তুমিময় আসক্তি পর্ব-১৩

0
1126

#তুমিময়_আসক্তি
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্ব_____১৩

সূর্যের তেজ কমে এসেছে অনেকটাই। মাঝে মাঝে দমকা বাতাস উড়িয়ে দিয়ে চলেছে জানালার সাদা পর্দা গুলো। সেদিকে আমার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই! জানালা ভেদ করে বাইরে তাকিয়ে আছি আর বাগানের গাছে বসা চড়ুই পাখিগুলোর কিচিরমিচির শুনছি ও দেখছি।

-ভাবী, তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিন। সময় তো বেশি নেই!

মনযোগে ব্যাঘাত ঘটলো। ঘাড় ঘুরিয়ে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই দেখলাম, নিহাল ভাইয়া মুখে হাসি ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দুই হাত ভর্তি এক গাদা শপিং ব্যাগ। তার পেছনে তিনটা মেয়ে। ভ্রু কুঁচকে বললাম,

-আপনার হাতে ওসব কী, নিহাল ভাইয়া?

-আপনাকে বউ সাজতে হবে না? এগুলো আপনার শাড়ি-গহনা আরও কী কী যেন! আজ তো আপনার আর ভাইয়ের বিয়ে!!

নিহাল ভাইয়া মুখের হাসিটা আরোও সম্প্রসারিত করে বললেন কথাটা। ছেলেটা অনেক প্রাণোচ্ছল আর উৎফুল্ল থাকে সবসময়। এইকয়দিনে যতো বার দেখেছি, মুখে হাসি ছাড়া একটা কথাও বলতে দেখিনি। সবসময় নির্জনের সাথে ছায়া হয়ে থাকে। অর্থাৎ নির্জনের ডান হাত, বা হাত দুটোই হলেন নিহাল ভাইয়া।

ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বললাম,

-বিয়ে! কোনো রিচ্যুয়াল তো করলেন না! না হলুদ আর না মেহেদী। বিয়ের আমেজ বলতে কিছু তো ফিল হচ্ছে না!

-আরে ভাবী, ফিকার নট! বিয়েটা বোরিং লাগছে তো কী হয়েছে? রিসিপশনটা দেখবেন সেই লেভেলের ধুমধাম করে হবে!

-বাসায় যাবো কখন?

-সন্ধ্যার পরপরই! এখন রেডি হয়ে নিন। এই যে, এরা আপনাকে বউ বানিয়ে দিবে, আই মিন, সাজিয়ে দেবে আর কি!

নিহাল ভাইয়ার কথা শুনে মেয়েগুলো হেসে দিলো। নিহাল ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে হেসে চলে গেলেন আর সাথে সাথেই শুরু হয়ে গেল বধূ বেশ ধারণের প্রয়াস!

.

বিকেল গড়িয়ে রাত নেমে এসেছে। সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে অনেক আগেই। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি। এই যেন বধূ বেশ আমার অনেক চেনা! লালের ওপর সোনালি কারুকার্যে শোভিত বেনারসি, মাথায় ভারী ওড়না, গাঁ ভর্তি গহনা, মেহেদী রাঙা দুই হাত ভর্তি চুড়ি, পায়ে আলতা, মাথায় টায়রা যুক্ত টিকলি, নাকে নথ, এসবই যেন আগেও আমায় শোভিত করেছিলো!

হঠাৎ খট করে দরজা খোলার শব্দে ভাবনার সুতো ছিঁড়ে গেল। হালকা কেঁপে উঠে আয়নায় আমার ডান পাশে ফুটে ওঠা প্রতিবিম্বের দিকে তাকালাম। নির্জন এসেছেন। বরের সাজে অদ্ভুত রকমের সুন্দর লাগছে তাকে। আয়নার ভিতরে আমার দিকে তাকাতেই তার দৃষ্টি থেমে গেল। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। ধীর গতিতে এগিয়েও আসছেন। নির্জনের দিকে ঘুরে ভীতসন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। একদম কাছাকাছি এসে দাঁড়াতেই নির্জন ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে বললেন,

-তোমায় কেমন লাগছে, তা বর্ণনা করার এবিলিটি আমার নেই! ইউ নৌ, যাই বলি না কেন; সবকিছুই কম পড়ে যাবে। কিন্তু এবার তোমায় অনেক অন্যরকম লাগছে। কারণটা কী জানো? আগের বার তোমার চোখে মুখে একটা আনন্দ ছিল, লজ্জাভাব ছিল। কিন্তু এবার সেসবের কিছুই নেই। আছে শুধু অস্বস্তি আর ভয়!

প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালাম। আগেরবার বলতে কী বুঝালেন? এর আগেও বউ সেজেছি আমি! কিন্তু কবে? জিজ্ঞেস করতে যাবো, এমনসময় উনি থামিয়ে দিলেন। ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে বললেন,

-হুঁশশ… নট আ সিঙ্গেল কোয়েশ্শেন! প্রশ্ন করলে কোনো উত্তর পাবো না, জানো তুমি। তবুও তোমার জানার এতো কিউরিওসিটি কেন?

অক্ষিদ্বয় গোল গোল করে তাকিয়ে আছি। আমার ওমন দৃষ্টির মানে হয়তো উনি কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পেরেছেন! ঠোঁট কামড়ে হেসে কয়েক ধাপ পিছিয়ে দূরে সরে দাঁড়ালেন। শান্ত ভঙ্গিতে বললেন,

-তোমাকে কিছু কথা না বললেই নয়! কিছু বিষয় জানাটা তোমার জন্য অনেক জরুরি।

-বিয়ে তো করছেনই! বলার মতো সময়ও অনেক পাবেন।

নির্জন অনেকটা হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকালেন। ওনার হয়তো মনে হচ্ছে, আমি বিয়ের জন্য তাড়া দিচ্ছি! কিন্তু আমার যে প্রচন্ড রকমের অস্বস্তি হচ্ছে, সেটা তো বলতে পারছি না!

-বিয়েটা হওয়ার পথে অনেক বাঁধা আসবে। সব পেরিয়ে যদি বিয়েটা হয়েও যায়, তবুও তোমার সাথে আমার কোনো কানেকশন থাকবে না। ইন ফ্যাক্ট, আমরা সেপারেটেড থাকবো।

বিস্ফোরিত চোখে তাকালাম। সেপারেটেড থাকবো? তাহলে বিয়েটা করার কী দরকার?

নির্জন একটা শ্বাস নিয়ে বললেন,

-বিয়েটা না হলে তোমায় আমি হারিয়ে ফেলবো, গুঞ্জন। একবার হারাতে হারাতে ফিরে পেয়েছি। সো, এবার আমি কোনো রিস্ক নিতে চাই না। কিন্তু তুমি সেদিন বলেছিলে, আমি তোমায় নিজের চাহিদা পূরণের জন্য বিয়ে করছি। এতোদিন এক বাড়িতে থেকেও তোমার থেকে যথেষ্ট দুরত্ব বজায় রেখে চলেছি। বিয়ের পরও সেভাবেই থাকবো। তোমার এ ব্যাপারে কোনো চিন্তা করতে হবে না। কখনো তোমার ওপর নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে যাবো না।

এক হাতে শাড়ি খামচে ধরে দাঁড়িয়ে আছি। যতো ধরনের নোংরা কথা আছে, সবই বলেছি আমি এই ছেলেটাকে! তবুও তার মধ্যে আমাকে হারানোর ভয়। ধরা গলায় বললাম,

-আমার জীবনটা তো প্রথম থেকেই অগোছালো! বিয়ের পর সেটাকে আরো অগোছালো করে দিতে চাইছেন।

-মানুষের জীবনে প্রতিটা স্টেপে ঝড় আসে, গুঞ্জন। ঝড়ের সময় দেখবে, ঝড়ো হাওয়ায় যে গাছটা হেলে পড়ে, ঝড় সেটাকে দ্রুত কাবু করে ফেলে। কিন্তু যে গাছটা বরাবরই শক্ত থাকে, সেটার ওপর ঝড় কোনো প্রভাব ফেলে না। দ্য মোরাল ওফ দ্য স্পিচ ইজ, তোমায় সবসময় নিজেকে শক্ত রাখতে হবে।

কথাগুলো সত্য। মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানিয়ে বললাম,

-আজ আপনার ওয়াইফ আসবে না? আপনার জীবনের প্রথম নারী!

নির্জন ঠোঁট কামড়ে হাসলেন। বললেন,

-আই উইশ, তুমি সবটা জানতে! নিজের প্রতি নিজেরই হাসি পেত তোমার। এখন চলো। দেরি হয়ে যাচ্ছে।

কথাটার মর্মার্থ বুঝতে পারলাম না। নিজের প্রতি হাসতাম! এখানে হাসির কী হলো? ভাবনার মাঝেই নির্জনের কন্ঠ নিঃসৃত কাব্যিক প্রয়াস কানে ভেসে এলো,

-কেন ভালোবাসি, কেন কষ্ট পাই?
তুমিও যেমন জানো, আমিও তো তাই!
তবুও ভালোবাসি, তবু ভেজে চোখ!
এভাবেই বেঁচে থাকা, এভাবেই শোক।।

.

বাড়ি ফেরার পর থেকেই সারা গায়ের সাথে আঠার মতো চিপকে আছে। বিয়েতে কাউকেই ইনভাইট করা হয়নি! শুধু সারা-ই একমাত্র নিমন্ত্রিত ব্যক্তি।

-তোকে বউ সাজে তো সেই লাগছে, ইয়ার! নির্জন ভাই তোকে দেখে কয়বার ফিট হয়েছে, সেটাই জানতে ইচ্ছে করছে আমার।

পূর্ণদৃষ্টিতে সারার দিকে তাকালাম। কয়েকদিন আগে ও-ই আমায় নির্জনকে বিয়ে করার বিরুদ্ধে কত কী বললো! আর আজ? আজ নিজেই কত স্বাভাবিক আচরণ করছে এই বিয়ের ব্যাপারে! অবাক চোখে তাকিয়ে বললাম,

-তুই একথা বলছিস? কিন্তু দুদিন আগেও তো নির্জনকে নিয়ে আমায় কত কথা বললি! তুই তো নির্জনের মতো একটা বিবাহিত ছেলেকে বিয়ে করতে নিষেধ করেছিলি আমায়।

সারা অনেকটা চুপসে গেল। আশেপাশে তাকিয়ে আমতাআমতা করতে লাগলো। এমনসময় নির্জন কোত্থেকে এসে বললো,

-আগে ও কিছু জানতো না, তাই নিষেধ করেছিলো। এখন ও সব জানে, তাই স্বাভাবিক আচরণ করছে। অ্যাম আই রাইট, শ্যালিকা?

সারা জোরপূর্বক হেসে মাথা নাড়ালো। আমি অবাক হয়ে বললাম,

-মানে?

-অতো মানে বুঝতে হবে না! কিছুক্ষণ পরেই কাজি চলে আসবেন। সো, চুপচাপ বসো।

বলেই নির্জন চলে গেল। সারাও নির্জনের পিছু পিছু কেটে পড়লো। ঘরের ভেতর একা একা বসে আছি। বেশ কিছুক্ষণ পর, দরজা খোলার শব্দে চকিত দৃষ্টিতে মাথা তুলে সামনে তাকাতেই দেখলাম, একটা অপরিচিত লোক ঘরে প্রবেশ করলো। মুখটা রুমাল দিয়ে বাঁধা বিধায় চেনা যাচ্ছে না। তার দিকে ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,

-কে আপনি? ক্………..

লোকটা আমার মুখের ওপর কিছু একটা স্প্রে করতেই কথা শেষ হওয়ার আগেই চোখের সামনে আঁধার ঘনিয়ে এলো। মুহূর্তেই ঢলে পড়লাম সেই অন্ধকার রাজ্যে।

.

চোখ খুলতেই নিজেকে একটা পরিত্যক্ত বাড়ির লিভিং রুমে আবিষ্কার করলাম। অস্পষ্ট টিমটিমে আলোয় বুঝলাম, এখানে আমি ব্যতিত আর কেউ নেই। সেই বধু সাজে এখনো সজ্জিত আমি। তার মানে নির্জনের আশঙ্কাই ঠিক হলো! বিয়ের পথে বাধা গুলো আমরা পেরোতে পারলাম না। কিন্তু আমাকে এখানে আনলো কে? নড়াচড়ার চেষ্টা করতেই ব্যর্থ হলাম। হাত-পা চেয়ারের সাথে বাঁধা। চিৎকার করতে যাবো, এমনসময় কেউ বলে উঠলো,

-ওয়েলকাম টু মাই ওয়ার্ল্ড, মিসেস আফ্রান জোহায়ের নির্জন! কিন্তু নির্জনের বউয়ের পরিচয়টা খুব দ্রুতই মুছে দেবো তোমার জীবন থেকে। ইউ উইল স্টার্ট আ নিউ জার্নি উইথ আ নিউ ইন্ট্রোডাকশন। তোমার নতুন পরিচয়! আর সেটা হলো মিসেস শুভ্রব আফনাদ।।

#চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে