দূর আলাপন পর্ব-২০+২১

0
195

দূর আলাপন ~ ২০
____________________________
নিনাদের ঘুম ভাঙে বিদঘুটে গরমে। মাথার ওপর ঘুরতে থাকা ফ্যানের বাতাসে তাপদাহের ছোঁয়া। হাতের ভাজে চিটচিট করছে ঘাম। মস্তিষ্কটা নাকাল, গায়ে দীর্ঘ নিদ্রাজড়িত আলস্য। ঘুমের রেশ লাগা বোজা বোজা চোখে প্রথমে সে কিছু বুঝতে পারে না। ভাবে আমেরিকাতেই আছে এখনো। তবে গরমটা যেন এখানকার আবহাওয়ার তুলনায় অস্বাভাবিক বেশি। রুম হিটার ছাড়া যেখানে চলে না একমুহুর্ত আজ হঠাৎ সেখানে চলছে ফ্যান….

ক’টা বাজে জানা দরকার। ক্লান্তি ঝেড়ে উঠে বসে নিনাদ। পাশে হাত রাখতেই ফোনটা পেয়ে যায়। সকাল আটটা ত্রিশ। সময় দেখে চোখ কচলাতে কচলাতে ঘরে তাকিয়ে থমকে যায়। এ কোথায় সে! কয়েক পল কাটে হতবিহ্বলতায়।
ঘিঁয়ে রঙা সেই পুরনো পলেস্তারা খসা দেয়াল, খয়েরী রঙের কাঠের আসবাব, আকাশী রঙা চাদর, পর্দা… এ-তো তার নিজের ঘর!
এখানে এলো কবে? নাকি স্বপ্ন দেখছে? মাথাটা ভীষণ ফাঁকা লাগে নিনাদের। দুহাতে কপাল চেপে ভাবতে চেষ্টা করে আদত ব্যাপার টা কি।
ধীরে ধীরে… ক্রমে ক্রমে একের পর এক বিচ্ছিন্ন ঘটনা জোড়াতালি দিয়ে গোটা চিত্রটা নিনাদের চোখে পরিষ্কার হয়। হ্যাঁ, সে নিজেই এসেছিল বাংলাদেশে। এসেছিল রবিবার বিকেলে। তারপর… আগেপিছে কিছু না ভেবেই চলে গেছিল তিহাদের বাড়ি। গিয়ে… নিনাদের মনে পড়ল না যাবার পর কি হয়েছিল আর নিজের বাসাতেই বা ফিরে এসেছে কিভাবে!

তবে আস্তে আস্তে সেসবও স্মরণে আসে। মনে পড়ে একটা দুর্বিনীত অসহায় ঘোরের মধ্যে বিকেলে পথে নেমেছিল সে। উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাটতে হাটতেই বোধহয় একসময় একটা সিএনজি ডেকে ফিরে এসেছিল বাড়ি। তারপর… তারপর… ফুআম্মা আর আফরিনের অজস্র প্রশ্নের মুখোমুখি। কোনোকিছুর প্রত্যুত্তর না করে নিনাদ চলে গেল নিজের ঘরে। জেটলেগের ক্লান্তি, মানসিক অস্থিতিশীলতা আরো যেন কি কি… সব মিশে একাকার করে ফেললো নিনাদের অসুস্থ মনকে। পোশাক পর্যন্ত বদলানোর শক্তি রইলো না। বিছানায় শুতেই গহন ঘুমের কিংবা অচৈতন্যের রাজ্যে ডুবে গেল সে…

এক সন্ধ্যা থেকে শুরু করে সকাল পর্যন্ত ঘুমিয়েছে নিনাদ। কি সর্বনাশ! তিন ওয়াক্তের সলাত কাযা করেছে। ফুআম্মাও নিশ্চয় চিন্তায় পাগল হয়ে আছেন। তড়িঘড়ি করে নামতে গিয়ে কবজিতে অকস্মাৎ একটা যন্ত্রণার ধাক্কা টের পায়। সঙ্গে সঙ্গে চোখ চলে যায় ব্যান্ডেজের দিকে। ভুলেই গেছিল হাতের ক্ষতটার কথা।
ঠিক এক বছর এক মাস পর বাংলাদেশে ফিরল। ভেতরে বাহিরে ক্ষত নিয়ে। এমনকি ঘরে ফিরে পরিবারের মানুষদের সঙ্গে ঠিকঠাক কথাও বলেনি। ডুবে গেছিল নিজস্ব দুঃখবোধের নিভৃত আলয়ে। ফুআম্মা আর আফরিনের মনে নিশ্চয়ই হাজার প্রশ্নের উদ্রেক ঘটিয়েছে ওর উদ্ভট আচরণ। ফুআম্মাকে দেয়ার মতো একটা যুতসই ব্যাখা এখন দ্রুত দাঁড় করানো প্রয়োজন।

আর কিছু ভাবার আগেই দরজার নব নড়েচড়ে ওঠে। নিনাদের যতদূর মনে আছে কালরাতে দরজার নব ভেতর থেকে সে বন্ধ করে ঘুমিয়ে ছিল। বোধহয় এতক্ষণে ওরা চাবির সন্ধান পেয়ে গেছে। দরজা খুলে গেল। ওপাশে আফরিন। হতবাক হয়ে একপলক তাকিয়ে থাকল তার পানে, তারপর দ্রুত ঘুরে চলে গেল। কিয়ৎক্ষণ পরেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন শিউলি। পেছন পেছন আফরিন।

চোখের পানি, নাকের পানি এক করে অবুঝ মেয়ের মতো নিনাদকে ধরে শিউলি কিছুকাল আহাজারি করলেন। সংশয়, দুশ্চিন্তা ভরা প্রশ্ন করে করে নিনাদকে করে তুললেন ব্যতিব্যস্ত।

.

তখন সকাল দশটা। ফুআম্মার জোড়াজুড়িতে নিনাদকে গোসল, খাওয়া দুটোই সম্পন্ন করতে হয়েছে। একফাঁকে নিনাদ পড়ে নিয়েছে কাযা সলাত গুলো। ফুআম্মা এতক্ষণ পাশে পাশেই ছিলেন, সবে গেলেন আফরিনের রান্না তদারক করতে। দীর্ঘদিন পর ছেলে প্রবাস থেকে ফিরেছে। ভালো কিছু রান্না না হলেই নয়।
যাবার আগে অবশ্য ঘরের সব কটা জানালা খুলে দিয়ে গেছেন। গ্রিলের ফাঁক গলে আসছে মন ভালো করা সকালের মিঠে রোদ।
ঢাকার সাদামাটা এই সকালের সময়ের ছবি আমেরিকায় থাকতে প্রায় রোজ মনে পড়তো নিনাদের। অথচ আজ জানালার পাশে বসে সুতীব্র আলোক রশ্মিতে অবগাহন রত হয়ে এসব দৃশ্য ঠিক তেমন উপভোগ্য মনে হচ্ছে না। মাথার দুপাশে চিনচিনে ব্যথা। কড়া এককাপ ব্ল্যাক কফি এই মুহুর্তে বিশেষ প্রয়োজন। সবচেয়ে ভালো হতো যদি নিজে বানিয়ে খাওয়া যেত। গুড স্ট্রিডের ওই একফালি উঠোন সমেত বাড়িতে যা সে রোজই বানাতো।
কিন্তু এখন ওর বিছানা থেকে নামা আর হাটাচলার ব্যপারে ফুআম্মা কড়া নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। অগত্যা বিছানার বাজুতে মাথা হেলিয়ে নিনাদ পুনরায় চোখকে বিশ্রাম দেবার চেষ্টায় রত হয়। তখনো মনের মধ্যে দাপিয়ে বেড়াতে থাকে তীব্র এক অস্থিরতা। নিনাদের ঘুমন্ত বিবেক ওকে স্মরণ করিয়ে দেয়, শুধু প্রিয় মানুষ গুলোর সঙ্গে দূরত্ব ঘোচানোর নিমিত্তে সে এদেশে ফিরে আসেনি।

পলকা তন্দ্রাঘোরে নিনাদ একবার শোনে দূরে… বহু দূরে একনাগাড়ে কেউ ওকে ডেকে চলেছে। মিহি স্বরের মন্দ্রিত আহ্বান। খানিক পর একটা মন্থর পায়ের ধিমিধিমি আওয়াজ ক্রমে নিকটবর্তী হয়। বিচরণ করতে থাকে ওর ঘরজুড়ে। সে হাটছে… ঘরময় মৃদুমন্দ সুরের লহরী, বাতাসে তার নিশ্বাসের সৌরভ হাসনাহেনার গন্ধের মতো ভাসে… অন্যমনে একেবারে অকারণে সহসা ডেকে ওঠে নিনাদ, ‘তিতিক্ষা…..’

দরজা ঠেলার কর্কশ শব্দে ভাঙে তন্দ্রা ওর। নিনাদ সচকিত হয়ে তাকায়। ঘরজুড়ে সমান লয়ে রিমঝিম নেচে চলেছে আলো এবং অন্ধকার। যে এগিয়ে আসে তাকে দেখে এতক্ষণ পরে নিনাদের বুক চিরে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস বেরিয়ে আসে। পলকা অভিমানে মুখ ফেরায় সে। তিহা বিছানা থেকে অনেকটা দূরে, একখানা কাঠের চেয়ার টেনে বসে। ক্লান্ত, গম্ভীর মুখ। যে মুখ অনেকদিন হাসে না, আনন্দ কলরোলে উচ্ছ্বাসিত হয় না, যার বুকের হিমে তরঙ্গ ছলকে ওঠে না যখন তখন। পুরনো বন্ধুর এই ক্লেশ জড়িত কান্তি দেখে তার ভেতরের অবস্থা খানিকটা আন্দাজ করে নেয় নিনাদ।

‘কেমন আছিস?’ পরিশ্রান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করা প্রশ্নটা বাতাসে ভর করে নিনাদের কানে এসে থামে।

‘ভালো… আলহামদুলিল্লাহ।’ থেমে থেমে বলে নিনাদ। ‘তুই?’

‘আমিও… আছি একরকম… ‘ সবসময় বলা তিতিক্ষার একটা কথা মনে পড়তেই তিহা সাথে যোগ করে ‘আলহামদুলিল্লাহ আলা কুল্লি হাল’

সৌজন্য জ্ঞাপনের পরই কথা হারিয়ে ফেলে ওরা। অথচ আগে ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যেত বন্ধুরা কেউ একবার কথা শুরু করলে। সেসব দিনের কথা ভেবে আজকাল খানিকটা আফসোস হয় তিহার। তার জীবন যাপনের পদ্ধতিটা বোধহয় বড় বেশি হালকা ধাঁচের ছিল। কোথাও কোনো গভীরতা নেই, স্থিরতা নেই, নিয়ন্ত্রণ নেই। ছেলেবেলা থেকেই বেশ একটু বেপরোয়া ছিল ওর চলাফেরার ধরন। বড় বেলায় এসেও যখন ইচ্ছে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরেছে, সন্ধ্যারাত পর্যন্ত আড্ডা দিয়েছে ক্যাম্পাসে, মর্জি হলেই খেতে চলে গেছে কোনো নামি-দামি রেস্তোরাঁতে। ইচ্ছেমতো বাঁচতে গিয়ে জীবনবোধ টোধ আর তেমন ভাবে জন্মাতে পারে নি। নিছক রংতামাশায় ডুবে থেকে সব একেবারে রসাতলে গেছে।

কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে থাকে তিহা। একসময় অপ্রাসঙ্গিক ভাবে বলে,’কাল এসে অনেকক্ষণ বসেছিলাম আমি আর বাবা। তুই সাড়া দিস না, দরজা খুলিস না…ওদিকে ফুআম্মা কেঁদেকেটে একাকার।’

‘কিচ্ছু টের পাইনি৷ রুমে এসেই শুয়ে পড়েছিলাম। একেই ধরল জেট লেগ, তার ওপর আগের রাতটাও নির্ঘুম কাটাতে হয়েছে ফ্লাইট ধরার জন্য। সব মিলিয়ে খুব টায়ার্ড ছিলাম।’

‘হাতের আঘাত টা কবেকার? হাসনাত তো এসব কিছু বলেনি!’

‘বলতে আমিই নিষেধ করেছিলাম।’

‘কেন?’

নিনাদ প্রতুত্তর করল না।

নিশ্বাস ফেলে পুনরায় কথা শুরু করল তিহা,’ফুআম্মা খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন গোটা ব্যাপার টা নিয়ে। ওখানে তোর অসুস্থ হয়ে পড়া… তারপর না বলেকয়ে হঠাৎ দেশে ফিরে আসা…

তিহার শেষ কথাটা শুনে নিনাদ বাঁকা হাসে।
‘আমার চলে আসায় ফুআম্মা দুশ্চিন্তাগ্রস্থ! অথচ যাবার বেলা ফুআম্মার আপত্তিই ছিল সবচেয়ে প্রবল।
ছাড়, তোর কথা বল? আমি আসাতে তোরও কোনো অসুবিধা হয়নি তো? না মানে এখন তো আমি আছি, বোনের বিয়ে দিতে চাইলে হয়তো যেকোনো সময় বেগড়া দিয়ে বসতে পারি!’

একটু আহত ভাব ফুটে ওঠে তিহার চোখে। অস্ফুটে বলে, ‘নিনাদ!’
তারপরই গুম হয় দীর্ঘ সময়ের জন্য। মুখ নিচু, চোখের পলক পড়ছে না। ভেতর ভেতর তিহা পুড়তে থাকে তীব্র অনুতাপবোধে। ভুল কিছু তো বলেনি নিনাদ। একটা সময় সত্যিই এমন ছিল তিহার ধারণা যে তিতিক্ষার বিয়েতে সবচেয়ে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে নিনাদ। কিন্তু খেলার ছক এভাবে উলটে যাবে কে জানতো?
যা কিছু আজ হয়েছে তার পেছনে সবচেয়ে বড় দোষটা বোধহয় তিহারই। অস্বীকার করতে পারে না সে। দু দুটো মানুষের জীবন জ্বলে পুড়ে তচনচ হয়েছে। আর মাঝে দাঁড়িয়ে তিহা ওদের অঙ্গার হতে দেখছে।

জানালার বাইরে ঝলমলে রোদ্দুর ঘেরা সকাল হঠাৎ ঘনঘোর হয়ে উঠল। অকস্মাৎ আলোর মাত্রা কমে এলো ঘরে। দুচোখে অশ্রুসায়র নিয়ে মুখ তুললো তিহা। প্রায়ান্ধকার ঘরেও যা নজর এড়ালো না নিনাদের।
‘নিনাদ, ভাই আমার, আমায় ক্ষমা করে দে।’ তিহার বাষ্পরুদ্ধ স্বরে আর্তনাদের মতো শোনালো কথাগুলো।

সহসা প্রতুত্তর করল না নিনাদ। যেন জানে এখনি তিহা আবার কিছু বলবে।
‘আ.. আমার ভুলের জন্যই এসব হয়েছে। আমি…. আমি… আমার বোনের খেয়াল রাখতে পারিনি। অথচ ও ছিল আম্মার রেখে যাওয়া শেষ আমানত…
আমার তিতির বিয়ে হবে… কত আলো জ্বলবে, মানুষ আসবে… এসবের উচ্ছ্বাসে অনেক জটিল বাস্তবতা আমার নজর এড়িয়ে গেছিল। ভুলে গেছিলাম সেই মানুষ রূপী হায়নার কথা, তার হুমকির কথা। শেষ পর্যন্ত আমার ভালো বোনটাকে সেসবের খেসারত দিতে হলো… ‘ তিহা হু হু করে কাঁদছে। কান্নার সঙ্গে ঝরছে তার বুকভাঙা হাহাকারের বেদনা। কান্নার রূপ এমন করুনও হয়! বড় কষ্ট হলো নিনাদের। ব্যস্ত গলায় বলল,
‘আহা… কিসব ছেলেমানুষী তিহা। দোষ কেন তোর হতে যাবে? ভাগ্য বলেও তো কিছু থাকে। তাছাড়া… আমিই বা কে যাকে তুই কৈফিয়ত দিচ্ছিস?’

সহসা মুখ তোলে তিহা। স্বরে প্রকাশ পায় বিস্ময়, ‘তুই ওর কেউ না?’

নিনাদ ওর ভুল ধারণা ভেঙে দেয়, ‘না। আমি শুধু তোর ভালো বন্ধু।’

তিহা মুহুর্তকাল স্তব্ধ থাকে,’তবে কেন ওর বিপদের কথা শুনে দূরদেশ থেকে ছুটে এলি? কেন আমার বোনের জীবনের সবচেয়ে বড় বিপর্যয়ে তোর নার্ভাস ব্রেকডাউন হলো?’

কিছু কথার উত্তর নিনাদের কাছে নেই। গম্ভীরতার চাদরে নিজেকে আড়াল করে তাই সে প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে।
‘প্লিজ তিহা এই নিয়ে আর কথা নয়। যেকোনো সময় ফুআম্মা চলে আসবেন।’

‘সেই ভালো। বোন আমার, সে সম্পর্কিত যাবতীয় বোঝাপড়াও আমারই করা উচিত। তুই সবে ফিরলি। কিছুদিন রেস্ট নে। সামনে বিয়ে, তা নিয়ে ভাব। নতুন জীবনের শুরুটা যেন নির্ঝঞ্ঝাট হয় দুআ রইল। ভালো থাকিস।’ দ্বিতীয় কোনো কথার সুযোগ না দিয়ে তিহা ঘর ছাড়ল।

চলবে…..।

দূর আলাপন ~ ২১

____________________________
বুকভরা বেদনার ফুলঝুরি নিয়ে বাড়ি ফেরে তিহা। নিনাদ বলেছে সে শুধু তিহার ভালো বন্ধু। আর কোনো সম্মন্ধ নেই তিহার পরিবারের সঙ্গে। হ্যাঁ, তাই তো! এমনি তো হবার কথা। অকারণে তিহা বেশিকিছু আশা করে বসেছিল ওর কাছে। আবেগের ঘোরটপে বাঁধা পড়ে বিস্মৃত হয়েছিল বন্ধুত্বের সীমারেখা।

এই ভুল তিহা দ্বিতীয় বার করবে না। আর কখনো যেচে যাবেনা নিনাদের কাছে। নিনাদের সামনে ভালো একটা সময় আসছে। সারাজীবন নিবিড় একাকীত্বের কষ্ট সয়েছে ছেলেটা। শীঘ্র শুরু করতে যাচ্ছে নতুন সংসার। এইবার ওকে ওর মতো একা ছেড়ে দেয়া উচিত। কেন ওর ভালো সময়ের আগে নিজের দুঃখের ঝাপি খুলে বসে নিনাদের চিরকালের কষ্টসহিষ্ণু মনটাকে আরো একবার অনবদমিত করে দেবে তিহা?

তারচেয়ে এইবার গুরুত্বের সাথে বোনের জীবন গোছানোর কথা ভাবা যাক। একটা নিজের সংসার, নিজের মানুষ… তিতিক্ষার মতো মেয়েদের জন্য এসব চাওয়া কি খুব বেশি কিছু? ভীষণ যত্ন আর ভালোবাসায় ভরপুর আপনার একটা সংসার কে না চায়? অতীতে যা কিছু হয়েছে তাতে তিতিক্ষার তো কোনো দোষ ছিল না। তিহা কানাঘুঁষোয় শুনেছে রাজন নাকি বিয়ে করেছে। বউ নিয়ে সেদিন ঘুরেও এসেছে বালি থেকে। অথচ.. যে মেয়েটার জীবন সে তচনচ করল, গোটা সমাজের কাছে সেই মেয়ে আজ ঘোর কলঙ্কিনী। ওর ঘর থেকে বের হওয়া বারণ, বিয়ে করা বারণ, সামান্য একটু হাসাও বারণ। তাহলেই লোকে বলবে, ‘নির্লজ্জ মেয়ের অবস্থাটা দেখো। এত বড় ঘটনার পরেও ওই মুখে এখনো হাসি আসে! ‘

অথচ যার দোষে এই কলঙ্ক হলো সে আজ ষোলো আনা স্বাধীন, কেউ ওর দিকে আঙুল তুলছে না, কটু কথা শোনাচ্ছে না। তৎপরিবর্তে মজলুমকে নিষেধের যাতা কলে প্রতিনিয়ত পিষ্ট করে যাচ্ছে এই সমাজ। আজকাল তিহার ঘৃণা হয় এই সমাজ আর সমাজের সব নিয়ম কানুনের প্রতি।

.

বাসায় ফিরতে ফিরতে বেলা একটা বেজে গেল। দরজা খুললেন মারুফ। হাতে পত্রিকা, মুখে মৃদু হাসিখুশি ভাব। কারণ টা তিহার বোধগম্য হয় না।
‘কি অবস্থা দেখে এলে ওর?’

তিহা নিশ্বাস ফেলে বলে,’ভালো, বেশ ভালো বাবা।’

‘আলহামদুলিল্লাহ, আচ্ছা এখন ভেতরে যাও মা।’

‘যাই..’ মাথা নুইয়ে ডাইনিং ছাড়িয়ে তিহা ভেতরের দিকে পা বাড়ায়। ডাইনিংয়ের পরেই রান্নাঘর। সেখান থেকে ভেসে আসছে টুকটাক আওয়াজ। ভেতরে এক পা ফেলে মুহুর্তের জন্য থমকায় তিহা। চুলার পাশে দাঁড়িয়ে বেশ মন দিয়ে তিতিক্ষা কি যেন রাঁধছে। পেছনে নিরাপদ দূরত্বে থেকে উৎসুক ভাবে মিমির রান্না দেখছে ছোটন।

তিহার মনে পড়ে না গত ছ মাসে একবারের জন্য বোনকে রান্নাঘরে দেখেছে কিনা। আজ তবে হঠাৎ…. তাহলে কি ওর বোনটা একটু একটু করে সুস্থ হতে আরম্ভ করেছে? ফিঁকে একফালি আশার আলো তিহার মনে ছলকে ওঠে। পেছন ফিরে ছোটনকে কি যেন বলতে গিয়ে সহসা তিহাকে দেখে কিঞ্চিৎ অপ্রতিভ হয়ে পড়ে তিতিক্ষা। কথাটা মাঝ পথে থাকতেই ভেতরে টেনে নেয়। জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ায় চুলোয় পাশে। বুবুর রান্নাঘর, বুবুর সংসার। দীর্ঘ সময়কাল ধরে এসব একা সামলাচ্ছে তো বুবুই। এতদিন পর আজ হঠাৎ এখানে তিতিক্ষার আসাটা হয়তো অনভিপ্রেত লাগবে বুবুর কাছে। স্বাভাবিক ভাবেই নিজের গোছানে সংসারে মেয়েরা অন্যের কর্তৃত্ব অপছন্দ করে।

তিহা ততক্ষণে বোনকে দেখে নিজের জায়গায় বিমূঢ়, ‘কিরে, রান্নাঘরে কি করছিস তুই?’

বোনের বলার ধরনে তিতিক্ষার অস্বস্তি আরো বাড়ে।
জবাবদিহির মতো খুন্তি সমেত হাতটা নামিয়ে ফেলে বলে,’ছোটনের খুব খিদে পেয়েছিল। বুয়া খালা আসেননি। ছোটন বলছিল নুডুলস খাবে, তাই….’

‘তুই নুডুলস রেঁধেছিস! দেখি ‘ ঔৎসুক্যে তিহা ঝুকে পড়লো প্যানের ওপর। কুচনো আদা, ছোট ছোট মাংসের ফালি, আর ডিম সমেত তিতিক্ষার এই নুডুলসের রেসেপি ছোটনের ভীষণ পছন্দ।

‘কি সুন্দর সুঘ্রাণ আসছে রে.. আমিও ভাগ পাব তো?’

বুবুর হালকা মেজাজ বুঝে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে তিতিক্ষা। ম্লান হেসে গিন্নির মতো ভারিক্কি আওয়াজে বলে,’সবাই ভাগ পাবে। বসার ঘরে চলো।’

‘তোরা যা, আমি এক্ষুনি বোরকা টা ছেড়ে আসছি…’

.

বারান্দায় বসে মারুফ পা নাচাচ্ছেন। হলুদাভ ল্যাম্পপোস্টের মায়াবী আলো চুইয়ে আসছে ভেতরে। সন্ধ্যায় এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। কামিনী ফুলের সুবাস বয়ে আনছে ঝিরিঝিরি শীতল বাতাস। ফুড়ফুড়ে মেজাজে থাকা মারুফ আপন মনে একটু গুনগুনিয়ে উঠলেন। আজকের দিনটাই অন্যরকম। সব ভালো ভালো ঘটনার সমাহারে পূর্ণ বিশেষ একটা দিন। তিতিক্ষার নিজের হাতে নাস্তা করে খাওয়ানো যেমন অবিশ্বাস্য ছিল তার চেয়েও অবিশ্বাস্য ছিল ডাইনিংয়ে সবার সাথে একসঙ্গে ওর খেতে বসা।

‘বাবা আসবো?’ দু কাপ চা হাতে তিহা দাঁড়িয়ে আছে।

‘আসো মা।’

‘আজ যে তোমায় খুব খুশি দেখছি বাবা?’

মারুফ আহ্লাদিত হলেন, ‘আমার তিতি মাকে দেখেছিস? আজ কেমন স্বাভাবিক ব্যবহার করছিল!’

‘দেখলাম। কিন্তু আল্লাহ না করুক যদি আবার বিগড়ে যায়… ‘

‘সে সম্ভবনাও ফেলে দেয়া যায় না। তবে তিতি আজকাল আগের চেয়ে খানিকটা স্বাভাবিক। তাই না?’

তিহা অন্যমনস্ক ভাবে মাথা নাড়লো, ‘হ্যাঁ। আ..
বাবা… তিতিকে নিয়ে একটু কথা ছিল। তোমায় সময় হবে?’

‘বসেই তো আছি। কি কথা?’

‘একটা জিনিস খেয়াল করেছো বাবা? চারপাশে এখন বিয়ের খুব ধুম। আফরিন মেয়েটার বিয়ে হলো, সামনে নিনাদেরও বিয়ে। তিতিক্ষার কাছে দূরের যে গুটিকয়েক বান্ধুবি ছিল শুনেছি ওদেরও প্রায় সবার বিয়ে হয়ে গেছে। অনার্সে ওঠার পর সহশিক্ষায় থাকবে না বলে তিতি পড়া ছেড়ে দিল। পড়লে এতদিনে হয়তো ওর অনার্সটা শেষ হয়ে যেত। ওর বয়সী মেয়েরা এখন কি সুন্দর গুছিয়ে সংসার করছে।
আর আমার বোনটা…. তিতি তো পুরোপুরি পাগল নয় বাবা। এক বড় বিপর্যয়ের ধাক্কায় হয়তো খানিকটা মানসিক ভাবে এলোমেলো। কত ত্রুটিপূর্ণ ছেলেমেয়ের তো বিয়ে হয়। আমাদের তিতির হতে পারে না?’

হাসিখুশি মারুফ গম্ভীর হলেন, কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললেন,’খুবই জটিল প্রশ্ন রে মা। এই যুগে ভালো ছেলের সন্ধান পাওয়া এমনিতেই দায়। তার ওপর তিতির অতীত জানার পর হয়তো কেউ আর রাজিই হবে না। আমার মেয়ের কোনো দোষ না থাকুক। কিন্তু সব কলঙ্কের দাগ তো মুছে ফেলা যায় না। তাছাড়া অত ভালো মনের ছেলে পাব কই বল?’

সেই তো… জেনেশুনে কে বিয়ে করবে ওর বোনকে? এমন কত মেয়ের কথা শোনা যায় সেচ্ছায় চরিত্রহনন করেও যারা শেষমেশ বাবা মায়ের ঠিক করা পাত্রের সঙ্গে সাচ্ছন্দ্যে বিয়ে করে হেসেখেলে সংসার ধর্ম করছে অথচ কোনো অন্যায় না করেও সমাজের সব তিতিক্ষাদের জীবনটা হয় অভিশপ্ত।

‘তবু একবার চেষ্টা করে হয়তো দেখা যেতে পারে। বয়স তো আমারো কম হলো না। আর কদিন বাঁচি না বাঁচি… খুব দুশ্চিন্তা আজকাল। মেয়েটার একটা গতি করে যেতে না পারলে..

‘চেষ্টা করে দেখবে বাবা?’

‘করবো ইন শা আল্লাহ।’ মারুফ নিবিড় হন। মুখে চিন্তার ছায়া। তিহাটা আজ হঠাৎ বোনের বিয়ে নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়ল কেন বুঝতে পারছেন না।

তিহাও বলতে পারল না ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কাছ থেকে পাওয়া অপ্রত্যাশিত আঘাতই ওকে আজ হঠাৎ বোনের ভবিষ্যত ভাবনায় দৃঢ় হতে উদ্দীপ্ত করেছে।

.

শুরুতে মেয়ের কথা শুনে দূরভিশঙ্কায় অস্থির হলেও তিতিক্ষার বিয়ের প্রসঙ্গ নিয়ে মারুফ প্রায় সারারাত ভাবলেন। বার্ধক্যের শরীর, সহজে ঘুম আসতে চায় না। খোলা বারান্দায় বসে মেয়ে দুটির ভবিষ্যত চিন্তায় কেটে গেল অর্ধেক রাত।
ফজরের পর চা খেতে বসে বড় মেয়েকে প্রথম নিজের সিদ্ধান্তের কথাটা জানালেন।

‘তিতি কোথায়? এখনো ঘরে?’ মারুফের স্বরে কিঞ্চিৎ ফিসফিস ভাব।

‘হ্যাঁ, কুরআন পড়ছে।’

‘আচ্ছা, এখানে বসো, কথা বলি।’

তিহা বাবার পাশে চেয়ার টেনে বসে,’বলো বাবা।’

‘মা রে শোন, সংসার হলো জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষাক্ষেত্র। সংসারের প্রয়োজনে মানুষ বদলায়, বদলাতে হয়। এমন কত বাউন্ডুলে ছেলেকে দেখেছি সংসারে পড়ে একেবারে দায়িত্বজ্ঞান বোধ সম্পন্ন পুরুষ হয়ে উঠেছে।
আমার তিতির জীবনের দুঃখ ফেলনা নয়, তবে চেষ্টা করলে হয়তো এই অসীম দুঃখবোধকেও খানিকটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। তিতির কাছে আর কোনো ভালো থাকার উপকরণ নেই বলেই দুঃখটাকে কেন্দ্র করে সে সারাক্ষণ ঘোরে।
এইযে একা একা কাঁদা, কথা বলা, ভাঙচুর করা… বাস্তবিক জটিলতায় পড়লে নিজের দুঃখ নিয়ে এত স্পর্শকাতর হবার সময় কি ওর হতো?
কথাগুলো হয়তো রূঢ় শোনাচ্ছে। না রে মা?
ভাবছিস সংসার তো তাহলে খুব মন্দ জিনিস। ব্যস্ততায় আটকে মানুষকে আত্মবিস্মৃত করে দেয়।
হ্যাঁ, হয়তো খানিকটা তাই। কিন্তু সংসারে রূঢ় বাস্তবতার পাশাপাশি থাকে গভীর মায়ার শৃঙ্খল। যে একবার সংসারে ঢোকে, মায়ার মজবুত আবেষ্টন তাকেই আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ফেলে। তখন সংসারের জন্য রক্ত জল করা সব পরিশ্রম, সমস্ত আত্মত্যাগকেও সামান্যই মনে হয়। সংসার হলো কাঁটা গাছের ফুলের মতো। কাঁটা বিঁধে যাবার যন্ত্রণাও যেমন থাকে, তেমনি থাকে নির্মল ফুলের সৌরভ।

আমি আশা করছি তিতিক্ষার এইসব একাকী কষ্টের দিনগুলো হয়তো আর থাকবে না, যদি ওকেও আমরা একটা সংসার গড়ে দিতে পারি।’

তিহা বিহ্বলতা কাটিয়ে শুধু জানতে চায়, ‘ওকে সংসার গড়ে দেবে? কিন্তু কিভাবে বাবা?’

মেয়ের চোখে শঙ্কার ঝাপতাল মারুফের দৃষ্টি এড়ালো না। বললেন,’আমাদের মেয়ের যেহেতু একটা খামতি আছে, এমন কাউকেই আমাদের খুঁজতে হবে যে খামতি সহ আমার মেয়েটিকে গ্রহন করতে প্রস্তুত। তাতে হয়তো আগের মতো ভালো ঘর, ভালো বর পাব না। একটা দরিদ্র ছেলে যদি খুঁজে পাই, যার সঙ্গে বিয়ে হলে আমার মেয়েটা আমার কাছেই থাকবে… আমি একা মানুষ, তিতি মা যদি স্বামী সংসার নিয়ে চিরকাল আমার কাছে থাকে তবে তো আমি বর্তে যাই।
তুই কি বলিস?’

‘তাই হোক বাবা। কিন্তু তিতি… কি করে ওকে এসবের জন্য রাজি করাই?’

‘একদিনে তো কিছু হবে না। সময় সুযোগ অনুযায়ী রোজ অল্প অল্প বোঝালে একসময় তিতি হয়তো বাস্তবতা বোঝার চেষ্টা করবে। দেখ তুই পারিস কিনা।’

‘দেখবো।’ বলে তিহা মলিন মুখে একটু হাসে।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে