বিবর্ণ ভালোবাসা পর্ব-০৬

0
739

#বিবর্ণ ভালোবাসা
#Tahmina_Akhter

৬.

রাতটা ততটুকুই উপভোগ্য ছিল যতক্ষণ অব্দি দুজন নর-নারী একে অপরের অতি নিকটে অবস্থান করছিল। একসময় বিদায়ের ঘন্টা বেজে ওঠে। রুদ্রের প্রেমময়ী শহর আজ বিভীষিকাময় শহরে রুপান্তরিত হতে যাচ্ছে। হোক না প্রেমময়ী রাতটুকু অল্প সময়ের। তবুও, তো আজ সে তনুজার বুকের মাঝে মাথা রেখে শান্তির প্রশ্বাস ফেলেছে।

শেষরাতে মুয়াজ্জিনের আজান শুনে ঘুমন্তরত তনুজাকে নিজের নগ্ন বুক থেকে সরিয়ে উঠে বসে রুদ্র। ধীরপায়ে এগিয়ে যায় স্নানঘরের দিকে। মাঘমাসে এই সময়টাতে গোসল করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। কিন্তু, রুদ্রকে দেখে মনে হচ্ছে ওর কাছে এখন এই বাড়ি থেকে চটজলদি বের হয়ে যাওয়াটা জরুরি। গোসল শেষ করে নিজের কামরায় না গিয়ে মেহমানের জন্য বরাদ্দকৃত ঘরটায় চলে যায় রুদ্র। গতকাল, ব্যাগ এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র গুছিয়ে রাখে রুদ্র। হলদে রঙের টিশার্ট, বাদামী রঙা প্যান্ট, চোখে সানগ্লাস পরে একবারে তৈরি হয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসে রুদ্র। যেহেতু এখন ফজরের ওয়াক্ত হয়েছে তারমানে সালেহা ঘুম থেকে জেগে ওঠেছে। রুদ্র তড়িঘড়ি করে ওর দাদীজানের ঘরে চলে যায়। গিয়ে দেখে ওর দাদিজান সবেমাত্র বিছানা থেকে নামছেন। রুদ্রকে অসময়ে নিজের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সালেহা দ্রুতপায়ে নাতির কাছে চলে যান। ভয়ার্ত স্বরে রুদ্রকে জিজ্ঞেস করছেন,

— রুদ্র অসময়ে তুমি এখানে? তনু ঠিক আছে তো?

রুদ্র এগিয়ে এসে মুখে মুচকি হাসি ঝুলিয়ে ওর দাদীজানের হাত ধরে বললো,

— আমি ফিরে যাচ্ছি, দাদিজান। তনুজার খেয়াল রাখবেন।

রুদ্রের ফিরে যাওয়ার কথা শুনে থমকে যায় সালেহা। নাতির হাত সরিয়ে দিলেন। মুখ ফিরিয়ে চলে যেতে যেতে বললেন,

— তোমার আমানতের খেয়াল আমি কেন রাখব? তাকে তুমি সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছো না কেন?

রুদ্র ওর দাদীজানের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে “আল্লাহ হাফেজ” জানিয়ে বের হয়ে আসে। দুই কদম পেরুতে নিজের কামরার সামনে এসে থমকে দাঁড়িয়ে পরে রুদ্র। মন বলছে শেষবারের মতো একটিবার তনুজাকে দেখা নেওয়া যাক। কিন্তু, মস্তিষ্ক বলছে, আজ যদি মনের কথা শুনে তবে রুদ্রকে মুখ থুবড়ে পরতে হবে। মনটাকে শক্ত করে বাঁধতে হবে। নয়তো, পরিকল্পনা মোতাবেক রুদ্র কিছুই করতে পারবে না।

মন এনং মস্তিষ্কের স্নায়ুযুদ্ধে মনের বিজয় হলো। রুদ্র বিনাশব্দে দরজা খুলে ভেতরে উঁকি দেয়। তনুজা বেঘোরে ঘুমিয়ে আছে। শরীরের কাপড় এলোমেলো হয়ে আছে। রুদ্র দরজা খুলে তনুজার কাছে এগিয়ে যাচ্ছে। খাটের কাছাকাছি এসে রুদ্র দাঁড়িয়ে থাকে। তনুজার মুখখানি দেখতে থাকে অনিমেষ দৃষ্টিতে। মনে হচ্ছে যেন তনুজার মুখশ্রী মুখস্থ করছে। একসময় মনের অদম্য ইচ্ছেকে পূরণ করতে উপুড় হয়ে তনুজার কপালে চুমু দেয়। সোজা হয়ে ওঠে দাঁড়ায় রুদ্র। তারপর, পেছনের দিকে না তাকিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হয়। রুদ্র যদি একটিবার পেছনে তাকিয়ে দেখতো তবে দেখতে পেতো তনুজা অশ্রুসিক্ত নয়নে রুদ্রকে বিদায় জানাচ্ছে।

১৯শে ফেব্রুয়ারী,

আজ রুদ্র ফিরে আসছে।দীর্ঘ দেড় মাস অতিবাহিত হওয়ার পর আজ রুদ্রের পদধূলি তার জন্মভূমিতে পরবে। জমিদার বাড়িতে যেন আনন্দের ঢেউ বইছে। চারদিকে সাজ সাজ রব। সালেহা এবং রুক্মিণী মিলে দাসীদের বিভিন্ন কাজের হুকুম দিচ্ছে।

— ছোট সাহেবের বৌকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না বড়ো মা।

হতদন্ত হয়ে এইবাড়ির একজন বিশ্বস্ত দাসী সালেহার কাছে এসে জানালেন তনুজার নিখোঁজ হবার সংবাদ। সালেহা অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইলেন দাসীর দিকে। রুক্মিনি এগিয়ে এসে নিজের শ্বাশুড়িকে জিজ্ঞেস করলেন,

— কি হয়েছে, আম্মা?? আপনাকে এতটা বিচলিত দেখাচ্ছে কেন?

— তনুজাকে পুরো বাড়িতে খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছে না। রুদ্র এসে যদি তনুজাকে দেখতে না পায় তবে আমি কি জবাব দিব?

মনের অস্থিরতা বৃথা লুকানোর চেষ্টা করে কথাটি বললেন সালেহা। রুক্মিণী কিছু একটা ভেবে দাসীকে জিজ্ঞেস করলো,

— রুদ্রের কামরায় দেখেছো? তনুজা সেই ঘরে থাকতে পারে। একটি দেখে এসো তো।

দাসী আদেশ পাওয়া মাত্র একদৌঁড়ে রুদ্রের কামরার দিকে পা চলে যায়। পিছু পিছু সালেহা এবং রুক্মিণী রুদ্রের কামরার উদ্দেশ্য হাঁটতে শুরু করে।

পশ্চিমের হাওয়া ; অদূরে ঘাট বাধানো পুকুর। পুকুরের চারপাশে নারিকেল আর সুপারি গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বাতাসের সাথে সাথে গাছের ডালপালা গুলো এপাশ থেকে ওপাশে এলিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে বিশাল বটগাছের মগডাল থেকে কোকিলের কুহু কলরবে চারদিকে এক অন্যরকম সুর তৈরি হচ্ছে। তপ্ত দুপুরে ঝাপসা গরমে পুরো শরীর থেকে যেন আগুন বের হচ্ছে। তবুও, আজ রুদ্রের ঘরে বসে থাকতে ভীষণ ভালো লাগছে তনুজার। পুরো জমিদার বাড়ির এক একটি ইটের কোণায় যেন কিসের হাহাকার মিশে আছে। যার দরুন তনুজার দম বন্ধ হয়ে আসে। তাই তো সেই বিশ্রী অনুভূতি থেকে বাঁচতে তনুজা রোজ রুদ্রের ঘরে এসে বসে থাকে। সময় কেটে যায় অতি দ্রুত। মাঝে মাঝে রুদ্রের ঘরে থাকা বুক সেলফ থেকে বই বের করে অতি মনোযোগ নিয়ে পড়া হয়। কখনোবা রুদ্রের ঘর দক্ষিণের দেয়ালে ফ্রেমে বাঁধানো রুদ্রের ছবির দিকে তাকিয়ে তনুজা মনে মনে হাজারো কথা লেনদেন করে রুদ্রের সঙ্গে। ছবিতে হাসৌজ্জ্বল রুদ্র শুধু তনুজার কথাগুলো শুনেই যায় পাল্টা জবাব দেয় না।

হলদে রঙের তাঁতের শাড়িতে আজ তনুজাকে অন্যরকম দেখাচ্ছে। যেমন: নতুন কনেকে হলুদের উদ্দেশ্য হলুদ শাড়ি পরানো হলে যেমন দেখানো হয় ঠিক তেমন। ফুলের গহনা পরিধান করলে হয়তো তনুজাকে দেখলে কেউ নতুন কনে ভাবত!

— তুই এখানে, তনু! আমরা সবাই তোকে খুঁজতে খুঁজতে পাগলপ্রায় দশা। কাউকে না জানিয়ে এই ঘরে বসে আছিস কেন?

নানীজান সালেহার কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে ঘাড় ফিরিয়ে দরজার দিকে তাকালে তনুজা দেখতে পায়, রুদ্রের বড়ো মা, ওর নানীজান এবং এই বাড়ির একজন দাসী তনুজার দিকে তাকিয়ে আছে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে।

তনুজা জানালার কাছ থেকে সরে এসে সর্বপ্রথম মাথায় শাড়ির আঁচল দিয়ে ঘোমটা দিল। তারপর, মাথা নিচু করে নানীজান সালেহার সামনে দাঁড়িয়ে বললো,

— নানীজান, আমি বুঝতে পারিনি আপনারা এতটা অস্থির হয়ে পরবেন। খুবই লজ্জিত আমি।

তনুজার কথা শুনে সালেহা মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন,

— তোকে না পেয়ে আমি অস্থির হয়েছি ঠিকআছে। কিন্তু, তোর স্বামী এসে যদি তোকে দেখতে না পায় তখন আমি কি জবাব দিব? ব্যাপারটা ভাবতে গিয়ে আরও অস্থির হয়ে পরেছিলাম আমি। জানিসই তো রুদ্র চলে যাবার সময় আমার কাছ তোকে আমানত হিসেবে রেখে গিয়েছে। এখন সেই আমানতের খিয়ানত করি করে করে? যাক এখন রুদ্র এলেও আমার চিন্তা নেই।

সালেহার কথার মানে বুঝতে না পারছে না তনুজা। রুদ্র এখানে আসবে কেন? এই না কিছুদিন হলো দেশের বাইরে গিয়েছে। বছর দুয়েক গেলে তবেই না দেশে ফিরবে।

— আবার কি ভাবছিস? রুদ্র বাড়িতে ফিরে আসার আগে গোসল সেড়ে নতুন শাড়ি পরে তৈরি হয়ে নে। জানিসই তো স্ত্রীর সৌন্দর্য দেখার হক একমাত্র তার স্বামীর।

সালেহা কথাটি বলে তনুজার হাত ধরবে তার আগে পেছনে থেকে কেউ এসে বলছে,

— আমার ঘরে এত লোকজন ভিড় জমিয়েছে কেন?

চেনা সুর কর্নকুহুরে পৌঁছেতেই তরিৎ গতিতে দরজার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই তনুজার পা শীতলের ন্যায় জমে যায়। বহুদিন পর দৃষ্টি আড়ালে থাকা মানুষটা হুট করে যখন দৃষ্টির অতি নিকটে অবস্থান করে তখন কেমন অনুভূত হয় আজই অপলব্ধি করতে পেরেছে তনুজা! পানির পিপাসাযুক্ত একজন মানুষ যেমন পানি দেখলে খুশি হয়। ঠিক তেমনি একপলক রুদ্রকে দেখার দৃষ্টির পিপাসা মিটে গেছে তনুজার।

একমাসে কি রুদ্র কিছুটা শুকিয়ে গেছে? কিন্তু, গায়ের রঙ আগের থেকে উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। চাপা দাঁড়ি যেন আরও ঘন হয়ে গজিয়েছে। কালো রঙের শার্ট আর ব্লু রঙের জিন্স প্যান্ট। শার্টের হাতা কনুই অব্দি গুটিয়ে রেখেছে।

তনুজার পখর দৃষ্টিকে লক্ষ করছে রুদ্র। তনুজাকে নিজের বুকের মাঝে চেপে ধরতে ইচ্ছে করছে ভীষণ। কিন্তু, গুরুজনেরা সামনে থাকায় সেই ইচ্ছেকে বলিদান দিয়ে ভদ্রলোক সেজে সকলের মধ্যমনি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

— তুমি এসেছো রুদ্র! আমরা তোমার ফিরে আসার অপেক্ষায় ছিলাম। এবার হাতমুখ ধুয়ে তাড়াতাড়ি খাবার খেতে চলে এসো। আর, তনু তুই চলে আসিস রুদ্রের সঙ্গে। চলো বৌমা চলো। দাসীকে বলে খাবার গুলো টেবিলে সাজাতে হবে।

কথাগুলো ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছিলেন সালেহা। তনুজা রুদ্রের সামনে একা দাঁড়িয়ে থাকবে এই কথাটি স্মরণে আসতেই সালেহাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— নানীজান আমি আপনাদের সাথে যাব। আপনাদেরকে সাহায্য করতে পারব আমি।

তনুজার কাঁপা কন্ঠে বলা কথাটি শুনে রুদ্র, রুক্মিনি এবং সালেহা কিছু একটা আন্দাজ করতে পারে। রুদ্র ঘরে ঢুকে সোজা খাটের ওপরে গিয়ে বসে। আর সালেহা তনুজাকে চোখ রাঙানি দিয়ে বললো,

— আমি যা বলেছি তাই কর। তুই রুদ্রকে সাথে নিয়ে তবেই আসবি।

চলে গেলেন সালেহা। আর তনুজা হাল ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।

রুদ্র তনুজার মুখের দিকে তাকিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তনুজাকে দেখছে। আগের আর এখনকার তনুজার মাঝে বিস্তর ফারাক আছে তাই বুঝার চেষ্টায় আছে রুদ্র। আগের থেকে স্বাস্থ্য কিছুটা উন্নিত হয়েছে। চেহারা যেন আরো লাবন্যময় হয়ে ওঠেছে। দেখতেও বেশ আদুরে দেখাচ্ছে। ছোট বাচ্চাদের দেখলে যেমন গাল হাজারটা চুমু খেয়ে আর গাল টেনে ধরে আদর করতে ইচ্ছে করে। ঠিক তেমনি তনুজাকে দেখে রুদ্রের তেমনি আদর করতে ইচ্ছে করছে।

লজ্জা এবং অস্বস্তি দুটোই আবিষ্ট করে রেখেছে তনুজাকে। মাথা নিচু করে রুদ্রের দৃষ্টি থেকে বাঁচতে চাইছে তনুজা। কিন্তু, এভাবে কি আর বাঁচা যায়?

— তনুজা???

রুদ্রের ডাক শুনে তনুজা চোখ বন্ধ করে ফেলে। হটাৎ করে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে। গায়ে কেমন শীত শীত অনুভূত হচ্ছে! একটা ডাক শুনে মূহুর্তের মাঝে শরীরে এতটা পরিবর্তন হতে পারে?

— তোমাকে আমি সঙ্গে করে নিয়ে যেতে এসেছি। যাবে তো তুমি আমার সঙ্গে?

তনুজা চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে রুদ্রের তরে অবিশ্বাস্য চোখে। তবে, কি রুদ্র তাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে এসেছে?

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে