বিবর্ণ ভালোবাসা পর্ব-০৫

0
775

#বিবর্ণ ভালোবাসা
#Tahmina_Akhter

৫.

— আগামীকাল ভোর পাঁচটায় আমার ফ্লাইট। মালদ্বীপে ফিরে যেতে হবে।

অনর্গল কথাগুলো রুদ্র পাশ ফিরে শুয়ে পরে। তনুজা চোখ বন্ধ করেছিল সবে। রুদ্রের ফিরে যাওয়ার কথা শুনে চোখ খুলে তাকিয়ে রইলো মাথার ওপরে থাকা ছাঁদের দিকে।

দু’জন মানুষ একই ছাঁদের নীচে, একই বিছানায় শুয়ে আছে। খানিকটা দূরত্ব। তবে অতটা দূরত্ব নয়। দুজনের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ দু’জনেই শুনতে পাচ্ছে। হৃদয়ে হাজারো কথা। কিন্তু, মুখে নীরবতা। হয়তো, এইজন্যই বলে পাশাপাশি থেকেও মাঝে মাঝে আমরা অনেক দূরত্বে অবস্থান করি। চাইলেও এতখানি দূরত্ব কমিয়ে কাছাকাছি আসা যায় না।

বহুক্ষণ পেরিয়ে যাওয়ার পর তনুজার মনে হলো রুদ্রের কাছ থেকে এখনি জেনে নেয়া উচিত কেন রুদ্র সেদিন জোরজবরদস্তি করে ওকে বিয়ে করেছে?

তনুজা পাশ ফিরে রুদ্রের দিকে তাকালো। রুদ্র জেগে আছে। তনুজাকে পাশ ফিরতে দেখে রুদ্র পাশ ফিরতে চাইলে তনুজা হাত বাড়িয়ে রুদ্রকে বাঁধা দেয়। রুদ্র নিজের কাঁধে তনুজার হাতের স্পর্শ পেয়ে স্তব্ধ হয়ে পরে। এমন সময় জানালা দিয়ে উত্তরের বাতাস এসে রুদ্রকে ছুঁয়ে চলে যায়। হিমশীতল হাওয়ার স্পর্শে হোক কিংবা তনুজার স্পর্শে রুদ্রের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে।

রুদ্রের কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে তনুজা হাত সরিয়ে নেয়। শোয়া থেকে উঠে বসে। দুই হাঁটুতে মুখে গুঁজে রুদ্রকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— কেন বিয়ে করেছেন আমায়? দুদিন হলো তবুও কি জানতে পারব না আমি, কেন আপনি আমাকে বিয়ে করলেন?

রুদ্র সেই আগের মতো চুপ করে রইলো। রুদ্রের এমন নীরবতা দেখে তনুজার চোখে জল ভরে ওঠে। দু-চোখের কোল ঘেঁসে জল গড়িয়ে পরতে থাকে। কান্নারত কন্ঠে রুদ্রকে ফের জিজ্ঞেস করে তনুজা।

রুদ্র তনুজার কান্নারত কন্ঠ শুনে পাশ ফিরে তনুজার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে আহত দৃষ্টিতে। এতকাল রুদ্র জেনে এসেছে এবং দেখে এসেছে তনুজা খুবই শক্ত এমন কঠিন মন-মানসিকতার অধিকারী। হুট করে কেঁদে ফেলার মতো মেয়ে নয় তনুজা। যেদিন জীবনের চরম ব্যর্থতার জন্য সমাজ ওকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছিল সেদিনও তনুজা কাঁদেনি। তবে, আজই কেন? নাকি নিজের জীবনের সঙ্গে একই সুতোয় বাঁধা পরা রুদ্রকে নিজের জীবনের গুরত্বপূর্ণ স্থানে মানতে পারছে না তনুজা?

গায়ের কাঁথা সরিয়ে শোয়া থেকে উঠে রুদ্র। খাটের সাথে বালিশ রেখে তাতে হেলান দিয়ে বসে রুদ্র। রুদ্রকে উঠে বসতে দেখে তনুজা অতি সন্তর্পনে চোখের জল মুছে নেয়। ভাগ্যিস, পুরো ঘর জুড়ে অন্ধকার বিরাজমান। রুদ্র যদি তনুজার চোখের জল দেখে ফেলত তবে মনে মনে তনুজাকে দূর্বল দলের লোক হিসেবে দেখত।

— তোমাকে আমি আরও আগে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। তখনও, তুমি রাজি ছিলে না তনুজা।

বহুকাল পর রুদ্রের মুখ থেকে নিজের পুরো নাম শুনে তনুজার বুকে কাঁপন ধরে যায়। তনুজাকে সবাই পুরো নামে কেউ ডাকে না। সবাই তনু বলে ডাকে। একমাত্র রুদ্র ছিল যে কি না তনুজা বলে ডাকত। তনুজার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। মনে হচ্ছে কিছু একটা গলায় বিঁধে আছে ; হয়তো সংকোচ!

রুদ্র দেখছে তনুজাকে মন ভরে। জানালা দিয়ে চাঁদের আলো ঘরে আসছে। সেই আলো এসে তনুজার গায়ে পরছে। সবুজ রঙা শাড়িতে অদ্ভুত সুন্দরী দেখাচ্ছে। গায়ের রঙের সাথে শাড়িটা বেশ ফুটেছে। মুখটা দেখা যাচ্ছে না। দীঘল কেশের আড়ালে ঢাকা পরেছে চাঁদ মুখখানা। পিঠের কাছ থেকে শাড়ি সরে যাওয়ায় ঘাড় থেকে কোমড় অব্দি মাঝখানে দেবে যাওয়া লম্বালম্বি খাঁজটা রুদ্রকে বেশ টানছে।

— আমি অতীত সম্পর্কে জানতে চাইনি। পুরনো স্মৃতি হারিয়ে গেছে আমার মন-মস্তিষ্ক থেকে। তাই নতুন করে সেই কালো অধ্যায় নতুন করে মনে করতে চাই না। আমি জানতে চাই কেন আপনি আমাকে বিয়ে করেছেন?

তনুজার কথা শুনে রুদ্র তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো।

— অতীত ভুলে গিয়েছো তুমি! বেশ ভালো। এখন তুমি আমার কথা শুনো। অতীতে তুমি রুদ্রের ভালোবাসাকে অনাদরে নিজ হাতে মনের গহীনে মাটি চাপা দিয়েছো। কিন্তু, বর্তমান অর্থ্যাৎ আজকের এই রাতে তুমি কিন্তু সেই রুদ্রের ঘরে, তারই বিছানায়, তারই পাশাপাশি বসে আছো, তারই স্ত্রী হয়ে। ভাগ্যের ফেরে তুমি মেহরাব মুস্তাকিম রুদ্রের স্ত্রী। এবার বলো, তুমি কি করে অতীত ভুলে গেলে? আমি ঠিক যতবার তোমার চোখের আসব ঠিক ততবার তোমার অতীত তোমার চোখের সামনে দৃশ্যমান হবে।

তনুজা নিজের ভেতরে রাগটুকু অতি সন্তর্পনে চাপা দিয়ে রুদ্রকে বললো,

— আমার প্রশ্নের জবাব নিশ্চয়ই এই কথাগুলো নয়?

তনুজার কথার জবাবে রুদ্র গা জ্বালানো হাসি দিয়ে বললো,

— সঠিক সময় এলে জবাব আপনা-আপনি তোমার কাছে পৌঁছে যাবে। ততদিন না হয় শান্তিতে বসবাস করো এই জমিদার বাড়ির একমাত্র ওয়ারিশ রুদ্রের অর্ধাঙ্গিনী হয়ে।

তনুজা রুদ্রের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। এই রুদ্রকে সে চেনে না। চোখের সামনে থাকা রুদ্রের চোখে কি যেন দেখতে পাচ্ছে তনুজা! হয়তো, তনুজাকে ধ্বংস করার অদম্য ইচ্ছা। অথচ, বছরখানেক আগে রুদ্রকে দেখলে মনে হতো ভোরবেলার পবিত্র বেলি ফুল।

রুদ্র তনুজার ওমন গভীর চাহনি থেকে বাঁচার জন্য খাট থেকে নেমে ঘর থেকে বের হয়ে চলে যায়। তনুজা রুদ্রকে আঁটকায় না। হয়তো, রুদ্রের চলে যাওয়াটা এখন তনুজার জন্য স্বস্তিদায়ক।

তনুজা এক পাহাড়সম দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে বালিশে মাথা পেতে শুয়ে পরে। ঘুমানোর জন্য ব্যর্থ চেষ্টা করে। ব্যর্থ চেষ্টা একসময় সফল হয়। তনুজা ঘুমের ঘোরে হারিয়ে যায়।

গভীর রাত ; আকাশে তারাগুলো মিটমিটিয়ে জ্বলছে। চাঁদ তখন ঠিক মাথার ওপরে। রুদ্র বারান্দায় বসে সিগারেটের ধোঁয়া উড়াতে ব্যস্ত। এমন সময় রুদ্রের দৃষ্টি গেল সেদিনের দেখা পরিত্যক্ত জমিদার বাড়ির উঠোনের মাঝে। কে যেন হাতে হারিকেন নিয়ে দ্রুতগতিতে হেটে পুরনো জমিদার বাড়িতে ঢুকে পরেছে? জোৎসনার আলোয়ে যতটুকু রুদ্র দেখছে ততটুকুতে বুঝা সম্ভব হলো না পুরনো জমিদার বাড়িতে ঢুকে পড়া মানুষটা নারী নাকি পুরুষ। রুদ্র ভ্রু জোড়া কুঁচকে তাকিয়ে রইলো উঠোনের দিকে।

হুট করে রুদ্রের মনে ভয়ের দানা বাঁধতে লাগল। হাতের সিগারেট পায়ের নীচে ফেলে পা দিয়ে পিষে দ্রুত পায়ে নিজের কামরার দিকে পা বাড়ায় রুদ্র।

কামরায় প্রবেশ করে দ্রুত দরজা খিল এঁটে দেয়। হাত বাড়িয়ে লাইট অন করে। জানালা দুটো আঁটকে খাটের ওপর বসে রুদ্র। রুদ্র ঘেমে নিয়ে একাকার। গায়ের পাঞ্জাবি খুলে ছুঁড়ে ফেলে দেয় ঘরের এককোনায়। ফ্যানের বাতাসও যেন রুদ্রের শরীরকে শীতল করতে পারছে না। রুদ্রের মনে হচ্ছে ও ভীষন তৃষ্ণার্ত। হাত বাড়িয়ে টেবিলসাইডের ওপর থেকে জগটা নিয়ে ঢকঢক করে বেশ খানিকটা পানি পান করে রুদ্র। ধীরে ধীরে রুদ্রের শরীর ঠান্ডা হতে থাকে।

এমন সময় তনুজার কথা স্মরণে আসে রুদ্রের। চোখ ঘুরিয়ে দেখতে পেলো তনুজা গভীর ঘুমে। ঘনপল্লব আঁখি যুগল স্থীর হয়ে আছে। জেগে থাকলে হয়তো বারবার পলক ফেলত ।

রুদ্রের মন হচ্ছে তনুজার ওই দুই চোখে একটু স্পর্শ করা প্রয়োজন। কতকাল ধরে মনে মনে এই সুপ্তবাসনা লালন-পালন করে আসছে। আজ নাহয় সেই সুপ্তবাসনার অবসান হোক। রুদ্র লাইট অফ করে তনুজার পাশে শুয়ে পরে।

ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় তনুজার চোখের কাছে। তারপর, দীর্ঘ সময় নিয়ে চুমু এঁকে দেয় তনুজার আঁখি যুগলে। নিজের চোখে কারো ভেজা স্পর্শ পেয়ে তনুজার ঘুম ভেঙে যায়। তনুজা ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে দেখলো, রুদ্র তার বেশ কাছে। রুদ্রের চাহনিতে আজ ভীন্ন আবদার দেখতে পাচ্ছে তনুজা। তনুজা রুদ্রের আবদার বুঝতে পারে। তাই তো ভয় পেয়ে দূরে সরে যেতে চায়। কিন্তু, রুদ্র তনুজাকে আবদ্ধ করে নেয় নিজের বুকের মাঝে। তনুজা ছাড়া পাবার জন্য ছটফট করতে থাকে। কিন্তু, রুদ্র তনুজাকে ছাড়ে না বরং আরও ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। একসময় তনুজার অঁধর নিজের অঁধর দিয়ে চেপে ধরে। তনুজা থমকে যায়। ছটফট ভাবটা নিমেষে চলে যায়। প্রথমবারের মতো সেই অচেনা অনুভূতি অনুভব করে তনুজা। দীর্ঘ সময় পর রুদ্র তনুজার অধরসুধাপান করে ছেড়ে দেয়। তনুজার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তনুজা চোখ বন্ধ করে থাকে। দুইচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পরে তনুজার। নিজের বুকে বন্দিনী তনুজাকে কান্নারত অবস্থায় দেখে রুদ্র তনুজাকে ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করলো,

— আমার স্পর্শ পেয়ে খুব ঘেন্না হচ্ছে তাই না, তনুজা? কিন্তু, কি করব বলো? তোমার অধরসুধাপান করেও যেন আমার নেশা কাটছে না। বরং, নেশা আমাকে আরও চেপে ধরেছে। মন বলছে নেশাটা আরও ভিন্নভাবে কাটাতে হবে। তোমার মন গহীনে লুকায়িত হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা ফের জাগ্রত করার তীব্র ইচ্ছা জেগেছে আমার মনে। চলে যাওয়ার আগে আজ তোমার অতি ঘনিষ্ঠে যেতে চাই আমি।

তনুজা রুদ্রকে বাঁধা দিতে পারল না। বরং, মনের কোণে লুকায়িত একটি অংশ বারংবার তনুজাকে যে অনুরোধ করছে আজ যেন নিজেকে রুদ্রের কাছে পুরোপুরি অর্থে সমর্পন করতে পারে। মনের চাওয়াকে পূরণ করতে চায় তনুজা। ভালোবাসার মানুষ তাকে আহ্বান জানাচ্ছে সে কি করে সাড়া না দিয়ে থাকবে? হয়তো, তনুজা মুখে স্বীকার করে না যে সে রুদ্রকে আগের মতো ভালোবাসে না। কিন্তু,মন তো জানে রুদ্র ঠিক সেই আগের মতো তার হৃদয়ের পবিত্র স্থানে বাস করে।

দুটি মানুষ আজ এক হলো। পুরনো ভালোবাসার ডাকে সাড়া দিয়ে। কিন্তু, তাদের পরিণতি কেমন হবে কারো জানা নেই?

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে