বিরহ ভালোবাসা পর্ব-১১

0
685

#বিরহ_ভালোবাসা
#Tahmina_Akhter

১১.

জাভেদ ভাইদের বাড়িতে যাওয়ার পর রবিন সাহেব আমার পেছনে হাত ধুয়ে পরে আছেন। মানে হলো একমিনিটের জন্যেও আমাকে একা ছাড়ছেন না। কি খাব? অনুষ্ঠান ইনজয় করছি কি-না? উনার দেয়া শাড়িটা কি আমার পছন্দ হয়নি? শাড়িটা পরলাম না কেন? ইত্যাদি ইত্যাদি।

রুপা আপার দেবর বলে আজ রবিন সাহেবকে কিছুই বলিনি। অন্যকেউ হলে মুখে ট্যাপ লাগিয়ে বাথরুমে বসিয়ে রাখতাম।

জাভেদ ভাইকে হলুদ পরিয়ে দেয়ার জন্য জাভেদ ভাইয়ের আম্মু বারবার অনুরোধ করছিলেন আমাকে। কিন্তু, অন্য কারো গা ছুয়ে হলুদ লাগানোর ব্যাপারটা আমার কাছে বিশ্রী মনে হয়। কিন্তু, গুরুজনের অনুরোধ ফেলতে পারব না আজ। তাই হাসিমুখে নূর আপা আর তর্সাকে নিয়ে জাভেদ ভাইকে হলুদ ছুঁয়ে দিলাম। জাভেদ ভাই আমাকে হলুদ ছুঁয়ে দিতে চাচ্ছিলেন এমন সময় হুট করে কোত্থেকে এসে রবিন সাহেব আমার কপালে হলুদ লাগিয়ে দিলেন। স্তব্ধ হয়ে খানিকক্ষণ রবিন সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কাউকে কিছু না বলেই সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে স্টেজ থেকে নেমে সোজা জাভেদ ভাইদের বাড়ি থেকে বের হয়ে আমাদের গাড়িতে গিয়ে বসে রইলাম।

কিছু সময় শুধু নিজেকে দিতে চাচ্ছিলাম। এই যে রবিন সাহেব আমার প্রতি আলাদা খেয়াল রাখছেন এটা কেন করছেন তিনি? কারণ, তিনি হয়তো আমাকে পছন্দ করেন। দেখতে শুনতে উনি কিন্তু মোটেও খারাপ নন। হাইটে শাদাদ ভাইয়ের সমান সমান হবেন। গায়ের রঙ শাদাদ ভাইয়ের থেকেও উজ্জ্বল। গালে ঘন দাড়ি আছে। হাসেনও খুব মিষ্টি করে। কিন্তু, আমার উনাকে ভালো লাগে না। আমার ভালো লাগে আমাকে ভীষন কষ্ট দেয়া শাদাদ ভাইকে। যাকে প্রতিমূহর্তে ভালোবাসি বলতে না পারার তীব্র যন্ত্রণায় আহত আমি। শাদাদ ভাই যখন মিষ্টি চোখে তাকিয়ে মুচকি হাসি দেন, তখন আমার মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মানুষটা হাসছে। তার খুশিতে কারো নজর না লাগুক এই প্রার্থনা করতে থাকা আমার মন। কিন্তু, মানুষটা কেমন যেন! একটিবারও আমার মনের ভাষা কিংবা চোখের ভাষা বুঝতে পারেন না তিনি?

কথাগুলো ভাবতে ভাবতে লতার চোখের পানি গাল গড়িয়ে পরে। মনে মনে শাদাদ ভাইকে পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট গালাগাল করছিল লতা। এমনসময় গাড়ির জানালা ভেদ করে একটি হাত এসে লতার চোখের পানি মুছে দেয়। লতা ভয় পেয়ে আঁতকে উঠল। তাকিয়ে দেখলো শাদাদ ভাই জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। লতা জানালার পাশ থেকে সরে বসলো। এবার কি করে লতাকে স্পর্শ করবে?

লতার কান্ড দেখে শাদাদ ভাই কিছু বললেন না। শুধু বড়ো একটা দীর্ঘ শ্বাস চেপে একটানে গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে গিয়ে লতার সঙ্গে চেপে বসলো। লতা সরে যাচ্ছিলো কিন্তু শাদাদ ভাই লতার হাত শক্ত করে চেপে ধরলেন। চুড়ির সঙ্গে হাতে চাপ লেগে লতা ভীষণ ব্যাথা পায়, চোখে জল চলে আসে। কিন্তু, শাদাদ ভাইয়ের এসব দেখার সময় কই? উনি তো জোর খাটাতে ব্যস্ত। লতা হাতের ব্যাথাটুকু সহ্য করতে না পেরে আস্তে করে বললো,

—- ব্যাথা পাচ্ছি। হাত ছাড়ুন।

লতার কান্না মাখা গলা শুনে শাদাদ ভাই হাত ছেড়ে দিলেন। লতা নিজের ডানহাতটা উচু করে দেখলো, লাল হয়ে গেছে আরেকটু হলে হয়তো চুড়ির চাপ লেগে হাতটাই কেটে যেত। শাদাদ ভাই ফোসফাস করতে করতে লতার গালে ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে বললো,

— যার তার সঙ্গে হাসাহাসি করা হচ্ছে। হলুদ মাখামাখি হচ্ছে। কই জীবনেও তো দেখিনি কাউকে তুই হলুদ পরিয়ে দিয়েছিস কিংবা কেউ তোকে হলুদ পরিয়ে দেয়ার সাহস করেছে? কিন্তু, ওই ছেলেটার সাহস কি করে হলো তোর এই জায়গায় ছুঁইয়ে দেবার?

কথাটি বলে শাদাদ আলতোহাতে লতার হলদে কপালে টোকা দেয়। লতা চোখ বন্ধ করে ফেলে জবাব দিতে চাচ্ছে না সে। কিন্তু, শাদাদ ভাই তো নাছোরবান্দা। তিনি জবাব না শুনে আজ নড়বে না বোধহয়। শাদাদ ভাই এরইমাঝে একটি ভয়ানক কান্ড ঘটালেন। লতার চোখদুটো যেন কোটর থেকে বের হওয়ার মতো উপক্রম।

টিস্যুতে করে হলুদ এনেছিলেন বোধহয়। সেই হলুদটুকু লতার গালে এবং লেপ্টে দিয়ে ক্ষান্ত হয়ে তবেই গাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেন শাদাদ ভাই। এদিকে লতা রাগে-দুঃখে পারছে না হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদতে। এই জীবনের কোনো মানে আছে! কোত্থেকে পাগল-ছাগল সব এসে লতার সঙ্গে বাঁদরামি করে চলে যায়।

একে একে সবাই চলে এলে গাড়ি নিয়ে রওনা হয় নিজেদের বাড়ির উদ্দেশ্য। এবার লতা নূর আপার সঙ্গে বসে এসেছে। শাদাদ ভাই লতার সঙ্গে জোর করে বসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, লতার একটাই কথা ওর নাকি আজ ছেলেদের গায়ের পারফিউম নাকে লাগছে আর বমি বমি পাচ্ছে। তাই পলাশ, শিপলু কিংবা শাদাদ ভাই কেউ যেন ওর পাশে না বসে। ব্যস, আর কেউ সাহস করেনি লতার পাশে বসার জন্য।

একমাত্র শাদাদ ভাই জানে লতা যে মিথ্যা কথা বলছে। এই মেয়ের বাহানা তো দিতেই হবে। মাথায় তো শয়তানি বুদ্ধি কিলবিল করে কি করে শাদাদ ভাইকে নিজের কাছ থেকে দূরে রাখা যায়। শয়তান মাইয়া?

জাভেদ ভাইদের বাড়ি থেকে হলুদ দিয়ে রুপা আপাকে হলুদ পরিয়ে দেয়া হলো। একে একে সবাই রুপা আপাকে হলুদ পরিয়ে দেয়। বাকি শাদাদ ভাই আর লতা। অদূরে দাঁড়িয়ে নিজের বড়ো বোনকে দেখছে শাদাদ। বোনটা আজ বাড়িতে আছে। আগামীকাল ঠিক এই সময়ে বোনটা এই বাড়িতে থাকবে। মাঝে মাঝে শাদাদ ছুটি পাবে তখন হুট করে এসে বোনকে চমকে দেয়া যাবে না। মাকে তো ছোটবেলা থেকে পায়নি শাদাদ। মা সমতূল্য বড়ো বোনের কাছ থেকে মায়ের মমতা-আদর পেয়ে অভ্যস্ত শাদাদ। বোনটা চলে গেলে বড্ড একা হয়ে যাবে শাদাদ। হুট করে শাদাদের চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে চোখের জমানো জলে। সবার আড়ালে এসে অতি সন্তর্পনে টিস্যু দিয়ে চেপে চোখের পানি মুছে ফেলে। তারপর, হাসিমুখে এগিয়ে যায় বোনের দিকে কারণ বোনের চোখে অপেক্ষা দেখতে পাচ্ছে।

শাদাদ রুপা আপার কপালে এবং গালে হলুদ ছুঁয়ে দিয়ে একটু দূরে সরে দাঁড়ায়। কারণ, মধু এবার হলুদ লাগাবে। কিন্তু, মধুটা আছে কোথায়? আসার পর থেকে গায়েব! এমনসময় সিঁড়ি বেয়ে নামছিল শাদাদের মধু সবুজ রঙের কটি যুক্ত কূর্তি আর ধুতি সালোয়ার পরে। চুলগুলো ছেড়ে দেয়া। পুরাই পাকিস্তানি নায়িকার মতে দেখাচ্ছে আমাদের মধুকে। শাদাদ ভাই ঢোক গিলে অন্যদিকে তাকালেন। কিন্তু, বেহায়া চোখের দৃষ্টি ঘুরে ফিরে সেই মধুর দিকে যাচ্ছে। শাদাদ ভাই খেয়াল করলেন মধুর কপালে, গালে হলুদ নেই। তারমানে, সব ধুয়েমুছে তারপর তৈরি হয়ে নীচে এসেছেন।

লতা রুপা আপার সামনে বসে একটু করে হলুদ নিয়ে গালে লাগিয়ে দিলেন। রুপা মুচকি হেসে লতাকে বললো,

— এবার তো আমার মনে হচ্ছে, আমার বিয়ের পর তোর বিয়ে। তাই তোকেই আমার হলুদটুকু লাগিয়ে দিলাম। যেন অতিশীঘ্রই তোর বিয়েটা সম্পন্ন হয়।

কথাটি বলে শাদাদের দেয়া কপালের হলুদটুকু এনে লতার কপালে লাগিয়ে দেয় রুপা। দূরে দাঁড়িয়ে বোনের কান্ড দেখে অবাক হয় শাদাদ। কারণ, লতার আগেই শাদাদ রুপা আপাকে হলুদ দিয়েছিল আর কপালে শুধু শাদাদ হলুদ লাগিয়েছিল আর কেউ নয়। তবে, কি রুপা ইচ্ছে করে শাদাদের দেয়া হলুদ লতাকে ছুঁয়ে দিয়েছে?

হলুদের অনুষ্ঠান সম্পন্ন। আগামীকাল সকাল থেকে বিয়ের অনুষ্ঠানের তোড়জোড় শুরু। শেষ রাতে থেকে বাবুর্চিরা কাজ শুরু করবেন। এক হাজার মানুষের আয়োজন বলে কথা।

মধ্যরাত হয়ে যায় রুপা আপার হাতে-পায়ে ভর্তি মেহেদি লাগিয়ে দিতে। রুপা আপার হলে সবাই চেপে ধরে আমাকে মেহেদী লাগিয়ে দিতে। কিন্তু, মা এসে সকলের মাঝে থেকে আমাকে উঠিয়ে মায়ের ঘরে নিয়ে যায়। আমি আমার মায়ের এমন আচরণের সঙ্গে পরিচিত না। কারণ, সবার অনুরোধকে অগ্রাহ করে মা আমাকে নিয়ে এসেছেন। অথচ,মা সবার আগে বাইরের মানুষকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করেন। কি হলো আজ মায়ের?

লতা দাঁত দিয়ে নখ কাটতে কাটতে ভাবছিল। এমন সময় দরজা লক করার শব্দ পেয়ে নড়েচড়ে বসে লতা। লতার মা এগিয়ে এসে চুপটি করে লতার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কিছুটা সময় চুপ থেকেই সর্বপ্রথম যে কথাটি বললেন,

— আমাদের পরিবারের কখনো আত্মীয়ের মাঝে আত্মীয়তা হয় না, এটা জানিস তো লতা?

লতা মাথা নাড়িয়ে হ্যা বোঝায়। লতার মা লতার মাথায় হাত রেখে বললেন,

— তাহলে, শাদাদকে ভুলে যা তোর মনে শাদাদের জন্য অনুভূতি থেকে থাকে।

লতা চমকিত দৃষ্টিতে তাকায় ওর মায়ের দিকে। ওর মা কি করে জানলেন এই কথা? লতা মাথা নিচু করে ফেলে। কি জবাব দেবে ওর মাকে? কিন্তু, শাদাদ ভাইকে ভুলে যাওয়া লতার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু, শাদাদ ভাইয়ের মনে কি লতা আছে? যদি না থাকে তবে একা একা ওর মায়ের কথার বিরুদ্ধে লড়তে যাওয়া ঠিক হবে না। কার জন্য লড়বে লতা?

সে রাতের পর থেকে লতা আগের থেকে আরও গম্ভীর হয়ে যায়। একদিকে মায়ের আদেশ অন্যদিকে নিজের ভালোবাসার মানুষকে চট করে ভুলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ? যে কিনা চোখের সামনে দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা ঘুরঘুর করে। চট করে মিষ্টি চোখে তাকায় আবার চোখে চোখে কঠিন ধমক দেয় তাকে কি করে ভুলে যাওয়া যায়? জানা নেই লতার। কিন্তু, শাদাদ ভাইকে ভুলে যাওয়ার এই জার্নিটা কঠিনতম হবে লতার জন্য।

লতা যে শাদাদ ভাইকে ভুলে যাওয়ার জন্য মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হচ্ছে সেটা কি আমাদের শাদাদ ভাই জানবে? যেদিন জানতে পারবেন সেদিন লতার কি অবস্থা হবে কে জানে? লতার কথা বাদ কিন্তু এই সম্পর্কের ক্ষেত্রে নিজের পরিবারকে কি করে মানাবেন শাদাদ ভাই?

#চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে