?

তাজ ভাবতে চায় না এসব। এখন সবই উপরওয়ালার হাতে ছেড়ে দিয়েছে। সিলেট যাওয়ার জন্য প্যাকিং করতে লাগলো। জীবনের মোড় কী ঘুরতে চলেছে এই সিলেট ভ্রুমণে ?

চলবে,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে