তিমিরে ফোটা গোলাপ পর্ব-২০+২১+২২

0
747

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব-২০
Writer Taniya Sheikh

ট্রেনটা ছাড়বে ছাড়বে করেও এখনও দাঁড়িয়ে আছে প্লাটফর্মে। যাত্রীদের মধ্যে এই নিয়ে চাপা অসন্তোষ। ইসাবেলা ঘাড় গুঁজে বসে আছে। মুখশ্রীতে গভীর ভাবনার ছাপ। আগাথা মুচকি হেসে ওরই দিকে দৃষ্টি অনড় রেখেছেন। এই মুহূর্তে তিনি চুপ। হয়তো অপেক্ষা করছেন ইসাবেলার কাছ থেকে কিছু শোনার প্রত্যাশায়। ভাবনার জগৎ ছেড়ে বেরিয়ে এলো ইসাবেলা।

“নিকোলাসও নেকড়ে?” ওর মনে পড়ে সেই বাজারের ঘটনাটা। নিশ্চিত হতে আগাথাকে প্রশ্ন করল। আগাথা স্বাভাবিকমুখেই জবাব দিলেন,

“হ্যাঁ, কিন্তু_”

“আবার কিন্তু? ও ঈশ্বর! কী হচ্ছে আমার সাথে এসব? কেন হচ্ছে? আপনি জানেন গত কয়েক মাসে কীসব উদ্ভট পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি? আমার হঠাৎ হঠাৎ মনে হয়েছে আমি যেন একটা দুঃস্বপ্নের মধ্যে আছি। রক্তচোষা, নেকড়ে! জীবনটা আমার বন জঙ্গল হয়ে গেছে।”

ওর অভিযোগ শুনে আগাথা হাসলেন।

“তুমি ভারি মিষ্টি মেয়ে।”

“জি?”

“বলেছি তুমি ভারি মিষ্টি একটা মেয়ে।”

লাজুক মুখে হাসল ইসাবেলা। আগাথার দিকে চেয়ে লজ্জা লুকিয়ে বলল,

“আমি আমার দুঃখের কথা বলছি আর আপনি বলছেন অন্য কথা। আচ্ছা, এসব কথা বাদ। আপনি তখন বলছিলেন প্রায় রাতে পাওয়া সেই গন্ধটা আপনার বাবার ছিল। তিনি আপনাকে চিনলেন কীভাবে? আর আপনার মায়ের সাথেই তার সম্পর্ক কীভাবে হয়?”

আগাথা একটু চুপ করে বলতে শুরু করেন,

“বাবা মানুষরূপে থাকাকালীন পরিচয় মায়ের সাথে। দুজনই দুজনকে দেখে আকৃষ্ট হন। হঠাৎ করেই কাছে আসা। নিজের সত্যিটা মনে পড়তে বাবা চলে যান। মা সেই মিলনকে কৈশোরের ভুল মনে করে ভুলে গেলেন বাবাকে। কে জানত তাদের ক্ষনিকের ভুলে আমার জন্ম হবে। বাবার সাথে যোগাযোগ না থাকায় আমার কথাটা তাঁকে বলতে পারেননি মা। আঠারোতম জন্মদিনে বাবা আমার কথা জানতে পারেন। কে তাকে বলেছিল জানো?”

“কে?”

“আমার জোড়া, ম্যাক্স।”

“আপনার জোড়া!”

“হ্যাঁ, প্রতিটি নেকড়ের একজন জোড়া থাকে। একটা নির্দিষ্ট সময় পরে এরা একে অপরের গায়ের গন্ধে পরস্পরকে চিনে নেয়। ম্যাক্স আমার বিয়ের পরই চিনতে পারে। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমি ওর জোড়া হয়েও আর নই। অন্যের স্ত্রীকে তো আর জোড়া বলে জাহির করতে পারবে না। দূর থেকে কেবল আমাকে দেখে যেত। ওই যে গন্ধ পেতাম। তারমধ্যে প্রথম যে গন্ধ পেয়েছিলাম সেটা ছিল ম্যাক্সের। আমাকে বিমুগ্ধ করত সেই মিষ্টি গন্ধ।” এইটুকু বলে থামলেন। একটু যেন ভাবুক দেখা গেল। তারপর আবার বলতে আরম্ভ করলেন,

“ম্যাক্সের কথা শুনে বাবা আমাকে দেখতে আসেন লুকিয়ে। প্রথমবার দেখেই সবটা বুঝে গিয়েছিলেন তিনি। এতবড়ো কথাটি মা লুকিয়েছেন জেনে রেগে মাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে রওনা হন। কিন্তু পথিমধ্যে শান্ত মস্তিষ্কে ভাবেন, ভুল তো তাঁর। তিনিই খোঁজ নেননি। পেছন ফিরে তাকাননি। সেই সংকোচে দূর থেকেই দেখতেন আমাকে। কাছে আসার জন্য সময় নিচ্ছিলেন। এর মাঝে আমিই তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ওই যে তোমাকে যা বলেছি আগে।”

ইসাবেলা মাথা নাড়ায়। হঠাৎ বলে বসে,

“একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”

“অবশ্যই।”

“এসব আমাকে কেন বলছেন আপনি?”

“কারণ আছে।”

“কী?”

“মূল কারণ শুনতে চাও না পুরো গল্প?”

“কার গল্প? আপনার?”

“শুধু আমার না। নিকোলাসে, ন_”

“ওর ব্যাপারে শুনে আমার কী লাভ? আজকের পর ওকে আমি তো দেখব না। দেখতে চাইও না। আমার জীবনের দুঃসময় নিকোলাস।” মুখটা কঠিন হলো ইসাবেলার। আগাথা হাসলেন। বললেন,

“তবে মূল কথায় আসব?”

“হুম।”

আগাথা মূল কথায় এখনই আসতে নারাজ। তিনি সবটা বিস্তারিতভাবে আগে বলতে চান এই মেয়েকে। সব শোনার পরই মেয়েটাকে নিজের আসল উদ্দেশ্য জানাবেন। এর আগে বললে উদ্দেশ্য সফল হবে না। বড়ো আশা নিয়ে এসেছেন মেয়েটির সামনে।

“আমার সম্পর্কেও জানতে কৌতূহল জাগছে না। এই যে এতকিছু বললাম। সবটা তো শেষ হয়নি। পরেরটুকু শোনার আগ্রহ জাগছে না?”

প্রবল আগ্রহ জাগছে ইসাবেলার। কিন্তু ভয়ে প্রকাশ করছে না। কৌতূহলের কারণে আজ ওর এই দশা। ফের কৌতূহল দেখালে আবার কি না কী হয়! কিন্তু মনের মধ্যে কৌতূহলের পোকা কুটকুট করতে লাগল। ট্রেন ছাড়তে কতক্ষণ লাগবে কে জানে? ততক্ষণে আগাথার গল্প শুনলে মন্দ হয় না। কিছু সময় উশখুশ করে বলেই ফেলল,

“আপনার বাবা কী বলেছিলাম একা নিয়ে গিয়ে? আপনি নেকড়ে বলেই কি নিকোলাস জন্মসূত্রে নেকড়ে? নোভাও কি তাই? মৃত হওয়ার পরও আমার সামনে জীবিতরূপে কীভাবে এলেন? এবং কেন?”

একদমে বলে থামল ইসাবেলা। সলজ্জে মুখটা অন্যদিকে ঘুরাল। আগাথা মৃদু হাসলেন। বললেন,

“মাত্র এই কটা প্রশ্ন?”

লজ্জিত মুখটা এবার স্বাভাবিক করে ইসাবেলা বলল,
“আপাতত।”

একটু সময় নিয়ে আগাথা বলতে শুরু করলেন আবার,
“আমার বাবার প্রথম কথা ছিল, রিচার্ডের সাথে সম্পর্ক ছেদ করো। তাঁর ধারণা রিচার্ড আমার জন্য ভালো নয়। কিন্তু আমার মনের অবস্থা তখন ভিন্ন। রিচার্ডকে ছাড়ার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারতাম না। সুতরাং বাবার সাথে একদফা কথা-কাটাকাটি করে চলে এলাম। বাবা কয়েকবার বুঝাতে এলেন। এতে করে আমাদের বাবা -মেয়ের সম্পর্ক তৈরি হওয়ার আগেই তিক্তরূপ ধারণ করে। তাঁকে অমান্য করায় রেগে ত্যাগ করলেন। আমিও যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম না। এদিকে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দ্রুতই পেট বড়ো হতে লাগল। ভয়টাও বাড়ল আমার। অনাগত সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত, চিন্তিত কাটত দিনরাত। এতে করে আমার শারীরিক অবস্থা খারাপের দিকে যেতে লাগল। রিচার্ডের চিন্তা বাড়ল। ওকে একসময় সবটা খুলে বললাম। প্রথম তো বিশ্বাসই করেনি। যখন নেকড়ে রূপে ওর সামনে দাঁড়ালাম মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায় ওর। আমি ভাবলাম এবার বুঝি ও আমাকে ছেড়ে যাবে। কিন্তু না, সে আমার ভরসা, বিশ্বাস হয়ে রইল। সব জেনেও আমার প্রতি ভালোবাসার কমতি রাখেনি। গর্ভাবস্থার ছয় মাসে আমার পেট নয়মাসের ন্যায় বড়ো হয়ে ওঠে। লোকের নজর এড়িয়ে গৃহবন্দী হয়ে রইলাম। কিন্তু বাচ্চা জন্মদানের সময় তো আড়ালে থাকতে পারব না। রিচার্ড এক রাতে আমাকে নিয়ে রওনা হলো দূরের একটি গ্রামে। পথিমধ্যে আমার প্রসব বেদনা ওঠে। ঘোড়া গাড়ি থামানো হয় এক বনের পাশে। ভাগ্যের কী লীলা! ওই জঙ্গলের নেকড়ে লিডার ছিল আমার জোড়া ম্যাক্স। আমার গন্ধ পেয়ে সে সেখানে উপস্থিত হয়। রিচার্ড তখনও আমাদের ব্যাপারটা জানত না। ম্যাক্স আর আমার সরাসরি আলাপ হয়নি পূর্বে। দুজনে বিব্রতবোধ করছিলাম। এদিকে প্রচণ্ড ব্যথায় বেহাল দশা আমার। রিচার্ডের কাছে সবটা জানার পর আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো ম্যাক্সের আস্তানায়। সেখানেই জন্ম হয় আমার প্রথম সন্তান, আমার নিকোলাসের। জ্ঞান ফেরার পর প্রথম দেখে মনে হয়েছিল, যেন মানুষ নয়, স্বর্গের শিশু। সন্তানকে আশা করেছিলাম রিচার্ডের কোলে। কিন্তু না, নিকোলাসকে কোলে নিয়ে এগিয়ে এলো সোনালী কোঁকড়া চুলের, পিঙ্গলবর্ণের দীর্ঘদেহী যুবক ম্যাক্স। খুবই অস্বস্তি হচ্ছিল ওকে চোখের সামনে দেখে। অদ্ভুত এক অনুভূতি কাজ করছিল ভেতরে। আমার কোলে ছেলেকে তুলে দিয়ে আমাদের কপালে চুমু খেয়ে ম্যাক্স বলেছিল,

“চন্দ্র দেবী আমার সাথে নিষ্ঠুর এক পরিহাস করল। তা হোক, আমি মনপ্রাণে এখন চাই তুমি সুখে থাকো। কিন্তু একটা কথা বলতে চাই তোমাকে।” গম্ভীর হয়ে ওঠে ওর মুখ। আমি অধীর হয়ে অপেক্ষা করছি। যা বলল তারজন্য প্রস্তুত ছিলাম না। ও বলল,

“তোমার সন্তান কোনো সাধারণ মানব নয়। তুমি হয়তো ভাববে সাধারণ নয় বলতে তোমার মতোই বুঝাতে চাইছি। কিন্তু না, সাধারণ না বলতে বুঝাতে চাইছি ও ভবিষ্যত নেকড়ে লিডার। শুধু তাই নয়, ওর মধ্যে বিশেষ কিছু লক্ষণ রয়েছে।”

“বিশেষ লক্ষণ?”

“হ্যাঁ, তোমার ছেলে অর্ধ অমরত্বের লক্ষণ নিয়ে জন্ম নিয়েছে। যা কেবল হাজার বছরে একজন নেকড়ে লিডারের ভাগ্যে থাকে। আর এই কারণে ওর ওপর বিপদের মাত্রা প্রবল।”

ম্যাক্স আমার ভীত মুখে চেয়ে বলল,

“ভয় পেয়ো না আগাথা। ওর কিছু হবে না। আমি হতে দেবো না।” নিকোলাসের মাথায় হাত রেখে বলল,

“আজ থেকে ওকে দেখে রাখার দায়িত্ব আমার।”

কেন যেন ম্যাক্সের কথায় আমি ভরসা পেলাম। ওর হাতটা ধরে কৃতজ্ঞতা জানাব তখনই ও বলল,

“আরেকটা কথা আগাথা, ওর বয়স বিশ হওয়ার পূর্বে এ কথা আমি এবং তুমি ছাড়া তৃতীয় কেউ যেন জানতে না পারে।”

আমি বললাম,

“এতবড় কথা কিছুতেই লুকাতে পারব না রিচার্ডের কাছ থেকে।”

“পারতে হবে। তোমার সন্তানের জন্য পারতে হবে।”

সেদিন সন্তানের মুখ চেয়ে ম্যাক্সের কথা না চাইতেও মেনে নিয়েছিলাম। মনে মনে অপরাধবোধ জন্মে রিচার্ডের কাছ থেকে এতবড়ো ব্যাপার লুকিয়েছি বলে। জানতাম না এই অপরাধবোধই আমার সন্তানের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে একদিন। ম্যাক্স উঠে দাঁড়ায়। যাবে বলে ঘুরে ফের আমার দিকে তাকায়। বলে,

“একটা অনুরোধ রাখবে আগাথা?”

“কী?”

“তোমার ছেলের নামটা আমাকে রাখতে দেবে?”

যে অধিকার রিচার্ডের তা আমি ম্যাক্সকে কী করে দিই? কিন্তু ওর আশান্বিত মুখ চেয়ে না করতে পারিনি।

“ঠিক আছে।”

এগিয়ে এসে নিকোলাসকে কোলে তুলে কপালে চুমু খেয়ে বলল,

“নিকোলাস উইলিয়াম। আজ থেকে ওর নাম নিকোলাস উইলিয়াম।”

একটা সময় পর্যন্ত রিচার্ডের ধারণা ছিল নামটা আমিই রেখেছি। এবং বলেছিলাম, নিকোলাস আমার মতো নয়। সে রিচার্ডের মতোই মানুষ। কে জানত রিচার্ডের সন্দেহের শুরু সেখান থেকেই। আমার মিথ্যা বলা মুখ ও খুব সহজে চিনে নিতো। সেদিনও হয়ত নিয়েছিল। কিন্তু চুপচাপ থেকেছে। এদিকে নিকোলাস যত বড়ো হতে লাগল আমার ভয়টাও বাড়তে থাকে। নিকোলাসের প্রতি আমার এই অতি সাবধানতা রিচার্ডের সন্দেহ আরো বাড়িয়ে দেয়। আশ্চর্যগত ভাবেই ম্যাক্সের সাথে নিকোলাসের অসম বন্ধুত্ব তৈরি হয়। বাবার চেয়ে ওর কাছে প্রিয় ছিল ম্যাক্স। প্রায় সব সময়ই ওরা একসাথে সময় কাটাত। রিচার্ডের চোখের কাঁটা হতে লাগল ম্যাক্স। আমাকে আর ম্যাক্সকে নিয়ে সন্দেহের বীজ বুনতে শুরু করে মনে মনে। কেমন যেন বদলাতে শুরু করল। ম্যাক্সের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মেতে উঠল। নিকোলাসকে নিয়ে ম্যাক্সকে একদিন খুব করে অপমান করে। নিকোলাসের বয়স তখন ছয় কী সাত। ম্যাক্সের সাথে ঘুরতে যাওয়ায় খুব ধমকাতে লাগল ছেলেকে রিচার্ড। বাবার রাগত মুখ দেখে ভয়ে ম্যাক্সকে জড়িয়ে ধরেছিল। টেনে ওর বুক থেকে ছেলেকে ছাড়িয়ে রুম বন্দি করল। ম্যাক্স প্রতিবাদ করতে রিচার্ড তেতে ওঠে। দুজনের মধ্যে বাকবিতন্ডা চরমে রূপ নিলো। রাগের বশে মনের সকল ক্ষোভ সেদিন প্রকাশ করল রিচার্ড। আমাকে আর ম্যাক্সকে নিয়ে ওর মনের মধ্যে যে নোংরামি ছিল সব বেরিয়ে এলো। লজ্জায়, ঘৃণায় মনে হলো মরে যাই। ম্যাক্স আর আমি সত্যিটা বুঝাতে লাগলাম। কিন্তু ব্যর্থ হই আমরা। সত্যিটা জেনে আরো ক্ষেপে যায়। ম্যাক্সকে ঘুষি মারে। জামার কলার ধরে বের করে দেয় বাড়ির বাইরে। সেদিন আমার মুখ চেয়ে চুপচাপ মাথা নত করে চলে যায় ও। সেই যে গেল এরপর বছর কয়েক ওকে আমি আর দেখিনি। নিকোলাস পথ চেয়ে থাকত ওর আশায়। আবদার করত ম্যাক্সকে দেখার, ওর কাছে যাওয়ার। একদিন রিচার্ড ক্ষিপ্ত হয়ে ছেলেকে ঘরে ঢুকিয়ে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে বেদম প্রহার করে। আমার চিৎকার আশেপাশের লোক জড়ো হয়। রিচার্ড বাধ্য হয় বেরিয়ে আসতে। কেবল সেদিনের জন্য ওর ওই নিষ্ঠুরতা থেমেছিল। আস্তে আস্তে তা আরো বাড়ে। কারণে – অকারণে চলে নিকোলাস আর আমার ওপর ওর নিষ্ঠুরতা। আমাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা বন্ধ করল। ভাবলাম এবার বুঝি সব ঠিক হবে। হলো উলটো। আমাকে ব্যথা দেওয়ার আরেক রাস্তা সে খুঁজে পেয়েছে। আমারই চোখের সামনে নিকোলাসকে নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করতে লাগল। খুশি হতো যখন দেখত আমি ছেলের কষ্ট দেখে কাঁদছি। রিচার্ড যেন আর সেই স্বাভাবিক রিচার্ড নেই। সন্দেহের বিষ আকণ্ঠ পান করে মদ্যপ, বিকারগস্তে পরিণত হয়। ওই রিচার্ডকে আমি ভয় পেতাম। বাবার ওমন রূপ বালক নিকোলাসকে বাকরুদ্ধ করে দেয়। চঞ্চল, হাসি-খুশি ছেলেটা আমার একসময় চুপচাপ হয়ে গেল। পিতার নির্যাতনেও মুখ ফুটে আর্তনাদ বেরোতে না। এসব কারণে রিচার্ডের সাথে সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি হলো। সব অপমান হজম করে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলাম স্বাভাবিক হতে। বৈবাহিক সম্পর্ক কতকটা দ্বিচক্রযানের ন্যায়। একটা চাকা নষ্ট হলে আরেকটা এমনিতেই অকেজো হয়ে পড়ে। রিচার্ড ঠিক মতো বাড়ি ফিরত না, কথা বলত না। দু’জন কাছাকাছি আসতাম কেবল ওর দৈহিক প্রয়োজন পড়লে। একসময় সেটাও কমতে লাগল। ভয় বাসা বাঁধল মনে। কে জানত এই ভয়টাও একদিন সত্যি হবে। সোফিয়া ছিল ওর সহকর্মীর শ্যালিকা। মেয়েটা কয়েকবার এসেছিল আলাপ জমাত। আমার ওকে ভালো লাগেনি। হাসিটাও কেমন মেকি। ওই মেকি হাসির আড়ালে যে আমার সংসার গ্রাস করার লোভ ছিল তা সেদিন ঘূর্ণাক্ষরেও টের পাইনি। সত্যিটা জানাজানি হয় সোফিয়া সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়লে। বাচ্চাটা ছিল রিচার্ডের। সুতরাং ওর পরিবার থেকে রিচার্ডকে তাড়া দেওয়া হলো। বাধ্য হয়েই একপ্রকার গোপনে বিয়ে করল রিচার্ড ওকে। এদিকে আমি বোকার মতো আশা বেঁধেছিলাম রিচার্ড ওকে ছেড়ে আমার কাছে ফিরে আসবে। কিন্তু সে আর কোনোদিন মন থেকে আমার কাছে ফেরেনি। সবার অগোচরে সোফিয়া আর ওর সন্তানকে নিয়ে আলাদা সংসার শুরু করে। সোফিয়া সবসময়ই ভাবত আমাকে সে হারিয়ে দিয়েছে রিচার্ডকে কেড়ে নিয়ে। অন্ধ ভালোবাসা, অন্ধ বিশ্বাস মানুষকে বোকা বানায়। আমি বোকা ছিলাম, সোফিয়াও তেমনই। ওই বোকা মেয়ের মনটা আমারই মতো ভাঙল যেদিন আমি ফের আরেকবার সন্তানসম্ভবা হলাম। হয়তো আমিই ওকে শিক্ষা দিতে রিচার্ডের সাথে সম্পর্ক চলমান রেখেছিলাম। নিজের ব্যথাটা বুঝাতে চেয়েছিলাম। যখন দেখলাম উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। সুখ কিন্তু মোটেও পেলাম না। বড্ড খারাপ লাগল সোফিয়ার পর্যায়ে নেমে যাওয়াতে। ঘৃণা হলো নিজের প্রতি। নোভা গর্ভে আসার পর রিচার্ডকে কাছে ঘেঁষতে দিইনি। সিদ্ধান্ত নিলাম রিচার্ডের ঘর ছেড়ে আলাদা থাকব। রিচার্ড খুশি ছিল না। তবুও মুখ ফুটে প্রতিবাদ করেনি। আমি সেদিনও বোকার মতো চেয়েছিলাম ও ফিরে আসুক আমার কাছে। ক্ষমা চেয়ে জোর করে বুকে টেনে নিক। কিন্তু বাস্তবতা নিষ্ঠুর। ভালোবাসার চাইতে ঘৃণার ক্ষমতা প্রবল। এই যে এতকিছু ঘটে গেল। এর প্রভাব কেবল আমাদের তিনজনের ওপরই পড়েনি। আরেকজন ছিল যে নীরবে এসবে প্রভাবিত হয়েছে। আমার মানিক, আমার কলিজার টুকরো নিকোলাস। কোমলপ্রাণ ছেলেটা বাবার আদর আহ্লাদের বদলে নিপীড়িত হয়েছে। মায়ের নিত্যদিনের চোখের জল দেখতে দেখতে ভেতরে ভেতরে বদলাতে লাগল। বৈবাহিক সেই সম্পর্কের বিষাক্ততায় একা আমিই যন্ত্রণা পাইনি, পেয়েছে আমার ছেলেটাও। ছেলের জন্য ম্যাক্সের খোঁজ করলাম। ওকে খুঁজে সবটা বলতে বেচারা নিজেকে দোষাতে লাগল। নিকোলাসের সব দায়িত্ব নিতে চাইল। আমার আপত্তি ছিল না। আপত্তি জানায় রিচার্ড। আমাদের জড়িয়ে স্থানীয় রাজার কাছে বিচার দেওয়ার হুমকি দিলো। ওদিকে আমাদের নামে কুৎসা রটনা শুরু করে দেয় সোফিয়া। লোকের তিরস্কারে সেখানে টিকে থাকা দায় হয়ে পড়ে আমার। ম্যাক্স পরামর্শ দেয় পালিয়ে যাওয়ার। আমার সামনে তখন ওই একটা পথই খোলা। তিনজনে পালিয়ে এলাম অন্য শহরে। সেখানে নোভার জন্ম হলো। ও হলো রিচার্ডের মতোই সাধারণ মানুষ। কিন্তু নেকড়ে মায়ের কিছু প্রভাব ওর মধ্যে থাকবে বলে জানাল ম্যাক্স। ধীরে ধীরে নিকোলাসও স্বাভাবিক হয়ে উঠল ম্যাক্সের সান্নিধ্যে। ম্যাক্স নিজের আপনজন ছেড়ে আমাদের সাথে থাকতে লাগল। ওর কেয়ার, ভালোবাসা মুগ্ধ করল আমাকে। মুগ্ধতা প্রেমের সম্পর্কে গড়াতে সময় নিলো না। জোড়া হিসেবে ও আমাকে মার্ক করে। তারপরেই মনে হলো জন্মজন্মান্তরে সম্পর্ক ছিল আমাদের। যেন এক আত্মা দুই দেহ আমরা। আমাদের সেই সম্পর্ক মনুষ্য ধর্মের আর সমাজের চোখে ছিল নিষিদ্ধ। কিন্তু অচেনা ওই শহরে সেই খবর কারো জানার কথা না। সুখেই কাটছিল দিন। নিকোলাস কৈশোরে পা রাখল। নোভার মুখে তখন আধো আধো বুলি। প্রথমবার বাবা বলে ডাকতে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে ম্যাক্স। একদিন আমাকে বলে,

“আমি যদি সত্যি ওদের বাবা হতে পারতাম আগাথা!”

চোখদুটো ছলছল করছিল ওর। ভয় কেবল একা ম্যাক্সের ছিল না। আমারও ছিল। রিচার্ডের অধিকার সমাজ স্বীকৃত। অথচ, বাবা হিসেবে কোনো দায়িত্বই সে পালন করেনি। অন্যদিকে ম্যাক্স জন্মদাতা না হয়েও বাবা হয়ে উঠেছিল। আমি জানতাম মানুষের সমাজে এ পাপ। কিন্তু স্বেচ্ছায় পাপটাকে গ্রহণ করি আমরা দুজন। অর্ধেক মানবীয় সত্তার কারণে সেই পাপবোধে থেকে মুক্তি পেতে অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা বিয়ে করব। নিকোলাস সত্যিটা জানত। আমার আর ম্যাক্সের প্রণয়ের সূত্রটা ছিল ও। আমাদের খুশি দেখতে চেয়েছিল নিকোলাস। সুতরাং ও আমাদের বিয়ের সিদ্ধান্তে খুশিই হলো। ম্যাক্সের মনে চলছিল অন্য ব্যাপার। আমার ভেতরের মানবীয় পাপবোধ ও বুঝতে পারত। আর তাই তো কাওকে না জানিয়ে সে রিচার্ডের সাথে দেখা করে। তৎকালে ডিভোর্স অতটা সহজ ব্যাপার ছিল না। ম্যাক্স রিচার্ডের সাথে দেখা করে আপোষে ডিভোর্সের ঝামেলা শেষ করতে চেয়েছিল। ভুলটা বোধহয় সেখানেই হয়। ডিভোর্স দেবে বলে আশ্বস্ত করে রিচার্ড। আমিও কী বোকা ছিলাম। বিশ্বাস করলাম ম্যাক্সের মতো। সকল কাগজপত্র তৈরি করে ম্যাক্স গেল রিচার্ডের কাছে। তিনদিনের স্থানে পুরো একসপ্তাহ পার হলেও ম্যাক্স ফিরল না। চিন্তা হতে লাগল এবার। নিকোলাস একাই যেতে চাইল ম্যাক্সের খোঁজে। আমি জোর করলাম সাথে নেওয়ার। ছেলে মেয়েকে নিয়ে রওনা হলাম পুরোনো আবাসস্থলে। সেখানে পৌঁছে প্রথম ধাক্কাটা খেলাম। মানুষের সেই বসতি কবরস্থানের মতো ভূতুরে আর নিস্তব্ধতায় মোড়া। ঘর-বাড়ি সব পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে। অনেক ঘুরেও একটা মানুষের দেখা পেলাম না। শেষে নিরুপায় হয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম রিচার্ড এবং সোফিয়ার বাড়িতে যাওয়ার। নিকোলাস আমাকে শক্ত করে ধরেছিল। ছোট্ট নোভার মাথা আমার বুকে। ম্যাক্সের খারাপ কিছু ঘটেছে ভেবে কাঁদতে লাগলাম নীরবে। নিকোলাস সান্ত্বনা দিলো। বলল, ওর ম্যাক্স বাবা যাওয়ার আগে ওয়াদা করেছে ফিরে আসার। সে ফিরবে। আমার মন সেই সান্ত্বনা কিছুতেই মানছিল না। খারাপ কিছুর আভাস পাচ্ছিলাম আমি। তিনজনে এলাম রিচার্ডের আর সোফিয়ার বাড়িতে। অন্য সব বাড়ির মতো এ বাড়িও জনমানব শূন্য। ঘরের ধুলো ময়লা আর ঝুল দেখে মনে হলো, এই বাড়িতে অনেকদিন কেউ থাকে না। হতাশ হয়ে ভেঙে পড়লাম। নিকোলাস আমাকে শক্ত করে ধরে গাড়িতে তুলল। আমাকে কাঁদতে দেখে নোভা কান্না শুরু করে। নিকোলাসের মনের অবস্থাও ভালো না। ওর প্রিয় ম্যাক্স। তাঁর খোঁজ না পেয়ে নিকোলাস অস্থির হয়ে ওঠে। পাশ্ববর্তী একটা বাড়িতে আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ম্যাক্সের খোঁজে বেরিয়ে গেল। আমাদের সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য ও ছিল। কিন্তু ওর জন্য কেউ ছিল না। ওই মৃত্যুপুরীতে একলা খুঁজে ফিরেছে প্রিয় ম্যাক্স বাবাকে। শেষমেশ খুঁজে না পেয়ে বিধ্বস্ত হতাশ চেহারায় ফিরে এলো। হাঁটু মুড়ে নত মুখে বসল আমার সামনে। শিশুর মতো ফুপিয়ে কেঁদেছিল। বুঝলাম ম্যাক্সকে চিরতরে হারিয়েছি। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদলাম। দিন ফুরিয়ে সন্ধ্যা নামে চারিদিকে। সাথে আসা ঘোড়ার গাড়িটিকে খুঁজে পেলাম না। নিরুপায় হয়ে সেদিন আমাদের পুরোনো বাড়িতে রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। স্বপ্নেও ভাবিনি সেই রাত আমাদের জন্য কাল হয়ে আসবে।

চলবে,,,

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব-২১
Writer Taniya Sheikh

“আমি ম্যাক্সের শোকে কাতর হয়ে বিছানায় শুয়েছিলাম। ঘুম কিছুতেই এলো না চোখে। সারাদিনের ক্লান্তি আর অনাহারে শরীর দূর্বল। পরিত্যক্ত আমার সেই পুরোনো বাড়িতে খাবার বলতে কিছুই ছিল না। নোভা খিদে সহ্য করতে না পেরে কাঁদতে কাঁদতে আমার বুকেই ঘুমিয়ে গেল। অনেকক্ষণ নিকোলাসের সাড়াশব্দ না পেয়ে মৃদু গলায় ডাকলাম বার কয়েক। কিন্তু কোনো জবাব পেলাম না। যা ম্যাক্স ভক্ত ছেলে! রাতের অন্ধকারে ম্যাক্সকে খুঁজতে বেরোলো কি না ভেবে তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে নেমে এলাম। নোভা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। চাদরে গলা অব্দি ঢেকে দিলাম মেয়েকে। শিওরের জ্বলন্ত বাতিদানটা হাতে তুলে নিলাম। পুরো বাড়ির ভেতর খুঁজেও নিকোলাসকে পেলাম না। অজানা শঙ্কায় পাগলপ্রায় হয়ে ছুটলাম গৃহদ্বারের বাইরে।

“নিকোলাস, নিকোলাস!”

অশ্রুরুদ্ধ গলায় ডাকলাম ছেলেকে। কিন্তু ছেলে আমার কোথাও নেই। সেই পরিত্যক্ত গ্রামে রাতদুপুরে ছেলেকে কোথায় খুঁজব ভেবে দিশাহারা হয়ে পড়ি। মাথা ঠাণ্ডা করে ভাবনা চিন্তা করার মতো অবস্থা ছিল না আমার। সদর দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে বেরিয়ে পড়লাম সেই ভূতুরে জনমানব শূন্য গ্রামে ছেলেকে খুঁজতে। আকাশে সেদিন কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ উঠেছিল। ঘুটঘুটে আঁধারের চাদরে মুড়েছে সমস্ত গাঁও। তেলের বাতির ওই স্বল্প আলোতে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম। ভয় যে করছিল না তা নয়। প্রতি পদে পদে মৃত্যু ভয় তাড়া করে ফিরছিল। কিন্তু নিকোলাসের চিন্তা সবকিছুর উর্ধ্বে। বেশ কিছুদূর এগিয়ে গিয়েছিলাম। এমন সময় আমার সকল ভয়, চিন্তা দূর করে নিকোলাস ডেকে উঠল,

“মা!”

প্রাণ ফিরে পেলাম যেন। দৌড়ে ওকে বুকে জড়িয়ে চুমুতে চুমুতে ওর মুখটা ভরিয়ে দিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম,

“কোথায় গিয়েছিলি একা? ভয় পেয়েছিলাম তো।”

“মা, ও-দিকে!”

ভীত মুখে তোতলাতে লাগল নিকোলাস। রীতিমতো কাঁপছে ওর শরীর। আঙুল দিয়ে সামনে ইশারা করে কিছু বলতে চাইছে। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। কিছুটা শান্ত হয়ে বলল,

“মা, ওদিকে মানুষের লাশ পড়ে আছে। একটা না অনেকগুলো। পঁচে গলে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে ওদের মৃতদেহ থেকে।”

ভয় পেলাম আমি। এই গ্রাম পরিত্যক্ত হওয়ার কারণ আগে কেন ভাবিনি? নিকোলাসের হাত ধরে দ্রুত চলে এলাম বাড়ির ভেতর। নোভা তখনও ঘুমিয়ে। কোলে তুলে নিকোলাসের হাত ধরে সেই রাতেই গাঁ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

“আমরা কোথায় যাচ্ছি মা?”

“জানি না। শুধু জানি এই মুহূর্তে এই গাঁ ছাড়তে হবে।”

ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছেলে- মেয়েকে নিয়ে প্রাণ বাঁচাতে উদ্দেশ্যহীনভাবে এগোতে লাগলাম। পথে যেতে চোখে পড়ল কয়েকটা মৃত দেহ। আজই হয়তো মরেছে। পঁচে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে ওদের মৃতদেহ থেকে। দ্রুত পা চালালাম। মনে মনে ঈশ্বরকে ডাকছি। একজন অসহায় মা রাতের আঁধারে সন্তানদের বাঁচাতে আকুল আবেদন জানায় স্রষ্টার কাছে। স্রষ্টা আমার আবেদন রক্ষা ঠিকই করলেন, কিন্তু যার দ্বারা করলেন তাঁকে আমি আশা করিনি। রিচার্ড কীভাবে খবর পেয়েছিল জানি না। ঘোড়াগাড়ি করে এদিকেই আসছিল সে। আমাদের দেখে নেমে সামনে এলো। বলল,

“তাড়াতাড়ি গাড়িতে ওঠো।”

নিকোলাস আমাকে জড়িয়ে ধরে। রিচার্ড ওর ভয় বুঝতে পেরে বিমর্ষ মুখে আমাকে বলে,

“পুরো গাঁ প্লেগের প্রকোপে শেষ হয়ে গেছে। শুরুর দিকে যারা গাঁ ছেড়েছিল তারই রক্ষা পায়। এক মুহূর্ত আর এখানে নয়। তাড়াতাড়ি গাড়িতে ওঠো।”

সন্তানদের নিরাপত্তার কথা ভেবে আমি আর প্রতিবাদ করতে পারলাম না। ওদের নিয়ে উঠে পড়লাম গাড়ির ভেতর। নিকোলাস ঘাড় গুঁজে বসেছিল পাশে। রিচার্ড ওর মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। আমি গলা ঝাড়তে অপ্রস্তুত দেখাল ওকে। চোখে চোখ রাখছিল না। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল আমার। তবুও বললাম,

“আমাদের কথা কীভাবে জানলে?”

“এক পেয়াদা বলল। সে না কি কার কাছে শুনেছে তোমরা গাঁয়ে এসেছ।”

রিচার্ডের দৃষ্টি এবার আমার বুকে মাথা রাখা নোভার দিকে স্থির। হাত বাড়িয়ে ওর মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করল,

“কী নাম রেখেছ ওর?”

“নোভালি আগাথা।” বললাম আমি।

“আমার লাস্ট নাম দেওনি?” মনঃক্ষুণ্ন হলো। রাগে দাঁত কামড়ে বললাম,

“কেন দেবো? কী হও তুমি ওর?”

“বাবা হই।”

বিদ্রুপ করে হাসলাম। রিচার্ডের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। একটু ভয় পেলাম। রিচার্ড সেটা বুঝতে পেরে মুখ নামিয়ে নরম সুরে বলল,

“আমি তোমাদের সাথে অনেক অন্যায় করেছি আগাথা। ক্ষমা চাওয়ার মুখ নেই। তবুও যদি_”

“তবু যদি কী হ্যাঁ?” চেঁচিয়ে প্রশ্ন করলাম। নোভা চমকে উঠল ঘুমের ঘোরে। ওর মাথায় আলতো করে হাত বুলাতে আবার ঘুমিয়ে গেল। রিচার্ড আর কোনো কথা বলল না। গাড়ি এগোচ্ছে সামনে। কোথায় যাচ্ছি তখনও জানতাম না। জিজ্ঞেস করলাম,

“কোথায় যাচ্ছি আমরা?”

“আমি যেখানে আছি সেখানে। নিরাপদেই থাকবে তোমরা।”

“না, তোমার ওখানে যাব না। কোচওয়ানকে বলো, আমাদের শহরের বাইরে নামিয়ে দিতে। নিজেদের ব্যবস্থা আমরা বেশ করে নিতে পারব।”

“পাগলামির সময় না এখন আগাথা। প্লেগ মহামারির রূপ নিয়েছে। আশপাশের সব স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে ভয়ংকর ভাবে। আমার সন্তান_”

“খবরদার যদি ওদের সন্তান বলেছ। তুমি ওদের কেউ না।”

“তবে কে ওদের সব, ম্যাক্স?”

জবাব দিতে পারলাম না আমি। রিচার্ড রাগত মুখে বলল,

“আমি সব ভুলে যাব। তুমিও তাই করবে। আজকের পর ম্যাক্স নয় আমিই তোমাদের সব।”

“কিছুতেই না।”

রিচার্ড হাসল। গুরুত্বই দিলো না আমার প্রতিবাদ। নিকোলাস চুপচাপ শুনছিল। রিচার্ড ওর নত মুখপানে চেয়ে বলল,

“বাবাকে মনে পড়ে না নিক?”

নিকোলাস আমাকে শক্ত করে ধরে আছে। রিচার্ড খপ করে ওর হাত ধরে বলল,

“এখনও এত ভয় আমাকে তোর? কেন ভয় পাস, বল? আপন পিতাকে কেন এত ভয় পাবি তুই?”

“তুমি আমার পিতা নও।”

নিকোলাস প্রতিবাদ করে ওঠে। রিচার্ডের চোখ জ্বলছিল রাগে। হঠাৎই শান্ত হয়ে মৃদু হেসে আমাকে লক্ষ্য করে বলল,

“আগাথা, আগাথা, দেখো আমার ছেলে আমাকে পিতা বলতে অস্বীকার করছে। এর দায় কার?”

“তুমি ভালো করেই_” রিচার্ড আমার চোয়াল চেপে ধরে।

“তুমি আমার আগাথা। এত তো ভালোবেসেছিলাম। কেন ধোঁকা দিয়েছিলে? কেন?”

“কতবার বলব আমি তোমাকে ধোঁকা দিইনি।”

“তবে কেন ম্যাক্সকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছ তুমি?”

“তুমি সোফিয়াকে কেন বিয়ে করেছিলে?” পালটা প্রশ্ন ছুঁড়লাম। ম্যাক্স আর আমার সম্পর্ক ওদের মতো নয়। রিচার্ডকে আক্রমণ করতে প্রশ্নটা করেছিলাম। বেশ লেগেছিল ওর। নিকোলাস রিচার্ডের হাত আমার চোয়াল থেকে সরানোর চেষ্টা করছে। রিচার্ড হাত সরিয়ে আগের মতো বসে রইল গুম হয়ে। নিকোলাস ভীরু গলায় আমাকে ফিসফিস করে বলল,

“মা, আমরা সামনে নেমে যাব।”

“কোথাও নামবে না তোমরা। আজকের পর থেকে তোমাদের ভাগ্য আমি লিখব। আমি।”

সত্যি সেদিনের কথা রেখেছিল রিচার্ড। আমাদের ভাগ্য বদলে দিয়েছিল ও। জোরপূর্বক ওর ওখানে নিয়ে যায়। একপ্রকার বন্দি দশায় কাটতে লাগল আমাদের জীবন। সন্তানদের সামনে নেকড়ে রূপে আসতে পারিনি। ম্যাক্সের নিষেধ ছিল নিকোলাসের বিশ বছর হওয়ার আগে এসব কিছুতেই জানানো যাবে না। রিচার্ড আমার অসহায়ত্ব বুঝে বিদ্রুপ করত। ম্যাক্সের গায়েব হওয়ার পেছনেও ওরই হাত ছিল। কিন্তু কোনোদিন সেটা স্বীকার করেনি। সোফিয়া আমাদের মানতে পারেনি। কিন্তু রিচার্ডের ভয়ে চুপচাপ সহ্য করে আমাকে এবং আমার সন্তানদের। রিচার্ডের পাগলামি দেখেছি আমি। আমাকে নিজের করে রাখার জন্য সব করেছে সে। জাহির করেছে আমাকে সে ভালোবাসে। ভালোবাসা কাকে বলে ও জানেই না। ও কেবল বল প্রয়োগে অধিকার করতে জানে আর জানে ধূর্ততা। একজন সামান্য রাজকর্মচারী থেকে কূটবুদ্ধিতার জোরে রাজার খাস লোক বনে যায়। কিন্তু তাতেও ওর লোভ কমে না। পুরো রাজ্য নিজের দখলে চায় ওর। প্লেগ মহামারির প্রকোপে সমস্ত রাজ্যে দুর্ভিক্ষ নেমে এলো। না খেয়ে, রোগে আক্রান্ত হয়ে হাজার হাজার লোক মরল। রাজাকেও কৌশলে মেরে ফেলে রিচার্ড। সিংহাসন দখল করে বসে। বিশ্বস্ত সঙ্গী হিসেবে কাওকে ওর দরকার। সোফিয়ার ছেলে তখনও ছোটো। সুতরাং নিকোলাসের দিকে হাত বাড়ায় সে। শত চেষ্টার পরেও ছেলেকে ওর কালো ছায়া থেকে আড়াল করে রাখতে পারিনি। জানি না কী বলেছিল নিকোলাসকে ও। ছেলেটা আমার অনুরোধ, অনুনয় উপেক্ষা করে রিচার্ডের কথা শুনতে লাগল৷ অন্ধের মতো অনুসরণ করল ওকে। যাকে একদিন পিতা বলতে অস্বীকার করেছিল একসময় তাকেই নিকোলাস বাবা বলে ডাকল। ম্যাক্সের নামও শুনতে পারত না। আমাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে। এদিকে নোভাও বড়ো হচ্ছিল। রিচার্ড তাকেও আমার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়ার পাঁয়তারা শুরু করে। বছরের পর বছর পেরিয়ে যায়। আমার জীবনের পরিবর্তন হয় না। কিন্তু আমার নিকোলাস আমূল পাল্টে যায়। ওর বিশ বছর হতে মাত্র কয়েক মাসের বাকি। অধীর আগ্রহে দিনটার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। নিজেকে চিনবে ওইদিন ও। তখন আমি সব বলব ওকে। হয়তো সেদিন ফিরে আসবে সঠিক পথে। অন্যদিকে রিচার্ডের ক্ষমতা দিন দিন বাড়তে লাগল। প্রজাদের চোখে আমি ছিলাম রিচার্ডের স্ত্রী, রাজ্যের রাণী। সোফিয়া হয়ে রইল মিস্ট্রেস। মোটেও সন্তুষ্ট ছিল না ও। কিন্তু কিছু বলার সাহসও নেই রিচার্ডের সামনে। আমাকে আপন করে পেতে কত কী ই না করেছে রিচার্ড। আমি ওকে আর কোনোদিন গ্রহন করেনি। এই ক্ষোভ আর রাগ আরো ভয়ংকর করে তোলে ওকে। আমাকে শাস্তি দিতে নিকোলাসকে খারাপ পথে নামিয়েছে। মানুষ খুন থেকে শুরু করে সব রকম খারাপ কাজে নিকোলাসকে সামিল করেছে। আমার আবেগী, সহজ সরল ছেলেটা একসময় ভাবলেশহীন, নিষ্ঠুর পাথরের মূর্তিতে পরিণত হয়। আশপাশের দশ রাজ্যের লোক কাঁপত ওর নাম শুনে। রিচার্ডের প্রধান সেনাপতি সে৷ সুতরাং কোনো শাসকের সাহস ছিল না এই রাজ্য আক্রমণ করার। ইচ্ছে মতো যেকোনো রাজ্য নিজের দখলে নিয়ে নিতো রিচার্ড। তার জন্য যতটা নিচে নামার সে নিঃসংকোচে নেমে যেত। একসময় নিজেকে সর্বক্ষমতার অধিকারী মনে করতে লাগল। ঈশ্বরকে ভুলে গেল। নিজেকে সেই স্থানে তুলতে চাইল। অমরত্ব চায় এবার ওর। এরমধ্যে অজানা এক রোগের প্রাদুর্ভাব হয় পাশের রাজ্যে। এক নতুন প্রজাতির বাদুড়ের কামড়ে রক্তশূন্য হয়ে মরতে লাগল মানুষ। মৃত্যুর পর ওরাই আবার হিংস্র পিশাচে পরিণত হয়ে নিশিরাতে মানুষের রক্তপিপাসু হয়ে ওঠে। জনমনে ত্রাসের সৃষ্টি হয়। স্থানীয় পাদ্রীদের পরামর্শে মৃতদেহগুলোকে পুড়িয়ে ভস্মীভূত করে ফেলা হলো। নিস্তার পাওয়া গেল পিশাচদের হাত থেকে। মৃত্যুর মিছিল কিন্তু থামল না। ঈশ্বরের গজব নেমেছে বলে প্রচার হলো। গির্জায় গির্জায় প্রার্থনা শুরু হয়। সাধারণ মানুষ যখন ঈশ্বরের সন্তুষ্টি কামনায় দিনরাত গির্জার দুয়ারে মাথা কুটছে, তখন কিছু শয়তানের পূজারি পৈশাচিক অভিসন্ধি আঁটে। রিচার্ডও ছিল সেই দলে। জীবন্মৃত হওয়ার অর্থ মৃত্যুকে হারিয়ে দেওয়া। এমন সুযোগ হাত ছাড়া কী করে সে? স্বেচ্ছায় হলো অভিশপ্ত পিশাচ। আমার নিকোলাসকে ভুলিয়ে ভালিয়ে পিশাচে পরিণত করল। নিকোলাসকে আমি কিছুতেই থামাতে পারলাম না। আমারই চোখের সামনে আমার দুটো সন্তান পিশাচে পরিণত হলো। আমি অনুনয় করলাম নিকোলাসকে। হয়তো মা বলেই সেদিন সেই অনুনয় রেখেছিল ও। মরতে দিয়েছিল আমাকে। কবর দিয়েছিল মানুষের মতো। কিন্তু আমার আত্মা আজও শান্তি পায়নি। আজও চিৎকার করে কাঁদে সন্তানদের জন্য। তুমি প্রশ্ন করেছিলে না মৃত হওয়ার পরও কী করে এলাম তোমার সামনে? এক মা তাঁর অভিশপ্ত সন্তানদের শাপমোচনের জন্য মৃত্যু পুরীর শৃঙ্খল ভেঙে এসেছে। মৃত্যু পুরীর ওপারের ওই স্বর্গীয় সুখও এই মাকে আঁটকে রাখতে পারেনি। সে এই ধরা তলে এসেছে কেবল তাঁর সন্তানদের ওই পিশাচের জীবন থেকে মুক্ত করতে। যা সে জীবিতকালে পারেনি, মৃত্যুর পর পারতে চায়। আর তাইতো তোমার সামনে এসেছে। তোমার সাহায্য কামনায়।”

“আমার সাহায্য?” বিস্মিত হয় ইসাবেলা। আগাথার সব কথা শুনে আবেগি হয়ে পড়েছিল। কিন্তু শেষ কথাটা ওকে বিচলিত করে। আগাথা ওর হাত দুটো ধরে ছলছল চোখে বলল,

“তোমাকে আবার ফিরতে হবে ওদের কাছে। ওদের সবাইকে শেষ করে পৃথিবীটাকে পিশাচমুক্ত করবে তুমি। তার আগে একটা কাজ করতে হবে তোমাকে। আমার সন্তানদুটোকে দিয়ে ঈশ্বরের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করাবে। কীভাবে করবে সব আমি শিখিয়ে_” আগাথার কথা শেষ হওয়ার পূর্বে হাত ছাড়িয়ে নেয় ইসাবেলা। আর্ত কণ্ঠে বলল,

“আমি পারব না। ক্ষমা করুন আমাকে।” বহুকষ্টে ওই পিশাচদের কবল থেকে মুক্ত হয়েছে সে। জেনেশুনে ওদের কাছে যাওয়া আত্মহত্যার সামীল। ইসাবেলা কখনও তা করবে না। আশাহত হয় ক্ষণিকের জন্য আগাথা। কিন্তু হাল ছাড়ে না।

“নিজের জীবনের ভয় করছ? অথচ, তোমাকে বাঁচাতে ভ্যালেরিয়ার প্রাণ গেছে। স্বার্থপর মেয়েমানুষ, এই ভালোবাসো ভ্যালেরিয়াকে? ভীরুর মতো ফিরে গিয়ে শান্তি পাবে জীবনভর? ওরা ভ্যালেরিয়া, ফাদার জালোনভের মতো আরো কতশত মানুষ মারবে তার ইয়ত্তা নেই। আমার সন্তানদের মতো আরো কত জনকে যে পিশাচে পরিণত করবে! তুমি তো মা নও তাই আমার ব্যথা তুমি বুঝবে না। চাচা আপন জীবন বাঁচা। নিজেকে বাঁচিয়ে ফিরে যাও। অর্নথক প্রাণ গেল বেচারি ভ্যালেরিয়ার।”

আগাথা রুষ্ট, আশাহত মুখে উঠে দাঁড়ায়। ভ্যালেরিয়ার কথা মনে পড়তে বুকটা হু হু করে ওঠে ইসাবেলার। সেই কালো রাত মনে করে। ভ্যালেরিয়ার মৃত্যু চোখে সামনে ভেসে ওঠে। সিট থেকে দাঁড়িয়ে যায়। খুঁজতে লাগল আগাথাকে। ওই তো ট্রেনের বাইরে দেখা যাচ্ছে।

“এই মেয়েটা অনেকক্ষণ ধরে একা একা কথা বলছিল। মাথা টাথা খারাপ আছে বোধহয়?”

ইসাবেলা কেবিন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে নিজের সম্পর্কে সহযাত্রীদের ফিসফিসানি গলা শুনে থমকে দাঁড়ায়। তবে কি এরা আগাথাকে দেখেনি?

চলবে,,,

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব-২২
Writer Taniya Sheikh

সন্ধ্যার কুজ্ঝটিকা গাঢ় অন্ধকারে রূপ নিয়েছে। ট্রেনের হুইসেল বাজতে প্লাটফর্ম ফাঁকা হয়ে গেল। ট্রেন থেকে নেমে আগাথাকে অনুসরণ করল ইসাবেলা। কাছাকাছি বেশ নির্জন একটা স্থানে গিয়ে থামে আগাথা। পেছনে ইসাবেলা। ভীষণ খুশি আগাথা। যেমন ভেবেছিল তেমনই হচ্ছে। ইসাবেলার মস্তিষ্কের কিছুটা হলেও এখন তাঁর আয়ত্বে। আস্তে আস্তে পুরোটা আয়ত্বে নেবে। আর তারপর এই মেয়েকে দিয়েই হবে সন্তানদের শাপমোচন। শত জনমের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণতা পাবে এবার। তৃপ্ত হবে আত্মা। ইসাবেলা এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করে,

“কোন একটা শহরের নাম বলেছিল নোভা। নামই তো মনে নেই, সেখানে যাব কীভাবে?”

“ওসব নিয়ে ভাবতে হবে না তোমাকে। প্লাটফর্মের বাইরে ঠিক যেখানে টমটম দাঁড়িয়েছিল, গিয়ে দেখো সেটা এখনও সেখানে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে।”

“পল! তবে কি সেও আপনাকে দেখেছে?”

“না, আর কোনো প্রশ্ন নয় এখন। দ্রুত যাও।”

ইসাবেলা দু কদম এগিয়ে ফের ঘুরে দাঁড়ায়। বলে,

“আমি একা কীভাবে পারব ওদের সাথে? আমার বড্ড ভয় করছে। নিকোলাস জানলে মেরেই ফেলবে।”

“তুমি একা নও ইসাবেলা। আমি আছি তোমার সাথে। নিকোলাস টের পাওয়ার আগেই তুমি আমি মিলে ওদের শেষ করব।”

“কিন্তু কীভাবে?”

“সময় হলে সব জানতে পারবে। আর সময় নষ্ট করো না। যাও এখন।”

অসংখ্য প্রশ্ন মাথায় করে ইসাবেলা প্লাটফর্মের বাইরে এসে থামে। আশ্চর্য! ওই তো পলের সেই টমটম। সত্যি বলতে আগাথাকে ইসাবেলা ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না। প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে তাঁর কথায় রাজি হয়েছে কেন? ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত। মনের গহীনে সে এখনও বাড়ি ফিরে যাওয়ার পক্ষে। কিন্তু ভ্যালেরিয়ার প্রতি ওর দায়িত্ব ওকে ট্রেন থেকে নামিয়ে এনেছে। প্রিয় ভ্যালেরির মৃত্যুর দিন সে যে শপথ করেছিল, তাই মনে করে আগাথাকে অনুসরণ করে। আগাথার অতীত শুনে কষ্ট হয়েছে। সাহায্য করতেও ইচ্ছে হয়। তবে নিজেকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে না। ভ্যালেরিয়া পুরোটা জীবন উৎসর্গ করেছে ঈশ্বরের সমীপে। ঈশ্বরের সৃষ্টি মানুষের দুঃখ, কষ্ট দূরে নিয়োজিত ছিল। কিন্তু সে সব হেলা করে ইসাবেলাকে বাঁচাতে শেষমেশ প্রাণ দিলো। চাইলে একাই নিরাপদে ফিরে যেতে পারত। সমাজে ওর প্রয়োজন ছিল। ইসাবেলা জানে সেটা। ভ্যালেরিয়া সে দায়িত্ব হেলা করেছে কেবল ওর জন্য। তাকে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছাতে গিয়ে নিজের মৃত্যু ডেকে আনল ভ্যালেরিয়া। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সে ইসাবেলার নিরাপত্তার কথা ভেবেছে। অন্যদিকে ইসাবেলা কেবল নিজেকেই নিয়ে ভাবছে। প্রিয় ভ্যালেরির মৃত্যুর প্রতিশোধ নয়, নিজের জীবন বাঁচানোকে প্রাধান্য দিচ্ছে সে। ধিক্কার দেয় নিজেকে। চোখ দুটো ভীষণ জ্বলছে। ফের নোনা বর্ষণ হবে বুঝি।

“তুমি!”

পল বিস্মিত হয় ইসাবেলাকে দেখতে পেয়ে। ইসাবেলা অপ্রস্তুতভাবে হেসে বলে,

“হুম।”

“ট্রেন তো ছেড়ে গেল। বাড়ি যাবে না?”

ইসাবেলা না সূচক মাথা নাড়ায়। পল ভুরু কুঁচকে বলে,

“কেন?” তারপর বিস্মিত মুখে বলে,

“খবরদার! বলো না পুনরায় ফিরতে চাও আমার সাথে?”

ইসাবেলা আবার হাসে। সে জানে এই মুহূর্তে তাকে বোকাচন্ডি লাগছে। প্রয়োজন মানুষকে বোকা বানায়, আবার কেউ কেউ ইচ্ছে করে বোকা সাজে।

“মাথা খারাপ হয়েছে তোমার মেয়ে?” পল ধমকের সুরে বলে।

“নোভার সাথে জরুরি কথা আছে আমার। ফিরতেই হবে।” বলল ইসাবেলা। পল বিরক্ত হয়।

“আমি সেসব জানি না। আমাকে রাজকুমারী বলেছেন তোমাকে ট্রেনে তুলে দিতে, দিয়েছি। আমার কাজ শেষ। বিদায়।”

পল গাড়ির দিকে ঘুরতে ইসাবেলা বলে,

“তুমি আমাকে একা ফেলে যেতে পারো না।”

ঘাড়ের ওপর থেকে ইসাবেলার দিকে ফের ভুরু কুঁচকে তাকায় পল। তারপর মুখ সোজা করে কোচওয়ানের সিটে উঠে বসে।

“পরবর্তী ট্রেন ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে এসে পৌঁছাবে। পূর্বদিকে যাত্রী ছাউনি আছে। সেখানে গিয়ে অপেক্ষা করো, যাও।”

মাছি তাড়ানোর মতো হাত নাড়ায় পল। নিজের ওপর এখন রাগ হচ্ছে ওর। কেন যে ওই গণিকার ফাঁদে পা দিয়েছিল! ইসাবেলাকে ট্রেনে তুলে টমটমে ফেরার পথে মেয়েটির সাথে দেখা। নিকোলাসের কাজের চাপ ইদানীং খুব৷ তার ওপর ইসাবেলার ওপর নজর রাখার দরুন মাস খানেক যৌন সম্ভোগের সুযোগ পায়নি। বোধহয় সে কারণেই মেয়েটির সম্মোহনী ইশারায় দ্রুতই সায় দেয়। প্লাটফর্মের পাশের ঝোপের আড়ালে টেনে নিয়ে যায় মেয়েটি তাকে। দেরি সে কারণেই হয়ে গেল। কে জানত ওই দেরি তাঁকে এমন বিপদে ফেলবে। এই মেয়েকে পুনরায় ফিরিয়ে নেওয়ার অর্থ রাজকুমারীর রোষানলে পড়া। নোভা তাকে এমনিতেই সহ্য করতে পারে না। কেন, কে জানে? এই মেয়েকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে দেখলে কী যে হবে! এসব চিন্তা করতে করতে চাবুকটা হাতে তুলে নেয়। ঘোড়ার পিঠে বাড়ি দেওয়া আগে শেষবারের মতো দেখতে চায় ইসাবেলাকে। কিন্তু কই সে? হাতের চাবুক ততক্ষণে ঘোড়ার পিঠে পড়েছে। ক্ষুরে ধুলো উড়িয়ে রব তুলে ছুটছে ঘোড়া। পল যাত্রী আসনে তাকাতে ইসাবেলাকে দেখল। ঠোঁটে সেই বোকা বোকা হাসি। ঘোড়া থামালো পল। রাগত গলায় বলল,

“নামো বলছি।”

“নাহ!” দৃঢ়তার সঙ্গে জবাব দিলো ইসাবেলা। পল কপাল কুঁচকায়।

“না?”

“না”

মুখটা রুক্ষ কঠিন হলো পলের। বলল,

“তোমাকে টেনেহিঁচড়ে নামাতে পারি, জানো?”

একটু ঘাবড়ে গেল ইসাবেলা। কিন্তু হাসল নিষ্পাপভাবে। বলল,

“আমি জানি, তা তুমি করবে না। জেন্টেলম্যান কি না।”

পল হঠাৎই নেমে এলো। যাত্রী আসনের মুখে এসে দাঁড়ায়। গলা শুকিয়ে যায় ইসাবেলার। পল হাত বাড়াতে সরে গেল পেছনে। কাঁপা গলায় বলল,

“ছোঁবে না। সু, সু।”

পল ওর হাত টেনে নামাতে গেলে আরেক হাতে শক্ত করে সিট ধরে রাখে ইসাবেলা। বেশ তাগড়া পুরুষ পল। বয়সও তো বেশি নয়। বোধহয় ত্রিশ হবে। ইসাবেলা ওর শক্তির সাথে পেরে উঠছে না। সুতরাং কেঁদে দিলো গলা ছেড়ে। পলের হাত থেমে গেল। ও ভাবল টানাটানিতে ইসাবেলা বুঝি ব্যথা পেয়েছে। এই মেয়েটি কাঁদলে পলের খারাপ লাগে। মানুষ হিসেবে হয়তো এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু গত এক দশক রক্তপিপাসুদের দাস হয়ে থাকাতে মনুষ্য অনেক দোষ-গুনই ভুলেছে। তাছাড়া মানুষই বা কতটুকু ও। নিকোলাস এবং তার পরিবারের সেবায় সে যে কতশত মানুষকে ভুলিয়ে মৃত্যুর দুয়ারে ঠেলেছে, সঠিক হিসেবটাও আজ মেলাতে পারে না। মৃত্যুকে সামনে দেখে সেসব মানুষদের ভয়, বাঁচার আকুতিভরা রোদনেও সামান্যতম কষ্ট অনুভব করেনি। অথচ, যেদিন এই মেয়েটি ভরা বাজারে লাঞ্ছিত হলো, অসহায়ের মতো চিৎকার করে তার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেছিল। সেদিন জেগে উঠেছিল পলের মৃতপ্রায় মনুষ্যত্ব। নিকোলাসকে সেই প্রথমবার অনুরোধ করেছিল কোনো মানুষকে বাঁচাতে। অবাক হয়েছিল নিকোলাস। কিন্তু কোনো প্রশ্ন করেনি। অনুগত দাসের মন রক্ষার্থে, ইচ্ছে পূরণ করতে ঝুঁকি নিয়ে বাঁচিয়েছিল ইসাবেলাকে। মালিকের নিকট ভীষণরকম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে মনে মনে পল। আজ সেই পুরনো কথা মনে পড়ল ইসাবেলাকে কাঁদতে দেখে। মেয়েটা তাকে জেন্টেলম্যান ভেবেছে। তাচ্ছিল্যের সুরে হাসল। জেন্টেলম্যান আর সে! বোকা মেয়ে।

“হয়েছে। আর কাঁদতে হবে না। যা চাও তাই হবে। তবে মনে রেখো, পস্তাবে তুমি।”

পল উঠে বসল কোচওয়ানের সিটে। ঘোড়া ছুটছে আবার। সিটে বসে তখনও নাক টানছে ইসাবেলা। হাতে সামান্য ব্যথা পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু হাউমাউ করে কাঁদার মতো নয়। নিজের নাটকীয়তায় নিজেই যেন অবাক হলো। কী থেকে কী হয়ে যাচ্ছে সে। শেষমেশ মিথ্যা কান্নার অভিনয়ও করল। তাও আবার নিখুঁতভাবে! ছোটো থেকে এসবে সে বড্ড কাঁচা। তাতিয়ানা বেশ পটু মেকি কান্নায় আর অভিনয়ে। ইসাবেলা মিথ্যা বলতে গিয়ে বারবারই ধরা খেয়েছে। যা হোক, এই মুহূর্তে পলকে বোকা বানাতে পেরেছে এতেই আনন্দিত এখন সে। গাড়ি যত সামনে এগোচ্ছে বুকের ভেতরের ঢিপঢিপানি বাড়ছে। কী বলবে নোভার সামনে গিয়ে? অনেক ভেবেও যুতসই জবাব খুঁজে পেল না। নিকোলাস! এই একটা নাম মনে পড়লে কলিজা শুকিয়ে একটুখানি হয়ে যাচ্ছে। ঘূর্ণাক্ষরেও যদি ও সত্যিটা জানতে পারে ইসাবেলার আর রক্ষা থাকবে না। বিড়বিড় করে একজনকেই স্মরণ করল,

“আগাথা”

“আমাকে স্মরণ করেছ তুমি?”

“আগাথা!”

ইসাবেলা বিস্ময়াহত হয় আগাথাকে পাশে বসে থাকতে দেখে। তারপর মনে পড়ল সে তো প্রেতাত্মা। ওর জোরালো শব্দ পলের কান পর্যন্ত যায়। ঘুরে তাকায় সে।

“কী!”

“ব্যথা! আমার হাতটাতে খুব ব্যথা।” হাতের দিকে চেয়ে কাঁদো কাঁদো ভাব করল। পলের দৃষ্টি নমনীয় হয়। তারপর সামনে ঘুরে বসে। নিঃশব্দে হাঁফ ছাড়ল ইসাবেলা। আগাথার মুখের দিকে তাকাতে দেখল, হাসছেন তিনি। একটু লজ্জিত হলো। পলের পিঠের দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বলল,

“আমার ভীষণ ভয় করছে আগাথা। নোভা আমাকে দেখলে ক্ষেপে যাবে। কে জানে হয়তো মেরেও ফেলবে।”

হাসলেন আগাথা। ঠিক নোভার মতো। চমৎকার, মুগ্ধতা মেশানো সেই হাসি। মাথা দুদিকে নাড়িয়ে আগাথা বললেন,

“ও তোমাকে মারবে না। আর না কাওকে মারতে দেবে। চিন্তা করো না।”

“আপনি কীভাবে সিওর হলেন?”

আগাথার ঠোঁটে সেই মনোমুগ্ধকর হাসি নেই। তার বদলে কুটিল হাসি দেখা গেল। ভুরু কুঁচকে যায় ইসাবেলার। আগাথা সেটা লক্ষ্য করতে মৃদু গলা ঝেড়ে স্বাভাবিক মুখে বললেন,

“আমি তো ওদের মা তাই। আচ্ছা, আমি এখন গেলাম। প্রয়োজন হলে আবার স্মরণ করো।”

ইসাবেলা ওঁর হাতটা চেপে ধরে বলে,

“অন্তত এইটুকু শিখিয়ে দেন নোভা যদি ফিরে যাওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করে, কী বলব তখন?”

ইসাবেলার গালে পরম মমতায় হাত রেখে আগাথা বললেন,

“শান্ত হও, মাই প্রিসিয়াস। আমি আছি তো। এখন একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো।”

ইসাবেলার চোখ দুটো হাত দিয়ে বন্ধ করে ঘুমপাড়ানি ছন্দ আওতাতে লাগলেন। খুব বেশি সময় লাগল না ইসাবেলার চোখে ঘুম নেমে আসতে। ঘুম ভাঙল পলের ডাকে। আড়মোড়া ভেঙে জেগে দেখল গাড়ি থেমে আছে। পল দাঁড়িয়ে টমটমের মুখে।

“পৌঁছে গেছি আমরা। নেমে এসো।”

“এত তাড়াতাড়ি?”

পল মজা পেয়েছে কথাটা শুনে। ওর মুখ দেখে তাই বোঝা গেল। বিদ্রুপ করে বলল,

“হুম, প্রায় আট ঘণ্টা ঘুমালে তো পথ তাড়াতাড়িই শেষ হয়।”

“আট ঘণ্টা!”

তখনই আশপাশটা খেয়ালে এলো। বেশ অন্ধকার চারিদিকে। প্লাটফর্ম ছেড়েছিল তখন ছিল সন্ধ্যা। রাত কত হয়েছে এখন?

“কটা বাজে?”

নেমে প্রশ্ন করল ইসাবেলা। পল সামনে পা বাড়িয়ে বলল,

“একটু পরেই জানতে পারবে।”

সামনে বিরাট প্যালেস। ইসাবেলার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না, সে একজন প্রেতাত্মার কথায় প্রভাবিত হয়ে আবার ফিরছে পিশাচপুরীতে। বৈদ্যুতিক বাতির স্বল্প আলোতে যতসামান্যই বোঝা যাচ্ছে প্যালেসের বাইরের দিকটা। হঠাৎ ঢংঢং শব্দ করে বেজে উঠল প্যালেসের সামনের মিনারের ঘড়িটা। ঠিক দুটো বাজল। সচারাচর মিনারগুলোর ওপরে ক্রুশচিহ্ন থাকে। এই প্যালেসের সম্মুখভাগের মিনারে সেক্ষেত্রে ব্যতিক্রম দেখা গেল। প্যালেসে এগোতে এগোতে ইসাবেলা এদিক ওদিক এক নজর দেখে নেয়। টমটমের ঠিক পরেই একটি কৃত্রিম ফোয়ারা। তার মাঝে দুটো মূর্তি। ওদিকে বৈদ্যুতিক আলো তেমন না পড়ায় মূর্তিদুটোর মুখ বোঝা যাচ্ছে না। মূর্তি দুটোর মাঝ দিয়েই পানি পড়ছে। প্যালেসের সামনে দিয়ে পাকা রাস্তা। তারই একপাশে দাঁড়িয়ে আছে দুটো ভিন্টেজ কার। একটার হুড খোলা, কিছুটা জিপ আকৃতির। রাস্তার দু’পাশে ছাঁটা সবুজ ঘাস। প্যালেসের শেষ দু মাথায় মাঝারি ধরনের কিছু গাছের সারি। আঁধার নেমেছে ওদিকটাতে। পল প্যালেসের সদর দরজা ঠেলে ঢুকল। ইসাবেলা ভীরু পায়ে এগিয়ে যায়। তখন আগাথা ঘুম পাড়িয়ে যে প্রশ্ন ভুলিয়ে দিয়েছিল, এখন আবার মনে পড়ে গেল। কী বলবে নোভার সামনে দাঁড়িয়ে? প্যালেসের হলঘরের ওপর বৃহৎ ঝাড়বাতি। কিন্তু পুরোপুরি জ্বলছে না ওটা। অনুজ্জ্বল আলো ছড়াচ্ছে। সেই আলোতে দেখল পায়ের নিচের দামি মার্বেল পাথরে মোড়ানো পুরো হলঘর। খানিকটা লাল কার্পেটে ঢেকে আছে। হলঘরের একপাশে বিশাল বড়ো ডায়নিং। ঠিক সোজাসুজি সিংহাসন। ইসাবেলা জানে সিংহাসনটি কার? অবশ্যই দ্য গ্রেট পিশাচ নিকোলাসের। ঠোঁট বাঁকিয়ে ভেংচি কাটল ইসাবেলা। হলঘরে এই মুহূর্তে কেউ নেই। পল’কে খুঁজল। দেখা মিলল না কোথাও। একা এখানে ওখানে ভূতের মতো অনেকক্ষণ ঘুরল। দামি দামি আসবাবপত্র আর কিছু প্রতিচিত্র ছাড়া আর কিছুই নেই। হলঘরের মাঝ বরাবর প্রসস্থ সিঁড়ি। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এলো ইসাবেলা। কড়িডোরেও মৃদু আলো। ধীর পায়ে এগোতে লাগল। পায়ে পায়ে ভয় ওর। প্রথম যে দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় সেটা বন্ধ। পরের দুটোও তাই। তৃতীয়টাতে তালা নেই। বুক দুরুদুরু করছে। খুলবে কী খুলবে না? ইতস্তত কাটিয়ে দরজাটা ঠেললো। খুলে গেল সেটা। পস্তালো এবার ইসাবেলা। মেয়েলি শীৎকারে কানে আসতে অপ্রস্তুতভাবে জমে গেল সে। এই ঘরে বৈদ্যুতিক আলো নেই। ঘরের এককোনে জ্বলা ফায়ারপ্লেসের আলোতে দেখল বিছানায় হাঁটু মুড়ে বসা অর্ধনগ্ন একটি মেয়ে। মাথাটা পেছনে ঝুঁকে গেছে দৈহিক সুখে। হাতদুটো দিয়ে কাওকে জড়িয়ে ধরে আছে। যার ওপর বসে আছে তাকে অবশ্য দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু ওই দ্বিতীয় ব্যক্তির মাথাটা মেয়েটার ঘাড়ে। ওদিকটা অন্ধকার আর পর্দার ছায়ার কারণে ঠিকমতো দেখতে পেল না। দরজা খোলার শব্দ পেয়ে মেয়েটি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়েছে। তখনই ঠেলে সরিয়ে দিয়েছি দ্বিতীয় ব্যক্তি মেয়েটিকে। কিন্তু এখনও তাকে আড়াল করে আছে মেয়েটির শরীরের একাংশ। মেয়েটির বুক উন্মুক্ত। গলার পাশ দিয়ে তাজা রক্ত বেয়ে পড়ছে। শিউরে ওঠে ইসাবেলা। দ্রুত দৃষ্টি নামিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। বিছানা ছেড়ে নেমে রাগত মুখে মেয়েটি জিজ্ঞেস করে,

“কে তুমি?”

ভেবেছিল এই দরজাও বুঝি বন্ধ থাকবে ভেতর থেকে। কে জানত দরজার আড়ালে এসব চলছে। ভুলটা ওরই। নক করা উচিত ছিল প্রথমে। পিশাচ প্রাসাদের দরজায় নক? ইসাবেলা পা চালিয়ে দরজার কাছাকাছি যেতে মেয়েটা আবার প্রশ্ন করে। মাথা নাড়িয়ে ঘুরে দাঁড়াতে শুনল পরিচিত গলা।

“তুমি!”

প্রশ্ন ছিল না। আশ্চর্য যেন গলার স্বর। নিকোলাসের কাছে আশাতীত ছিল ইসাবেলার উপস্থিতি। গলা শুকিয়ে এলো ইসাবেলার। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তিটুকু পেল না ও। স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে পরিচিত সেই ভারী পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে।

“বেলা!”

থেমে গেল ইসাবেলার হৃৎস্পন্দনের গতি। প্রাণটা যেন উঠে এসেছে গলার কাছে। মুখ তুলে তাকানোর সাহস নেই। নিকোলাস সামনে এসে দাঁড়ায়। পরনে টাউজার ছাড়া কিছু নেই। ওর নগ্ন বুক ইসাবেলার মুখের সামনে। ফায়ারপ্লেসের আগুনের রশ্মির ছটা নগ্ন পিঙ্গলবর্ণের বুকের লোমগুলোকে মোহনীয় করে তুলেছে। সেই গোলাপ আর সিম্বোলিক আকৃতির ট্যাটু খুব কাছ থেকে দেখতে পাচ্ছে আজ। ইসাবেলার ইচ্ছে হলো হাতটা দিয়ে ছুঁয়ে দেখার। কিন্তু একচুল নড়তে পারছে না। চোখের পাতা দুটো কেমন ঢলে ঢলে পড়ছে। অস্পষ্ট হয়ে এলো দৃষ্টি। নিকোলাসের গায়ের সেই সোঁদা মাটির গন্ধ নাকে লাগল। সর্ব শরীর কেমন নিস্তেজ বোধ হচ্ছে। নিকোলাসের হাতটা ইসাবেলার বাহুতে থামে। বেশ উষ্ণ স্পর্শটা। সে ডেকে ওঠে পুনঃপুন,

“বেলা, বেলা।”

ঘোর অমানিশা ছেয়ে যায় ইসাবেলার সামনে। পাখির পালকের ন্যায় মনে হলো শরীরটা। যেন হাওয়ায় ভাসছে। হঠাৎ একটা পেশিবহুল হাত তাকে জড়িয়ে ধরে। গালে লোমশ কিছু অনুভব করল। মাথাটা হালকা বোধ হচ্ছে। নাকে এসে লাগছে সেই সোঁদা মাটির গন্ধ! উঁহু! সোঁদা মাটির সুবাস।

চলবে,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে