দূর আলাপন পর্ব-২২+২৩

0
185

দূর আলাপন ~ ২২

____________________________
নিনাদের কি যেন হয়েছে। ওই হতচ্ছাড়া দেশ ছেড়ে আসার পর থেকে ছেলেটা গুম হয়ে আছে নিজের মধ্যে। কিছু একটা যে ঠিক নেই তা বেশ বুঝতে পারেন শিউলি। আড়াল আবডাল থেকে ছেলের অদ্ভুত ভাবভঙ্গি যত নজর করেন, দুশ্চিতার অথৈজলের আরো গভীরে তলায় তার মন। হুল্লোড়প্রিয় ছেলে হঠাৎ অমন নিভে গেল, না বাইরে যাওয়া, না বন্ধুদের সঙ্গে আধ রাত্রির পর্যন্ত আড্ডা দেয়া আর নাই বা আফরিনের সঙ্গে খোঁচাখুঁচি। এমনকি খোদ শিউলির সঙ্গেও দুটো বাড়তি দুটো কথা কয় না আজকাল! এসব তো ভালো লক্ষন নয়।

শিউলির মনে নানারকম কুট সন্দেহ দানা বাঁধে। ওই পোড়ামুখো দেশটাতেই নিনাদ কোনো কান্ড বাঁধিয়ে এলো না তো? শুনেছেন বিদেশ বিভূঁইয়ে নাকি লজ্জাশরম নামক বস্তুটির কোনো অস্তিত্ব নেই। ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সবাই সম্ভ্রম বিসর্জন দিয়ে অকপটে পথঘাটে চলাফেরা করে। অমন বেহায়ার রাজ্যে থাকলে ছেলে মানুষের মাথা বিগড়ে যাওয়া তো অসম্ভব কিছু না। একমাত্র আল্লাহই জানেন কি ঘটেছে। তবে প্রবাস থেকে ফেরার কয়েক দিন পরেও যখন নিনাদ পুরোপুরি স্বাভাবিক হলো না শিউলির দুশ্চিন্তা প্রকট হলো।

তা তরুণ বয়সে এক আধবার ছেলেরা এমন বিগড়ে যায় ই। এর মোক্ষম সমাধান অবশ্যি শিউলির জানা আছে। দ্রুত বিয়ে দিয়ে ছেলেকে ঘরমুখো করা। শিউলি নিজের মতো তোড়জোড় শুরু করলেন। হবু বেয়ান বাড়ির সঙ্গে কথা বলে এগিয়ে আনলেন বিয়ের তারিখ। নিনাদ কিছু জানলো না। তাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলেন না শিউলি। জানিয়ে কি হবে? বরং আগে শুনলেই না আবার নতুন করে কোনো বিপত্তির সূচনা হয়…

.

বাইরে নরম সুন্দর রোদে ঘেরা সকাল। সোনা রঙের লহরি খেলছে কাঁচের জানালা জুড়ে। জানালা খুলে, দুহাতে টেনে পর্দা সরিয়ে দিল তিতিক্ষা। এগিয়ে গেল বারান্দার দিকে। দরজাটা খুলতেই হুড়মুড় করে একরাশ রোদ গ্রিল গলে এসে লুটিয়ে পড়ল ঘরের ভেতর। বারান্দার দরজা খুলে রেখে তিতিক্ষা ভেতরে চলে এলো। চারপাশটা দেখল ঘুরে। জানালার বাইরে পাখিদের প্রবল কিচিরমিচির আর শান্ত ঘরে সকালের স্নিগ্ধ রোদের লহরি। আজকের সকাল অন্যরকম সুন্দর। ভুল হলো, শুধু আজকের সকাল নয়। প্রতিটা দিনই হয়তো সকাল ঠিক এরকম সুন্দর হয়। এতকাল খেয়াল করেনি বলেই উপলব্ধি করেনি তিতিক্ষা।

রোজ ভোরেই তো এরকম মিষ্টি আলো ফেলে সূর্য দিনের প্রথম হাসি হাসে। বিকেলে গাছের ফাঁকে রোজ জাফরানি রোদ্দুর মেখে দিনের সমাপ্তি ঘোষণা করে সূর্যের তেজী আভা৷ অথচ প্রকৃতির এই আয়োজন একান্ত করে দেখার ইচ্ছে বহুকাল হয়নি তিতিক্ষার। দিনের পর দিন পেরিয়ে গেছে, ও সারাক্ষণ ডুবে থেকেছে একান্ত নিজের দুঃখভূমে। পৃথিবীর কোনো আলো, সুখ, গন্ধ, তৃপ্তি ওকে স্পর্শ করেনি। তিতিক্ষা নিজের জন্য স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছে এক দুর্বিষহ জীবন, আর নিজের দুঃখ দিয়ে তিক্ত করেছে পরিবারের বাকি মানুষ গুলোর জীবনকে।

কত বিভৎস স্মৃতির অনুরণনে, কান্নায়, ক্লেশে আর পরিতাপে দগ্ধ হয়ে হয়ে কেটেছে তিতিক্ষার দিনকাল। সহ্য করতে না পেরে, বিষাক্ত স্মৃতি মুছতে না পেরে একেক সময় সে পাগলামো করেছে। কষ্ট দিয়েছে নিজেকে আর নিজের সবচেয়ে প্রিয় দুজন মানুষকে…
সেই বিষাক্ত স্মৃতি পিছু ছাড়েনি। বোধহয় খুব সহজে ছাড়বেও না। এইতো… এইমাত্রই তো দুর্বহ অতীত স্মৃতির এক টুকরো ছবি ওর মনের কোণে এঁকে দিয়ে গেল অগ্নি হল্কার ছাইভষ্ম। তবে তিতিক্ষা এইবার নিশ্চল। আজ সে কাঁদবে না। অস্থির হবে না। বিচলিত বোধ করবে না শিরার অসহ্য দপদপানিতে। এ ওর নিজের কাছে নিজের অঙ্গিকার।

নির্বিকার, নিথর হয়ে বিছানায় বসে জানালার গ্রিলে চোখ তুলে চেয়ে থাকে তিতিক্ষা। গায়ে চিনচিনে অসহ্য জ্বালা শুরু হয় একরকম। এই জ্বালাটা সে আগেও টের পেত। সেসময় সহ্য করতে না পেরেই আঘাত করতো নিজেকে, সামনে যা পেত সব ধ্বংস করার পণ নিয়ে শুরু করতো ভাঙচুর।

ক্রমে বাড়ছে শরীরের চিনচিনে জ্বলুনিটা। মস্তিষ্কের অন্ধ কুঠুরিতে স্মৃতি নামক অভিশাপের দহন আর বুকের ভেতর অসহনীয় জ্বালা। তিতিক্ষা নাকাল বোধ করে। নিজেকে, নিজের অযাচিত অন্ধ ক্রোধকে সামলাতে হিমশিম খেয়ে যায়। তবু… সব সহ্য করে শিথিল হয়ে বসে থাকে। বুবুকে, বাবাকে অনেক শাস্তি দেয়া হয়েছে। আর না। ওদের মুখের সব হাসি গায়েবে করে, মনের মধ্যকার সমস্ত আনন্দ তরঙ্গ শোষণ করে, তিতিক্ষা সকলের জীবনকে বিস্বাদ করে তুলেছে। আর কতকাল নিরীহ দুজন মানুষ সহ্য করবে এই অনাচার?

যাই হয়ে যাক আজ, ওদের আর কাঁদাবে না তিতিক্ষা। কষ্ট হলে সয়ে নেবার চেষ্টা করবে, যতখন, যতদিন পারা যায়.. কিন্তু বাবা আর বোনের মুখে মেঘের কালো ছায়া আসতে দেবে না আর কখনো।
‘ইয়া আল্লাহ আমাকে সাহায্য করুন। অতীত ভুলিয়ে দিন। অন্তরের অস্থিরতা দূর করে দিন ইয়া রব।’ ঠোঁট নেড়ে নিঃশব্দে দুআ করতে করতে বুকের ভেতরে আগুনের শতধা নিয়ে বাথরুমের দিকে পা বাড়ায় তিতিক্ষা, ওযু করার উদ্দেশ্যে। ওযু নিশ্চয়ই তার অস্থিরতা প্রশমিত করবে।

ওযু শেষে যখন ফিরে আসে ওর চেহারায় তখন ঝিকমিকাচ্ছে ফোঁটায় ফোঁটায় জল। চোখের দৃষ্টি পরম শান্ত৷ তিতিক্ষা আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে, ওর ভেতরের অহেতুক ক্রোধের বেপরোয়া আস্ফালন তিঁনি থামিয়ে দিয়েছেন বলে। ওযুর উদ্দেশ্য ছিল মূলত রাগ দমন করা। তবে এবার কৃতজ্ঞতায় নতজানু হয়ে তিতিক্ষা বইয়ের তাক থেকে কুরআনও তুলে নিল। বুকে জড়িয়ে বারান্দার কাছে মাটিতে বসে পড়ল পা ভেঙে। কাঠের রেহালে কুরআন নামিয়ে রেখে পরম যত্নে পৃষ্ঠা উলটে থামল সূরা আরাফে। নম্র কোমল সুরে কুরআন পড়তে আরম্ভ করার পরই আস্তে আস্তে অবর্ণিত যাতনার বাষ্পে ভারাক্রান্ত হৃদয় হালকা হল। অন্তঃস্থল দখল করে নিতে শুরু করল নিখাঁদ প্রশান্তির ফল্গুধারা।

❝নিশ্চয়ই যারা তোমার পালনকর্তার সান্নিধ্যে রয়েছে, তারা অহংকারে তাঁর ইবাদতে বিমুখ হয় না ও তাঁর-ই মহিমা ঘোষণা করে এবং তাঁর-ই কাছে সিজদাবনত হয়। [ সুরা আরাফ – ২০৬]❞

কুরআন তিলাওয়াত করতে করতে কুরআনের সুরের সঙ্গে তিতিক্ষা আরো নিবিড় হয়ে মিশে যেতে থাকে। মনে মনে দৃপ্তকণ্ঠ বারবার স্বীকার করে, ‘এই আমার পরম প্রশান্তির স্থান.. কুরআন আমার প্রশান্তি… ইয়া রব, আপনি এই অসীম নিয়ামত টুকু আমার থেকে কখনো কেড়ে নিয়েন না। আপনার এই কালামকে এভাবে আকঁড়ে ধরে আমি চিরকাল শান্তি পেতে চাই। আমি মারা যেতে চাই কুরআন কে ভালোবেসে, কুরআনের বুলি আওড়াতে আওড়াতে। আমিন ইয়া রব্বুল আলামীন….’

.

বোনের ঘরে এসে তিহা মৃদু অবাক। পরিপাটি করে গোছানো আলো ঝলমলে ঘর। ওয়ারড্রবের সামনে দাঁড়িয়ে তিতিক্ষা কাপড় ভাজ করছে। মাথায় জড়ানো বড় ওড়না, মুখজুড়ে লেপন করে আছে নিরতিশয় স্নিগ্ধকর আভা। তিহা এসেছিল গুরুতর প্রসঙ্গ উত্থাপনের মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে। সব শুনে বোনের গোঁড়ামি বাড়াবাড়ি মনে হলে খানিকটা কঠোর হবার পরিকল্পনাও মাথায় ছিল। কিন্তু এখন তিতিক্ষার শান্ত সরল অভিব্যক্তি দেখে সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। সেই কঠোর, জেদী, আগ্রাসী মুখ তো এ নয়। এই চেহারার সবটা ঘিরে শুধুই নির্মলতা বিরাজমান। যেন ও চিরকাল এমনি ভীষণ নম্র, ভীষণ বাধ্য। কখনো কারো অবাধ্য ছিল না। এক মুহুর্তের তরেও না…
সে যেন সমস্তরকম অনৈতিকতা বিবর্জিত নিষ্পাপ এক প্রাণ। এইরকম এক মানবীর প্রতি কি করে কঠোর হয় তিহা?

বোনকে দেখে বহুপূর্বের হারানো সাহস আজ আবার তিহা ফিরে পায়। এইরকম মেয়ের কাছে হয়তো যা খুশি বলা যায়। না পূরণ হওয়া ইচ্ছেগুলোর কথা, স্বপ্নের কথা, শঙ্কার কথা.. আর মনের গহিনে যত অনিশ্চয়তার ঝাপতাল লুকিয়ে আছে, যত না বলা যাতনার সাতকাহন গচ্ছিত আছে… সব বলা যায় এমন মনের কাছে।

হাত ধরে বোনকে টেনে বসালো তিহা। নিজের খুব কাছে। মায়ের মতো স্নেহে মাথায় চুমু খেয়ে বলল,’বুবুর একটা কথা রাখবি?’

নির্মল নিস্তরঙ্গ হাসি তিতিক্ষার মুখে,’কি কথা বুবু?’

‘বলছি.. তার আগে একটা খবর জানাই। তোর দুলাভাই সকালে কলে জানিয়েছে আর কিছুদিনের মধ্যেই ওকে ঢাকায় পোস্টিং হয়ে যাবে।
তারপর হয়তো আর এবাড়িতে থাকা হবে না আমাদের….’
একদম অকারণে অযাচিত ভাবে গলার স্বর সামান্য কেঁপে ওঠে তিহার।

তিতিক্ষার উজ্জ্বল মুখ নিভে যেতে কয়েক মুহুর্ত মাত্র সময় লাগে।
‘থাকবে না?’

থেমে বলে, ‘একেবারে চলে যাবে বুবু?’ তিতিক্ষার স্বরে তীব্র অবিশ্বাস। খানিকটা অস্বাভাবিক ভাবে অবিশ্বাসের আঁচটা ওর চেহারায় ফুটে ওঠে।

কিশোরী মেয়ের মতো নাক টেনে হঠাৎ কেন যেন কেঁদে ফেলল তিহা।
‘যেতে হবে রে.. ‘

‘আর ছোটন…?’

‘ওকেও তো সঙ্গে নিতেই হবে। ‘

স্তব্ধ হয়ে কিয়ৎকাল বসে থাকল তিতিক্ষা। প্রস্তরীভূতের ন্যায়। অথচ… এই সময়টা খুব যে অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল, তা তো নয়। বিয়ের পর থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছে রওশান, ওর পোস্টিং টা কিভাবে ঢাকায় আনা যায়। তখন তিহার সাথে সাথে তিতিক্ষাও অনুযোগের স্বরে বারবার বলতো, ‘রওশান ভাইয়ের ঢাকায় আসতে আর কত দেরি বলতো বুবু? কবে যে তোমাদের একটা নিজের সংসার হবে…’

আর আজ, সেই শুভসময় আসতে যখন আর খুববেশি বাকি নেই, ওরা দুবোন তখন নিজেদের হাসির মুখোশ খুলে ফেলে একে অন্যের সামনে বসে কাঁদছে।
‘তোমরা চলে গেলে একা আ..আমি কি থাকবো বুবু? আর বাবা… বাবা কি করে ছোটনকে ছাড়া থাকবে?’

‘জানি না রে.. কিন্তু যেতে তো হবেই। কি করে আটকাই?’

সেই তো… সংসার তো নারীই গড়ে তোলে। নিজের সংসারে না ফিরে বুবু করবে কি? কিন্তু… কিন্তু… তিতিক্ষা তাহলে বাঁচে কি করে ওদের ছাড়া?

নিঃশব্দে খানিকক্ষণ বোনের অভিব্যক্তি লক্ষ্য করল তিহা। আশু একাকীত্বের আশঙ্কায় বিবর্ণ হয়ে তিতিক্ষা এখনি দিশেহারা বোধ করছে। মাথার ওপর থেকে ছাদ সরে গেলে যেভাবে শূন্য পরাভব হয় মানুষ, তেমন রিক্ত হাবভাব তিতিক্ষার মুখচোখে।

‘তিতি…’

‘বলো…’

‘তুই এত ভয় পাচ্ছিস কেন?’

‘তোমাদের ছাড়া কি করে থাকবো বুবু?’

‘চিরকাল কি কেউ কারো হয়ে থাকে রে বোকা? যে সন্তান মায়ের এত প্রিয়, সেই নাড়ী কাটা ধনকেও তো একদিন চির পর করে অন্যের ঘরে পাঠাতে হয়। সেখানে তুই আমি… আমরা তো দুইবোন। নিয়তির অমোঘ পরিকল্পনাতেই আমাদের গন্তব্য আলাদা করে লেখা। আমার তো যাবার কথা আরো আগেই ছিল। যাক, এতদিনে নিজের করে কিছু একটা পাব। আজ না হোক কাল, তোরও তো আপনার সংসার হবে। দেখবি তখন এসব দুঃখ কোথায় হারিয়ে যাবে… ‘

তিতিক্ষা যেন কি এক স্বপ্নের অতল গহনে আবিষ্টমান। চোখে শঙ্কার কোলাহল তুলে বলল,’আমি কোথাও যাব না… কক্ষনো যাব না বাবাকে ছেড়ে… ‘

‘কিন্তু বাবা যে কারো চিরকাল থাকে না তিতি… তখন তোর কি হবে বলতো? কে তোকে আশ্রয় দেবে? কার নিরাপত্তায় গোটা একটা জীবন একাকী কাটাবি তুই?’

বাস্তবতার নিঠুর মাটিতে তিতিক্ষার কল্পনাবিভোর মন আঁছড়ে পড়ে। সত্যিই তো! এই প্রশ্নের উত্তর নেই ওর কাছে। অথচ তিতিক্ষা স্পষ্ট বোঝে, নিয়তিকে এড়ানোর কোনো উপায় তার হাতে নেই। দূরভিশঙ্কা থেকে মুক্তির পথ খুঁজে না পেয়ে, নিজের জীবনের চরম বাস্তবতাকে আরো একবার গভীর ভাবে উপলব্ধি করে আচমকা তিতিক্ষা হু হু করে কেঁদে ওঠে। কেন? কেন এত নির্দয়ভাবে একা হবে একটা মানুষের জীবন?
কেন ক্ষুদ্র এক জীবনে সব হারিয়ে চূড়ান্ত একা হবার দুঃখ সইতে হবে একজন মানুষকে?

বোনকে উজার হয়ে কাঁদার সুযোগ তিহা দিল। ধৈর্য ধরে নিঃশব্দে ওকে ওর মতো কষ্টের ভার কমানোর সময় দিল। একসময় তিতিক্ষার কান্না লহু হয়ে এলে তিহা নিজের শীতল হাত রাখে ওর মাথায়।
‘বেশি কষ্ট হচ্ছে রে আপু? বুবুকে মাফ করে দে। বিশ্বাস কর, তোকে কষ্ট দিতে আমারও ততটাই কষ্ট হয়। কিন্তু বাস্তবতা যে আমাদের কল্পনারও অতীত। এভাবে বলতে চাইনি কিন্তু না বলেই উপায় কি বল? আমি নিজের সংসারে চলে যাব। প্রকৃতির নিয়মেই একসময় বাবাও আর থাকবেন না। তোর পরিণতি কি হবে বলতো? তুই রওশানের অধীনে থাকবি না ও তোর মাহরাম নয় বলে। বাবার অনুপস্থিতিতে তখন তোর মাহরাম কে হবে?
ভাবতে পারিস, তোর সমস্ত বিপদে আপদে, অসুখে বিসুখে সাহায্য লাগবে এমন একজনের, যার ছোঁয়া তোর জন্য হারাম। এই গ্লানির সামনে কিছু বাস্তবতাকে মেনে নেয়া কি খুব কঠিন?’

‘তাহলে আ.. আমি.. কি করবো বুবু? কোথায় যাব আমি?’ কান্নায় ভেঙে আসা স্বরে বিহ্বলতা জড়িত গলায় তিতিক্ষা জিজ্ঞেস করে।

‘তোকে কিছু করতে হবে না আপু। তুই শুধু আমাদের কথা শোন। তোর নিজের প্রয়োজনে, একান্ত আপনার স্বার্থে আমাদের একটা দাবি মেনে নে।’

‘কিসের দাবি?’

‘বিয়েতে সম্মতির দাবি। আমরা তোকে নিরাপদ দেখতে চাই। আর একটা মেয়ে তার বাবার পরে একমাত্র স্বামীর অধীনেই সবচেয়ে বেশি নিরাপদ। ভেবে দেখ। তোর কোনো ভাই নেই, মামা নেই, একজন চাচা শুধু আছেন। তারও আবার দুটো ছেলে। বাবার পরে কার আশ্রয়ে নিরাপদ থাকবি তুই? এখানে এই বাসায় একা একা?
এও কি সম্ভব?’

কিছুকাল দিশেহারা হয়ে তাকিয়ে রইল তিতিক্ষা। গালে জলের ভেজা ছাপ স্পষ্ট, চোখে তীব্র সংশয়।

‘বল পারবি তুই?’ বোনের কাঁধ ঝাঁকিয়ে তিহা জিজ্ঞেস করে।

তিতিক্ষা চোখ বোজে। চাপা স্বরে কান্না ছাপিয়ে সমাচ্ছন্নের মতো উত্তর দেয়,’ আমি কিছু জানি না… কিছু জানি না… ভয় করছে আমার.. বেঁচে থাকা এত কঠিন কেন বলতে পারো? একজীবনে বাঁচতে গেলে কেন এত খারাপ পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যেতে হয়? আমি আর সহ্য করতে পারছি না বুবু.. তোমরা প্লিজ আমায় রেহাই দাও। একটু শান্তি চাই আমি। আর কোনো অভিযোগ, অপমান, প্রশ্নের মুখোমুখি হতে চাইনা। আমাকে বাঁচাও। এই দুঃস্বপ্নের জীবনের হাত থেকে সবসময়ের জন্য আমায় উদ্ধার করো…’

‘সত্যিই যদি পারতাম… আর একবিন্দু আঘাত না দিয়ে তোর সব কষ্ট ভুলিয়ে দিতাম রে আপু। কিন্তু তা যে সম্ভব নয়। ভালো কিছুর অর্জন সবসময় কষ্ট সাপেক্ষ। আপাতত আমরা তোর ভালোর একটা পথই দেখছি। তা হলো… তোর বিয়ে…
যার মাধ্যমে একজন দায়িত্বশীলের হাতে তোকে তুলে দিয়ে আমি, আমরা চিরকালের মতো নিশ্চিন্ত হতে পারবো। ভবিষ্যতে কি হবে না হবে তা তো আমরা জানি না। তবে সুযোগ্য কাউকে খোঁজার ক্ষেত্রে আমরা চেষ্টার কোনো কমতি রাখবো না। এই শেষ বারের মতো বুবু ওপর একটু ভরসা রাখ…’

বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইল তিতিক্ষা, দীর্ঘ সময় ধরে। একসময় তিহা অধৈর্য হয়ে বোনের গা ঝাঁকালো,’কি রাখবি না?’

হঠাৎ যেন সম্বিৎ ফেরে তিতিক্ষার। ঘনঘন বারকয়েক চোখের পলক ফেলে, ঢোক গেলে। একসময় বাষ্পরুদ্ধ গলায় বোনের কথার স্বীকৃত স্বরূপ বলে, ‘রাখবো…’
চলবে…..

দূর আলাপন ~ ২৩

__________________________
মেয়েকে বিয়ে দেয়ার নিবিড় প্রচেষ্টা শুরু করলেন মারুফ। এতকিছুর পর মেয়ে রাজি হয়েছে। কখন আবার মত বদলে ফেলে… তার আগেই বিয়ের কাজ সমাধা করা প্রয়োজন। অবশ্য প্রথম সম্মন্ধটি ফোনকল পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকল। তিতিক্ষার অতীত শুনে ছেলে মোটা অঙ্কের যৌতুক দাবি করায় প্রারম্ভেই পিছপা হলেন মারুফ। দিন কতক পর সন্ধান পাওয়া গেল আরও একটি ছেলের৷ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সামান্য চাকুরীজীবী। শহরে নেই কোনো স্থায়ী আবাস। মেসে থাকে। ছেলেটির কোনো দাবিদাওয়া নেই। সব জেনেই রাজি হয়েছে। মারুফ পরম শান্তি বোধ করলেন। দুপক্ষের আলোচনার জন্য নির্দিষ্ট হলো দিনক্ষণ। ছেলেটির বাবা নেই। বৃদ্ধ মা গ্রামে থাকেন। শহরবাসী খালার সঙ্গে ছেলে নিজেই আসবে।

তিহার পরিবার নিজেদের মতো আয়োজন শুরু করল। অথচ পাত্রপক্ষ আসবার দিন সকালেও দেখা গেল তিতিক্ষা পূর্বের ন্যায় নির্বিকার। স্পষ্টতই টের পাওয়া যায়, ওর ভেতরে উচ্ছ্বাস আগ্রহ নামক বিষয়াদির কোনো আতিশয্য নেই। না আছে আশু ব্যপার টি নিয়ে সামান্যতম প্রতিক্রিয়া কিংবা কৌতুহল। যাকিছু হচ্ছে আর হবে সেসবকে ও স্রেফ নিজের নিয়তি বলে মেনে নিয়েছে।

বিকেলে কল আসে আফরিনের। তিহা তখন মেহমানদের নাশতার আয়োজনে মহাব্যস্ত। রিনরিনে হাসি হাসি গলায় কুশল জিজ্ঞেস করে আফরিন। তবে ওর উচ্ছ্বাস খানিকটা চাপা পড়ে যায় তিহার শশব্যস্ততার সামনে।
‘আমি ভালো আছি আফরিন। তোমার কি অবস্থা বলো? খুব খুশি মনে হচ্ছে?’

‘খুশির খবরে খুশি হমু না আপু? আর এক সপ্তাহ পরেই তো আমাগর নিনাদ ভাইয়ের বিয়া!’

‘নিনাদের বিয়ে… এরমাঝে তারিখও পড়ে গেছে? এতো তাড়াতাড়ি… বাহ… ‘ বলতে বলতে স্বর নিভে আসে তিহার। বিয়ে নিয়ে নিনাদের বুঝি এতো তাড়াহুড়ো ছিল? অতটাও তিহা আশা করেনি….

আফরিন তখন পুনরায় বলে চলেছে,’শুভ কাজে দেরি কইরা লাভ কি কন? তাছাড়া মাইয়াডাও ভালা পাওন গেছে। সুন্দরী মাইয়া তো, হের ওপর গ্রামে থাকে। রোজ এইগ্রাম ওইগ্রাম থাইকা সম্মন্ধ আসে। এদিকে মাইয়ার বাপের আবার নিনাদ ভাইরেই পছন্দ। তাই আর দেরি করতে চাইলো না কেউ।’

ধাক্কাটা ততক্ষণে কিঞ্চিৎ সামলে নিয়েছিল তিহা। নিস্তরঙ্গ গলায় বলল,’শুনে খুশি হলাম। নিদুর বিয়েটা শেষমেশ তাহলে হচ্ছে…
খানিক ইতস্তত শেষে জানাল,’ আজ অবশ্য আমাদের এদিকেও সামান্য একটা আয়োজন হচ্ছে। তোমাদের জানাতাম। সময় হচ্ছিল না। ভালোই হলো তুমি আজই কল করলে।’

‘কিসের আয়োজন আপু?’

মুহুর্তকাল ভাবে তিহা। তারপর স্বরে প্রসন্নতার মৃদু আভাস এনে বলে,’তিতির জন্য একটা সম্মন্ধ দেখা হচ্ছে। ওদের আজ আসবার কথা। সব ঠিক থাকলে হয়তো আজই আঙটি পড়িয়ে যাবে ইন শা আল্লাহ। দুআ করো আফরিন। খুব ভয়ে ভয়ে আছি…’

কথা শেষ হতেই তিহা শুনলো আফরিন চমকিত হয়ে ফোনের ওপাশে চিৎকার করছে,’ওমা! কি কন আপু! সত্যি? ছোট আপুরও বিয়া! কি আশ্চর্য .. একই সাথে দু বাসাতে বিয়ার ধুম লাগছে। আমার কিযে আনন্দ লাগতাসে… আপনি কেন আরো আগে জানাইলেন না কন তো?’

‘আরে এখনো তেমন কিছু তো হয়নি। শুধু দেখতে আসা মাত্র। এর মাঝেও কত কি হতে পারে… নিশ্চিত না হয়ে কি করে বলি বলতো?’

‘সে কথাও ঠিক। তবে এইবার কিন্তু আর কিছু গোপন করা চলব না। ছোট আপুর বিয়ের সব কাজে আমি থাকমু।’

‘সে তো থাকবেই.. তোমাদের ছাড়া আমাদের এই শহরে আর আছেই বা কে বলো?’ কথার ফাঁকে ঘড়ি দেখে তিহা। আচ্ছা আফরিন, ওরা মনে হয় এবার চলে আসবে। রাখি এখন? পরে কথা হবে। ঠিকাছে? ‘

‘হ্যাঁ হ্যাঁ… রাখেন আপু। পোড়া মুখ আমার। এত ব্যস্ততার মধ্যে আপনেরে কথায় আটকায়া রাখছি। আপনি মেহমানের দিকে নজর দেন আমি বরং খবরটা ফুআম্মারে জানাই।’

লাইন কেটে গেল। ফোন হাতে নিয়ে মুহুর্তকাল স্থির দাঁড়িয়ে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললো তিহা। আশ্চর্য! সময়ের সাথে সাথে সম্পর্ক গুলোও কিরকম পালটে যায়! যে নিনাদ একটা সময় নিজের সমস্ত খুটিনাটি কথাও ওদের না জানিয়ে থাকতে পারতো না আজ সে বিয়ের মতো অতবড় একটা ব্যপার চেপে রেখেছে। এই তাহলে বন্ধুত্বের আদত রূপ? এত ঠুনকো এই সম্পর্কের গাঁথুনি? অথচ বন্ধুদের একসময় জীবন মনে করতো তিহা। শুধু তিহা কেন? মনে করত ওরা সবাই… নিনাদ, নিমি, পাপড়ি, রাকিব…

.

ছেলের নাম রায়হানুল আমিন। বেশ ভদ্র গোছের ছেলে। বসার ঘরে আলাপরত মারুফের মনে মনে বেশ পছন্দ হলো। তিহার সাথে অন্দরে এসেছেন বাকি দুজন অতিথি। পাত্রের খালা ও খালার পুত্রবধূ। তিহা তাদের নিজের ঘরে এনে বসালো। কথায় বার্তায় আর আচরণ পরখ করে মৃদু আভাসও পেয়ে গেল দুজনের মানসিকতার। ওরা বোধহয় কিঞ্চিৎ সঙ্কীর্ণ ঘেঁষা। খালাতো ভাইয়ের বউটি ঘুরে ঘুরে দেখছে তিহার কামরা আর কামরার সমস্ত আসবাব। মেয়েটির চোখে সজাগ সন্ধানী দৃষ্টি। খালা ভদ্রমহিলাটি যেন আরেক ধাপ এগিয়ে। আসার পর থেকে এমন ভাব করছেন যেন তিহা আর তিহাদের গোটা বাড়িটা অচ্ছুৎ। এখানে পা ফেলে তিনি এদের ওপর বড়ই দয়া করেছেন। তিহা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে। মারুফ ফোনে এনাদের মৃদু আভাস দিয়েছিলেন তিতিক্ষার অতীতের ব্যপারে। হয়তো এজন্যই ভদ্রমহিলার আচরণে এই অসঙলগ্নতা।

মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলা একসময় চোখ স্থির করলেন তিহার দিকে। হাসি হীন নির্বিকার মুখ। বললেন, ‘মেয়ে কোথায়? নিয়ে আসো দেখি।’

দুজনের আচরণ খেয়াল করতে থাকা তিহা সম্বিত ফিরে পেয়ে বিনীত ভাবে হাসে,’জি নিয়ে আসছি।’

নিজের ঘরে ওই দুজন মানুষের সামনে নিয়ে যাবার আগে দরজার কাছে এসে তিহা বোনের হাত ধরল। তাকাল বোনের বিবর্ণ হয়ে আসা ত্রস্ত মুখের ওপর।
‘একদম নার্ভাস হবি না। বুবু আছি তো তোর সঙ্গে। শুধু খানিকক্ষণ ওদের পাশে বসতে হবে। পারবি না?’

তিতিক্ষার মুখে অনুমাত্র দোলাচল নেই। উত্তরের আশা নেই বুঝতে পেরে হাত ধরে বোনকে নিয়ে চলল তিহা।

‘আসো.. বসো আমার পাশে।’ ভদ্রমহিলা হাত বাড়িয়ে দিলেন তিতিক্ষার দিকে। নিশ্চল মূর্তির মতো তিতিক্ষা পাশে বসল। শাশুড়ী বউমা দুজনেই বিস্মিত নেত্রে ওকে দেখছেন। ব্যাপার টা খেয়াল করে মৃদু অস্বস্তি তাড়া করে বেড়াতে থাকে তিহাকে। মানুষ গুলোর চাহনি যেন কেমন। তিতিক্ষার পা থেকে মাথা অবধি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।

সহসা ভদ্রমহিলা তিতিক্ষার হাত ধরলেন। মুখে ম্লান হাসি জিইয়ে রেখে বললেন,’ দেখি… তোমার চুল গুলো দেখি।’ কথাটা শেষ করেই অনুমাত্র আভাস না দিয়ে ওদের দুইবোনকে হতভম্ব করে একটানে মাথার অবগুণ্ঠন খুলে অসংকোচে হাত রাখলেন তিতিক্ষার চুলে। খানিকক্ষণ পরখ করার পর মৃদু স্বরে ভেসে এলো মন্তব্য,’সবই তো ভালো…’ মুখে ফুটল অস্ফুট পরিতৃপ্তির হাসি।

অদূরে দাঁড়ানো তিহা বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকে। খেয়াল করে তিতিক্ষার মুখের শিথিলতা হারিয়ে ক্রমে যেন একটু ক্রুর ভাব ফুটে উঠছে। মৃদু ত্রাসভাব ছলকে ওঠে তিহার বুকে। জন্মকাল থেকে শহুরে জীবন যাপনে অভস্ত্য ওরা দুইবোন মেয়ে দেখার এসব উদ্ভট আচার ব্যবহারের সঙ্গে আদতেই অপরিচিত। তার ওপর সকল কিছুতে তিতিক্ষার স্পর্শকাতর হয়ে পড়ার ওই প্রবণতাটা। স্বাভাবিক ভাবেই এসব আচরণ দুবোনের চোখে ভীষণ দৃষ্টিকটু। এমনকি তিহার মৃদু আশঙ্কাও হলো, তার উত্তপ্ত মস্তিষ্কের বোন হয়তো যেকোনো সময় রাগে ফেটে পড়বে।

তিতিক্ষা কে দেখেই কিনা কে জানে, কিছু সময় যাবার পর ভদ্রমহিলার মুখের রূঢ়তা আস্তে আস্তে কমে আসছিল। সহজ স্বাভাবিক আলাপে অভস্ত্য হচ্ছিলেন তিনি। নিজের ভাগ্নে সম্পর্কে একটা দুটো কথাও বলতে আরম্ভ করলেন। পাশে বসা তিতিক্ষা আগের মতই নির্বিকার নিঃশব্দ। সৌজন্যতা বজায় রাখতে অল্পস্বল্প হাসতে হচ্ছিল তিহাকে। অকস্মাৎ ভদ্রমহিলার একটা কথা শুনে থমকে গেল তিহা। ভাগ্নের কথা বলতে গিয়ে তিনি হঠাৎ রাজন নামটির উল্লেখ করলেন। দীর্ঘ দিন ধরেই এই বাড়িতে রাজন নামটির উচ্চারণ কঠিন ভাবে নিষিদ্ধ। এই নিয়ম আপনাতে তৈরি হয়েছে, আর বেশ নিষ্ঠার সাথেই এতকাল পালিত হয়ে এসেছে। ভদ্রমহিলার কথার ঢঙে তিহা বুঝলো রায়হানুল আমিনেরই অন্যনাম রাজন। সঙ্গে সঙ্গে একটা ঢোক গিলল তিহা। স্পষ্টতই টের পেল এই সম্মন্ধ এগোনোর আর কোনো আশা নেই।

তখনো পরম মমতা ভরে ভাগ্নের নাম উচ্চারণ সমেত নানারকম সুনাম গেয়ে যাচ্ছেন তার খালা। পাশে বসা তিতিক্ষার মুখ ক্রমে ফ্যাকাসে হয়ে আসছে। বহুদিন পর ওই নামটা কানের কাছে এত বার শুনে বিভীষিকাময় স্মৃতি পুনরবার জাগরূক হয়ে উঠছে ওর মানসপটে। তিহা কি করবে সহসা ভেবে পেল না। বোনের রক্ত সরে যাওয়া মুখের পানে বিহ্বল হয়ে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ। কিছু বলতে গিয়ে তোতলাতে লাগলো।

ভদ্রমহিলার কথা আর তিহার বিমূঢ়তা সব স্থানু করে দিয়ে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো তিতিক্ষা। মুখ অস্বাভাবিক কঠিন, কপালে ঘাম, আর ফুলে ওঠা শিরার রগ… সবকিছু নিয়ে কম্পিত স্বরে ঘোষণা করল,’আমি আসছি।’

রাজনের খালা ভদ্রমহিলা টি নিতান্তই সরল অথবা অত্যধিক চতুর। তিতিক্ষার রাগ তিনি টের পেলেন না কিংবা ইচ্ছে করেই তার পরোয়া করলেন না। অতর্কিতে ওর হাত ধরে ফেলে ভাবলেশহীন গলায় বললেন,’আরো কিছুক্ষণ বসে যাও।’

এই অনধিকার চর্চা মানতে পারল না তিতিক্ষার নাজুক মন। ক্রোধে শক্ত হয়ে এলো তার হাতের মুঠি। পেছন ফিরে স্থবির স্বরে বলল,’হাত ছাড়ুন।’

দৃষ্টিতে একরাশ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলেন ভদ্রমহিলা।
‘ওমা! এমন করছো কেন? রাগ করলে নাকি?’

তিতিক্ষা আগের কথার পুনরাবৃত্তি করল,’হাত ছাড়ুন আমার।’

‘কি রাগ মেয়ের! অত কাহিনি ঘটাবার পরেও দেখছি তেজ কমেনি!’

যেন আক্রোশে ফেটে পড়ে কেউ তিতিক্ষার গালে প্রবল এক চপটা’ঘাত বসাল। পেছন ফিরে প্রস্তরমূর্তির ন্যায় মধ্যবয়সীর পানে তাকিয়ে রইল তিতিক্ষা।
‘তাকিয়ে আছো কেন? কিছু মিথ্যে বলেছি? অত বাজে অতীত যার সে তো সবার পা সেপে থাকবে। উল্টো তুমি কিনা আমার সাথেই তেজ দেখাচ্ছো?’

বুকটা ধড়াস করে ওঠে তিহার। এসব কি হচ্ছে ঘরে! এসবকিছু কি সত্যিই ঘটছে? কোথায় চারিদিকে খুশির জোয়ার বইবার কথা ছিল আজ.. আর সেখানে কিনা তার বোনকে অতীতের কথা তুলে চরম ভাবে হেনস্তা করা হচ্ছে..
আবারো… আবারো এরকম একটা মানসিক আঘাত পেল তিতিক্ষা। পেল তার বড় বোনেরই জন্য। ইয়া আল্লাহ, এই সব মিথ্যে হয়ে যাক। যা কিছু আজ হলো সব তুমি দুঃস্বপ্নের মত ক্ষণস্থায়ী করে দাও। কিচ্ছু চাই না। দরকার নেই আমার বোনের বিয়ের। শুধু এই লাঞ্চনা থেকে তুমি আমার বোনকে উদ্ধার করো!’

রাজনের খালা অতটুকুতে থামলেন না। বয়সজনিত কর্তৃত্বের নিরিখেই তার মনে হলো মা হীনা এই দুই তরুণী কে আরো কিছু সৎ উপদেশ দেয়া উচিত। কড়া গলায় আরো দু চার কথা শুনিয়ে তিনি খান্ত হলেন। নিরবে সবটা গলাধঃকরণ করল তিতিক্ষা। কথা শেষ হলে শান্তভাবে একবার তাকাল বোনের মুখে। তারপর ধীরস্থির পদক্ষেপে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার কয়েক মুহুর্ত পর তিহা শুনলো পাশের ঘরের দরজাটা মৃদু শব্দে বন্ধ হয়ে যেতে।
চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে