তিমিরে ফোটা গোলাপ পর্ব-৯৬+৯৭+৯৮

0
1300

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৯৬
Writer তানিয়া শেখ

অনেক খোঁজাখুজির পর ভোলইয়ার মৃত দেহ পাওয়া গেল লনের ঝোপের আড়ালে । তাশার সে কী কান্না। রেইনি হিমশিম খেল কান্না থামাতে। তাতিয়ানার বিড়াল পছন্দ না, কিন্তু মেয়ের খুশির জন্য মাতভেইর এই উপহারটাকে সে অপছন্দও করেনি। মেয়েটার খুব প্রিয় হয়ে উঠেছিল ওটা।

“আর কেঁদো না, সোনা। বাবা তোমাকে নতুন একটা বিড়াল এনে দেবে।”
তবুও মেয়ের কান্না কোনোভাবে থামাতে পারল না। মাতভেই এগিয়ে এলো। কোলে নিলো মেয়েকে। এটা ওটা বলে সান্ত্বনা দেয়। তাতিয়ানার ভীষণ খারাপ লাগল মেয়ের জন্য। মাতভেই আর ওর চোখাচোখি হতে চোখ সরিয়ে নিলো। ঠাণ্ডা লড়াই চলছে ওদের মধ্যে। মাতভেই তাতিয়ানার বিশ্বাসে আঘাত করেছে। ইসাবেলার সম্পর্কের ব্যাপারেও জেনেও লুকিয়েছে ওর থেকে। দারুন কষ্ট পেয়েছে মনে তাতিয়ানা। মাতভেই ক্ষমা চায়। সত্যি বলতে ও জানত না ইসাবেলা এখনও নিকোলাসের সাথে সম্পর্কে আছে। ভেবেছিল আন্দ্রেইর সেই হুমকির পর ওদের মধ্যে আর যোগাযোগ নেই। থাকবেই বা কি করে, নিকোলাস তো জানতোই না ইসাবেলা বেঁচে আছে না মরে গেছে। ইসাবেলাও আর ওকে কিছু বলেনি। সন্দেহ তো হয়েছিল মাতভেইর, কিন্তু সন্দেহের কিনারা পর্যন্ত যাওয়ার অবসর হয়ে ওঠেনি।
তাতিয়ানা সব শোনার পরও গম্ভীর। মাতভেই জানে এই গম্ভীরতা কাটতে সময় লাগবে, চেষ্টা লাগবে। সব করবে মাতভেই। মানুষ ভুলের উর্ধ্বে নয়। তবে সেই ভুল শিক্ষা হওয়া উচিত।

বিড়ালটাকে ভাগাড়ে ফেলে ওরা মহলে প্রবেশ করল। কেবল দাঁড়িয়ে রইলেন একজন, আন্না মেরিও। তাঁর দৃষ্টি গেল সোজা ইসাবেলার জানালার দিকে। মায়ের চোখকে ফাঁকি দেওয়ার আগে ধরা পড়ে গেল ইসাবেলা। ওর ওই বিষন্ন, অপরাধী মুখ ওতদূরে দাঁড়িয়েও স্পষ্ট দেখতে পেলেন আন্না মেরিও। ইসাবেলা চট করে নিজেকে আড়াল করে নিলো। আজ মায়ের মুখোমুখি দাঁড়ানোর সাহসও ওর নেই। দু-হাতের মুষ্টি শক্ত হলো, দাঁতে দাঁত কামড়ে ধরে আছেন। নিজেকে প্রতারিত মনে করলেন। এই মেয়ে তাঁর বিশ্বাস ভেঙেছে। তাঁর সকল শিক্ষা পায়ে পিষে আজ পিশাচিনী হওয়ার পথে৷ তবে প্রতারণার চেয়ে মাতৃত্ববোধ প্রবল। এক মা দেখছে তাঁর মেয়ে বিপথে যাচ্ছে। আজন্ম আদরের আহ্লাদে, সুশিক্ষায় মানুষ করা মেয়েটা অন্ধকার পাপের দিকে ধাবিত হচ্ছে। অথচ, তিনি হাত গুটিয়ে বসে আছেন। চোখের সামনে সন্তানকে অন্ধকারে হারিয়ে যেতে দেখেও চুপ করে আছেন। অভিমান, ক্রোধ, তিরস্কার ও ছোটো করা ছাড়া আর কি কিছু করার নেই? না, এভাবে চুপ করে থাকবেন না তিনি। পানি মাথার ওপর চলে যাবে নয়তো। ভ্যালেরিয়া গেল, রজার গেল, ভোলইয়া গেল, এমনি করে চুপচাপ থাকলে একদিন সব শেষ হয়ে যাবে।

“নিকোলাস ম্যাক্সওয়েলদের বংশ নির্বংশ করতে চায় আন্নে। তোমার মেয়েকে ও ব্যবহার করছে। তোমার মেয়ে!” তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলেন মার্কোভিক। তারপর বললেন,

“ও আর তোমার মেয়ে নেই। দেখেছো না কীভাবে ওই পিশাচের পক্ষে কথা বলে। বশীভূত করে ফেলেছে ওকে পিশাচটা। এখনও সময় আছে আন্নে। এখনও সব ঠিক হতে পারে। তুমি একটু সহযোগিতা করলে ফিরে পাবে তোমার মেয়েকে, রক্ষা পাবে ম্যাক্সওয়েল বংশ। নয়তো সব শেষ হয়ে যাবে, ধ্বংস হয়ে যাবে সব।”

পিতার কথা স্মরণ করতে শক্ত মুষ্টি আলগা করলেন। ভুল করেছেন পিতাকে অমান্য করে। এই ভুলের শাস্তি বেশ করে পেয়েছেন। এবার তার প্রায়শ্চিত্ত করবেন। একজন মা, একজন ম্যাক্সওয়েল হিসেবে এ তাঁর কর্তব্য।

মার্কোভিক একপ্রকার আশা ছেড়ে দিলেন। ম্যাক্সিমও তাই। কিন্তু ড্যামিয়ানের দৃঢ় বিশ্বাস নিজের পরিকল্পনার ওপর। এত বছর একটু একটু করে বুদ্ধি খাঁটিয়ে ধৈর্য ধরে পরিকল্পনা করেছে। ত্যাগ কি করেনি? শিকার টোপ ফেলে ধরতে হয়। ইসাবেলাকে ও টোপ হিসেবে ব্যবহার করেছে। রিস্ক ছিল। কিন্তু নিকোলাস যখন আস্তে আস্তে ওর প্রতি দুর্বল হলো তখন ভয়টা কেটে যায়। মনে মনে হেসেছে। লোকে বলে মেয়েলোক দুর্বল। আবেগের আতিশয্যে ভরা জীব। কিন্তু এই মেয়েলোক দিয়েই বিশ্ব জয় সম্ভব। যে পুরুষ পণ করেছে ঘর করব না, নত হব না তাকেও এই নারীদের একজন ঘরে টানে, সম্মুখে হাঁটু ভেঙে বসায়। স্বার্থপর, নিষ্ঠুর পিশাচ যার হৃদয়ে প্রেম ছিল না, মায়া ছিল না সেও প্রেমে পড়ল, তুমুলভাবে, হৃদয় নিংড়ে। নারী শক্তির উৎস। এই শক্তি দিয়ে সৃষ্টিকর্তা পৃথিবী সজীব, সৌন্দর্যমণ্ডিত ও পুন্যময় করেছেন। আর টেনেছেন পুরুষের লাগাম। শয়তান করল ঠিক উলটো। স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হওয়ার প্রতিশোধ সে নিয়েছে এই নারীকে কুমন্ত্রণা দিয়েই। যে পুরুষের লাগাম টানার শক্তি রাখে তাকে বশ করা সহজ নয়। কিন্তু যে করতে পেরেছে জয়মাল্য তারই জোটে। সুতরাং এই জয়মাল্যও ড্যামিয়ান অধিকার করবে।
সফলতার কয়েক কদম দূরে এসে হতাশ হবে না। প্রশ্নই ওঠে না। আন্না মেরিওকে ও ঠিক চেনে। আজ হোক কাল আন্না মেরিও ওর কাছে আসবে। আসতেই হবে। ওর পাতা ফাঁদে পা দেওয়া ছাড়া আর যে পথ নেই তাঁর। ড্যামিয়ান নিশ্চিন্ত মনে বিয়ারে চুমুক দেয়। মার্কোভিক ওর এই শান্ত হয়ে থাকায় বেশ বিরক্ত হচ্ছেন।

“না, আমি তোমার এই নীরবতা আর মানতে পারছি না ড্যামিয়ান। ওই পিশাচটা আমার ছেলে, মেয়েকে মারল। আমার নাতনি ওর বশে। বিনা বাধায় ও আমার মহলে আসছে যাচ্ছে। কোনদিন না আমাদের সবাইকে সমূলে শেষ করে দেয়। এমন বিপদ মাথায় করে হাত গুটিয়ে বসে থাকার মানে হয় না।”

“তুমি আমার ওপর বিশ্বাস হারাচ্ছ মার্কোভিক? বলেছি তো সবুর করো। এতকাল করলে আর ক’টা দিন _” ড্যামিয়ানের কথা অসমাপ্ত থাকে দরজায় কড়া পড়তে।

“ভেতরে এসো।”

তরুণী ভৃত্যাটি দরজা খুলে নত মুখে দাঁড়ায়,

“মনিব, একজন ভদ্রমহিলা আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। তাঁকে কি বসার ঘরে অপেক্ষা করতে বলব?”

মার্কোভিকের দিকে তাকিয়ে ড্যামিয়ান হাসল। বলল,

“ক’টা দিন নয় আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর আমরা লক্ষ্যে পৌঁছাচ্ছি প্রৌঢ় ম্যাক্সওয়েল। তোমার আমার আমাদের সবার সফলতার চাবিকাঠি দুয়ারে এসে গেছে।”

তারপর ভৃত্যার দিকে তাকিয়ে আদেশ করল,

“যাও, আমার আন্নেকে সসম্মানে এখানে নিয়ে এসো।”

ভৃত্যাটি প্রস্থান করল। একটু পর আন্না মেরিওকে নিয়ে হাজির হয়। মার্কোভিক ও ম্যাক্সিমের চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এই মুহূর্তে ভীষণ অন্যরকম দেখাচ্ছে আন্না মেরিওকে। বিপর্যস্ত, বিপন্ন। কিন্তু চোখ জ্বলন্ত। ড্যামিয়ান এগিয়ে আসতে আন্না মেরিও গম্ভীর গলায় বললেন,

“আমি এখানে খোশগল্প করতে আসিনি ড্যামিয়ান। তুমি আগেও যেমন ঘৃণিত ছিলে আমার চোখে, আজও আছো ভবিষ্যতেও থাকবে। অযথা তোষামোদি করতে এসো না। ওই পিশাচকে আমি আমার মেয়ের জীবন থেকে চিরতরে সরাতে চাই। আমার ভাই-বোনের মৃত্যু, পূর্বপুরুষদের অপমান, নির্যাতনের কারণ যদি ওই পিশাচই হয় তবে ওর ধ্বংস কামনা করছি আমি।”

মেয়ের প্রতি পুষে রাখা সব রাগ ভুলে গেলেন মার্কোভিক। বিড়বিড় করে বললেন,

“এই না হলে আমার রক্ত। আমার মেয়ে। ম্যাক্সওয়েলদের মেয়ে।” ম্যাক্সিম পিতার কাঁধে হাত রাখল,

“বলেছিলাম না আপনাকে রক্ত সময়মতো ঠিক জ্বলে উঠবে। দেখুন বাবা, দেখুন।”

ড্যামিয়ান কাছে এসে আন্না মেরিওর করপুটে চুম্বন করল। তারপর বলল,
“তোমার প্রার্থনা কবুল হোক আন্নে।” ম্যাক্সিম ও মার্কোভিকও সমস্বরে একই কথা বলে ওঠে।

পেটে চিনচিনে ব্যথা টের পাচ্ছে ফের ইসাবেলা। হাতের ব্যান্ডেজ খুলে কাটা জায়গাটাতে জোরে কামড়ে ধরল। চোখ খিঁচে রইল ব্যথায়। জিহ্বায় রক্তের স্বাদ না পাওয়া পর্যন্ত ওভাবে কামড়ে ধরে থাকল হাতটা। রক্ত জিহবায় পড়তে চুষে নেয়। এমন করতে বড়ো অস্বস্তি ও বমির উদ্রেক হলো। কিন্তু এমন না করেও যে উপায় নেই।
কিছুক্ষণ পরে পেটের চিনচিনে ব্যথাটা আর টের পায় না। হাঁপ ছাড়ে। পুনরায় ব্যান্ডেজ করল। হাতের ব্যথা সহনীয় কিন্তু পেটের ওই ব্যথা সহনশীলতার বাইরে। উপায়ন্তর না দেখে এই পন্থা বেছে নিয়েছে। আজ নিকোলাস এলে ঠিক বলবে সমস্যার কথাটা। ও নিশ্চয় একটা উপায় বের করবে। মুক্তি দেবে এই যন্ত্রণা থেকে। কিন্তু এই যন্ত্রণার কারণ এখনও অনুসন্ধান করে পেল না।
দেওয়াল ঘড়িতে পৌনে নয়টার ঘণ্টা বাজল। ইসাবেলা বালিশে মাথা দিয়ে সিলিং এ একদৃষ্টে চেয়ে আছে। সকাল বেলা দেখা মায়ের শীতল চোখদুটো ওর রক্ত হিম করে দেয়। তিনি কি ভোলইয়ার মৃত্যুর পেছনে ইসাবেলাকে সন্দেহ করেছেন? সত্যিটা জানলে তাঁর প্রতিক্রিয়া কী হবে ভাবতেই মন বিষাদে ভরে যায়। মা ওকে আগের চাইতে এবার আরও ঘৃণা করবেন। সকলে ঘৃণার চোখে তাকাবে। এত ঘৃণা কী করে সহ্য করবে? শত, সহস্র মাইলের দুরত্বেও এ ঘৃণার বাণ রোজ ওর বুকে বিঁধবে, রোজ পীড়িত করবে।

গতকাল নিকোলাসের সাথে চলে গেলেই ভালো হতো। কেন গেল না? কীসের মায়ায় এখনও এই মহলে পড়ে আছে? আপনজনেরা ওকে ঘৃণা করে পর করেছে কিন্তু ও তো তাদের এখনও ভালোবাসে, এখনও আপনই ভাবে। এখান থেকে একবার গেলে আর ফেরা হবে না হয়তো। এরা কি ভুলে যাবে ইসাবেলাকে? কেউ মনে রাখবে না? এই রক্তের বাঁধন ছিঁড়ে যেতে কষ্ট পায় ও। এদের ব্যবহারে কান্না পায়, চার দেওয়ালের মাঝে সংকুচিত আর বড়ো একা হয়ে পড়ে। তবুও এদের ছাড়তে গিয়ে থমকে যায়, চোখ ফেটে কান্না আসে।
চোখ মুছে ইসাবেলা উঠে বসল। কিছু জিনিস স্মৃতি হিসেবে নিয়ে যাবে। সেগুলো ব্যাগে গোছাতে লাগল। ব্যাগ গুছিয়ে এই কক্ষটা আরেকবার একনজর দেখে। ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। শেষবার বাবা- মায়ের সঙ্গে অন্তত দেখা করা উচিত। না, চলে যাওয়ার কথা বলবে না। দরজা খুলে আজ অনেকদিন পর বাইরে পা দিলো।

রাশিয়ার নিবিড় জঙ্গলের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে ড্যামিয়ানের গাড়ি। পাশে ম্যাক্সিম, পেছনে মার্কোভিক ও আন্না মেরিও। সম্পূর্ণ রাস্তায় তিনি একটা কথাও বলেননি। এই মুহূর্তে তাঁর মনে কী চলছে তিনজনের কেউ ই জানে না। যাই ভাবুক শুধু প্লানের বিপরীত না গেলেই হলো।

“আমরা আমাদের লক্ষ্য থেকে আর মাত্র কয়েক কদম দূরে। সফলতার দ্বারপ্রান্তে এসে গেছি।”

ড্যামিয়ান নেমে দাঁড়ায়। একে একে বাকিরা নামল। সবার শেষে আন্না মেরিও। আড়চোখে পেছনে তাকালেন। শ’খানেক সৈন্য নিয়ে এসেছে ড্যামিয়ান। শুধু মানুষ নয় নেকড়েও রয়েছে। কেমন যেন লাগে তাঁর। ড্যামিয়ান পিস্তল বের করে হাতে নেয়। ম্যাক্সিমও তাই করল। সাথে পিশাচবধের সামগ্রী শেষবার যাচাই করে। মার্কোভিক নিরস্ত্র দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি এর বেশিদূর যাবেন না। গাড়িতে বসে জয়ের স্লোগানের অপেক্ষা করবেন। মেয়েকে বুঝালেন আজ তিনি গর্বিত আন্না মেরিওকে মেয়ে হিসেবে পেয়ে। ম্যাক্সওয়েলরা চিরজীবন তাঁর এই কর্মের জন্য প্রশংসা করে যাবে। আন্না মেরিও কিন্তু চুপ করে রইলেন। কঠিন প্রতিমার ন্যায় স্থির তিনি। ড্যামিয়ান সৈন্যদের আদেশ করল তাঁকে অনুসরণ করতে। এগিয়ে গেল সে। পিছু পিছু ম্যাক্সিম ও আন্না মেরিও। তাদের পেছনে সৈন্যরা। জঙ্গলে পা রাখতেই আড়াল থেকে নেকড়ের চাপা গর্জন শুনতে পায়। সৈন্যদের সতর্ক হতে ইশারা করে ড্যামিয়ান। ম্যাক্সিমের হৃদয়ে প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে। রজার এখানেই কোথাও দম ছেড়েছিল।

“প্রিয় ভাইটি আমার। তোমার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেব আজ আমি। একেকটার গর্দান টেনে ছিঁড়ে ফেলব।আমার ভাইয়ের হত্যাকারীদের রক্তে গোসল করব আমি।” মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল ম্যাক্সিম। ড্যামিয়ান আন্না মেরিওর দিকে নিজের পিস্তল বাড়িয়ে দিলেন,

“এটা রাখো। তোমাকে নিরাপদ রাখতে সাহায্য করবে এটা।”

একবার পিস্তল আরেকবার ড্যামিয়ানের দিকে তাকালেন আন্না মেরিও। তারপর বললেন,

“তুমি নিরস্ত্র থাকবে?”

ড্যামিয়ানের মনে লাগল কথাটা। এখনও আন্নে ওর জন্য চিন্তা করে। একই রক্ত বইছে ওদের দেহে। এই টানেই ড্যামিয়ান এদের পর ভাবতে পারে না। রক্তসম্পর্কের এই টানে এরা এক হয়েছে আজ। আন্না মেরিও ওর মুচকি হাসি দেখে চট করে মুখ বদলে ফেললেন। ড্যামিয়ান বলল,

“চিন্তা করো না আন্নে। আমার দুটো হাত এই পিস্তল থেকেও বড়ো অস্ত্র।”

আন্না মেরিও মুখ ঘুরিয়ে নিতে ড্যামিয়ান সামনে তাকাল। কয়েক পা সামনে দিতে কোথা থেকে একটা নেকড়ে আক্রমণ করে বসল। তারপর আরেকটা, আরেকটা…. ড্যামিয়ান রুদ্রমূর্তি ধারণ করে। একাই পর পর দুটোর গলা ছিঁড়ে মাথা আলাদা করে ফেললো। যত মারছে ততই যেন সংখ্যায় বাড়ছে নেকড়ের দল। মনে মনে নিকোলাসের এই নিরাপত্তা নীতিকে গালি দিলো ড্যামিয়ান। আজ এসপার ওসপার করেই যাবে। হয় শেষ করবে না হয় শেষ হবে। দুই পক্ষে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চললো। তলোয়ারের ঝংকার, পিস্তলের বিকট শব্দে জঙ্গল কাঁপছে যেন। সমানে সমানে মরছে দুই পক্ষের সৈন্যরা। বাতাস ওদের আর্তগর্জনে ভারি হয়ে ওঠে। ড্যামিয়ান নেকড়েগুলোর গর্দান ছিঁড়ে, আছরে ফেলে রক্তাক্ত শরীরে আন্না মেরিওর কাছে এলো। ভয়ে থরথর করে কাঁপছিলেন তিনি। হাতের পিস্তলটা কখন যে পড়ে গেছে জানেনও না। ম্যাক্সিম তাঁকে নিরাপত্তা বেষ্টনীর ভেতর রেখেছে। ভয়ার্ত রক্তশূন্য মুখে চারিদিকে দেখছেন। এ কোন নরকে এসে পড়েছেন? মনে মনে ভাবলেন। ড্যামিয়ান তাঁর কাঁধে হাত রাখল।

“আন্নে, তোমাকে ভয় পেলে চলবে না। ইসাবেলার ভালোর জন্য, রজার ও ভ্যালেরির মৃত আত্মার শান্তির জন্য, ম্যাক্সওয়েলদের জন্য তোমাকে সাহসী হতে হবে। ওই যে সামনের দুর্গ দেখছো। ওখানেই শুয়ে আছে ওই পিশাচটা। আমাদের হাতে সময় কম আন্নে। শক্ত করো নিজেকে। ভয়কে ঠেলে সরিয়ে দাও। যাও আন্নে, ওই পিশাচকে শেষ করে এসো।”

আন্না মেরিওর ঠাণ্ডা রক্ত মুহূর্তে গরম হয়ে ওঠে। ভয় পুরোপুরি ঠেলে সরাতে সক্ষম না হলেও ড্যামিয়ানের কথাতে মাথা নাড়ান সামনে পেছনে। গভীর শ্বাস নিলেন। ড্যামিয়ান ম্যাক্সিমকে ইশারা করে দুর্গ পর্যন্ত নিরাপদে আন্নাকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। দুই ভাইবোনকে সামনের বাধা সরিয়ে এগিয়ে যেতে দেখছে ড্যামিয়ান। দুর্গের চূড়ায় তাকাল। সহাস্যে সদর্পে বলল,

“আফসোস আমাদের সাক্ষাৎ এই পৃথিবীতে আর হলো না বড়ো ভাই। বড়ো ইচ্ছে ছিল তোমার মুখোমুখি হওয়ার কিন্তু তুমি সেই ইচ্ছেতে পানি ঢেলে দিয়েছ। যদি সেদিন ঈর্ষা না করতে, মাকে হত্যা না করতে তবে আজ আমাদের সম্পর্ক ভিন্ন রকম হতো। আমরা নিশ্চিত বন্ধু হতাম। ওপরে গিয়ে তোমার ম্যাক্স বাবাকে আমার কথা জানিয়ো। আমি জানি এখন তুমি সব জেনে গেছ। পিতাকে বলো আমি তাঁকে ভালোবাসি। আর আমার মা_” চোয়াল কঠিন হয় ড্যামিয়ানের। একটা নেকড়ে এলো আক্রমণ করতে। ড্যামিয়ান খানিক সরে যায়। নেকড়ে আক্রমণে ব্যর্থ হয়ে ঘোৎ ঘোৎ করে। হিংস্র চাহনিতে চেয়ে আছে। ড্যামিয়ান ফের তাকায় দুর্গের দিকে। ক্রুর কুটিল হেসে বলে,

“তোমার বেলাকে আমি বড়ো আদরে আহ্লাদে রাখব বড়ো ভাই। এতটা ভালোবাসা দেবো যে ও তোমায় ভুলে যাবে, চিরতরে ভুলে যাবে। বড়ো ভাইয়ের কাছে ছোটো ভাই ওয়াদা করছে। আলবিদা বড়ো ভাই, আলবিদা।”

নেকড়েটা দাঁত খিচিয়ে ওর দিকে আক্রমণ করতে এলে ড্যামিয়ান ছুটে গেল সেদিকে। মুহূর্তে একজন মানব যুবক পরিবর্তন হয় বাদামি লোমশওয়ালা এক নেকড়েতে। কামড়ে ছিঁড়ে ফেলে অপর নেকড়েটির গলা। তারপর আকাশের দিকে মুখ তুলে গর্জন করল।

পুরো দুর্গে ভুতুড়ে নিস্তব্ধতা। বাইরের নেকড়ে ও মানুষের গর্জন দরজার মুখে এসে মিলিয়ে যাচ্ছে। আন্না মেরিও ত্রস্ত পায়ে ভেতরে পা রাখলেন। ধুলোমলিন শ্রী ছাড়া দুর্গটির ভেতরের অংশ। কালের চাকায় পিষ্ট হয়ে একসময়ের জমকালো, ঐশ্বর্যময় সৌন্দর্যের দুর্গটির জীর্ণ দীন অবস্থা। আগাছা, মাকড়সার জালে জড়িয়ে আছে হলঘর। ধুলোর ওপর পায়ের ছাপ ফেলে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। ম্যাক্সিম থামাল। ম্যাপ মুখস্থ করে এসেছে সে। সিঁড়ির নিচে গোপন কক্ষে রয়েছে নিকোলাসের কফিন। কক্ষের মুখ খুঁজতে লাগল। ভালো করে খুঁজতে পেয়ে গেল মুখ। পাথরের পাটাতনে মুখটি বন্ধ করা। ম্যাক্সিমের একার পক্ষে সম্ভব নয় এটা উঠানো। আন্না মেরিওকে দাঁড় করিয়ে সে সাহায্যের জন্য গেল। সতর্ক করে পিস্তল এবং পিশাচবধের সামগ্রী রেখে গেল সেখানে। ম্যাক্সিম যেতে আন্না মেরিও পাটাতন সরাতে চেষ্টা করে। পারলেন না। অনেক্ক্ষণ কেটে যাওয়ার পরও ম্যাক্সিম এলো না। আন্না মেরিও সবকিছু তুলে নিয়ে অন্য দিকে পথ খুঁজলেন। দুর্গের এদিক ওদিক ঘুরেও পথ পেলেন না। বাদুরের বিষ্ঠা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সর্বত্র। উৎকট গন্ধে তাঁর পেট মুচরে ওঠে। কয়েকটা বাদুর ঝিম ধরে ঝুলছিল এখানে সেখানে। নিঃশব্দে তিনি ফের সিঁড়ির নিচে ফিরে এলেন। আশ্চর্য পাটাতন সরিয়েছে কেউ! আশপাশে ম্যাক্সিমকে খুঁজে পেলেন না। দরজার মুখে একটা নেকড়ে দাঁড়িয়ে। তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। ভয় পেয়ে গেলেন। কাঁপা হাতে পিস্তল উঠাতে বাদামি পশমওয়ালা নেকড়টা চোখের নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেল। নেকড়েটা বোধহয় তাঁকে সাহায্য করতে এসেছিল। কিন্তু কী যেন চেনা ওর মধ্যে।

“পাটাতন কে সরালো? তুমি?” ম্যাক্সিমের বিস্মিত গলা। আন্না মেরিও মাথা নাড়ালেন,

“না, একটা নেকড়ে। বাদামি পশমওয়ালা। তুমি চেনো ওটাকে? ড্যামিয়ানের পোষা কি? ওর চোখজোড়া কেমন যেন চেনা চেনা জানো!”

ম্যাক্সিম গলা ঝাড়লেন। দৃষ্টি লুকালেন। প্রসঙ্গ পালটে বললেন,

“আর দেরি করো না আন্নে। নেমে যাও নিচে। একটু পর পিশাচটা জেগে উঠলে আমরা সকলে মারা পড়ব। জলদি করো।”

সিঁড়ি বেয়ে অন্ধকার কবরে নামল দুজন। ম্যাক্সিম আলো জ্বালিয়েছে। নিচটা অস্বাভাবিক রকমের শীতল। গুমোট বাতাসে সোঁদা মাটির গন্ধে দম বন্ধ হয়ে এলো যেন আন্না মেরিওর। এদিক ওদিক তাকালেন সতর্কে। এক পা সামনে দিতে হঠাৎ ম্যাক্সিম বাহু চেপে ধরে। বা’দিকে আঙুল তুলে বলল,

“ওই যে পিশাচটার কফিন।”

আন্না মেরিও বাতির আলোয় একটু দূরে আবছা অন্ধকারের মাঝে মেরুণ রঙের কাঠের কফিনটা দেখতে পেলেন। ম্যাক্সিম তাঁর আগে এগিয়ে গেল। ঠেলে সরালো কফিনের মুখ। প্রতিশোধের নেশায় তার মগজ টগবগ করে ফুটছে। ইচ্ছে হচ্ছে এক্ষুণি পিশাচটার গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। আন্না মেরিও এসে দাঁড়ালেন কফিনের সামনে। তাকালের কফিনে শায়িত সুদর্শন পুরুষটার দিকে। এই রূপের জালে তাঁর সরলা মেয়েকে বশ করেছে, সতিত্ব কেড়েছে। এই পিশাচের জন্য মায়ের দেওয়া শিক্ষা, আপন ধর্ম সব বিসর্জন দিয়েছে তাঁর বেলা। পরিবারকে ত্যাগ করতেও রাজি আজ ও। নিকোলাস মিথ্যা ভালোবাসার লোভ দেখিয়ে টেনে নিতে চাইছে অন্ধকার নরকে। মা হয়ে তা তিনি কী করে হতে দেবেন! সন্তানের মঙ্গলের জন্য মায়েরা সৃষ্টিকর্তার সাথে লড়ে যায় আর এ তো সামান্য এক পিশাচ। আন্না মেরিওর মনে হলো জীবনে তিনি কাওকে এতটা ঘৃণা করেননি এই পিশাচ যুবককে যতটা করেন।

“তাকিয়ে তাকিয়ে কী দেখছো? শেষ করে ফেলো ওকে? তাড়াতাড়ি করো।”

আন্না মেরিও ক্রুশটা হাতে নিলেন। ওপরে তুলতে চোখ মেলে তাকায় নিকোলাস। শ্বদন্ত বেরিয়ে এলো। চোখ রক্তজবার ন্যায়। হাত থেকে ছুরি খসে পড়ে গেল। পিছিয়ে গেলেন আন্না মেরিও। বুক কাঁপছে ভয়ে।

“ও তোমার ক্ষতি করার অবস্থায় নেই এখন। ভয় পেয়ো না আন্নে। এগিয়ে এসো। ক্রুশটা তুলে নাও। আর মাত্র কয়েক মিনিট বাকি। জলদি করো আন্নে। ওর জেগে ওঠার সময় হয়ে গেল।”

ম্যাক্সিমের তাড়ায় আন্না মেরিও ফের ক্রুশটা তুললেন। এগিয়ে গেলেন কফিনের দিকে। নিকোলাসের মুখে তাকালেন না। সোজা ওর বুকের বা’পাশে ঢুকিয়ে দিলেন। ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল নিকোলাস দেহ। ম্যাক্সিম রসুন গুঁজে দেয় ঠোঁটের ফাঁকে। আন্না মেরিও ছুরি তুলে নিলেন। তাকাবেন না তাকাবেন না করেও নিকোলাসের মুখের দিকে তাকালেন। সেই রক্তচক্ষু, শ্বাদন্ত কিছুই নেই। অসহায় এক মুখ দেখছেন আন্না মেরিও। দৃষ্টিতে আকুতি। বাঁচার? তাঁর মাতৃহৃদয় নরম হয়।

বাঁচার আকুতি কোনোদিন দেখায়নি নিকোলাস। শেষ হয়ে যাওয়ার ভয় ছিল না আগে। শূন্যতায় বাঁচা আর মরা কী! কিন্তু এখন তো শূন্য নয়। ইসাবেলা ওর আছে। এরা আজ সেটাও কেঁড়ে নিতে মরিয়া। এত আকাঙ্ক্ষায় পাওয়া ভালোবাসা কেন এদের চক্ষুশূল? নিকোলাস তো কিছু চায় না। শুধু ইসাবেলার সাথে থাকতে চায়। প্রয়োজনে ও নোভার মতো হয়ে যাবে। মানুষের রক্ত পান ত্যাগ করবে, মানুষের মতো সামাজিক হবে। যাকে কোনোদিন মানবে না বলেছিল তাঁকেও মানবে। নত হবে ওই সৃষ্টিকর্তার সামনে। তবুও এরা ওকে না মারুক। আন্না মেরিওর দয়া হোক একটু। দুপুর হতে আর কত দেরি! নিকোলাসের এই অসহায়ত্ব দূর হোক, হাতে পায়ে প্রাণ আসুক। আন্না মেরিও এত বড়ো অবিচার করতে পারেন না মেয়ের ওপর। ইসাবেলা ওর পথ চেয়ে থাকবে। নিকোলাস কী করবে এখন! সৃষ্টিকর্তা ক্ষমা করুক, দয়া করুক ওর ওপর। বাকি জীবন একনিষ্ঠমনে তাঁর গোলামি করে যাবে নিকোলাস। শুধু ইসাবেলার থেকে দূর না করুক, দূর না করুক।

এই যুবক তাঁর বেলার ভালোবাসা। যেই ভালোবাসার টানে সব ছাড়তে রাজি ও৷ এ কী নিছক মোহ বা ছল? আন্না মেরিওর হাত কাঁপল। ছুরিটা তিনি শক্ত করে ধরতে পারছেন না। নিকোলাস মরলে ইসাবেলা আগের মতো হবে তো? পিটারকে ভুলতে পারলে একেও নিশ্চয় ভুলতে পারবে, পারবে না? এ যে ওর জন্য ঠিক নয়।

“আন্নে সময় বয়ে যাচ্ছে তাড়াতাড়ি করো। ও তোমাকে ছলনায় ফেলতে চাইছে। ভুলো না ওতে।

ভাইয়ের কথা উপেক্ষা করে আন্না মেরিও বিড়বিড় করে বললেন,
“তুই আমার নিষ্পাপ মেয়ের গায়ে পাপ লাগিয়েছিস। আমাদের মাঝে এনেছিস দুরত্ব । ম্যাক্সওয়েলদের যখনই সামনে পেয়েছিস নির্মমভাবে হত্যা করেছিস। আমার ভ্যালেরিয়া, ভাই রজার কাওকে ছাড়িসনি। আজ কি দেখেছি জানিস? আমার বেলা, তাশার প্রিয় বিড়ালটিকে হত্যা করেছে। কী করে ছেড়েছিস আমার মেয়েটিকে! তোর ধ্বংস আমার মেয়ের জীবনে কল্যাণ বয়ে আনবে। শান্তি ফিরে পাবে। এক মা তাঁর মেয়ের মঙ্গলের জন্য সব করতে পারে। সেটা তোর মতো পিশাচবধই হোক না কেন!”

আন্না মেরিও ক্রোধে কাঁপছেন। নিকোলাসের কপাল কিঞ্চিৎ কুঁচকে যায়। ইসাবেলা বিড়াল হত্যা করেছে? কেন? ও কি কিছু গোপন করেছে! ওর কিছু না হোক। ধ্বংসের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়েও ইসাবেলার জন্য দুশ্চিন্তা করল। হতাশায় ডুবে যায়। পরাজিত এক প্রেমিক, যে নিজেকেই বাঁচাতে ব্যর্থ সে নিজের ভালোবাসা কী করে বাঁচাবে! ওর শেষ হয়ে যাওয়াতে যদি ইসাবেলার কল্যাণ হয়, জীবনে শান্তি আসে তবে তাই হোক। চোখ বুজল নিকোলাস। আন্না মেরিও শক্ত করে ছুরিটা ধরলেন।

ইসাবেলা পিতা-মাতার কক্ষের দরজায় নক করে। কয়েকবার নক করতেও ভেতরে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না৷ দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। ওলেগ আধশোয়া হয়ে আছেন বিছানার কোণায়। একটা হাত তার মুখের ওপরে। বাবাকে ভীষণ মিস করবে ইসাবেলা। চোখ ভিজে এলো। ধীর পায়ে পিতার মাথার কাছে দাঁড়ায়।

“বাবা।”

ওলেগ চুপ রইলেন। একচুল নড়লেন না। ইসাবেলার গলা ধরে এলো,

“বাবা।”

ওলেগ আস্তে আস্তে মুখের ওপর থেকে হাত সরালেন। কিন্তু চোখ মেললেন না। ইসাবেলা ঠোঁট চেপে কান্না গিলে বলল,

“আমার সাথে তুমিও কথা বলবে না বাবা? এত খারাপ হয়ে গেলাম আমি? এত পর?”

“পর?” চোখ মেললেন ওলেগ। কঠোর চাহনি তাঁর। এমনভাবে বাবাকে আগে দেখেনি ইসাবেলা। ওলেগ তিরস্কারের সুরে বললেন,

“আমরা পর করেছি? আমি তোমার হাত ধরে এত অনুনয় করলাম, এত বুঝালাম তারপরেও আমাদের ছেড়ে ওই পিশাচটার সাথে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছ। এখানে কেন এসেছ বিদায় নিতে? যাও বিদায় দিলাম। দূর হও আমার সামনে থেকে। স্বার্থপর, অকৃতজ্ঞ মেয়ে। তোমার মা ঠিকই বলেছিল। তোমাকে গর্ব ভেবে ভুল করেছি আমরা। আসলে তুমি আমাদের লজ্জা। যে সন্তান পিতা-মাতার মান সম্মান ডুবিয়ে লোকচক্ষুর আড়ালে এক পাপী, অভিশপ্ত শয়তানের হাত ধরে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করে সে লজ্জা ছাড়া কী?”

ইসাবেলা ঠোঁট সজোরে কামড়ে ধরে আছে। কান্না শব্দ রোধ করতে পারলেও চোখের পানি অপ্রতিরোধ্য। নিজেকে সামলে অশ্রুরুদ্ধ গলায় বলল,

“আমি স্বার্থপর, অকৃতজ্ঞ তাই না বাবা? তোমরা তো পিতা-মাতা৷ গুরুজন, সন্তানের শিক্ষক। তবে তোমরা কেন উদার হতে পারলে না? আমি তো স্বীকার করেছি ভুল হয়েছে আমার। অন্যায় করেছি তোমাদের না জানিয়ে বিয়েটা করে। জানিয়ে করলে বিয়েটা হতে দিতে বলো? কোনোদিন না। আমি যে ওকে খুব ভালোবাসি বাবা। ও আমার জীবনের পরম ও শ্রেষ্ঠ পাওয়া। একবার যদি শান্তিতে কথা বলতে তবে বুঝতে তোমার মেয়ের জন্য ওর চেয়ে উপযুক্ত পাত্র পৃথিবীতে আর নেই।”

“তাই বলে একটা পিশাচ!”

“বার বার কেন এই এক শব্দে থামছ তোমরা? অন্যের কথায় কেন বিচার করেছে ওকে। একবার নিজে থেকে বুঝতে চাওনি, চেষ্টাও করোনি। কেন? ও পিশাচ বলে। পিশাচ বলে কি ওর ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার থাকবে না?” ওলেগ জবাব দিলেন না। ইসাবেলা চোখ মুছলো।

“আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো বাবা। তোমরা যদি একটু উদার হতে তবে আজ আমাকে এখানে দাঁড়িয়ে বলতে হতো না, চলে যাচ্ছি আমি। বাধ্য করেছো তোমাদের ছাড়তে আমাকে। ভালো থেকো বাবা।”

ইসাবেলা দরজার দিকে পা বাড়াতে ওলেগ উঠে বসেন।

“তুমি কোথাও যাচ্ছো না, শুনেছ? জেনেশুনে তোমাকে এতবড়ো ভুল করতে দিতে পারি না আমরা।”

“আমি যাব বাবা, অবশ্যই যাব। আমি অ্যাডাল্ট হয়েছি। জোর করে নিজেদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারবে না। এই মহলে বন্দি করে রাখতে পারবে না তোমরা আমাকে।”

ওলেগ কাষ্ঠ হাসলেন।

“কার সাথে যাবে শুনি? ওই পিশাচ তো আসবে না। তোমার পর্যন্ত পৌঁছানোর ওর সকল পথ বন্ধ করতে গিয়েছে আন্নে।”

ইসাবেলা চমকে তাকায়। আর্ত হয়ে ওঠে ওর মুখ,

“ভয় দেখানোর জন্য মিথ্যা বলছ, না বাবা?”

ওলেগ কঠিন মুখে বসে আছেন। ইসাবেলার বুক দুরুদুরু করছে। এদিক ওদিকে তাকায়।

“মা কোথায়, বাবা? মা, মা। বাবা প্লিজ বলো?”

মেয়ের কাতর প্রশ্নের জবাবে ওলেগের গলা দিয়ে কিছুই বের হয় না। তিনি মনকে একটাই কথায় বার বার বুঝ দিচ্ছেন, যা করছেন তাতেই ইসাবেলার মঙ্গল। ইসাবেলা শঙ্কিত হয়ে উঠল। এই কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে এলো। মা মা বলে চিৎকার করতে করতে হলঘরে নামল। ওলেগ চোখ বন্ধ করলেন। মেয়েদুটো তাঁর বড়ো আদরের। ওদের সকল দুঃখ কষ্ট দ্বিগুণ হয়ে লেগেছে তাঁর বুকে। আজ কি না নিজে ছোটো মেয়েকে দুঃখ দিলেন! কিন্তু এতেই যে মেয়েটার কল্যাণ নিহিত।

হলঘরে বসে থাকা সকলে ইসাবেলার চিৎকারে এগিয়ে এলো। পাগলের মতো মা মা করে ডাকছে। কেউ জানে না আন্না মেরিও কোথায়। মা’কে কোথাও না পেয়ে ওর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। বার বার বাবার কথা স্মরণ হয়। মা ওর এতবড়ো সর্বনাশ করবে? নিকোলাসকে হারানোর ভয়ে আতঙ্কিত, ভীত৷ হঠাৎই পেটের বুঁজে থাকা ব্যথা রগে রগে চিলিক দিয়ে ওঠে। দুহাত চেপে ধরে বসে পড়ে ফ্লোরে। ভ্লাদিমি, মাতভেই ও তাতিয়ানা ছুটে এলো। আর্তচিৎকার করে ওঠে ব্যথায় ইসাবেলা।

“ইসাবেল, কী হলো তোমার?” তাতিয়ানা উদ্বিগ্ন হলো। বোনকে জড়িয়ে ধরেছে। ইসাবেলা ওদের প্রশ্ন উপেক্ষা করে কোনোরকমে হাতের ব্যান্ডেজ খুললো। রক্ত চুষতে থাকে। ভয়ে ছিটকে সরে যায় তাতিয়ানা। বাকিরা বিস্ময়াহত। পিছিয়ে যায় ওরা। কিন্তু মাতভেই তেমনই দাঁড়িয়ে আছে। ও যে এসবের সাথে খুব ভালোভাবে পরিচিত। ধীর পায়ে এগিয়ে এলো। বসল এক হাঁটু ভেঙে ইসাবেলার সামনে৷

“বেল?”

সিক্ত রক্তাক্ত মুখে তাকালো ইসাবেলা।

“মাতভেই আমার নিকোলাস_” ঠোঁট কাঁপছে ইসাবেলার। ভুরু কুঁচকে তাকায় মাতভেই। নিকোলাস! আবার সেই নাম। মাতভেই কিছু বলবে তখনই সদর দরজা খুলে গেল। আন্না মেরিও নির্বিকার মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। ইসাবেলা আস্তে আস্তে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। মা মেয়ের দৃষ্টি এক হয়। পেটের ব্যথা ক্ষীণ হয়ে আসছে কিন্তু বুকের ব্যথা বড্ড বেশি ইসাবেলার। কী শান্ত ওর মায়ের মুখ! সারা দেহ যেন অবশ হয়ে এলো ইসাবেলার। গলা চিরে বেরোলো,

“তুমি ওকে শেষ করে এলে, মা?”

চলবে,,,

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৯৭
Writer তানিয়া শেখ

হলঘরে কঠিন নীরবতা। “তুমি ওকে শেষ করে এলে মা?” এই বাক্যটির শব্দগুলো রহস্য আর উত্তেজনা ধারণ করে হলঘরের বায়ুতে মিশে গেল। এই “ওকে” টা কে তা যেন বুঝতে সময় লাগল বাকিদের। যখন বুঝল একটা হালচাল উঠল। ঠিক হঠাৎ ওঠা বাতাসের ধাক্কায় নদীর জলের বিস্মিত ঢেউ। একবার তরঙ্গ তুলে ফের শান্ত। উপস্থিত মানুষগুলোর কৌতূহলি, জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মা মেয়ের দিকে। কারও কারও চোখে আনন্দ খেলে গেল। পিতৃহত্যাকারীর ধ্বংসই যে কাম্য ছিল। এখন ওর স্ত্রীরও শাস্তি হোক। বিধবা হওয়াই কি যাবজ্জীবন শাস্তি না? রজারের স্ত্রী ও সন্তানেরা ঘৃণিত চোখে চেয়ে রইল ইসাবেলার দিকে। ইসাবেলার এখন আর কিছুই অনুভূত হলো না। নিজের অস্ত্বিত্ব কি কিছু টের পাচ্ছে? নিকোলাস নেই কথাটা ও যেন ভাবতে পারে না। আরও ভাবতে পারছে না সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ওর মা কাওকে একেবারে মেরে ফেলতে পারেন। এটা ঠিক বিভিন্ন কারণে তিনি কঠোর হয়েছেন। তবে পাষাণ ঠিক বলা যায় না। মায়েদের সাথে পাষাণ কথাটা বড্ড বেমানান। কিন্তু আজ মায়ের শীতল চোখে চেয়ে কেন মনে হচ্ছে তিনি মানুষ নন, মা নন, একজন পাষাণ মূর্তি। এই মূর্তি সব পারে, সব সম্ভব তাঁর দ্বারা। এমনকি… ইসাবেলার শ্বাসে টান ওঠে। বুকের বা’পাশ মথিত হয়। জিহবা শুকিয়ে এলো। কথা বলতে পারছে না। মনে হলো আর কখনো বলতে পারবে না। এতদিন ছিচকাঁদুনির মতো দিনরাত শুধু কেঁদেছে। কিন্তু আশ্চর্য এখন ওর চোখে খরা। বোবার মতো একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে। চোখে সহ্য হয় না,তবুও চোখ সরায় না।

“তুমি ঠিক আছো আন্নে?”

চকিতে তাকাল ইসাবেলা। দু’চোখে আগুন ঠিকরে বেরোলো যেন মায়ের পাশে দাঁড়ানো ড্যামিয়ানকে দেখে। তারপর একই উত্তাপ আর উষ্মার সাথে করে ফের মাকে দেখল। আন্না মেরিও জোর করে মুখ তুলে আছেন। মেয়ের চোখের তাপ, নীরব অভিযোগ তাঁর ক্লান্তি বাড়িয়ে দেয়। ঘাড়টা ক্লান্তিতে বসে আসতে চাচ্ছে। ধকলও তো কম যায়নি। খুন কি সহজ কাজ! খুন! পিশাচকে মারা কি খুন বলে?

আন্না মেরিও ড্যামিয়ানের কথার জবাব দিলেন না। বোবাকালার ন্যায় চুপ করে রইলেন। অবসন্নতায় হাঁটু ভেঙে আসতে চায়। কয়েক ধাপ সিঁড়ি পার হলেই তাঁর শোয়ার ঘর। বিছানায় গা এলিয়ে দিতে পারলে বাঁচতেন। ড্যামিয়ান আন্না মেরিওর মুখ দেখে একটু ভাবুক হলো। তারপর তাতিয়ানাকে বলল,

“অ্যানা, আন্নেকে কক্ষে নিয়ে যাও।”

তাতিয়ানা নড়ল না। অবাধ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ড্যামিয়ানের দিকে। সাহস কতবড়ো তাতিয়ানাকে হুকুম করে! হাঁপ ছাড়ে ড্যামিয়ান। নেহাৎ মনটা প্রসন্ন বলে কথা বাড়ালো না। একটুও বদলায়নি এই মেয়ে। এই ধরনের মেয়েকে শায়েস্তা করতেই ভালো লাগে। তবে তাতিয়ানার প্রতি ওর তেমন আকর্ষণ নেই।
ম্যাক্সিম পেছন থেকে স্ত্রীকে হুকুম করলেন আন্নেকে কক্ষে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ম্যাক্সিমের স্ত্রী এগিয়ে এলো। মার্কোভিক বসলেন সোফায়। এ বাড়ির প্রধান ভৃত্যা তিখন হাতে এক গ্লাস পানি নিয়ে তাঁর পাশে দাঁড়ালেন। অবসাদ মুখে মুচকি হাসলেন মার্কোভিক। হাত বাড়িয়ে নিলেন গ্লাসটা। তারপর হলঘরের বসা নাতনির নির্মোহ মুখে কটাক্ষে চাইলেন।
ড্যামিয়ানের মনে তখন পৈশাচিক আনন্দ। ইসাবেলার এই শোকাভিভূত নির্বাক চেহারা ওকে সেই অতীত আনন্দ স্মরণ করিয়ে দেয়। আর তো কয়েক মুহূর্ত তারপর ইসাবেলা পুরোপুরি ওর সম্পত্তি। একটাই ক্ষোভ নিকোলাসের স্পর্শ লেগেছে ওর গায়ে। কিছু পেতে গেলে কিছু খোয়াতে হয়। ড্যামিয়ান খুব চেষ্টা করেছে এই কথাটা মানতে, কিন্তু জোর করে সব মানিয়ে নেওয়া যায় না। ইসাবেলাকে এজন্য আরও শাস্তি দেবে। ওর উচিত ছিল নিজেকে সম্পূর্ণ ওই পিশাচকে সঁপে না নেওয়া। ভালো তো পিটারকেও বেসেছিল।কিন্তু ওকে তো সব সঁপেনি। তাহলে নিকোলাসকে কেন? চোয়াল ফুলে ওঠে এসব ভাবতে ভাবতে। ইসাবেলা যত বড়ো হয়েছে ততই ওর প্রতি অধিকারবোধ বেড়েছে। সেটা ওর মন ও শরীর দুটোর ওপরই। আকর্ষণই কি কম? ওকে নিয়ে উষ্ণ সেসব মুহূর্ত কল্পনা করলে শরীর গরম হয়, অস্থিরতা সর্বাঙ্গে নাড়া দেয়। বিড়বিড় করে বলে,”আর তো মাত্র কয়েকটা দিন, আর তো মাত্র কয়েকটা দিন।”

“চলো বসবে।”
ম্যাক্সিম সোফার দিকে এগিয়ে গেল। ইসাবেলাকে নিয়ে এদের আর ভাবনা নেই। দুদিন পর ওই পিশাচের ভূত আপনাতেই নেমে যাবে।

ড্যামিয়ানও যেতে উদ্যত হয়। কয়েক কদম গিয়ে থেমে যায়। খেয়াল হলো এইমাত্র কিছু ও দেখেছে। চকিতে ফেরে। ইসাবেলার ঠোঁটের কোণে তখনও খানিক রক্ত লেগে ছিল। আনমনেই ঠোঁট ভেতরে ঠেলে চুষে নিলো ও। ড্যামিয়ানের উজ্জ্বল চোখদুটোতে মুহূর্তে আঁধার ঘনিয়ে এলো। কোথাও দেখার ভুল হয়েছে। সুতরাং আরও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। ঢিলেঢালা মেক্সি ড্রেস পুরোপুরি ওর বাড়ন্ত পেট লুকাতে পারেনি।

আন্না মেরিওকে ধরতে শিউরে ওঠেন ম্যাক্সিমের স্ত্রী অ্যানাতোলা। প্রচন্ড ঠাণ্ডা তাঁর হাত।

“তোমার কি অসুস্থবোধ হচ্ছে?” সিঁড়ির দিকে যেতে যেতে চাপা গলায় বললেন আন্না মেরিওকে। আন্না মেরিও দুর্বলভাবে মাথা নাড়ালেন ওপর নিচে৷

“ডাক্তার ডাকতে বলব?”

আন্না মেরিও ক্ষীণ গলায় বললেন,

“না।”

দুজনে সিঁড়ির কাছাকাছি। আন্না মেরিও সবে এক পা ফেলবেন প্রথম সিঁড়িতে, কিন্তু থমকে গেলেন।

“জবাব না দিয়েই চলে যাচ্ছ? কেন জবাব নেই? দিতে লজ্জাবোধ হচ্ছে বুঝি?” পেছনে মেয়ের তীক্ষ্ণ কণ্ঠ শুনতে পেলেন। কিন্তু প্রত্যুত্তরে কিছুই বললেন না। না ফিরলেন।

হাতটা কোমরের একপাশে রেখে উঠে দাঁড়ায় ইসাবেলা। ছাড়িয়ে নেয় মাতভেইর হাত থেকে নিজেকে। বিদ্রুপের হাসির শব্দ তোলে। তীব্র চাহনি।

“এত সাহস দেখিয়ে, বংশ গৌরবের অহংকারে মাথা উঁচু করে নিকোলাসকে শেষ করতে গেলে আর এখন বলতে সংকোচ হচ্ছে? কেন? তুমি তো মহান কাজ করে এসেছ। ওই দেখো তোমার পিতা ও ভাই কেমন সগর্বে, সদর্পে বসে আছেন। ভবিষ্যৎ ম্যাক্সওয়েলরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ রাখবে তোমাকে তাঁদের বংশ বাঁচিয়েছ কি না।”

“চুপ করো, বেলা।” মায়ের সে নিষেধ যেন শুনতেই পেল না ও। আরও কাছে এসে দাঁড়ায়। থমথমে মুখ।

“বংশ! তুমিও শেষপর্যন্ত ওই মানুষগুলোর মতো নীচ হলে যারা মনুষ্যত্বের চেয়ে বংশমর্যাদাকে প্রাধান্য দেয়! ছি! তোমার মেয়ে ভাবতে আমার না ভীষণ ছোটো লাগছে। যাকে আদর্শ মেনে এতবড়ো হলাম এখন দেখি পুরোটাই সে অশুদ্ধ, অন্তঃসারশূন্য। নিজের আদর্শ বলে এতকাল যা চালিয়েছে সবটা ভং। ভেতরে ভেতরে তুমি তোমার পিতার মতো বংশগরিমায় অন্ধ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, আত্মকেন্দ্রিক, নিষ্ঠুর, পা..”

“থামো, থামো।” আন্না মেরিওর চিৎকারে মহল কেঁপে ওঠে। রাগত চোখে তাকান মেয়ের দিকে। ইসাবেলা হাসে। মোটেও স্বাভাবিক নয় সে হাসি।

“পিশাচ মেরে এসেছ, মানুষ তো না! তাহলে বলছ না কেন? কীসের বাধা বলতে? ওকে মারতে যখন বাধেনি বলতে বাধছে কেন আন্না মেরিও?”

সাথে সাথে ইসাবেলার গালে বিকট শব্দে চড় পড়ে। নিচে পড়তে পড়তেও টাল সামলায়। গালের একপাশ অসাড়। মা যে ব্যথা আগে দিয়েছে তার কাছে এ ব্যথা কিছুই না।

“সেই তখন থেকে একই বুলি আউড়ে যাচ্ছ! বেয়াদব মেয়ে। এতগুলো মানুষের সামনে মা’কে অপমান, অপদস্ত করে প্রতিশোধ নিচ্ছো? তোমার ওই পিশাচ প্রেমিককে শেষ করেছি বলে? বলো, বলো। তবে শোনো বলছি। হ্যাঁ শেষ করেছি ওকে আমি। কীভাবে করেছি শুনবে? ওর হৃদয়ে ক্রুশবিদ্ধকরে, গলায় ছুরি চালিয়ে আগুনে ভস্মীভূত করে দিয়েছি। ও আর নেই, বেলা। ছাই হয়ে মিশে গেছে শূন্যে। এতক্ষণে হয়তো নরক দুয়ারে পৌঁছে গেছে।”

লম্বা শ্বাস নিলেন আন্না মেরিও। এখনও নিকোলাসের ছাইয়ে পরিনত হওয়ার দৃশ্য যেন প্রত্যক্ষভাবে দেখতে পান। স্বস্তি কেন দেয় না এই স্মৃতি। কেন নিকোলাসের কাতর, পরাজিত মুখ তাঁকে টিটকারি করে। ভুল করলেন কি?
ইসাবেলার মুখে রা নেই। নিকোলাস নেই! এবার যে জীবন্ত হলো কথাটা। ওর বুকের ভেতর দুমড়ে মুচড়ে গেল। শরীরের শক্তি বুঝি নিঃশেষ হয়ে আসে। সামনেটা সব ঝাপসা।ইসাবেলা কামড়ে ধরে আছে ঠোঁট। রক্তের স্বাদ পাচ্ছে। কাঁদবে না, কাঁদবে না।

“মাত্র কয়েকদিনের পরিচয়ে ওই পিশাচ তোমার সব হলো, হ্যাঁ? আর আমরা, আমি? বংশমর্যাদায় অন্ধ, আরও কী কী বলছিলে.. তোমার যা ইচ্ছে হয় বলো। তুমি তো আর মা নও তাই আমার ভয়, আমার জ্বালা বুঝতে পারবে না। সে আশাও করি না। কিন্তু মানুষের সামনে এমন করে অপদস্ত করো না। আমি যা করেছি তোমার ভালোর জন্যই করেছি।” বললেন আন্না মেরিও। ইসাবেলা ভগ্ন গলায় বলল,

“ভালো! কত ভালোই না করলে তুমি আমার! তাকাও আমার দিকে, দেখো ভালো করে। সত্যি করে বলো তো ভালো করেছ কি না। জানি তো এখন আর সত্যি বলার সাহস তোমার নেই। কিন্তু আমি বলব। যতই চড়, কিল মারো সত্যি আমি বলবোই। নিকোলাস শুধু আমার প্রেমিক নয় স্বামী। এই কথা জানার পরও তুমি ওকে হত্যা করলে। ও যদি তোমার ভাইয়ের মৃত্যুর, ভাবির বৈধব্যের কারণ হয় তবে তুমিও আমার স্বামীর হত্যাকারী, আমার বৈধব্যদশার কারণ।”

“বেলা!”

“ডাকবে না ওই নামে আর। ওই নামে যে নিকোলাসও আমায় ডাকত। তোমার মুখে ওই নাম আমি আর শুনতে চাই না। ডেকো না।”

বলতে বলতে মায়ের পাশ কেটে সিঁড়ির রেলিং ধরে টলতে টলতে নিজের কক্ষের দিকে চলে গেল। এদের মাঝে দমবন্ধ হয়ে আসছে ইসাবেলার। এমনিতেও কী দম নিতে পারছে সহজে! কান্নার বাঁধ ভাঙছে ভেতরে। তবুও কাঁদবে না। এদের সামনে অন্তত না।
আন্না মেরিওর মাতৃহৃদয় মেয়ের শোকাভিভূত দশা দেখে কাতর হয়। অপরাধবোধটাকে এটা ওটা বুঝিয়েও চাপা দিতে পারলেন না সম্পূর্ণ। খানিক আলগা সে হলোই। কিন্তু তাঁর গম্ভীর ব্যক্তিত্ব অবিচল। ক্ষীণ দ্বিধাবোধ জাগলেও ভুল করেছেন একথা মানতে নারাজ। মেয়ে দৃষ্টি সীমার বাইরে যাওয়ার পরও একইভাবে স্থির রইলেন। তারপর সিঁড়ি মাড়িয়ে কীভাবে যে নিজ কক্ষে পৌছালেন বলতে পারেন না। ওলেগ বিছানার এককোণে গোঁজ হয়ে বসেছিলেন। আন্না মেরিও মনে মনে প্রার্থনা করলেন স্বামী যেন কোনো প্রশ্ন না করে। আজ আর কোনো প্রশ্নের জবাব দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। ওলেগ চুপ করেই রইলেন। এখানে বসেই সব শুনেছেন। দোষ যদি কিছু করে আন্না মেরিও তাতে তাঁর অংশীদারত্ব সমান। উৎসাহ তো তিনিও দিয়েছেন। মেয়ের ব্যথাতুর মুখ ভেবে চোখ টলমল করতে লাগল। আন্না মেরিও ওপাশে ঘুরে শুয়ে আছেন বলে দেখতে পেলেন না। আস্তে আস্তে তাঁর চোখও সজল হলো। মেয়ের প্রতিবাদ, দোষারোপ, আগুনচক্ষু তাঁকে অশান্তি দিলো। জীবনে এমন অশান্তি তিনি কোনোদিন অনুভব করেননি, কোনোদিন না।

বিছানা মড়ার মতো শুয়ে আছে ইসাবেলা। ঠোঁট কেঁপে কেঁপে ওঠে। নিকোলাস নেই, আর দেখবে না, স্পর্শ করতে পারবে না। শুনতে পারবে, “বেলা, আমার বেলা।” ইসাবেলার ভেতরে ঝড় ওঠে। ভেঙেচুরে দেয় সব। কিন্তু কাঁদে না, ওর দৃষ্টি শূন্য। অতি শোকে মানুষ বোধহয় পাথর হয়ে যায়।

পেটের ভেতর কে যেন লাথি দিলো। হলঘরেও একবার হয়তো দিয়েছিল। মনের ভুল ভেবেছে ইসাবেলা। কিন্তু এখন বুঝল মনের ভুল না। একটার পর একটা লাথির মারছে পেটে, নড়ছে। আগের তুলনায় ভীষণ ব্যথা। ইসাবেলার চোখ গড়িয়ে পড়ল অশ্রু। কিন্তু শব্দ হয় না। ধীরে ধীরে হাতটা পেট ওপর রাখে। স্পষ্ট টের পেল এবার। কেউ রয়েছে ওখানে। অন্তঃসত্ত্বা হয়েছে এই সন্দেহ করার অবসর পায়নি। কিংবা পেলেও গুরুত্ব দেয়নি আগে। মা হতে পারবে সেই আশায় কী করেছিল! এখন ওর চোখে আতঙ্ক আর অদ্ভুত এক আবেশ খেলে গেল। মা হবে! নিকোলাসের সন্তানের মা? নিকোলাস! ও বেচারা জেনেও গেল না ইসাবেলা ওর সন্তান ধারণ করেছে। খুশি হতো কী? ইসাবেলা অন্তঃসত্ত্বা হোক ও কোনোদিন চায়নি তবুও হয়তো নারাজ হতো না। ইসাবেলা এবার মৃদু শব্দে কাঁদল পেটের ওপর হাত বুলিয়ে, “কী দুর্ভাগ্য নিয়েই না নিজের অস্তিত্ব জানান দিলি তুই! আমার রিক্ত নিঃস্ব জীবনে তুই যে বিস্ময় নিয়ে এলিরে.. তোর বাবাকে যে ওরা কেঁড়ে নিয়েছে। আমার নিকোলাস! ওকে ছাড়া আমি বাঁচি কী করে বল তো। কিন্তু তোকে দিয়ে ঈশ্বর যে মরার পথও বন্ধ করে দিলো। প্রভু, আমি নিকোলাসকে তোমার সামনে নত হতে দিইনি বলে কী ওকেই কেঁড়ে নিলে! আমার সন্তানের এখন কী হবে? আমার পাপের শাস্তি ওকে পিতৃহারা করে কেন দিলে তুমি? নিকোলাস! প্লীজ ফিরে এসো। নিকোলাস!”

আচমকা ওর হাত ধরে কেউ টেনে তুললো।

“ওই পিশাচের সন্তান ধারণ করেছিস তুই!”

ড্যামিয়ানের ক্ষুব্ধ কণ্ঠ। ইসাবেলা ঘৃণিত চোখে তাকায়,

“হাত ছাড় বলছি। ছাড়!”

শক্তিতে পেরে ওঠে না ইসাবেলা। ড্যামিয়ান আরও শক্ত করে হাত ধরে আছে।

“কেন? আমার স্পর্শ সহ্য হয় না? কিন্তু ওই পিশাচের স্পর্শ সহ্য হয়েছে। ওর সাথে শুতে তোর ভালো লেগেছে, ওর সন্তান পেটে নিতে ভালো লেগেছে। শুধু আমি স্পর্শ করলে তোর গায়ে জ্বালা ধরে, না? কুত্তি মাগী, তোর পেট ছিঁড়ে ওই সন্তান বের করে আনব। আমার শত্রুর বংশ তোর পেটে থাকতে পারে না। তুই আমার তোর সব আমার। ওই পেটে যদি কারো সন্তান থাকে তবে সেটা আমার হবে।”

“খবরদার যদি আমার সন্তানের দিকে হাত বাড়িয়েছিস তুই? আমি সেই ছোটো মেয়েটি নেই যে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে কেঁদে দেবে। নিকোলাসকে শেষ করার মূল ষড়যন্ত্রকারী তুই, তাইনা? আমার মায়ের ব্রেন ওয়াশ করে তুই ওকে শেষ করেছিস। ভেবেছিস এসব করে আমাকে হাসিল করবি? করে দেখা!”

ইসাবেলা চ্যালেঞ্জ আর নির্ভীক রূপ দেখে ড্যামিয়ান যে অবাক হয়নি তা নয়। কিন্তু দ্রুত সেটা আড়াল করে হেসে ওঠে।

“দেখবি? আমাকে চ্যালেঞ্জ করার আগে ভাবা উচিত ছিল বেবিগার্ল। যতটুকু অবশিষ্ট আছিস ওইটুকু ভেঙেচুরে আমার মহলের শোপিস করে রাখব তোকে। কিন্তু তার আগে ওই পিশাচের সন্তান দূর করতে হবে তোর ভেতর থেকে।”

“আমার সন্তানের ক্ষতি করার চেষ্টা করলে তোকে আমি প্রাণে মেরে ফেলব ড্যামিয়ান। হুমকি দিচ্ছি না। আমি আর সেই নিষ্পাপ ইসাবেলা নেই। এই দু’হাতে পিশাচ মেরেছি। তোকে মারতে আর কী।”

ইসাবেলা অন্য হাতে পেট আগলে রাখল। ড্যামিয়ান হঠাৎই ওর গলা চেপে বিছানার ওপর ফেলে দেয়। নিঃশ্বাস নিতে ছটফট করে ইসাবেলা। ছাড়াতে চায় নিজেকে। কিন্তু পেরে ওঠে না। ড্যামিয়ান যেন একটা অসুর।

“আমাকে মারবি? আগে নিজে বেঁচে দেখা। তোকে আজ এমন শাস্তি দেবো যে ফের মুখ তুলে গলা উঁচু করে কথা বলার সাহস করবি না আমার সাথে।” ড্যামিয়ান অন্য হাতে ইসাবেলার বুকের ওপরের কাপড় এক টানে ছিঁড়ে ফেলে। দু টুকরো অন্তর্বাসের মাঝে বাড়ন্ত পেট উন্মুক্ত হয় ওর সামনে। লজ্জায়, অপমানে চিৎকার করে ওঠে ইসাবেলা৷ ড্যামিয়ান দেখে পেটের এদিক ওদিকে কিছু নড়ছে। ক্রুর হেসে খামচে ধরে পেটের উপরিভাগ। ব্যথায় গলা ফাটিয়ে কেঁদে ওঠে ইসাবেলা। ড্যামিয়ান তবুও থামে না। আঙুল গেঁথে দেয় ত্বকে। এই হাত দিয়েই যেন ছিঁড়ে ফেলবে পেট।

“আমার এত বছরের শ্রম তুমি এত সহজে নষ্ট করে দিতে পারো না বেবিগার্ল। আমি তা হতেই দেবো না। এই শিশু পৃথিবীর আলো দেখলে আমার এত ত্যাগ, সফলতা সব যে বৃথা যাবে। জেনেশুনে বিপদ ডেকে আনি কী করে বলো?”

ইসাবেলার চিৎকারে মাতভেই ও ভ্লাদিমি ছুটে এলো। এসে যেই দৃশ্য দেখল তাতে খুন চেপে যায় ওদের মাথায়। দুই জনে টেনে ছাড়িয়ে আনার চেষ্টা করে। ড্যামিয়ানের একার শক্তির সাথে কুলিয়ে উঠতে পারে না ওরা। ভ্লাদিমি এলোপাতাড়ি লাথি ঘুষি দিয়ে বিছানার একপাশে ফেলে দেয়। মাতভেই ওর বুকের ওপর উঠে বসে সেই সুযোগে। জানালার পর্দা টেনে ছিঁড়ে বোনের লজ্জা ঢাকল ভ্লাদিমি। জড়িয়ে ধরে ওর কম্পিত শরীর।

“বোন আমার, ভয় নেই। ভাই তোর কিছু হতে দেবে না।”

তাতিয়ানা দৌড়ে এসে ওকে নিজের কাছে নিলো। ভ্লাদিমিকে ক্রোধিত হয়ে বলল,

“ওই শয়তান যে হাতে আমার বোনকে ছুঁয়েছে ভেঙে ফেল সে হাত। কুকুরটাকে আজ উচিত শিক্ষা দিয়ে ছাড়বি ভ্লাদিমি।”

মাতভেই ও ভ্লাদিমির সাথে খুব মারামারি শুরু হলো ড্যামিয়ানের। ওর সাথে পেরে ওঠে না দুজন। কিন্তু বেশ আঘাতপ্রাপ্ত হয় ড্যামিয়ান। ভ্লাদিমি বড়বোনের কথামতো ওর একটা হাত ঠিক মুচরে দিলো। পালটা আঘাত হিসেবে ভ্লাদিমির মাথা ফাটিয়ে দেয় দেওয়ালে আছরে। মাতভেই বুক চেপে ধরে মেঝেতে গোঙাচ্ছে। ড্যামিয়ান রাগে হিস হিস করতে করতে ফের হিংস্র ভঙ্গিতে ইসাবেলার দিকে অগ্রসর হয়। তাতিয়ানা ভীত হলেও ওকে সতর্ক করে,

“খবরদার ড্যামিয়ান, আর এক পা এগোবি না।”

ড্যামিয়ান আমলেও নিলো না। ইসাবেলা আর্ত মুখে দুহাতে পেট আগলে রাখে। ড্যামিয়ান সেদিকে হাত বাড়াতে আন্না মেরিও পেছন থেকে ওকে ভারী কাঁচের ফুলদানি দিয়ে আঘাত করেন। ছিটকে পড়ে যায় নিচে ও৷ মাথার পেছনে ব্যথা অনুসরণ করে হাত দিতে রক্তে ভিজে গেল হাত।

“তোর সাহস কী করে আমার মেয়ের দিকে হাত বাড়ানোর?”

“আন্নে!” ড্যামিয়ান উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে কিছু বলতে চায় কিন্তু সেই সুযোগ আন্না মেরিও দিলেন না। কষে চড় দিলেন ওর গালে। ফের দেবেন মার্কোভিক চেঁচিয়ে থামিয়ে দিলেন।

“কী হচ্ছে এখানে?”

“জিজ্ঞেস করুন এই শয়তানকে। কোন সাহসে ও আমার মেয়ের ঘরে ঢুকল। দেখুন কী করেছে। ওকে তো আমি জীবন্ত কবর দেবো আজ।”

এই বলে মারতে উদ্যত হয় আন্না মেরিও। ড্যামিয়ান তাঁর হাত ধরে ফেললো।

“আর না আন্নে, আর না। তোমার প্রতি সামান্য শ্রদ্ধাবোধ আছে বলেই মারলে, গালমন্দ করলেও কিছু বলিনি। সব সময় তো এমন হবে না।”

“ড্যামিয়ান!” মার্কোভিক সাবধান করল কড়া গলায়। ড্যামিয়ান ছেড়ে দেয় আন্না মেরিওর হাত। তারপর ইসাবেলার আতঙ্কিত মুখে চেয়ে চোয়াল শক্ত করে বলে,

“তোমার নাতনি ফের ওই পিশাচকে ফিরিয়ে আনতে চাইছে। অন্তঃসত্ত্বা ও। নিকোলাসের সন্তান ওর গর্ভে।”

চলবে,,,

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৯৮
Writer তানিয়া শেখ

দিনদিন অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়েছ ইসাবেলা। চারিদিকে কেবল শূন্যতা আর শূন্যতা। অথর্বের মতো নিজ কক্ষের চার দেওয়ালে দিনরাত কেটে যায়। যতক্ষণ চোখ মেলে থাকে একদৃষ্টে জানালার বাইরে তাকিয়ে রয়। কী জন্য কে জানে! অপেক্ষা! আর কীসের? সব তো শেষ ওর। কেউ আসবে না, কেউ না। কেউ বলল কিন্তু নামটা আর নিলো না। নাম নিলেই বুকের ভেতর ঝড় ওঠে। কত কী ভাঙে। চামড়ার আস্তরণের কারণে দেখা যায় না। এতেই ভালো হয়েছে। লোকে দেখলে অস্বস্তি।

অদূর বনে কুয়াশা জড়িয়ে আসে। সন্ধ্যা উতরে রাত নামল। অন্ধকারে আজকাল গা ছমছম করে ইসাবেলার। মৃত্যু ভয় জাগে। আগে কি ভয় পেত? এত নয়। পিটারের দেওয়া আঘাতের পর তো স্বেচ্ছায় মরতে পর্যন্ত রাজি ছিল। সময় পরিবর্তন হয়। ইসাবেলা এখন আর সেই ইসাবেলা নেই। কত বদলে গেছে। কুমারী থেকে স্ত্রী হয়েছে, নারী হয়েছে। আর মাস কয়েক পর মা হবে। আনমনেই ডান হাত বাড়ন্ত পেটের ওপর রাখল। ডাক্তার বলেছেন পাঁচমাস চলছে। কিন্তু পেটের ফুলে ওঠাটা কিছু অস্বাভাবিক। যেন আটমাসের গর্ভবতী। পাঁচমাসে পেট এতটা দেখার কথা নয়। পরীক্ষা নিরীক্ষা করে আশ্বস্ত করেছেন বাচ্চা ঠিক আছে। তবে ডাক্তার কোনো একটা ব্যাপার নিয়ে আশ্বস্ত ছিলেন না। হয়তো পেটের শিশুটির অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণে। কিন্তু সেটা মুখে বলেননি। ইসাবেলা সব বোঝে। সাথে ওর অনাগত সন্তানটিও। ডাক্তার দেখতে এলে একেবারে শান্ত হয়ে যায়। বিপদ টের পায় যেন। মা ছাড়া আর কারো সান্নিধ্যে ভরসা পায় না। মা’কে বুঝিয়ে দেয় ওর নীরবতা দিয়ে। মায়ের ধারে-কাছে কোনো পরপুরুষ বা অসৎ লোক এলে গম্ভীর হয়। একেবারে বাপের মতো! থমকায় ইসাবেলা। মলিন হাসিটুকু উবে যায়। গলাটা কেমন শুকিয়ে আসে। চোখ দুটো উদাস, নির্জীব। সেই ঝড় আবার ওঠে। বড্ড দুর্বল লাগে তখন ওর। চোখ বুঁজে খাটে শোয়। ঘুম খুব কম হয়। তবুও জোর করে চোখ বুঁজে ঘুমানোর চেষ্টা করে। একমাত্র ঘুমই বাস্তব নির্মম স্মৃতিগুলো ভুলিয়ে দেয়। কিন্তু এর সাইড ইফেক্টও আছে। এভাবে শুয়ে থাকলে হাত পায়ে পানি জমে যায়। সুতরাং ফের ওকে উঠতে হয়। পায়ে জোর নেই। ধীরে ধীরে হাঁটে। এই কক্ষে পায়চারি করে, জানালায় বসে দূর আকাশে সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত দেখে। আর সন্তানের সাথে ফিসফিস করে কথা বলে। কত যে কথা! শেষই হতে চায় না। দুজনের মাঝে অদ্ভুত এক মায়ার সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে। ইসাবেলার এখন আর একা লাগে না। কিন্তু রাত হলে কেন যেন ভয় ভয় করে। অন্ধকার পেলেই কেউ যেন সেখানে ওঁৎ পাতে। মৃত্যু! কিন্তু ইসাবেলা এখন মরতে চায় না। ইচ্ছে করলেও সে উপায় নেই। এই সন্তানটির জন্য যে বেঁচে থাকতে হবে। মায়েরা বড়ো সেনসিটিভ হয়। ইসাবেলাও হয়েছে। আগের চেয়ে বেশি। অনাগত সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে খুব সতর্ক। ড্যামিয়ানের সেই আক্রমণ স্মরণ করলে গায়ে কাঁটা দেয়। কেন যে বার বার বলছিল,”ও আবার ফিরিয়ে আনতে চাইছে ওই পিশাচকে।” যে ছাই হয়ে বাতাসে মিশে গেছে তাঁকে কী ফিরিয়ে আনা যায়? এ বাড়ির কেউ ওর কথা বিশ্বাস করেনি। আন্না মেরিও দারোয়ান ডেকে জোরপূর্বক বের করে দিতে চেয়েছিলেন। মার্কোভিক বাধা দিলেন। এতেই রেগে যান আন্না মেরিও। তিন-চারদিন বাদে সপরিবারে ফিরে আসেন স্বামীর ভিটাতে। যুদ্ধ পুরোদমে চলছে। রাস্তায় বেশ ভুগান্তি পোহাতে হয়েছিল এজন্য। তবে স্বস্তির কথা ওদের বাড়িটি এখনও বিপদমুক্ত।

ইসাবেলার শরীরে আগের মতো বল নেই। শীর্ণকায় হয়ে গেছে। এইটুকু পায়চারি করে হাঁপিয়ে উঠল। বসল বিছানায় হেলান দিয়ে। কক্ষ অন্ধকারে নিমজ্জিত। আলো নিয়ে এখনও কেউ এলো না! অন্ধকার ভালো লাগছে না। ওর সকল প্রার্থনা কবুল না হলেও এটা হলো। তাতিয়ানা নিঃশব্দে কক্ষে ঢুকলো। হাতে জ্বলন্ত বাতিদান। অন্য হাতে খাবারের ট্রে। অন্ধকার ঘরে আলো খেলে গেল পলকে।

“আজ কেমন বোধ করছ?” বাতিদান টেবিলের ওপর রেখে জিজ্ঞেস করল তাতিয়ানা। তারপর ট্রেটা নামালো।

“ভালো।” দুর্বল গলায় বলল ইসাবেলা। মৃদু আলোতে বোনের পাণ্ডুর, শীর্ণ মুখ দেখে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তাতিয়ানার ভেতর থেকে। এগিয়ে ওর কাছে বসতে ইচ্ছে করে কিন্তু সাহস পায় না। এই বোন আজ সেই বোন নেই যাকে মন চাইলে জড়িয়ে ধরা যেত, মজা করে রাগানো যেত। এই বোন কেমন যেন হয়ে গেছে। কিছুটা ভয়ের কারণ, কিছুটা ভয় পাইয়ে দেওয়ার কারণ।

“তোমার খাবার রেখে গেলাম। খেয়ে নিয়ো।”

ইসাবেলা জবাবে মাথা নাড়ল। তাতিয়ানার চলে যাওয়া উচিত। তবুও দাঁড়িয়ে রইল। একদৃষ্টে দেখছে বোনকে।

“তোমাকে আগের চাইতে বেশি রোগা ও দুর্বল দেখাচ্ছে।”

“ওহ!”

“ইসাবেল, জেনেশুনে কেন নিজেকে শেষ করছো বলোতো? আমার ভীষণ কষ্ট হয় তোমাকে এভাবে দেখলে। শুধু আমার নয় আমাদের সকলের। মাতভেই, ভ্লাদিমি, বাবা, মা..”

“তুমি এখন এসো, অ্যানা।”

এমনই হয়। বাবা-মায়ের কথা ইসাবেলা এখন আর শুনতে চায় না। এরা যেন কেউ না ওর। তাতিয়ানা মলিন মুখে দরজার দিকে অগ্রসর হয়। কাঁধের ওপর দিয়ে তাকালো। এখনও পাথরের মতো ঠাঁই আধশোয়া হয়ে আছে ইসাবেলা। বন্ধ চোখের পাতা একটুও নড়েনি।

“তোমাকে আমরা ভালোবাসি ইসাবেল। সারাজীবন বাসব। তুমি মুখ ঘুরিয়ে নিলেও।”

ইসাবেলা নিরুত্তর। হাঁপ ছাড়ে তাতিয়ানা। তারপর নিঃশব্দে দরজা বাইরে দিয়ে বন্ধ করে। একটু পর কড়িডোরে ওর পায়ের শব্দ মিলিয়ে যায়। ইসাবেলা চোখ খুললো। খিদে পেয়েছে বেজায়। পেটেরজন ছটফট করছে খাবে বলে। ধীরে ধীরে উঠে এলো টেবিলের কাছে। ট্রে-তে প্রতিদিনের মতো সব খাবার রাখা। কিন্তু চোখ দুটো চকচক করে ওঠে পাশের বড়ো গ্লাসের দিকে তাকাতে। টকটকে তাজা রক্ত। তাতিয়ানা “আমরা তোমাকে ভালোবাসি” কথাটা মিথ্যা বলেনি। ভালোবাসে বলেই ঘেন্নাপিত্তি সত্ত্বেও রোজ গ্লাসে গ্লাসে রক্ত দিয়ে যায়। আগলে রাখে সমাজ ও ধর্মের নিয়ম উপেক্ষা করে। ইসাবেলার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত। কিন্তু ও অকৃতজ্ঞের মতো কেবল গ্রহণ করে চলেছে। বিবেক টিবেক ঠিক কাজ করে না আগের মতো। হাত বাড়িয়ে গ্লাসটা তুলে নেয়। প্রথমে নাকের সামনে আনে। মুহূর্তে তৃষ্ণা প্রবল হয়, নেশা ধরে। পেটের সেই জন হুল্লোড় লাগিয়ে দেয়। নাকের সামনে থেকে ঠোঁটের ফাঁকে গ্লাসের মুখ ঢুকিয়ে গটগট করে গিলে ফেললো। অদ্ভুত এক পৈশাচিক শান্তি পায় পান করার সময়। কিন্তু পুরোটা পেটে চলে যেতে সেই গা ঘিনঘিন করে, বমি পায়। বাকি খাবার আর খেতে ইচ্ছে করে না। শুয়ে পড়ে জানালা মুখো হয়ে। বাইরে ঘন অমাবস্যার রাত। বিয়ে বাড়ির ব্যান্ড পার্টির ন্যায় ঝিঁঝি ডাকছে সুর তুলে। সেই সুর শান্তি নয়, আনন্দ নয় যেন বিষণ্ণতা ছড়ায়। দূরে কালো আকাশ। ইসাবেলার কেন যেন মনে হলো আজ বৃষ্টি হবে, তুমুল বেগে।

মার্কোভিকের ওপর খুব চটলো ড্যামিয়ান। ওর এতকালের সুপরিকল্পিত প্লানে পানি ঢালতে চাইছে বুড়োটা। আজ নয় কাল করে করে অযথা সময় নষ্ট করছে। বুঝতে চাইছে না গত হওয়া এক একটা দিন ওদের জন্য বিপদ ঘনিয়ে আনছে। ওই শিশুর জন্ম বিপদ বৈ আর কী। কিন্তু বুড়োটা বুঝলে তো! আন্না মেরিওর ওপরও কম ক্ষোভ না। মাথামোটা মহিলা একটা কথা শুনলো না। সকল কিছু উপেক্ষা করে মেয়েকে নিয়ে ফিরে গেল রিগাতে। এখান থেকে চলে গেলে ড্যামিয়ান হার মানবে ভেবেছে? রাতে ঘুম হয় না। নিকোলাস বেঁচে ছিল সে একরকম অশান্তি ছিল। প্রতিশোধের আগুনে রোজ পুড়ত ড্যামিয়ান। মরেছে এখন দুঃস্বপ্ন হয়ে ঘুমের মধ্যে হানা দেয়।
জ্যোতিষী মহাশয় বলেছেন, ওই শিশুই ইসাবেলা নামক নক্ষত্রের পাশে দেখা দ্বিতীয় নক্ষত্র। ওই শিশুই হবে ড্যামিয়ানের প্রতিদ্বন্দ্বী ও সর্বনাশের কারণ। এতকিছু জানার পর চুপ থাকা মহা বোকামি যা ড্যামিয়ান করবে না। মার্কোভিকের বাধা উপেক্ষা করে রওয়ানা হলো ইসাবেলার গর্ভের শিশুটিকে হত্যার উদ্দেশ্যে।

রিগা পৌঁছাতে খুব বেশি ঝামেলা হলো না ওর মতো ধূর্ত, হিংস্র অর্ধ নেকড়ের। বিশেষ ক্ষমতাবলে দুই রাত পর হাজির হলো রিগাতে। আলেক্সিভ মহলের পেছনে যখন পৌঁছালো তখন মধ্য রাত। একটু আগে ঝুমবৃষ্টি হয়েছে। এখন ঝিরিঝিরি পড়ছ। ভেজা আলখেল্লার হুড কাঁধে নামিয়ে লন থেকে সদর দরজার সামনে এলো। হাতের কসরতে সহজে সদর দরজা খুলে ফেললো। বহুবার এসেছে এখানে। অন্ধকার হলঘর পেরিয়ে দ্রুত পায়ে ওপরে উঠে এলো৷ তারপর সোজা ইসাবেলার কক্ষের সামনে৷ শব্দ না করে ইসাবেলার কক্ষের দরজা খোলে। পা টিপে এগিয়ে দাঁড়াল ওর শিওরে। বাইরে মেঘ গুড় গুড় করছে। বিদ্যুৎস্ফুরণের এক ঝলক আলো এসে পড়ল এ কক্ষে। সেই আলোতে ইসাবেলাকে দেখে চমকে যায় ড্যামিয়ান। এ কী দেখছে! এ তো ইসাবেলা নয়৷ হতেই পারে না। সেই সতেজ, সুশ্রী সুদর্শনা কই? সামনে শুয়ে থাকা শীর্ণকায়, কুৎসিত নারীটি কিছুতেই ইসাবেলা হতে পারে না। বুকের বা’পাশ কেউ যেন খামচে ধরলো ওর। যে রাগ নিয়ে এসেছিল তা ভেঙেচুরে ক্ষোভ আর অভিমান পর্যবসিত হয়। ঝুঁকে গেল ইসাবেলার মুখের দিকে। ক্রমে ক্রমে চোয়াল কঠিন হয়। বিড়বিড় করে বলল,

“তোমাকে তো এমন করে নিজের ওপর অবিচার করতে দিতে পারি না আমি, বেবিগার্ল। তোমার ওপর যে অধিকার আমারও কিছুটা রয়েছে। তা তোমাকে দিতেই হবে।”

ইসাবেলা যেন শুনতে পেল। ঘুমের মধ্যে নড়ে ওঠে। চোখ খুলবে অমনি ড্যামিয়ান একটা কাপড় ওর নাকে চেপে ধরতে একটু ছটফট করে নিস্তেজ হয়ে যায়। তারপর কাঁধে তুলে নেয় ইসাবেলার দেহখানি। পা বাড়ায় দরজার বাইরে।

পরদিন দ্বিপ্রহরে চেতনা ফিরতে নিজেকে কুটিরে আবিষ্কার করে। নড়াচড়া করতে গিয়ে টের পায় হাত পা বাঁধা। একটু ধাতস্থ হতে আশপাশের পাখির কূজন, গাছের পাতায় পাতায় ঘর্ষণে আন্দাজ করে নেয় কুটিরটি বনমধ্যে। নিজের জন্য ওর ভয় করে না। বাঁচা- মরা আজ ওর কাছে সমান। যত ভয় পেটের সন্তানটিকে নিয়ে। ওর এই অবস্থা কে করেছে তা বুঝতে সময় লাগল না। একজনই আছে যে ওর শত্রু, ওর অনাগত সন্তানের মৃত্যুকাঙ্খী।

“সারপ্রাইজ! ঘুম ভাঙল তবে, বেবিগার্ল?” ড্যামিয়ান দুহাত মেলে মুচকি হেসে কুটিরে প্রবেশ করে। মনে মনে কাষ্ঠ হাসল ইসাবেলা। একচুল ভুল হয়নি। ড্যামিয়ান ওর সামনে এসে এক হাঁটু ভেঙে বসল।

“কতদিন বাদে তোমায় আবার দেখলাম। খুশি হওনি? যাঃ একটু খুশি হও। আমি কিন্তু বেজার হয়েছি তোমাকে দেখে। নিজের কি হাল করেছ দেখেছ! তুমি তো আমার। তোমার রূপ, যৌবন এমনকি তোমার আত্মা পর্যন্ত আমার। তাহলে আমার অনুমতি ছাড়া এসব নষ্ট করার সাহস তুমি কী করে পেলে, হুঁ? কঠিন শাস্তি হবে তোমার, কঠিন শাস্তি।”

ইসাবেলা শুকনো ঠোঁট দুটো চেপে ধরে আছে। তাকায় না ড্যামিয়ানের মুখে। কিন্তু ড্যামিয়ান এত সহজে নিস্তার দেবে? চেপে ধরে ওর হাড় বেরোনো চোয়াল। অন্যসময় হলে ব্যথায় কুঁকড়ে উঠত ইসাবেলা। এখন শক্ত হয়ে যায়।

“কথা বলবি না? সেদিন তো খুব মুখ চলছিল। আজ চুপ কেন? না কি কিছু না করলে মুখ খুলবি না।”

ড্যামিয়ান ওর বাড়ন্ত পেটের দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকাতে ইসাবেলা শঙ্কিত হয়। কোনোমতে বলে,

“ও তোমার পথে কোনোদিন বাধা হবে না। ওয়াদা করছি ওর পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবে না। জানতে দেবো না ওকে কিছু। যেতে দাও আমাকে। বাঁচতে দাও আমার সন্তানকে।”

ড্যামিয়ান কী যেন ভাবল। তারপর বলল,

“বাঁচাতে চাস তোর সন্তানকে?”

“অবশ্যই।”

“এক শর্তে। তুই আমার সহধর্মিণী হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলে তোর সন্তানকে আমি ছেড়ে দেবো। রাজি?”

ইসাবেলার নির্জীব চোখে আগুন ঝরে।

“মাথাখারাপ হয়ে গেছে তোর? তোর সহধর্মিণী হওয়ার চাইতে মৃত্যু পছন্দ করব।”

“কার মৃত্যু? তোর সন্তানের? আচ্ছা তাহলে তাই হবে।”

ড্যামিয়ান উঠে দাঁড়ায়। কুটিরের এককোণে ছুরি আর কিছু ভেষজ পাতা নিয়ে ওর সামনে এসে থামে আবার। বসল ঠিক ওর বাড়ন্ত পেট মুখোমুখি। ইসাবেলা কিছু বলার আগে একটানে ওর পরনের ঢিলে জামাটা ছিঁড়ে ফেলে। ভেতরে কেবল সাদা অন্তর্বাস। এই দেহের প্রতি ড্যামিয়ানের লোভ আছে কিন্তু এখন তত প্রবল নয়। বাড়ন্ত পেটটাই ওর চোখের কাঁটা। তীক্ষ্ণ চোখে বাড়ন্ত পেটের দিকে তাকিয়ে আছে। হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করতে গেলে কুঁকড়ে গেল ইসাবেলা। আর্ত গলায় বলল,

“আমি রাজি।”

এত সহজে! ড্যামিয়ান অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো। মনে মনে খানিক হতাশ হলো কি! আরেকটু ভয়, আরেকটু ব্যথা না দেখতে পারার আফসোস রয়ে গেল। কিন্তু বিয়েতে রাজি হলো এই আনন্দও কম নয়। রাজি না হয়েও উপায় নেই ইসাবেলার। জ্যোতিষী খামোখা ওকে ভয় দেখিয়েছে। এই তো কত সহজে ইসাবেলা ওর হবে। আজই অর্ধেক। কাল পুরোপুরি। ড্যামিয়ান হাসিমুখে নিজের পরনের আলখেল্লা খুলে ওকে ঢেকে দিলো। তারপর কপালে চুমু দেয়। ঘা ঘিনঘিন করে ওঠে ইসাবেলার। দাঁতে দাঁত কামড়ে ঘৃণাবোধ গিলে ফেললো। গতবারের মতো বোকামি আজ ও করবে না। দুর্বলকে গায়ের জোরে নয় বুদ্ধিতে এগোতে হয়।

“এখন আমার হাত-পায়ের বাধন খুলে দাও।” বলল ইসাবেলা। যতটা সম্ভব মনভোলানো হাসি হাসল। কিন্তু শুকনো সাদাটে ঠোঁটের সেই হাসি ড্যামিয়ানের ভালো লাগল না। আলখেল্লার পকেট হাতড়াতে হাতড়াতে বলল,

“এত তাড়া কীসের? এই অবস্থায় দেখতে কিন্তু বেশ লাগছে আমার।”

ইসাবেলা চুপ রইল। ড্যামিয়ান একটা ছোট্ট কৌটা বের করল পকেট থেকে। কৌটার মুখ খুলতে জ্বলজ্বলে হিরের আংটি দেখা যায়। ইসাবেলা বা’হাতের দুর্বল মুষ্টি প্রাণপণে শক্ত করে ধরে। ড্যামিয়ান যেন বুঝল। বক্রিম হাসি দেখা গেল ওর ঠোঁটের কোণে। তারপর ইসাবেলার হাতের বাঁধন খুলে দেয়। টেনে সোজা বসালো। দুর্বল ইসাবেলা সোজা হয়ে বসতে পারল না। মেরুদণ্ডে জোর নেই। ড্যামিয়ান বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে। সরে যেতে চায় ইসাবেলা। কিন্তু সেই জোর কই! বা’হাতের মুষ্টি আলগা করতে একটু কষ্ট হলো না ড্যামিয়ান। হঠাৎ রাগে ওর মুখ কঠিন। অনামিকায় এখনও নিকোলাসের নামের আংটি সগৌরবে আছে। রূঢ়তার সাথে টেনে খুলতে গেলে ইসাবেলা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে।

“যার চিহ্ন আর নেই তার স্মৃতি রাখাও ঠিক না। বরং যে আছে ও থাকবে তার স্মৃতি এখন থেকে বহন করবে। খুলে ফেলো ওই জঞ্জাল।” বলল ড্যামিয়ান।

নিকোলাসের নামের আংটিটি খুলে জোর করে নিজের নামের আংটি পরিয়ে দেয় ড্যামিয়ান। মুখটা আঁজলা ভরে তুলে ঠোঁটে চুমু খায়। এই চুমু ওকে অধিকারের প্রথম নিদর্শন। যদিও ওমন নিরস, শুষ্ক ঠোঁটে চুমু খেয়ে কেমন যেন বিস্বাদ ঠেকল।

ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে থাকে ইসাবেলা। সমস্ত শরীর রি রি করে উঠল। বহুদিন বাদে চোখে পানি এলো। অসহায়ত্বে, ঘৃণায় ভেতরে ভেতরে ফুঁসতে লাগল।

“খিদে পেয়েছে? খাবে কিছু?”

ওর মুখে ওপর থেকে চুল সরিয়ে বলল ড্যামিয়ান। ইসাবেলার পেট গড়গড় করে ওঠে খিদের চোটে। ঠিক খিদে নয় তৃষ্ণা। রক্ত তৃষ্ণা। ইসাবেলা দাঁত কামড়ে নীরব থাকে। ড্যামিয়ানের হাত থেকে কিছু খাবে না। ওর নীরবতায় ড্যামিয়ান ভুরু কুঁচকে বলে,

“খাবে না? কেন? ভয় হয় পাছে কিছু খাইয়ে পেটেরটাকে মেরে ফেলব বলে? ভয় করো না। কথা দিয়েছি ওর কোনো ক্ষতি করব না আমি। বিশ্বাস রাখতে পারো।”

তীব্র চাহনি ইসাবেলার। বিশ্বাস! ওর মতো শয়তানকে কখনও বিশ্বাস করবে না ও। কিন্তু ভান করে যেতে হবে। ড্যামিয়ান আবার উঠে কুটিরের বাইরে গেল। ও বেরিয়ে যেতে একটানে নিজের শরীর থেকে ওর আলখেল্লা খুলে ফেললো। ছেঁড়া জামায় নিজের লজ্জা ঢাকার চেষ্টা করে। অন্যহাতের পাতায় ঠোঁট মুছতে মুছতে চামড়া ছিঁড়ে রক্ত বের করে ফেললো ইসাবেলা। অশুচিতা সর্বাঙ্গে৷ সামনেই ড্যামিয়ানের ছুরি। বিয়ের খুশিতে ভুলে গেছে হয়তো। আজ ওকে বিয়ের সাধ মিটিয়ে দেবে। লুকিয়ে ফেললো ইসাবেলা ওটা। দুহাতের যা শক্তি তাতে ড্যামিয়ানের সাথে লড়াই করে পেরে উঠবে না। মনের শক্তি সঞ্চয় করে। মনবল দৃঢ় হলে ক্ষুদ্র জীবও বৃহৎ জন্তুর সাথে লড়ে যায়, জয়ী হয়।

প্রায় মিনিট খানেক সময় পরে ড্যামিয়ান ফিরল। হাতে তাজা রক্ত ভরা পাত্র। সাথে আরও কিছু সাধারণ খাবার।

“খেয়ে নাও। কাল আমাদের বিয়ে। কত কাজ! এই শরীরে পেরে উঠবে না। শক্তি দরকার তো।”

খাবারগুলো রাখল ওর সামনে। মেঝেতে পড়ে থাকা আলখেল্লা, ইসাবেলার ঠোঁটের রক্ত দেখার পরও উচ্চবাচ্য করলো না। যেন দেখেইনি। ইসাবেলা খায় না। কিন্তু রক্ত দেখে লোলুপ হয়ে ওঠে। মনের সাথে যুদ্ধ চলে। খাবে না, খাবে না। ও জানে হারবে। ড্যামিয়ানের ওই বিদ্রুপের হাসি তাই তো বলে।

“আমার খিদে নেই এখন। রেখে দাও পরে খাব।”

বলেই উলটো দিকে শুতে যায়। ড্যামিয়ান ওর হাত চেপে ধরে।

“এই অনিয়ম তো হতে দিতে পারব না হবু স্ত্রী আমার। খেতে হবে তোমাকে। হা করো। হা।”

ইসাবেলা মুখ খোলে না। ড্যামিয়ান রাগ রাগ গলায় বলল,

“হা করো ইসাবেলা।”

ইসাবেলা তবুও হা করল না দেখে ধৈর্য হারায় ড্যামিয়ান। ওর চোয়াল চেপে ধরে জোর করে ঠোঁট আলগা করে।

“ভালো কথার মেয়ে নস তুই। জোর করি মনে মনে এটাই বুঝি চাস? বেশ…”

ড্যামিয়ান থেমে যায় ওর বুকের ভেতর ধারালো কিছু আঘাত করতে। নিচে তাকিয়ে দেখল রেখে যাওয়া ছুরিটি ইসাবেলা বুকে ঢুকিয়ে দিয়েছে। ব্যথায় মুখ বিকৃত হয়ে যায়। ছেড়ে দেয় ইসাবেলার চোয়াল। সুযোগ পেয়ে উঠে দাঁড়ায় ইসাবেলা। কালক্ষেপণ না করে ছুটে বেরিয়ে আসে কুটিরের বাইরে। পায়ে জোর নেই তবুও বনমধ্যে ছুটতে লাগল দিশাহীন। কুটিরের ভেতর থেকে ড্যামিয়ানের হুঙ্কার ভেসে আসছে। ইসাবেলা আরও জোরে ছোটে। পড়তে পড়তে কোনোমতে সামলায় বার কয়েক। কিছুদূর গিয়ে হাঁপিয়ে ওঠে। আর পারছে না ছুটতে। পেট ধরে একটা গাছের আড়ালে বসে। খুব নড়াচড়া করছে ওর অনাগত সন্তান। ইসাবেলা হাত বুলিয়ে বলল,

“বড্ড খিদে পেয়েছে না তোর? একটু কষ্ট কর সোনা। মা এখান থেকে বেরিয়েই তোকে খাওয়াবে। একটু সবুর কর।”

ইসাবেলা অবাক হয় পেটের নড়াচড়া থামতে। যে সন্তান গর্ভাবস্থায় মায়ের দুঃখ বোঝে সে মানুষের কষ্টের কারণ হবে! ইসাবেলার চোখ ছলছল করে।

“লক্ষী আমার, তুই তো মায়ের ভালো বাচ্চা। ওরা মিছেই তোকে নিয়ে বাজে কথা বলে। তুই কারো ক্ষতির কারণ হতে পারিসই না। ঈশ্বরের আশীর্বাদ যে তুই।”

“ইসাবেলা!” একটু দূরে ড্যামিয়ানের চিৎকার শুনে উঠে দাঁড়ায় ইসাবেলা। আবার সামনের ঝোপঝাড় সরিয়ে এগিয়ে যায়। হাঁটতে হাঁটতে এসে থামল পাহাড়ের চূড়ায়। সামনে গভীর খাদ। এখানে থাকা নিরাপদ নয়। ইসাবেলা ঘুরে দাঁড়ায় জঙ্গলের দিকে। কিন্তু হায়! সামনে যে বিপদ স্বয়ং ক্ষুব্ধ মুখে দাঁড়িয়ে আছে।

“ভেবেছিলি পালিয়ে বাঁচবি? বোকা মেয়ে, তোর পরীক্ষা নিচ্ছিলাম তো আমি। ড্যামিয়ান ছুরি ফেলে রেখে গেছে। এই সুযোগ! ওকে শেষ করে পালিয়ে যাব। সাপও মরবে লাঠিও বেঁচে যাবে। আহ! বেচারী! সাপ মরেনি আর লাঠিটিও অর্থাৎ তোর সন্তানও বাঁচবে না।”

ড্যামিয়ান এগিয়ে এলো। ওর বুকে কোনো আঘাতের চিহ্নই নেই। ইসাবেলা এর কারণ উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়। পিছিয়ে যায় সভয়ে। এত শ্রম ওর শরীর নিতে পারছে না। চোখের সামনে ঝাপসা, মাথা ঘুরে উঠছে। অবসন্নতায় ভেঙে পড়ছে হাঁটু।

“আমাদের বাঁচতে দাও ড্যামিয়ান, ছেড়ে দাও আমাকে।” অনুনয় করে বলল ইসাবেলা। ও আর জোর পাচ্ছে না কোনোভাবে। ড্যামিয়ান হাসল ওর অসহায়ত্বে। তারপর মুখ ভার করে বলল,

“আমিও তো চাই তুমি বাঁচো বেবিগার্ল। কিন্তু ওই অনাগত শিশুটি তা তো হতে দেবে না। ও তোমার কী দশা করেছে দেখেছ? আমি তোমার ভালো চাইছি বলেই বলছি, শেষ করতে দাও ওকে। ও তোমার ভেতর থেকে গেলেই তুমি আবার আগের মতো হয়ে যাবে। নয়তো মরে যাবে। মেরে ফেলবে ও তোমাকে।”

“তুমি কিছু জানো না। সন্তান মায়ের মৃত্যুর কারণ হয় না।”

“হয়, হয়।” ড্যামিয়ান চেঁচিয়ে ওঠে। মনে মনে বলল,”আমি নিজেই তো আমার মায়ের মৃত্যুর কারণ হয়েছি। জেনেশুনে তোমাকে মরতে দেবো না। তুমি ছাড়া আমি যে কিছুই না।”

ইসাবেলা ওকে বুঝানোর চেষ্টা করে। ড্যামিয়ান বোঝে না। ফেলে দেয় ঘাসের ওপর ইসাবেলাকে। জোর করে ওর পেটের কাপড় সরিয়ে খামচে ধরে পেটটা।

“না, না। দোহাই আমার সন্তানকে ছেড়ে দাও ড্যামিয়ান। আমি সত্যি সত্যি তোমার হয়ে যাব। বিশ্বাস করো আমাকে। বাঁচতে দাও আমার সন্তানকে। চিরজীবন তোমার দাসী হয়ে থাকব আমি। দয়া করো।”

“দাসী তো আমার হয়েই আছো। ওই তো তোমার অনামিকার আংটিটি সাক্ষী তার। কিন্তু এই শিশুটিকে আমি বাঁচতে দিতে পারব না। ও আমার এবং আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। ওকে মরতেই হবে।”

ড্যামিয়ান জোর করে ইসাবেলার মুখে কিছু গুঁজে দেয়। গিলতে বাধ্য করে। একটু পর ইসাবেলা শরীরে অনুভূতিবোধ টের পায় না। অবশ সব যেন।

“একটুও ব্যথা পাবে না তুমি বেবিগার্ল। বুঝতেই পারবে না কখন ওই আপদকে তোমার ভেতর থেকে দূর করে ফেলব।” বললো ড্যামিয়ান।

ইসাবেলা সত্যি কিছু টের পায় না। কিন্তু সজল ঝাপসা চোখে দেখতে পায় ড্যামিয়ান ওর পেট ছেদন করে রক্তাক্ত কিছু বের করে আনে। ওর সন্তান! ড্যামিয়ান সত্যি ওকে মেরে ফেললো!

ইসাবেলার পেট সেলাই করে জড়িবুটি বেঁধে দিতে রক্তক্ষরণ বন্ধ হলো। ও চেতন না অচেতন বুঝতে পারল না ড্যামিয়ান। পাশেই গর্ভফুলের ভেতর শিশুটি। পাঁচমাসেই যেন পূর্ণ বিকাশ ঘটেছে ওর। কিঞ্চিৎ নড়েচড়ে উঠছে ফুলের মধ্যে। আলগোছে হাতে তুলে নেয় গর্ভফুল। হার্টবিট দ্রুতবেগে চলছে শিশুটির। ড্যামিয়ান ভালো করে দেখল। একটা মেয়ে শিশু! মনে মনে হাসল। এই তুচ্ছ মেয়ে শিশু ওর সর্বনাশ করবে! হাঁটতে হাঁটতে পাহাড়ের কিনারে এসে থামে। গর্ভফুলসহ শিশুটিকে শূন্যে তুলে ধরে। এখান থেকে ফেললে ওর চিহ্ন থাকবে না। সব ঝামেলার অবসান ঘটবে। কিন্তু আচমকা একটা অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে গেল। গর্ভফুলের মাঝে চোখ মেলে তাকায় শিশুটি। একজোড়া নীল চোখ। ড্যামিয়ানের কঠিন, নির্মম হৃদয় মুহূর্তে নমনীয় হয়। মায়ায় ফেলে দেয় শিশুটির চাহনি। ওর পাপী মন কাঁপিয়ে দেয়। একে তো ড্যামিয়ান মারতে পারবে না, কিছুতেই না। গর্ভফুল হাতে ঘুরতে ইসাবেলার মুখোমুখি হয়। আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে ওর চোখ দিয়ে। হাতে সেই রক্তাক্ত ছোরা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বুকের বসিয়ে দেয় সেটা। ড্যামিয়ান বেসামাল হয়ে পা পিছলে পড়ে গেল পাহাড় থেকে। কিন্তু তার আগে ছো মেরে গর্ভফুলটি নিজের কাছে নিয়ে নিলো ইসাবেলা। ড্যামিয়ান একেবারে নিচে পড়েনি। পাহাড়ের গা ধরে ঝুলে আছে। উঠতে চেষ্টা করল। ইসাবেলা হাতে আঘাত করে। ড্যামিয়ান বলল,

“বেবিগার্ল, আমি তোমার সন্তানকে মারব না। প্লীজ উঠতে দাও আমাকে।”

ইসাবেলা বিশ্বাস করে না। আরও আঘাত করে। ড্যামিয়ানের হাতের শক্তি দুর্বল হয়ে আসে। ভয় দেখিয়ে, অনুনয় করেও ইসাবেলার মন গলাতে পারে না। ঠেলে সরিয়ে দিতে লাগল পাহাড়ের গা থেকে ওকে।

“তোর মতো শয়তানের এই পৃথিবীতে কোনো প্রয়োজন নেই। আমার সব কেঁড়ে নিয়েছিস তুই৷ তোকে সাবধান করেছিলাম,আমলে নিসনি। তুই পিশাচ থেকেও নিকৃষ্ট। তোকে মারলে পাপ নেই। মর তুই।”

পা দিয়ে ড্যামিয়ানের বুকে লাথি দিয়ে ফেলে দিলো। প্রচন্ড আর্তচিৎকার করতে করতে গভীর খাদে হারিয়ে যায় ড্যামিয়ান। ইসাবেলা অনামিকার আংটিটি খুলে ছুঁড়ে ফেলল খাদে। তারপর ঘাসের ওপর নেতিয়ে পড়ে। পেটের সেলাই ছিঁড়ে রক্ত পড়ছে। হাঁটু ভিজে গেছে রক্তে। ইসাবেলার চোখ যায় গর্ভফুলের ভেতর শিশুটির দিকে। দু’হাতে তুলে বুকে টেনে আনল। ও কী বেঁচে আছে? নড়াচড়া করছে না কেন? কেঁদে ওঠে ইসাবেলা।

“ইসাবেলা!”

চমকে তাকায় সামনে ইসাবেলা। আগাথা দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর পাশে আন্দ্রেই। ইসাবেলা আহাজারি করে উঠল। ওর অপরাধী মুখ যেন বলে,

“আগাথা, আমার সন্তান আর নেই। আমি কাওকে ধরে রাখতে পারলাম না। তোমাকে দেওয়া ওয়াদা ভেঙে যে পাপ করেছি প্রভু খুব করে তার শাস্তি দিলেন। আমি আজ রিক্ত আগাথা।”

আগাথা কঠিন মুখে চেয়ে রইলেন। আন্দ্রেইর দিকে তাকায় ইসাবেলা।

“তুমি ঠিক ছিলে আন্দ্রেই। সেদিন তোমার কথা শুনলে নিকোলাস অন্তত বেঁচে থাকত। সন্তানহারা হতে হতো না আমাকে। আমাকে শাস্তি দাও। মেরে ফেলো তোমরা।”

আন্দ্রেইর মনে আজ রাগ নেই। সহানুভূতি জেগে ওঠে ইসাবেলার জন্য। ওর কান্না আহত করে। এমনটা ও কোনোদিন চায়নি। ভাই ত্যাগের ব্যথা থেকে হারানোর ব্যথা প্রবল। অপরাধবোধ, শোক ওকে স্তব্ধ করে দেয়। আগাথা এগিয়ে গেলেন। তাকালেন গর্ভফুলের দিকে। দুহাত মেলতে গর্ভফুল শূন্যে ভেসে ওঠে। ইসাবেলা ধরতে যায়,

“হাত বাড়িয়ো না ইসাবেলা। সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখতে চাও তো ছোঁবে না।”

বেঁচে আছে তবে ওর সন্তান! বেঁচে থাক। বেঁচে থাক। হাত গুটিয়ে নেয় ইসাবেলা।

“ও যে আমার নাড়ি ছেঁড়া ধন। মা হয়ে একটু ছুঁতে পারব না? এমন কঠোর হয়ো না আগাথা।”

আগাথা নিজের হাতে নিলেন গর্ভফুল। নাতনির দিকে তাকিয়ে তাঁর আনন্দ ধরে না। কষ্টও হয়। নিকোলাস মেয়ের মুখটা দেখতে পেল না। সব দোষ এই ইসাবেলার। ওর স্বার্থপরতায় বলি হতে হয়েছে নিকোলাসকে। এখন তাঁর নাতনি মৃত্যু পথে ধাবিত হচ্ছে। দাদি হয়ে তাই কী সহ্য করবেন?

“নাড়িছেঁড়া ধন? আজ বুঝলে আপন সন্তান কোলছাড়া হলে কেমন লাগে? স্বার্থপর মেয়ে! এই শিশু তুমি কোনোদিন কাছে পাবে না। ভেবেছিলাম তুমি আমার বংশ রক্ষা করবে। শাপমোচন করবে আমার সন্তানদের। মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে ঠকিয়েছ আমাকে তুমি। নিকোলাসের ভালোবাসা পেয়ে আমাকে দেওয়া ওয়াদা ভুলে গেলে! লোভী! তোমার মতো লোভী, স্বার্থপরের কাছে আমার বংশের শেষ চিহ্ন আমি রাখব না।”

“না, আগাথা। ক্ষমা করো আমাকে। আমার পাপের শাস্তি ওইটুকু শিশুর ওপর তুলো না।”

আগাথা উপেক্ষা করে ওর আকুতি। এত সহজে ইসাবেলাকে ক্ষমা করবেন না তিনি।

“চলো আন্দ্রেই। এখানে সময় নষ্ট করো না।”

“আগাথা মা, ইসাবেলাকে এই অবস্থায় ফেলে গেলে বাঁচবে না ও।”

“মরুক!” কথাটা বলতেই জিহবা কামড়ে ধরে আগাথা। কিন্তু ইসাবেলা শুনতে পায়। ব্যথিত মুখ করে বলে,

“তাই হোক। কিন্তু আমার সন্তানকে বাঁচিয়ো তুমি আগাথা। ও যতটা আমার তোমারও তো কম নয়। তোমার কাছে যদি নিরাপদে থাকে, তবে থাক।”

অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ইসাবেলা মুমূর্ষুপ্রায়। গলার সাথে সাথে প্রাণটাও যেন শুকিয়ে এলো। শূন্য সিক্ত চাহনির সামনে আঁধার নামে। শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। ঘোর লাগে। এত ব্যথা, এত নিরাশা মধুর হয় নিকোলাসের মুখখানা কল্পনায় ভেসে উঠতে। বিড়বিড় করে বলল,

“আমার কল্পনা ছেড়ে বাহুডোরে ধরা দাও নিকোলাস। একটু ছুঁয়ে দেখি, একটু অনুভব করি। আর যে তুমিহীন চলে না আমার। একটুও চলে না।”

চলবে,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে