বিরহ ভালোবাসা পর্ব-১২

0
700

#বিরহ_ভালোবাসা
#Tahmima_Akhter

১২.

রুপা আপার বিয়ের আজ একবছর পূর্তী উপলক্ষে বাড়ির সকল মানুষকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে জাভেদ ভাই।

গত সপ্তাহে জাভেদ ভাই আমাকে চিঠিতে দাওয়াত দিয়েছেন। কিন্তু, আমার যাওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই। আগের মতো সেই চঞ্চলতা আমার মাঝে নেই। হারিয়ে গেছে ঠিক আমার ভালোবাসার মতো। আগে ফ্যামিলির কোনো অকেশান হলে আমি আগে আগে উপস্থিত থাকতাম। ভালো লাগত আনন্দ হৈ-হুল্লোড় করতে। সবাই এক সঙ্গে জোড়ো হবেন মানে শাদাদ ভাইও আসবেন। কিন্তু, এখন আমি নিজেই গা বাঁচিয়ে চলি শাদাদ ভাইয়ের কাছ থেকে। তাকে একপলক দেখা মানেই আমার সঙ্গে আমার নিজের করা প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করা। তার নাম শুনলে পৃথিবীর সকল কিছুকে পা ঠেলে দিয়ে মনে হয় তার সামনে গিয়ে দাঁড়াই শুধুমাত্র একটুখানি ভালোবাসা পাওয়ার লোভে। কিন্তু, মায়ের কাছে আমি কথা দিয়েছি, আমি তাকে আমার মনে রাখব না। সেদিনের পর থেকে মনেও রাখি না তাকে। কিন্তু, সে তো আমারই শরীরের একটা অংশ। তাকে আমি মনে না রাখলেও আমার অবচেতন মন ঠিকই শাদাদ ভাইয়ের অস্তিত্বতে নিজের মাঝে ধারণ করে রেখেছে। মাঝে মাঝে ভাবি এই যে জীবনটাকে হাতের মুঠোয় এনে তাকে ভালোবাসার যন্ত্রণায় প্রতিনিয়ত আমি আহত হচ্ছি, সে কি জানে? জানবে কোত্থেকে? তাকে কখনো সাহস করে বলতে পারিনি, শাদাদ ভাই আমার বাকি জীবনটাতে শুধু আপনাকেই চাই, অন্য কাউকে নয়।

—- লতা, তোর বাবা-মা এসেছে। গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে তোর জন্য অপেক্ষা করছে।

নীলাদ্রির কথায় আমার ধ্যানভগ্ন হয়। উঠে গিয়ে আমি জানালার কাছে দাঁড়াই। দেখলাম গেটের বাইরে সত্যি সত্যি বাবা-মা দাঁড়িয়ে আছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে গায়ের চাদরটা খুব ভালো করে গায়ে জড়িয়ে হোস্টেলের ছোট্ট ঘর থেকে বের হয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যাচ্ছি।

আজ এক বছর হলো পড়াশোনার বাহানায় হোস্টেলে থাকছি। পড়াশোনা তো স্রেফ বাহানা মাত্র। শাদাদ ভাইকে এলপলক দেখার লোভ সামলাতে আমি ঠাঁই নিয়েছি হোস্টেলের ওই ছোট্ট ঘরটায়।

গেটের বাইরে যত অগ্রসর হচ্ছি ঠিক ততই চোখের সামনে দৃশ্যমান হচ্ছে আমার বাবা-মায়ের শুকনো মুখখানা। মা দৌঁড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমিও মাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলাম। আহ্, বহুদিন পর মায়ের ঘ্রাণ পেলাম। হুট করে আমার কেন যেন ভীষন কান্না পাচ্ছে! বাবা এগিয়ে এসে আমার মাথায় হাত রাখলেন। আমি বাবার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

—- বাবা কেমন আছো?

— তোকে ছাড়া আমার কখনোই ভালো লাগেনি। তাই বলব আমি ভালো নেই।

লতা ওর বাবার কথার জবাব না দিয়ে ওর মাকে ছেড়ে দিয়ে বললো,

— আজ হুট করে চলে এলে যে?

লতার প্রশ্ন শুনে লতার বাবা-মা একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন। লতার মা লতার বামহাত ধরে বললো,

— জাভেদ নাকি তোকে চিঠি পাঠিয়েছে? লতা মাথা নাড়িয়ে হ্যা বোঝালো।

— আমাদের সবাইকে দাওয়াত দিয়েছে ওদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য। তোকে ছাড়া আমরা যাই কি করে? তাই তোকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে এসেছি।

লতা জানত এমন কিছু হয়তো বলতে এসেছে ওর বাবা-মা। লতা কিছুসময় চুপ থেকে মাথা নিচু করে জিজ্ঞেস করলো মাকে,

— শাদাদ ভাই আসবে, মা?

লতার মা চট করে মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন। মেয়েটার মুখের তাকিয়ে যেন মেয়ের সকল অনুযোগ, পরিবার থেকে দূরে থাকার বাহানা সবটা পরিষ্কার হয়ে গেছে তৃনার কাছে। মেয়েটার দিকে তাকালে বড্ড মায়া হয়। মেয়েটা গরীব ঘরের একটা চাষী ছেলেকে পছন্দ করতো। তাহলে মেয়েকে সেই বিনাবাক্য সেই ছেলের হাতে তুলে দিতো। কিন্তু, পরিবার ছেলের কাছে?

লতার বাবা লতার মাকে চুপ থাকতে দেখে নিজেই লতাকে জবাব দিলেন।

— না শাদাদ আসবে না। কমিশনড অফিসার পদে যোদ দিয়েছে বেশ কদিন হলো। নতুন অবস্থায় এত ঘন ঘন ছুটি পাবে বলে মনে হচ্ছে না।

শাদাদের পদোন্নতি ঘটার কথা শুনে লতা আনন্দিত হলো বেশ। হুট করে লতার মনে হলো ওর খুব খুশি খুশি লাগছে।

— মা, আমি ব্যাগটা গুছিয়ে আসছি। তোমরা সিএনজি ডাকো।

কথাটি বলে তড়িঘড়ি করে আবারও হোস্টেলের ভেতরে চলে যায় লতা। এদিকে লতার বাবা-মা খুশি হলেন। লতার বাবা আরেকটু এগিয়ে যায় মেইন রোডের কাছে সিএনজি ডেকে আনার জন্য।

সবকিছু ঠিকঠাক করে নিজের বাবা-মায়ের সঙ্গে রওনা হয় লতা। আজ বহুদিন পর নিজের আপন ঠিকানায় ফিরে যাচ্ছে লতা।

বাড়ির মেয়ে বাড়িতে ফিরে এসেছে বলে যেন আজ বাড়িতে ঈদের খুশি ফিরে এসেছে। লতার বড়ো জেঠু লতাকে দেখে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

— বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করা যায় না? বাড়ির মেয়ে বাড়িতে থাকবে হাঁটবে, ফিরবে মন চাইলে পড়াশোনা করবে। আর তুই কিনা হোস্টেল গিয়ে পড়ে আছিস। জানিস আমাদের মন কতটা পুড়ে তোর জন্য।

কথাগুলো বলতে বলতে ভারাক্রান্ত হয়ে পরলেন লতার জেঠু। লতা তো নিজেকে নিজে বড্ড গর্ববোধ করছে। ওর অনুপস্থিতিতে ওর পরিবার ওকে মিস করে এটাই তো অনেক। আর কি চাই লতার? চলার পথে পরিবারের সার্পোট থাকলেই চলবে। শাদাদ ভাইয়ের ভালোবাসা ছাড়াও দিব্যি চলা যায় এই রঙের দুনিয়ায়।

সন্ধ্যে হবার আগে সবাই রওনা হলো রুপার শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্য। পৌঁছানোর পর দেখা গেলো মাগরিবের আজান পরছে চারপাশে। তাই বাড়ির পুরুষেরা মিলে নামাজ পরতে চলে যায় মসজিদে।
আর নারীরা ঘরে নামাজ পরে নেয়। লতার পিরিয়ড চলছে বিধায় চুপ করে ড্রইংরুমে বসে। দেয়াল ঘড়িতে সময়টা দেখে নিলো নামাজ শেষের পথে। হয়তো,কিছুক্ষণের মধ্যে সবাই চলে আসবে।

লতা আজ গোলাপি রঙের শাড়ি পরে এসেছে। লতা শাড়ি পড়তে চায়নি কিন্তু নিজের মায়ের অনুরোধ কি আর ফেলতে পারবে? তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও শাড়ি পরে এসেছে। মাঝে সিঁথি করে চুলগুলো বেনি করে বামপাশের কাঁধে ওপর ফেলে রেখেছে।

মাথা নীচু করে লতা জীবনের সমীকরণ মেলাতে ব্যস্ত তখন। এমনসময় একটি হাত লতার দিকে এগিয়ে আসে। লতা তাকিয়ে দেখলো একটি জিলাপি। হাতের মালিককে দেখার জন্য লতা ওপরে তাকায়। ব্যস, চোখদুটো তখনই স্থীর হয়ে যায় মানুষটার মুখখানা দেখার পর। স্বপ্ন নাকি বাস্তব কোনটা বিশ্বাস করবে লতা? বোকাচোখে তাকিয়ে লতা মানুষটাকে জিজ্ঞেস করে,

— আপনি কি সত্যি আমার চোখের সামনে আছেন, শাদাদ ভাই?

লতার কথায় শাদাদ ভাই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন,

— হ্যা তোর চোখের সামনে আছি মধু। নে তো জিলাপিটা ধর। হাত থেকে রস গলিয়ে পরছে।

লতা তখনও বিশ্বাস করতে পারছিল না যে ওর চোখের সামনে শাদাদ ভাই দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে শাদাদ ভাই লতার সামনে জিলাপি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। লতার জিলাপি নেবার নাম গন্ধও নেই। শাদাদ ভাই চট করে নিজের পাঞ্জাবির পকেট থেকে টিস্যু বের করে তাতে জিলাপিটা রেখে টি-টেবিলের ওপরে রেখে দিলো। দূরে গিয়ে বেসিন থেকে হাত ধুয়ে এসে দেখলে লতা নেই, গায়েব।

শাদাদ ভাইয়ের তখন ইচ্ছে করছিল চোখের সামনে যা-কিছু সব ভেঙে চুরমার করে ফেলতে। কিন্তু, বোনের শ্বশুরবাড়ি বলে রাগটা ঢোক গিলে গলার নীচ অব্দি নামিয়ে রাখলো ।

একে একে সব গেস্টরা আসা শুরু করে। সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ রুপা এবং ওর স্বামী জাভেদ কেক কাটে নিজের প্রথম বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে। এদিকে লতাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে শাদাদ ভাই। কিন্তু লতার নামগন্ধও নেই এই পার্টিতে। হুট করে শাদাদের মনে হলো, লতা আবার বাড়িতে ফিরে যায়নি তো। কারণ, অদূরে লতার বাবা-মা রুপা আপার শ্বাশুড়ির সঙ্গে দাঁড়িয়ে গল্পসল্প করছেন।

শাদাদ কাউকে না জানিয়ে চট করে এই বাড়ি থেকে বের হয়ে রওনা হলো নিজেদের বাড়ির উদ্দেশ্য।

আজ যে করেই লতার সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন। এভাবে লুকোচুরি খেলার মানে কি? এই মেয়ে ওকে নিজের হাতে মেরেই ফেললেই তো পারে। এভাবে গোপনে, আড়ালে থেকে ওকে না দেখার অসুখে রেখে মেরে ফেলার দরকারটা কি? শাদাদ ভাই যতবার কাজের ফাঁকে ছুটিতে এসেছে ক্লান্ত শরীর আর লতার জন্য উদ্বিগ্ন হৃদয়টাকে নিয়ে। ঠিক ততবারই মনে আশা রেখে এসেছে যে, এবার হয়তো বাড়িতে ফিরে গেলে হয়তো লতাকে দেখতে পাবে। কিন্তু, প্রতিবার ফলাফল শূন্য। বাড়িতে ফিরে লতাকে দেখতে পায়নি ক্লান্ত শাদাদ ভাই। কতবার লতার হোস্টেলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল একটিবার ওকে মুখখানা দেখার জন্য। কিন্তু, তিনি তো শাদাদ ভাইয়ের আসার খবর পেলে শরীর খারাপের কিংবা পরীক্ষার অজুহাত দেখিয়ে বের হতেন না। এদিকে গার্লস হোস্টেলে পুরুষদের ভেতরে এলাও করে না। নয়তো, ভেতরে গিয়ে কানের নীচে দুচারটা থাপ্পড় লাগিয়ে দিতো শাদাদ ভাই

আজ সবকিছুর হিসাব নিবে কড়ায়গণ্ডায়। লতা কি চায় আজ জানতে চাইবে সবটা? নিজের বাইকে চড়ে রওনা হলো শাদাদ ভাই। মনের মাঝে তখন হাজারো উৎকন্ঠা।

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে