পিশাচ পরিবার চতুর্থ / অন্তিম পর্ব

0
1865

#পিশাচ_পরিবার
#চতুর্থ/অন্তিম_পর্ব
©Tasmima Yeasmin
.
.
ওপাশ থেকে আবার কেউ বলে উঠলো, “এক্ষুণি মারিস না। পরশুদিন পূর্ণিমা রাতে ওকে কুমারী বলি দেবো। তাতে আমাদের শক্তি আরো বেড়ে যাবে।”
অদৃশ্য একটা শেকল আমার পায়ে আটকে গেলো। টেনে নিয়ে গেলো খাটের তলায়। সেখানে কিছু একটার সাথে আমার শরীরে ধাক্কা লাগলো। অন্ধকারে হাতড়ে দেখলাম কাপড়ের নিচে কারো একটা শরীর ঢাকা রয়েছে। তারমানে নিশ্চয়ই এটা একটা লাশ। পঁচা একটা গন্ধ এসে আমার নাকে ঠেকলো। পেটের নাড়িভুঁড়ি সব বেরিয়ে আসতে চাইছে গন্ধে। বিশ্রী গন্ধে একগাদা ভয় নিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। ওপাশে কোনো শব্দ নেই। সব নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছে৷ নিশ্চয়ই ঐ ছায়ামূর্তিগুলো চলে গিয়েছে। আমি ভেবেই পাচ্ছিনা কি করবো। তখন ঐ লোকটার থেকে সাহায্য নেওয়া উচিত ছিলো। তাহলে নিশ্চয়ই বাঁচার একটা না একটা রাস্তা পেয়ে যেতাম। যাই হোক না কেন, এখান থেকে আমাদের বের হতেই হবে। কিন্তু বড় আপাকে কিভাবে বাঁচাবো। ওদের সাথে তো আপাও পিশাচ হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। আমার উচিত ছিলো ঐ সবুজ লকেট টা বড় আপার গলায় কিছু না বলে পরিয়ে দেওয়া। আমি মনে মনে একরকম পণ করলাম আমি এখান থেকে বের হবোই এবং বড় আপাকে সাথে করেই।
.
.
অন্ধকারে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমি জানি না। ঘুম ভাঙতে মাথার পেছনে প্রচন্ড যন্ত্রণা অনুভব করলাম সেই সাথে শরীর ও নাড়াতে পারছি না। মাথায় হাত দিতে গিয়ে দেখলাম আমার হাত পা বেঁধে রাখা হয়েছে জংলি কাঁটাযুক্ত লতাপাতা দিয়ে। হ্যাচকা টান দিতেই কাঁটায় ভীষণ লাগলো। চারদিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছি আমাকে কোথায় আটকে রেখেছে।
বিশাল বড় একটা স্টোররুম। চারপাশে ধুলাবালি আর ময়লা। বেশিরভাগই পুরাতন আর ভাঙাচোরা আসবাবপত্রে ভর্তি। বাইরে এখন দিন বোঝা যাচ্ছে। ছোট একটা জানালা থেকে কয়েকটা আলোর রেখা এসে পরেছে মেঝেতে। কিছুক্ষণ নিজের বাঁধন খোলার চেষ্টা করলাম কিন্তু কোনো লাভ হলো না। ওরকম বাঁধা অবস্থায় পরে রইলাম।
.
.
কতক্ষণ হয়ে গেছে জানি না। কেউ একজন ফিসফিস করে কানের কাছে চারু, এই চারু বলে ডাকছে। আমি চোখ মেলে অন্ধকারে দেখার চেষ্টা করলাম কে আমার পাশে বসে আছে। বড় আপা এসেছে। আমি বললাম, “বড় আপা তুই এসেছিস এখানে?”
বড় আপা আমার হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, “চারু আমি থাকতে তোর কিছু হবে না, কিছু হতে দেবো নাকি আমি। তোকে যা যা বলছি তুই মনযোগ দিয়ে শোন। আর কিছু সময় পর এখান থেকে বের হবি তুই। এই স্টোররুম থেকে বের হলে ছয়টা ঘরের পর ছোট একটা দরজা আছে। দরজার তালা খুলে রাখবো আমি। ওটা আসলে একটা সুড়ঙ্গ মুখ। ওখান দিয়ে গেলে জঙ্গলে পৌঁছে যাবি। তারপর চলে আসবি বকুল তলা আর কি কি করতে হবে জানিস তো?”
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “হ্যাঁ আপা।” বড় আপা আমার কপালে চুমু খেলেন। আবছা অন্ধকারে আপার গলায় সবুজ লকেটটা জ্বলে উঠলো। আমি ঠোঁটে খেলে গেলো স্মিত হাসি।
.
.
নিঃশব্দে স্টোর রুম থেকে বের হয়ে এলাম আমি। হাটঁতেও কষ্ট হচ্ছে। মাথা ভনভন করে ঘুরছে। নিজের মনকে শক্ত করে বললাম, “দূর্বল হলে চলবেনা আমার।” ছোট দরজাটার কাছে চলে আসলাম। দরজা খুলে সুড়ঙ্গে পা রাখতে অতল অন্ধকারে হারিয়ে গেলাম। দেয়ালের গায়ে হাত রেখে হেঁটে চলছি আমি। হাঁটতে হাঁটতে শেষমেশ শেকড় বাকড়ে ভরা একটা জায়গায় এসে পৌঁছালাম। ছোট্ট একটা ঘরের মতন কিন্তু চারদিকে শেকড় বাকড় ছড়ানো। দুইদিকে দুইটা গুহার মতন চলে গেছে। আমি বুঝতে পারছিলাম না কোনদিক দিয়ে যাবো। নষ্ট করার মত সময় আমার হাতে নেই। একটা গুহা ধরে হেঁটে চললাম। কিন্তু না আমি ভুল পথে এসেছি। এটা যতক্ষণে টের পেলাম ততক্ষণে আমার পায়ের গোড়ালি চোরাবালিতে আটকে গেছে আর হাতের কাছে ধরার মত কিছু নেই। হঠাৎ কোথা থেকে যেন একটা শিকড় এসে আমার কোমরে পেঁচিয়ে ধরলো আর আমাকে চোরাবালি থেকে টেনে তুললো। আবার ফিরে এসে আমি পাশের গুহাটা ধরে হাঁটলাম আর জঙ্গলে এসে পৌছাঁলাম। আকাশে পূর্নিমার চাঁদ উঠে গিয়েছে। আমি চাঁদের আলোয় দেখলাম আমি দিঘির এপাশে আছি। এপাশ থেকে বাড়িটাকে একটা জীবন্ত পিশাচপুরীর মত লাগছে। জঙ্গল দিয়ে হেঁটে ঘুরে যাওয়ার থেকে ভাবলাম দিঘি সাঁতরে ওপারে যাই৷ দিঘির পানিতে ঝাঁপ দেয়ার পরে বুঝলাম কি ভুলটা করেছি। পানি বরফের মত ঠান্ডা। উত্তেজনায় এতকিছু দেখার সময় নেই। তখনই মনে হলো কেউ একজন পা ধরে পানির নিচের দিকে টানছে। আমি বারবার ছাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছি আর সে পেছন থেকে টেনে ধরছে। কোনোমতে দিঘির ঘাটে এসে পৌঁছালাম। দিঘির দিকে তাকাতেই চমকে উঠলাম। রক্তমাখা একটা হাত দিঘির পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে।
.
.
ঠান্ডায় একরকম কাঁপুনি ধরে গেছে আমার। বকুল গাছের তলায় অসংখ্য বকুল মাটিতে লেপ্টে রয়েছে। মাটি খোড়ার জন্য বাড়ি থেকে খুঁজে একটা পুরাতন শাবল নিয়ে এসে সেটা দিয়ে মাটি খুড়তে শুরু করলাম। কে যেন কাঁধে হাত রাখলো। চমকে তাকাতেই দেখি দিহান। ঠান্ডা গলায় বললো, “কি করছো তুমি চারু? ওদিকে তো একবার দেখ?” একথা বলে হাত দিয়ে ইশারা করলো। সেখানে সাদা কাপড়ে জড়ানো দুটো লাশ। আমি কাছে যেতেই লাশ দুটোর মুখ থেকে কাপড় সরে গেলো। বাবা আর মায়ের লাশ। এত বেশি অবাক হলাম যে কাঁদতেও ভুলে গেলাম। নিজেকে বোঝালাম চারপাশে এখন অনেক কিছুই হবে কিন্তু সেদিকে খেয়াল দেয়া চলবে না। আমি আবার ফিরে আসলাম বকুল গাছের নিচে মাটি খুড়ে রূপোর বাক্সটা বের করার জন্য। আরেকটু খুড়তেই আমার চারপাশ থেকে অজস্র মানুষের গলার শব্দ শুনতে পেলাম। সেইসাথে চারপাশ থেকে অদ্ভুত সব আওয়াজ আসতে লাগলো। কেউ ফিসফিসিয়ে বলছে, “তুই মরবি, ঠিক মরবি। এখনো সময় আছে বন্ধ কর আর ফিরে যা।” দ্রুত মাটি খোড়ার পর বের হয়ে এলো একটা কংকালের খুলি। আবারো খুড়তে লাগলাম। এবার বেরিয়ে এলো সেই রূপোর বক্স। তাড়াতাড়ি বাক্স খুলতেই পেলাম একটা অতি সাধারণ আয়না। আয়নাটা দ্রুত চাঁদের দিকে ধরতেই মনে হলো পেছনে হাজার হাজার মানুষ আত্মচিৎকার করছে। ফিসফিসানি বন্ধ হয়ে গেলো। আয়নাটা আলোকিত হয়ে জ্বলজ্বল করতে লাগলো। আশেপাশে দিহানকে দেখলাম না আর লাশ দুটো উধাও। দৌড়ে ঘরের ভেতর চলে গেলাম কিন্তু কোথাও কেউ নেই।
.
.
বাড়ির সবাই ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ধীরে ধীরে ওদের দিকে এগোতে লাগলাম। ছাদে পরে থাকা কিছু একটাতে পায়ে বেধে অসতর্কতাবশত হাত থেকে আয়নাটা পরে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো। শব্দে সবাই ঘুরে আমার দিকে তাকালো। দিহানের পরিবারের সবার চোখ সবুজ হয়ে জ্বলছে। সম্মোহিতের মত ধীরে ধীরে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো সবাই। তীরে এসে তরী ডুবিয়ে ফেললাম আমি।
.
.
দিঘির ঘাটে আমি বড় আপার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি। হাতে কুড়ানো বকুল। থালার মত মস্ত চাঁদটা দিঘির জলে আলো ছড়াচ্ছে। চারদিক শান্ত, স্নিগ্ধ আর সুন্দর। বড় আপা আমার চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বললেন, “জানিস কি ভয় পেয়েছিলাম আমি। ভেবেছিলাম বুঝি মরেই যাবো।”
আমি বললাম, “আয়নাটা ভাঙার পর ওরা যখন আমার দিকে এসেছিলো আমি ভাবিনি আয়নাটা জুড়ে যাবে আর আয়নার আলোতে ওদের শরীরে আগুন ধরে যাবে।”
বড় আপা বললেন, “সব তোর জন্যই হয়েছে রে। আমি বারবার নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছিলাম। সেরাতে তুই যখন ছিটকে নিচে পড়ে গেলি সবুজ লকেটটা আমার পায়ে এসে পড়লো আর আমি স্বাভাবিক হয়ে গেলাম। তারপর ওটা গলায় পরে নিয়েছি। বিয়ের আগে প্রথমবার যখন দেখা করেছিলাম ও আমার শরীরে হাত দিয়ে আঠার মত কিছু একটা লাগিয়ে দিয়েছিলো আর তার পরেই আমি কেমন যেন হয়ে যাই। নিষাদকে বলি আমি এই ছেলেকেই বিয়ে করবো তোমাকে যেন আর আমার চোখের সামনে না দেখি। আর ছেলেটা কই যে চলে গেলো।”
“চিন্তা করিস না আপা। বাড়িতে গিয়েই নিষাদ ভাইয়ের সাথে দেখা করিস।” বড় আপা চুপ করে রইলেন। আমি টের পেলাম বড় আপা নিঃশব্দে কাঁদছে।
.
.
বাড়িতে এসেছি সেই লোকটার সাহায্যে। ভবঘুরে লোকটা সত্যিই আমার আর বড় আপার জীবনে আশীর্বাদ হয়ে এসেছিলেন। উনি সাহায্য না করলে হয়তো ফিরে আসতেই পারতাম না। মজার কথা হচ্ছে ঐ জঙ্গলবাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে খুব একটা বেশী দূরে ছিলোনা। এদিকে আমাকে আর আপাকে নিয়ে আসার পর আব্বা আম্মার ঘোর কেটে যায়। ওনাদের উপরেও কালোজাদু করেছিলো। এদিকওদিক খুঁজতে থাকে আমাদের। তখন কালোজাদুর প্রভাব থাকায় আর মনে ছিলো না আপাকে কোথায় কার কাছে বিয়ে দিয়েছে। মানুষজন নানান কথা বলাবলি করছে তাতে আমাদের কি। আমরা দুবোন তো ফিরে এসেছি আমাদের পরিবারের কাছে।
.
.
পুনশ্চঃ ছাদের রেলিংয়ে বসে পা দুলিয়ে দুলিয়ে জলপাইয়ের আচার খাচ্ছি। এই কয়েকদিনের ঘটনাকে একটা দুঃস্বপ্ন মনে করেই ভুলে গেছি। ওদিকে ছাদের ওপাশে বড় আপা আর নিষাদ ভাইয়া ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। কয়েকদিন আগেই বিয়ে হয়েছে ওদের। আপার লম্বা খোলা চুল হাওয়ায় উড়ছে আর আপা বাচ্চাদের মত খিলখিলিয়ে হাসছে। নিষাদ ভাইয়া একহাতে লাটাই ধরে আপার দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে। সত্যিই ভালোবাসা থাকলে সাধারণ সব মূহুর্তও অসাধারণ হয়ে ওঠে।
#সমাপ্ত
#হ্যাপি_রিডিং

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে