তিমিরে ফোটা গোলাপ পর্ব-২৩+২৪+২৫

0
759

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব-২৩
Writer Taniya Sheikh

রাত্রির প্রায় শেষ প্রহর। নিকোলাস বসে আছে ইসাবেলার শিওরে। মেজাজ চরম খারাপ ওর। ইসাবেলার অচেতন মুখপানে চেয়ে রাগটা অবশ্য গলে গলে যাচ্ছে। এই মেয়ে জানেওনা নিকোলাসের ওপর কতটা প্রভাব ফেলেছে সে। সেই যে প্রথমবার ঝিলের পাড়ে ইসাবেলাকে দেখেছিল। নগ্ন দেহে একটু একটু করে ডুবছিল ওর শরীর। কুয়াশা চাদর হয়ে জড়িয়ে রেখেছিল চারপাশ। মুখশ্রী ছিল ঠাণ্ডার দাপটে গোধূলির লালিমা। প্রচণ্ড কাঁপছিল ওর গোলাপি ঠোঁটদুটো। যখন ডুব দিয়ে মাথা তুলল, ভেজা চুল গোলাপ রাঙা বুকে লেপটে ছিল। মনে হয়েছিল যেন গ্রিক দেবী আফ্রোদিতি নেমে এসেছে ধরার জলে। সেই প্রথমবার হৃদয় সমুদ্রে উত্তাল ঢেউ ওঠে। বুকের বা’পাশ শব্দ করে উঠেছিল নিকোলাসের। শ্বাস প্রশ্বাসের গতি অস্বাভাবিক হয়। ইসাবেলা তাকে আকৃষ্ট করেছিল সেদিন। ভেবেছিল তা হয়তো কেবল ওর রক্তের তৃষ্ণার জন্য। রক্ত পানের পর মোহটা কেটে যাবে। হলো উলটো। প্রথমদিনের পর ওর রক্তের স্বাদ কিছুতেই ভুলতে পারল না। শুধু কি রক্ত? ইসাবেলার চাহনি, বিমর্ষ মুখ সর্বক্ষণ ভাবনায় স্থান করে নেয়। এমনটা হয়নি পূর্বে। মেয়েটার প্রতি আলাদা রকমের টান অনুভব করেছে। ইতঃপূর্বে যা কারো প্রতি হয়নি। এমনকি নিকোলাসের জোড়া যে মেয়েটি ছিল তার প্রতিও এমন কিছু অনুভব করেনি। মার্গারেটের সাথে দেখা প্রায় দশ বছর পূর্বে। সোনালি চুল, সুশ্রী মুখবয়বের মার্গারেট নিকোলাসকে প্রচণ্ড ভালোবাসত। ভালোবেসে স্বেচ্ছায় নেকড়ে থেকে ভ্যাম্পায়ার হয়েছিল। ছায়ার মতো অনুসরণ করত নিকোলাসকে। ওর ওপর আসা বিপদের সামনে আগে দাঁড়াত। নিকোলাসের নিঃসঙ্গ জীবনে মার্গারেট সঙ্গী হয়ে এসেছিল। তেমন করে ভালো না বাসলেও বেশ পছন্দ করেছিল জোড়াকে নিকোলাস। ভালোই যাচ্ছিল ওদের সম্পর্ক। কিন্তু ফাদার জালোনভ মার্গারেটকে কেড়ে নিলো নিকোলাসের জীবন থেকে। মেরে ফেলল ওরা ওকে। মাদামের বাড়িতে ইসাবেলার সাথে ভ্যালেরিয়ার সম্পর্ক জানতে পেরে বেজায় খুশি হয়েছিল। সিদ্ধান্ত নিয়েছিল শেষ করবে এই মেয়েকে। প্রতিশোধ নেবে মার্গারেটের মৃত্যুর। কিন্তু পারেনি নিকোলাস। ইসাবেলার নিষ্পাপ চেহারা তার ভেতরের পিশাচটাকে হারিয়ে দেয়। একেবারে মারা হয় না আর। নিজের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে মাদামের বাড়ি ছেড়েছিল। ফেরার আগে মাদামকে বশিভূত করে ইসাবেলার ক্ষতির শেষ চেষ্টা করে। যা প্রত্যক্ষভাবে পারেনি, পরোক্ষভাবে পারতে চেয়েছিল। সেখানেও ব্যর্থ হয়। পুনরায় ওকে দেখে অবাক হয়েছিল সেদিন। এই মেয়ে একবার নয় দু দু বার চড় মেরেছে, অসম্মান করেছে। যা অন্য কেউ করার দুঃসাহস পর্যন্ত দেখায় না। দেখালে জীবিত থাকে না আর। অথচ, নিকোলাস এই মেয়েকে কিছুই বলেনি। স্রেফ নির্বোধ বলে উপহাস করেছে। যখন মনে হয়েছে মেয়েটা তার মধ্যে অদ্ভুত অজানা এক অনুভূতির জন্ম দিচ্ছে, সতর্ক হয়ে যায়। ওর রক্তের নেশা ছেড়ে ওর থেকে দূরত্ব পর্যন্ত গড়ে। আন্দ্রেইর সুস্থ হওয়ার অপেক্ষায় দিন কাটতে লাগল। ভেবেছিল আন্দ্রেই সুস্থ হলেই মেয়েটাকে ওর হাতে তুলে দেবে। তারপর যা ইচ্ছে হোক। কিন্তু যখন প্রাসাদ ছেড়ে পালিয়ে গেল, রেগে যায় নিকোলাস। ইসাবেলা তাকে আগুনে পুড়িয়ে শেষ করতে চেয়েছিল। বোকা মেয়ে জানে না নিকোলাসকে আগুনে পুড়িয়ে মারা যায় না। কিন্তু ওর স্পর্ধা দেখে ক্ষিপ্ত হয় নিকোলাস। পণ করে এবার এই মেয়েকে হত্যা করবেই করবে। সেই পণ মুহূর্তে ভেঙে গেল যখন ইসাবেলাকে কর্নেলার পতিতালয়ে অসহায় অবস্থায় আবিষ্কার করে। ওর ভেতরের শয়তানটা ভীষণ খুশি হয়েছিল। বলেছিল বেশ হয়েছে। এবার জীবনভর পতিতালয়ের কর্দমাক্ত খোয়ারে বন্দি থাক। লাগুক কলঙ্কের চন্দন ললাটে। কটাক্ষ করেছিল ইসাবেলাকে। তারপর নিজের প্রয়োজনে কর্নেলার পাঠানো মেয়েটার সাথে একান্তে রুমে গিয়ে বসে। মার্গারেটের মৃত্যুর পর এখানে ওর প্রায়ই আসা হয়। কর্নেলা ওর সত্যিটা জানে। এমন অনেকেই জানে। তারা স্বার্থসিদ্ধি জন্য নিকোলাসের সত্যি গোপন রেখেছে। একটা গোপন চুক্তি আছে তাদের মধ্যে। প্রয়োজন পরস্পরকে সাহায্য করে তারা। সেদিন কর্নেলার পাঠানো মেয়েটার রক্ত পান করলেও দৈহিকভাবে মিলিত হতে পারেনি। কীভাবে পারবে? ইসাবেলার ভাবনা তাড়া করে ফিরছিল। সুতরাং রাগে হিস হিস করতে করতে বেরিয়ে যায় সেখান থেকে। এই মেয়েটার কারণে গত কয়েক মাসে কোনো মেয়ের সাথে একান্তে সময় উপভোগ করতে পারেনি। আর না পেরেছে বার বার চেষ্টার পরও ওকে মারতে। শেষবার নোভা এসে বাঁচিয়ে দিলো। ওরা কী ভেবেছে? নিকোলাস বোকা? বোঝেনি ওদের অভিনয়? এই তুচ্ছ মানবীকে বাঁচাতে নোভার ওমন আচরণ যারপরনাই আশ্চর্য করেছে। কিন্তু চুপ করে ছিল। যেন কিছুই বোঝেনি। ইসাবেলার কাছ থেকে যত দূরে সরতে চেয়েছে ততই মুখোমুখি হয়েছে। ও যখন কথা বলা বন্ধ করেছে, নিকোলাসের খারাপ লেগেছে। কেন লেগেছে তার কারণ অনুসন্ধান করেও পায়নি। ইসাবেলাকে কাঁদতে দেখে উপেক্ষা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। সান্ত্বনা দেওয়া, মিষ্টি কথা বলে সমবেদনা জানানো এসব নিকোলাসের দ্বারা অসম্ভব। তবুও সে গিয়েছিল ওর কাছে। জিজ্ঞেস করেছিল কী হয়েছে। জবাব দেওয়া দূরের কথা উলটো রাগত চোখে চেয়েছিল। নিকোলাস ভালো করেই জানে ইসাবেলা তাকে ঘৃণা করে। সুযোগ পেলে তাকে শেষ করতে ওর হাত কাঁপবে না। এত কিছু জানার পরও ইসাবেলাকে সে বাঁচিয়ে রেখেছে। কমিউনিটির পিশাচেরা ইসাবেলার রক্তের গন্ধে সর্বক্ষণ আশপাশে ঘুরঘুর করে। নিকোলাসের ভয়ে ঘাপটি মেরে আছে। ইভারলির পরিণতিতে আরো সতর্ক হয়েছে সকলে। ওকে শাস্তি দিয়েছে কেবলমাত্র ইসাবেলাকে অশোভনভাবে স্পর্শ করার জন্য। ইসাবেলাকে কেউ অশোভন স্পর্শ করলে একদম সহ্য করতে পারে না। ওই যে পেটমোটা লোকটা স্পর্শ করেছিল, তার দেহ ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছে নিকোলাস। পরে অবশ্য এ নিয়ে বেজায় নাখোশ হয়েছে। মনকে এই বলে বুঝ দিয়েছে যে, পলের অনুরোধ রক্ষার্থে ওকে বাঁচিয়েছে। তাছাড়া আর কী? ইসাবেলা মরুক বাঁচুক তাতে ওর কিছু এসে যায় না। তবে এ কথা ঠিক ইসাবেলার কারণে সে বার বার ভুল করছে, ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ব্যাপারটা রিচার্ডের নজরে পড়েছে। নাখোশ হয়ে আছে সে। নিকোলাস ক্ষমতার দেয়াল দিয়ে ইসাবেলাকে নিরাপদে রেখেছিল। যদিও একথা বাহ্যিকভাবে স্বীকার করবে না। স্বীকার না করলেও এই নিয়ে কমিউনিটির সকলে মনঃক্ষুণ্ন। নিকোলাস রাজা হওয়াতে চেপে আছে সেটা। রিচার্ড বার বার সাবধান করছেন। জোর করছেন ওকে মেরে ফেলতে। নিকোলাস চুপচাপ সেসব এড়িয়ে গেছে। বোনকে উপহার দেওয়া দাসীর নিরাপত্তা দিয়েছে। এ ছাড়া আর কিছু নয়। রিচার্ড ছেলের মনগত জটিলতা আন্দাজ করেছেন। ছেলের ওপর এখন আর প্রভাব খাটাতে না পারলেও মেয়ের ওপর পারেন। বাবা, সৎমা আর বাকিদের কথার তিরস্কার সহ্য করতে না পেরে শেষমেশ ইসাবেলাকে পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় নোভা। নিকোলাসকে জানিয়েছিল। জবাবে সম্মতি জানিয়েছে সে। সব সমস্যার মূলে ইসাবেলা। ওকে তাই দূরে সরিয়ে দেওয়ায় সঠিক বলে মনে করে। রিচার্ড খুশি হয়। নিকোলাসও। এই মেয়ের প্রতি অদ্ভুত অজানা অনুভূতিটাকে কিছুতেই প্রশ্রয় দেবে না সে। পিশাচদের এসব অনুভূতি থাকা উচিত নয়। সামান্য একটা মেয়ে মানুষের প্রতি মন কেন দূর্বল হবে? মনকে শক্ত করে। সে যোদ্ধা। কোনো যুদ্ধে হার মানবে না। হোক না তা মনের বিরুদ্ধেই। নোভা যখন এসে জানালো ইসাবেলা ফিরে গেছে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে নীরবে। কিন্তু মনটা খুশি হয়নি। একটা নিগূঢ় শূন্যতা জেঁকে বসেছিল। সেটাকে ঠেলে সরাতেই গ্যাব্রিয়েল্লাকে কাছে টেনেছে। স্থানীয় মন্ত্রীর সুন্দরী যুবতি মেয়ে গ্যাব্রিয়েল্লা। নিকোলাসের সত্যিটা জানার পরও সে রাজি হয়েছে বিছানা সঙ্গী হতে। শুধু গ্যাব্রিয়েল্লা কেন? যে কোনো মেয়ে ওর সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসবে। ওকে পেতে মৃত্যুকেও গলার হার করে নেবে সানন্দে। গ্যাব্রিয়েল্লা বুকের কাপড় খুলে বসল ওর সামনে। ঝুঁকে চুমু খেতে চায় ঠোঁটে। এই একটা জিনিসে প্রচন্ড আপত্তি নিকোলাসের। যাকে তাকে চুমু খাবে না। শেষবার হয়তো মার্গারেটকে চুমু খেয়েছিল। তারপর আর কাওকে হয়তো,, থেমে গেল ভাবনা। দাঁতে দাঁত পিষল। আবার সেই ইসাবেলার ভাবনা! গ্যাব্রিয়েল্লার কাঁধ টেনে শ্বদন্ত বসিয়ে দেয়। একটু ব্যথা পেলেও প্রকাশ করে না মেয়েটা। নিকোলাসকে প্রলুব্ধ করতে শীৎকার করতে লাগল। ঘনিষ্ঠ হয়ে জড়িয়ে ধরে। নিকোলাসের সহচরী হতে আগ্রহী সে। মেয়েটাকে পছন্দ হলো নিকোলাসের। ইসাবেলার ভাবনা দূরীকরণে এই মেয়েটিই বেস্ট অপশন। দু’হাতে কাছে টেনে নিয়েছিল। ভেবেছিল এবার ইসাবেলার ভাবনা তাকে আর বিরক্ত করবে না। নির্বিঘ্নে গ্যাব্রিয়েল্লার সাথে রাতটা একান্তে কাটবে। বিধিবাম, স্বয়ং ইসাবেলা এসে হাজির হলো ওর সামনে। নিজের চোখকে প্রথমে বিশ্বাস হয়নি। ভ্রম ভেবেছিল। ভ্রম হলে সে একা দেখত, গ্যাব্রিয়েল্লা দেখবে কেন? বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়ায়। ডাকে। জবাব নেই। কাছাকাছি দাঁড়াতে জ্ঞান হারায় ইসাবেলা। মহা বিরক্ত নিকোলাস। এই মেয়ে কথায় কথায় জ্ঞান হারায় কেন? নিশ্চয়ই তাকে বেকায়দায় ফেলতে। স্মৃতির ঘোর কাটল দরজা খোলার শব্দে।

“ইসাবেল!”

দরজা ঠেলে নোভা প্রবেশ করে। উদ্বিগ্ন হয়ে বসল ইসাবেলার শিওরের অন্যপাশে। নিকোলাস কিছুতেই বুঝতে পারে না পিশাচদের ওপর এই মেয়ের এত প্রভাব কেন? প্রথমে সে তারপর নোভা এমনকি আন্দ্রেইও এই মেয়ের প্রতি মায়া দেখিয়েছে। নিশ্চয়ই জাদু টোনা জানে এই মেয়ে। হ্যাঁ, তাই হবে। যত দ্রুত সম্ভব একে দূরে পাঠাতে হবে। এত দূরে যেখান থেকে ওর ভাবনাও নিকোলাসকে স্পর্শ করবে না।

“কী হয়েছে ওর? ”

“আমাকে কেন প্রশ্ন করছ? ওকেই জিজ্ঞেস করো।”

“ও তো অচেতন।”

“চেতনা ফেরাও।”

নিকোলাস রাশভারি মুখে উঠে দাঁড়ায়। গ্যাব্রিয়েল্লাকে জোর করে বিদায় দিয়েছে। রাগ করেছে সে। ওর রাগ ভাঙাতে এক মিনিট সময় লাগবে না নিকোলাসের। চোয়ালে আঙুল ঘষতে ঘষতে মুচকি হাসল। নোভা পানি এনে ইসাবেলার চোখে মুখে ছিটা দেয়। পিটপিট করে চোখ মেলতে নিকোলাসের মুখ দেখল প্রথমে৷ নিকোলাসের মুচকি হাসি দপ করে নিভে গেল। চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। পৃথিবীতে এত এত মেয়েলোক থাকতে এই মেয়ের চাহনি কেন হৃদয় সমুদ্র উত্তাল করে? পারলে হৃদয়টাকে খামচে বের করে আনত এক্ষুনি। বিদ্রোহী, বেঈমান হৃদয়। অপছন্দ করে এই মেয়েকে নিকোলাস। ভীষণ অপছন্দ করে। নিকোলাসের কুপিত দৃষ্টি দেখে বিস্ফোরিত হয়ে গেল ইসাবেলার চোখ দুটো। বড়োসড়ো একটা ঢোক গিলে চোখ ফের বন্ধ করে ফেলল।

“ইসাবেল”

নোভার হাত গালে পড়তে চমকে তাকায়।জোরপূর্বক হেসে অস্ফুটে বলল,

“নোভা।”

“ঠিক আছো তুমি?”

হ্যাঁ বোধক মাথায় নাড়ায় আস্তে করে। চোখের কোণা দিয়ে নিকোলাসকে দেখছে। মনে মনে প্রার্থনা করছে ও যেন এখান থেকে চলে যায়। সব প্রার্থনা কবুল হয় না। এটাও তেমন। নোভা ওকে বসতে সাহায্য করে। তারপর বলল,

“পল আমাকে সবটা বলেছে। আমি খুব রেগে আছি ইসাবেল। কেন ফিরেছ আবার? বলেছিলাম না চলে যেতে?”

ধমকের সুরে কথা শেষ করল নোভা। ইসাবেলা এবার কী বলবে? আগাথাকে স্মরণ করেও লাভ হলো না। ওই তো দূরে তাঁর প্রেতাত্মা দাঁড়িয়ে। বেশ ফাঁসিয়েছে তাকে। পথ না পেয়ে ঠোঁট উলটে কেঁদে দিলো। নোভা যত প্রশ্ন করে ও তত জোরে কাঁদে। নিকোলাস দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ দেখছিল। একপর্যায়ে রেগে ধমকে উঠল।

“চুপ, একদম চুপ।”

নোভা এবং ইসাবেলা চমকে উঠল। ইসাবেলার বুক ঢিপঢিপ করছে। হাত পা বুঝি ঠাণ্ডা হয়ে এলো।

“অনেকক্ষণ ধরে দুজনের নাটক দেখছি আমি। একজন প্রশ্ন করছে আরেকজন ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছে। নোভা, তুই বলেছিলে ওকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিস। ও এখানে কেন তাহলে?”

“সেটাই তো জানতে চাচ্ছি। কেন ফিরেছ ইসাবেল? জবাব দাও?”

ইসাবেলা ঠোঁট উলটে কাঁদতে যাবে তখনই নিকোলাসের হাত ওর গলায় এসে থামে। খুব জোরে নয়। মৃদুভাবে চেপে ধরে ওর গলা।

“আরেকবার ভ্যা করবে তো এখনই শেষ করে ফেলব। বলো কেন ফিরেছ?”

কাঁদবে তো দূরের কথা দম ফেলতেই ভুলে গেল ইসাবেলা। নিকোলাসের হাতের আঙুল গলায় মৃদু চাপ দিতে ঠোঁট দু’টো ঈষৎ ফাঁকা হয়ে গেল। নিকোলাসের অগ্নিদৃষ্টিতে এবার ভিন্ন কিছু জেগে ওঠে। ইসাবেলার ঠোঁটে স্থির হয় মনোযোগ।

“বড়োভাই?”

নোভার উদ্বিগ্ন গলার স্বরে হুঁশ ফেরে নিকোলাসের। মাথা ঝাঁকিয়ে হালকা গলা ঝেড়ে বলল,

“কালই আবার ফেরত পাঠাবি এই আপদটাকে। কাল মানে কাল নোভা। এর এক সেকেন্ড এদিক ওদিক হলে খুব খারাপ হয়ে যাবে।”

ইসাবেলার গলা ছেড়ে দরজার দিকে পা বাড়ায়। জোরে শ্বাস ছেড়ে গলায় হাত বুলিয়ে ইসাবেলা সেদিকে তাকিয়ে রেগে বিড়বিড় করে বলে,

“ব্লাডি ব্লাড সাকার।”

কথাটা ঠিক বিড়বিড় করা হয়নি। বেশ জোরেই বলে ফেলেছে অসতর্কে। নোভা বড়ো বড়ো চোখ করে তাকায় ওর দিকে। নিকোলাসের পা থেমে গেছে। ঘুরে দাঁড়ায়।

“কী বলেছ তুমি?”

ইসাবেলা ঠোঁটে হাত ঢেকে মাথা ঝাঁকায়। নিকোলাস ওর দিকে আসতে এক লাফে নোভার পেছনে গিয়ে লুকাল।

“তোমার সাথে জরুরি কথা আছে নোভা। প্লিজ তোমার ভাইকে যেতে বলো।”

আস্তে আস্তে বললেও নিকোলাস শুনল সে কথা। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল ওর। এতই যখন ভয় ফিরে এসেছে কেন? নির্বোধ। নোভা ভাইয়ের দিকে অনুনয়ের চোখে তাকাল। ঘুরে দাঁড়ায় নিকোলাস। যেতে যেতে বলে,

“কাল দুপুরে ওকে যদি দেখেছি মনে রেখো নোভা, ওইদিনই ওর জীবনের শেষদিন।”

ইসাবেলা ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে আর মনে মনে বলে,

“তোর জীবনের শেষদিন না দেখে আমি মরব না না রে হারামজাদা।”

“ইসাবেল”

কোমরে হাত রেখে ঘুরে দাঁড়ায় নোভা। পল তাকে জানিয়েছে ইসাবেলা জোর করে আবার ফিরেছে এখানে। কিন্তু কেন? এত ভয় দেখালো, অপমান করল তারপরও কেন ফিরেছে? ও তো বাড়িই চলে যেতে চেয়েছিল। নোভা ওর সেই ইচ্ছে পূরণ করেছে।

“কেন ফিরেছ তুমি?”

“ক্ষমা চাইতে।”

“কী?”

“ও-ওই যে খরগোশ_”

নোভা হাত তুলে চুপ করিয়ে দেয়।

“আগেই বলেছি ক্ষমা চাওয়ার কিছু নেই। যা সত্যি তাই বলেছ। আবার কেন একই কথা বলছ?”

দাঁতে দাঁত কামড়ে বলল নোভা। ইসাবেলা আগাথাকে দেখছে। সে ইশারায় উৎসাহ দিচ্ছে এই টপিক চালিয়ে যেতে।

“নোভা প্লিজ!” ইসাবেলা কাতর গলায় বলল। নোভার হাতটা টেনে ধরে মাথা নুয়ে ফুঁপিয়ে বলল,

“আমাকে বাঁচিয়েছ তুমি। হতে পারো পরিস্থিতির বশে পিশাচ কিন্তু মনের দিক দিয়ে তুমি মানুষ। খুব ভালো মানুষ। ডাইনি নও। খরগোশটাকে ইচ্ছে করে খাওনি।”

“ইচ্ছে করে খেয়েছি ওটাকে আমি।”

“আমরা যেমন খিদে পেলে ভাত খাই, পিপাসা পেলে পানি পান করি। তুমিও তেমনি ক্ষুধাতৃষ্ণার তাড়নায় খরগোশটাকে খেয়েছ। এতে তোমার কোনো দোষ নেই। এটা তোমার শরীরবৃত্তীয় প্রবৃত্তি, চাহিদা। কিন্তু তখন রাগের মাথায় কথাটা আমি বুঝতে পারিনি। আমার মা বলেন উপকারীর উপকার স্বীকার করতে হয়। আমি উলটো তিরস্কার করেছি তোমাকে। অকৃতজ্ঞ আমি।”

ইসাবেলার চোখের পানি নোভার হাতের ওপর পড়ে। এই পানি মেকি কান্নার নয়। ইসাবেলা সত্যিই অনুতপ্ত। নোভা হাত ছাড়িয়ে বলল,

“হয়েছে, হয়েছে। যাও ক্ষমা করে দিয়েছি।” ইসাবেলা খুশি হয়। পরক্ষণেই খুশিটা ম্লান হলো। এত তাড়াতাড়ি ক্ষমা করলে এখানে থাকা হবে না যে। থাকতে না পারলে প্রতিশোধ নেবে কী করে? ভ্যালেরিয়ার শেষ কাজ এখন তো ওকেই সমাপ্ত করতে হবে। অদূরে মোরগ ডেকে উঠল। নোভা বলল,

“পলকে বলছি তোমাকে আবার ট্রেনে তুলে দিতে। ক্ষমা তো পেয়েছ এখন নিশ্চয়ই ফিরতে বাধা নেই?”

ইসাবেলা হ্যাঁ, না কিছু বলল না। নোভা জবাবের অপেক্ষা করে না। ভোর হওয়ার আগেই ফিরে গেল কফিনে। ইসাবেলা চিন্তিত মুখে বসল বিছানার ওপর। কীভাবে থাকবে এখানে? আগাথাও হাওয়া।

চলবে,,,

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব-২৪
Writer Taniya Sheikh

পল আসার আগে প্যালেস ছাড়ল ইসাবেলা। এছাড়া আর কোনো পথ ছিল না সামনে। পলের সামনে পড়লে তাকে ফিরতেই হতো আবার। চাইলেও আজ আর ফেরার ইচ্ছে নেই। সূর্যোদয় তখনও গগনের পূর্ব প্রান্তে পুরোপুরি জেগে ওঠেনি। জার্মানির প্রথম সূর্যোদয় হয় এই গরলিটজে। অসম্ভব সুন্দর সেই মুহূর্ত। নিইস নদীর পাড়ের নিরালায়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় দেখল ইসাবেলা। প্রত্যুষের স্নিগ্ধতা গরলিটজের বাতাসে। নরম তুলোর মতো বাতাস এসে গা ছুঁয়ে দিয়ে যায়। রোদ ভারি মিঠা লাগে। একাকী ভাবাবেশে আচ্ছন্ন হয়ে দিশাহীন পথ চলছে। বাড়ি ফিরবে না। তবে কোথায় যাবে? কোথায় থেকে ভ্যালেরিয়ার শেষ কাজ সমাপ্ত করবে? এসব ভাবতে ভাবতে বার্চ গাছের আড়ালে বসল। সামনে বইছে নিইসের শান্ত জলের ধারা৷ এই নদীটিকে কেন্দ্র করে হাজার বছর আগে গড়ে ওঠে গরলিটজ শহর। আশপাশের স্থাপত্যে লেগে আছে পুরাতন সেই শিল্প এবং ঐতিহ্যের ছোঁয়া। শহরটি একেবারে অপরিচিত ইসাবেলার কাছে। কারো সাথে কথা বলবে সে জো নেই। এখানকার ভাষা ওর অজানা। ভাবপ্রকাশের অন্যতম মাধ্যম ভাষা৷ ইশারা- ইঙ্গিতে কাওকে কতটুকই আর বুঝাতে পারবে। যদিওবা তা করত কিন্তু ওই গাঁয়ের বাজারে ঘটে যাওয়া দূর্ঘটনার পর এখানকার মানুষকে ওর বিশ্বাস নেই। একটু দূরে পাকা সড়ক। আশ্চর্যের ব্যাপার বেলা বাড়ার পরও রাস্তা বেশ ফাঁকা। খুব একটা লোক সমাগম দেখা গেল না। কোথাও একটা গম্ভীরতার রেশ টের পাওয়া যায়। মাঝেমাঝে দু একটা জার্মান সৈন্যবাহী জীপ দেখা গেল। শহরটা টহল দিচ্ছে ওরা। রোদের তাপ বাড়তেই ইসাবেলা উঠে পড়ে। ওদিকটা বার্চ আর পাইনবৃক্ষের সারি। একটু ছায়ায় গিয়ে বসল এবার। কাল থেকে না খাওয়া। পেটটা বড্ড জ্বালাচ্ছে। হাতে অর্থকড়ি কিছুই নেই। কিছু খেতে হলে অর্থ দরকার। বেলা বেড়ে দুপুর। অনাহারে ইসাবেলার শরীর দুর্বল। দু’হাতে পেট চেপে বার্চ গাছের তলে গা এলিয়ে বসে আছে। খিদে সহ্য করতে না পেরে একসময় উঠে দাঁড়ায়। রাস্তায় তখনও তেমন একটা লোকের দেখা নেই। টহলরত সৈন্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ডাউন টাউনের উঁচু দালানের গা ঘেঁষে এগোতে লাগল। ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় খারাপ কিছুর সংকেত দিচ্ছে। খিদে পেটে সেটা তেমন আমলে নিলো না। লুকিয়ে ও গরলিটজের বাইরে চলে এলো। সামনে দুটো রেস্তোরাঁ দেখা যাচ্ছে। কয়েকজন পুরুষ এবং মহিলাকেও দেখতে পেল। বা’দিকে কাঁচা বাজার। বেশ কয়েকজন নারী পুরুষের ভিড় সেখানেও। ইসাবেলা যাবে কি না ভাবতে লাগল। একসময় দ্বিধাবোধ কাটিয়ে পা বাড়ায়। আগাথার ওপর ভীষণ রাগ হচ্ছে। কেমন একলা আর অসহায় অবস্থায় ছেড়ে উধাও হলো! ভুল হয়েছে একজন প্রেতাত্মাকে বিশ্বাস করে। নোভা বলেছিল ওর মা পবিত্র আত্মা। এমন হয় পবিত্র আত্মা? মিথ্যা বলে, প্রতারণা করে! নিকোলাস এবং নোভার নিষেধ উপেক্ষা করে প্যালেসে থাকা অসম্ভব। ওদেরকে ও বিশ্বাস করে না। আগাথা যতই সান্ত্বনা দিয়ে বলুক, ওরা ইসাবেলাকে মারবে না। কেন যেন ইসাবেলা সেকথা মোটে বিশ্বাস করতে পারেনি। একবার ভেবেছিল ওই প্যালেসের কাছাকাছি কোথাও আত্মগোপন করে থাকবে। সেখানেও ভয় ছিল। ইসাবেলাকে খুঁজে পেতে সমস্যা হতো না ওদের। কিছুতেই ওদের মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি করতে চায় না ও। যে করেই হোক নিকোলাসদের সমূলে শেষ করতে হবে। কিন্তু কীভাবে ভ্যালেরিয়ার এই অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করবে? কীভাবে?

“আগাথা, কোথায় আপনি? আমি যে দিশেহারা হয়ে পড়েছি।”

বাজারের পাতলা ভিড়ের মধ্যে হাঁটছে। তারপর আবাসিক এলাকার পথে এগোতে লাগল। দুটো টমটম পাশ কেটে যায়। বাড়িগুলোর সামনে শিশুরা খেলছে। ইসাবেলাকে দেখে এক পলক তাকিয়ে আবার নিজেদের খেলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল ওরা। এভাবে উদভ্রান্তের ন্যায় হেঁটে আরো ক্লান্ত আর হতাশ হয়। সামনে একটা চার্চ দেখতে পেয়ে সেদিকে গেল। ভেতরে কেউ নেই। হাঁটু মুড়ে বসে প্রার্থনা করল ঈশ্বরের কাছে ইসাবেলা। তিনি যেন একটা পথ দেখিয়ে দেন ওকে। হঠাৎ বিকট আওয়াজে চমকে ওঠে। নড়ে উঠল চার্চটাও। বেরিয়ে এলো বাইরে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। একটু আগে যেখানে শিশুরা খেলছিল সেই আবাসিক স্থানটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে বোমা। শিশু কিংবা সেই দালান কিছুরই আর চিহ্ন নেই। ভগ্নস্তূপে পরিণত হয়েছে সামনেটা। ইসাবেলা যখন এক পা বাড়াল বোমার আঘাতে ধ্বংস হওয়া সেই আবাসিক এলাকার পথে তখনই আবার সেই বিকট শব্দ। এরপর কিছুক্ষণ ওর শ্রবণশক্তি কাজ করা বন্ধ করে দিলো। স্তব্ধ হলো সামনের সব। বাজার, রেস্তোরাঁ মুহূর্তে মৃত্যুপুরিতে পরিণত হয়েছে। এক হিটলারের স্বপ্ন পূরণ আর স্বেচ্ছাচারিতায় কেবল গরলিটজ নয় পুরো বিশ্বে বেজে উঠেছে যুদ্ধে দামামা। মরছে লক্ষ কোটি নিরীহ মানুষ। ইসাবেলা যুদ্ধের এই নির্মমতা সম্পর্কে একেবারে আড়ালে ছিল। রাশিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলের জীবনপ্রবাহে কিংবা নির্জনের ওই পরিত্যক্ত প্রাসাদের বন্দিত্বদশায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা কী করে জানবে? গরলিটজের আকাশে তখন ধোঁয়া আর মৃত্যু ক্রন্দনের হাহাকার। ইসাবেলা পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল। পা নড়ছে না। আকাশে যুদ্ধ বিমান উড়ে যাচ্ছে। একের পর এক গান ফায়ারিংএর শব্দ। লোকের হুলস্থুল লেগে গেল। আহত, অক্ষত সবাই প্রাণ বাঁচাতে ছুটছে এদিক ওদিক। সাজোয়া জার্মান সৈন্য ট্যাংক এদিকেই আসছে। ইসাবেলার হুঁশ ফিরল। দৌড়াতে লাগল উলটো দিকে। ও একা নয় সাথে আরো মানুষ। সকলে নিরাপদ স্থানের খোঁজে দৌড়াচ্ছে৷ সামনের এক সমতলের কাছাকাছি টানেলে গিয়ে লুকাল সকলে। আকাশে তখনও যুদ্ধ বিমানের ভয়ংকর গর্জন। এই মুহূর্তে খিদের কথা আর মনে নেই ইসাবেলার। ভাগ্যের ওপর ভীষণ ক্ষোভ জন্মাল। বারবার কেন সে বিপদের সামনে পড়ছে? একটা বিপদ না কাটতে আরেকটা এসে হাজির। দু’হাতে হাঁটু জড়িয়ে নীরবে কাঁদতে লাগল। ও একা কাঁদছে না। সাথে নারী, শিশুদের অনেকে কাঁদছে। বোমার আঘাতে আহতদের হাত, পা, শরীরের বিভিন্ন স্থান দিয়ে রক্ত পড়ছে৷ আত্মীয় পরিজন হারিয়ে কেউ কেউ বিলাপ করতে লাগল। সন্ধ্যা নামে বাইরে। যুদ্ধ বিমানের শব্দ আর শোনা যাচ্ছে না আকাশে। দু’একজন বেরিয়ে এলো টানেল ছেড়ে। তারপর আস্তে আস্তে বাকিরা। এদের সকলেই এই মুহূর্তে গৃহহারা। উদ্দেশ্যহীন গন্তব্যের পথে এগোতে লাগল। ইসাবেলা কোথায় যাবে ভেবে পায় না। একা একা হাঁটছে সমতলের ওপর।

“ইসাবেলা!”

“আগাথা!” পাশে আগাথার প্রেত্মাতা দেখে হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠল ইসাবেলা। চোখ ফেটে এলো জল। ওর সারা শরীরে কাঁদা ময়লা। আগাথা ওকে জড়িয়ে ধরল বুকে। সান্ত্বনা দিতে দিতে নিয়ে চলল সামনের বনমধ্যে। বেশ কিছু সময় পরে শান্ত হয় ইসাবেলা। আগাথা তাকে বলে এই ধ্বংসযজ্ঞের কারণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উত্তাপে পুড়ছে পুরো বিশ্ব। যার সামান্য নমুনা দেখেছে ইসাবেলা।

“এভাবে চললে তো পৃথিবীটা শেষ হয়ে যাবে।” বিমর্ষ মুখে বলল ইসাবেলা।

“ক্ষমতার লোভ বড়ো খারাপ জিনিস ইসাবেলা। এই লোভ একবার যার ভেতর ঢোকে সে বিকারগ্রস্ত হয়ে যায়। বিকারগ্রস্ত লোক ভালো আর খারাপের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না৷ ফলস্বরূপ আশপাশের সবটা বিনষ্ট করে সে। পৃথিবী এখন এমনই কিছু বিকারগ্রস্তের হাতে বন্দি। চিন্তা করো না। খারাপ যত ক্ষমতাবানই হোক না কেন তা অস্থায়ী। ভালোদিনের সূর্য একদিন উঠবেই আবার।”

আগাথার কথাতে কিছুক্ষণ গুম মেরে বসে রইল। চারিদিকে ঘুটঘুটে আঁধারে ছেয়ে গেছে। কোথা থেকে কয়েকটা শুকনো কাঠ আর পাথর এনে আগুন ধরালেন আগাথা। তারপর নিয়ে এলেন পাউরুটি, মুরগি পোড়া আর শ্যাম্পেইন।

“এসব পেলেন কোথায়?”

আগাথা মুচকি হাসলেন। বললেন,

“প্রেতাত্মাদের জন্য এসব যোগাড় করা ব্যাপার না।”

ইসাবেলা গপাগপ খেয়ে নিলো। পেটপুরে খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বলল,

“আপনি খাবেন না?” তারপর জিহ্বা কামড়ে বলল,

“আমি বারবার ভুলে যাই আপনি প্রেতাত্মা। প্রেতাত্মাদের তো ক্ষুধাতৃষ্ণা লাগে না। ঠিক বলেছি না?”

আগাথা মাথা নাড়ায়। শ্যাম্পেইনের দু’ঢোক গিলে ফের বোতলে মুখ লাগিয়ে হঠাৎ আনমনা হয়ে গেল। আগাথা খেয়াল করে।

“কী হলো আবার?”

“সারাদিনে দেখা দিলেন না কেন? আমি ভেবেছি আপনি আমাকে ধোঁকা দিয়েছেন। কী করব কিছুই ভেবে পাচ্ছিলাম না।” ঠোঁট ফুলিয়ে ফেলল। মনে পড়ল তখনকার স্মৃতি। বিষণ্নতায় ভরে ওঠে মুখ। আগাথা হাত বাড়িয়ে ওর থুতনি তুলে বলেন,

“ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পৃথিবীতে আগমন আমার জন্য নিষিদ্ধ ইসাবেলা। আমি অনুতপ্ত গতকাল ভোরে কিছু না বলেই চলে গিয়েছিলাম বলে। কিন্তু ভাবতে পারিনি তুমি সেখান থেকে বেরিয়ে আসবে বোকার মতো।”

শেষটায় গলার স্বর কঠিন হলো আগাথার। ইসাবেলা অনুযোগের সাথে বলল,

“তো কী করতাম? নিকোলাসের কথা শোনেননি? সকালে আমাকে দেখলে নির্ঘাৎ মেরে ফেলত।”

“ও তোমাকে মারত না।”

“আপনি কীভাবে সিওর?”

“আগেও বলেছি তোমাকে, আবার বলছি, আমি ওর মা। আমি জানি ও কী পারে আর না পারে।”

ইসাবেলা এবার চুপ হয়ে রইল। আগাথা বললেন,

“তুমি আমাকে বিশ্বাস করো না, না?”

আরো ঝুঁকে পড়ে ইসাবেলার মাথা। আগাথা গম্ভীর গলায় বললেন,

“আমার দিকে তাকাও ইসাবেলা।”

“একদিনের পরিচয়ে কাওকে বিশ্বাস করা সহজ কথা নয়।”

“তার মানে অবিশ্বাস করো আমাকে তুমি?”

“আমি তা বলিনি।”

“তা হলে কী বলতে চাইছ পরিষ্কার করো।”

“হুট করে আপনাকে বিশ্বাস করতে পারব না আমি। ধৈর্য ধরতে হবে আপনাকে। বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে হবে।”

আগাথা হাঁফ ছাড়লেন। দুজনে চুপচাপ বসে রইল। কাঠের আগুন প্রায় নিভে এসেছে। ঠাণ্ডা বাতাস বইতে শুরু করেছে। শীত শীত বোধ হয় ইসাবেলার। আরেকটু আগুনের নিকটে গিয়ে বসল। তারপর নীরবতা ভেঙে বলল,

“আমি এখন কোথায় থাকব?”

“নিকোলাসের প্যালেসে ছাড়া আবার কোথায়?”

“এবং সেটা কীভাবে সম্ভব?” বিদ্রুপের সাথে বলল ইসাবেলা।

“প্রেতাত্মার দ্বারা সব সম্ভব।” ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে উঠে দাঁড়ালেন আগাথা। ইসাবেলাও দাঁড়াল। ভুরু কুঁচকে তাকায়। আগাথা কিছু না বলেই সামনে এগোতে লাগলেন। পেছন পেছন ইসাবেলা। সে যতই বলুক আগাথাকে বিশ্বাস করে না, কিন্তু এটাও সত্য আগাথাকে না চাইতেও বিশ্বাস করতে হচ্ছে। উপায় যে নেই আর।

নিকোলাস জেগে উঠে নিঃশ্বাস টানল। না, ইসাবেলার শরীরের সেই ঘ্রাণ পেল না। এর অর্থ ইসাবেলা চলে গেছে প্যালেস ছেড়ে। বিক্ষিপ্ত এক অনুভূতির যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল মন। বিরক্ত হলো পিশাচ সত্ত্বা। গ্যাব্রিয়েল্লাকে খবর দিতে হবে। ইসাবেলার ভাবনা মাথা থেকে যে করেই হোক দূর করা চায়। পল’কে ডাকল। নত মাথা, আর্ত মুখে এসে দাঁড়ায় সে। নিকোলাস যে জন্য ডেকেছিল তা বলল না। বরং প্রশ্ন করল,

“বেলাকে পৌঁছে দিয়েছিস?”

বড়োসড় ঢোক গিলতে দেখল পল’কে। একটা অজানা শঙ্কা ঘিরে ধরে নিকোলাসের মনটাকে।

“পল!” চেঁচিয়ে উঠল একপ্রকার।

“সে পালিয়েছে।” ভীত কণ্ঠে বলল পল। নিকোলাস মুহূর্তে ওর গলা চেপে ধরে। ক্রোধাবিষ্ট চোখদুটো, শ্বদন্ত বেরিয়ে এসেছে লাল টুকুটুকে ঠোঁটের কোণ দিয়ে। পলের কলিজা শুকিয়ে এলো। সে ভয়ে ভয়ে বলল,

“আমি ঘরে গিয়ে তখন তাকে পাইনি। অনেক খুঁজেছি প্যালেসে। কোথাও নেই ও।”

নিকোলাস ওর দেহ ছুঁড়ে ফেলে ঘরের একপাশে। চাপা গর্জন করতে করতে ধোঁয়ার কুণ্ডলী হয়ে বাতাসে মিলিয়ে গেল।

চলবে,,,

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব-২৫
Writer Taniya Sheikh

রুপোলী থালার মতো চাঁদ উঠেছে আকাশে। শরতের শেষের এই ঝকঝকে রাতের আসমান সেজেছে অজস্র তারার তারায়। সন্ধ্যার পরপরই যে গাঢ় অন্ধকার প্রকৃতির ওপর চেপে বসেছিল তা এখন ম্লান। প্যালেস ছেড়ে শহরের মাঝে এসে দাঁড়িয়েছে নিকোলাস। শহরজুড়ে যুদ্ধের থমথমে ভাব। মনে কিছুতেই শান্তি আর স্বস্তি নেই। আবার একা না বলে পালিয়েছে ইসাবেলা। একবার বিপদে পড়েও ওর শিক্ষা হয়নি। নির্বোধ মেয়ে! সেদিন গাঁয়ের বাজারে খুব করে নিকোলাসের ভেতরের পিশাচটা ওর ওপর ক্ষমতা খাটিয়েছিল। প্রায় মানিয়ে নিয়েছিল ইসাবেলাকে সাহায্য না করতে। কিন্তু মনের গহীনে তীব্র জ্বালা অনুভব করে মেয়েটার কান্না দেখে। শান্ত হয়ে থাকা নেকড়েটাও ক্ষিপ্ত, বিধ্বংসী হয়ে ওঠে। ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলতে চায় ওই মানুষদের যারা ইসাবেলাকে কাঁদিয়েছে, ব্যথা দিয়েছে। পিশাচটা তখন বিদ্রুপ করে,

“তবে তো তোমাকেও সেই শাস্তি গ্রহণ করতে হবে। ব্যথা তো তুমিও দিয়েছ।”

“আমি! না, আমি ওকে ব্যথা দিইনি। তুমি দিয়েছ, তুমি।” মনটা প্রতিবাদ করে। পিশাচ রেগে বলে,

“বোকার মতো কথা বলো না। আমি আর তুমি অভিন্ন। আমার দিকে আঙুল তুললে সেটা দর্পণ হয়েও তোমারই মুখ দেখাবে। তাই বলছি চুপচাপ উপভোগ করো। আমি পিশাচ। আর আমি তুমি আলাদা নই। পিশাচের মন থাকতে পারে কিন্তু তাতে অনুভূতি যা আছে সব এক একটা থিয়েটার করা পাকা অভিনেতা। সব মেকি, ছদ্মবেশী।”

“তাই যদি হয় তবে ওর কান্না আমাকে কেন পীড়া দেয়?”

“ওসব ভ্রম। ওর প্রতি মায়ার কুপ্রভাব। মরুক ও। মরলেই তোমার ভ্রমটা কেটে যাবে। মরুক ও, মরুক।”

নিকোলাস শক্ত হয়ে বসেছিল। পেটমোটা লোকটা ইসাবেলার গায়ে অশালীনভাবে হাত দেয়। লজ্জায়, অপমানে কাঁদছিল ও। নিকোলাসের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। অসহ্য হতে লাগল মনের পীড়া। পিশাচটা প্রাণপণে চেষ্টা করছে বিকল্প উপায়ে পীড়া উপশমের। বার বার বলছে,”মরুক ও, মরুক।” কিন্তু সব ব্যর্থ হলো পলের অনুরোধে। পিশাচটা খানিক অবাক আর ক্ষুব্ধ, মনটা খুশি। বাইরে তপ্ত সূর্যালোক। এরমধ্যে ওখানে পিশাচরূপে যাওয়া মৃত্যুঝুকির সমতুল্য। কিন্তু বসে থাকার উপায় নেই। শরীরটা আল্লখেল্লায় ভালো করে ঢেকে ইসাবেলাকে উদ্ধারে গেল। সূর্যের তেজে জ্বলছে ওর ত্বক৷ সে কী যন্ত্রণা! তার ওপর পেটমোটা লোকটার বিদ্রুপ। রাগের মাথায় স্থান ক্ষণ মনে ছিল না। এমনটা সচারাচর হয় না। সে রাজা। মাথা ঠাণ্ডা করে ভেবেচিন্তে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হলো। কারণটা আবারো ইসাবেলা। এই মেয়ের কারণে একটার পর একটার নিয়ম, সংযম লঙ্ঘন হচ্ছে। লোকটা ওর বুকের কাপড়ে ফের হাত দিতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে নেকড়ে সত্ত্বা। সাধারণত নেকড়েরূপটাকে পরিহার করে সে। মানবরূপী পিশাচ থেকে নেকড়েতে পরিবর্তন খুবই কষ্টদায়ক। শরীরের রগে রগে, ভাঁজে ভাঁজে টান খায়। পুনরায় মানবীয় রূপে ফিরতেই দূর্বল হয়ে পড়ে। অবশ হয়ে আসে অঙ্গ প্রতঙ্গ। ইসাবেলাকে বাঁচাতে, উঁহু! তা কেন হবে? ইসাবেলাকে কেন এত কষ্ট করে বাঁচাতে যাবে? সে এসেছে কেবল পলের অনুরোধে। এই প্রথম কিছু আবদার করেছে। সেই আবদার ফেলবে কী করে? প্রিয় দাস বলে কথা। কিন্তু আজ তো কেউ আবদার করেনি। কেন দিশেহারা হয়ে খুঁজতে বেরিয়েছে মেয়েটাকে? কেন? এই কেন’র জবাব নিকোলাসের কাছে নেই। পূর্বে এমন অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে তাকে যেতে হয়নি। নতুন এই অনুভূতির সব যেন বেপরোয়া। ভেতরে-বাইরে কেবল চলে স্নায়ুযুদ্ধ। শেষমেশ কে হারবে আর কে জিতবে তা ভাবার অবসর এই মুহূর্তে নেই। নাক টানতে টানতে চলল ইসাবেলার ঘ্রাণের খোঁজে। ওটা পেলেই ওকে পেয়ে যাবে। শহর ছাড়িয়ে বনের প্রান্তে এসে থামল। ইসাবেলার ঘ্রাণটা একটু যেন মিশে আছে এখানকার বাতাসে। খুব করে শ্বাস টানে। শুকতে শুকতে সেই টানেলের মুখে এসে দাঁড়ায়। এক টুকরো ছেঁড়া নীল কাপড়। গতরাতে এমন একটা ফ্রকই পরেছিল ইসাবেলা। কাপড়টা হাতে নিয়ে নাকের কাছে আনে। এই তো পাচ্ছে ঘ্রাণ। দু’চোখ মুদে গভীর শ্বাস টানল। মনটা পূর্বের চেয়ে বেশি আকুলিবিকুলি করে ওঠে। নেকড়েটা চাপা গর্জন করে ভেতরে। ইসাবেলাকে ফিরে পাবার বেজায় তাড়া। এই একটা ব্যাপার নিকোলাসকে বেশ অবাক করে। তার জোড়া মার্গারেট ছিল। ভেতরের নেকড়েটা স্বয়ং সেটা প্রকাশ করেছিল তখন। কিন্তু এমন করে কোনোদিন মার্গারেটের জন্য অস্থির হতে দেখা যায়নি। ইসাবেলা তো ওর জোড়া নয়। তাহলে এমন করছে কেন?

“দ্রুত চলো, এক্ষুনি খুঁজে বের করো।”

“তোমার এত জলদি কেন?” প্রশ্ন করে পিশাচসত্ত্বা। একটু আমতা আমতা করে নেকড়েটা জবাব দেয়,

“আমি ঠিক জানি না কেন।”

সত্যিই সে জানে না কীসের মোহ তাকে ইসাবেলার সান্নিধ্য পাবার জন্য টানে৷ মার্গারেটের মৃত্যুর পর বিমর্ষ, নিঃসঙ্গ জীবন সাচ্ছন্দ্যে কাটিয়েছে নেকড়ে সত্ত্বা। খারাপ একেবারে লাগেনি তা নয়। মেয়েটার প্রতি ভালো লাগা ছিল। খুব কেয়ার করত ও নিকোলাসকে। ইসাবেলা তেমন কিছুই করেনি। বরঞ্চ খিটখিটিয়ে থাকে সর্বক্ষণ। আর তারই অনুপস্থিতিতে সে অস্থির হয়। অন্যদিকে পিশাচসত্ত্বার চোখের বালি ইসাবেলা। মেয়েটাকে দেখলে বলে ওঠে, “মেরে ফেল, মেরে ফেল।” নিকোলাস দুই সত্ত্বার ভিন্ন মতে বিব্রত, বিরক্ত। মাথা দু’হাতে চেপে দাঁড়িয়ে রইল। সব কিছুর মূলে ওই ইসাবেলা। মেয়েটা কেন চুপচাপ ফিরে গেল না? কেন ওকে জ্বালাচ্ছে? একবার হাতের কাছে পেলে হয়। টানতে টানতে নিয়ে যাবে রাশিয়া। ছুঁড়ে ফেলবে ওর পৈতৃক ভিটার সামনে। হঠাৎ গান ফায়ারিংএ ভাবনায় ছেদ পড়ে। অদূরে গরলিটজ আর পোলান্ডের সীমান্ত। সৈন্যদের ক্যাম্পে জ্বলছে তেলের বাতির আলো। জায়গাটা নিরাপদ নয়। এত এত স্থান থাকতে ইসাবেলার ঘ্রাণ সে এখানেই পেল। এই বিপজ্জনক স্থানে। বিদ্রুপাত্মক মুচকি হাসে ও।

“নির্বোধ তো আর এমনিতেই বলিনি। নির্বোধ, নির্বোধ!”
নিকোলাস দাঁত কামড়ে ফের হাওয়ায় মিশে গেল।

“আগাথা, আর কতক্ষণ হাঁটতে হবে? আর যে পা চলে না।”

গহীন বনের ঝোপঝাড়ের মাঝ দিয়ে হেঁটে চলছে ইসাবেলা। ফ্রকের স্থানে স্থানে ছিঁড়ে গেছে। শুকনো ডাল, কাঁটাযুক্ত ঝোপের আঘাতে হাতে-পায়ের কয়েক জায়গায় আচর লেগেছে। জ্বলছে খুব। আগাথা চুপচাপ সামনে এগোচ্ছেন। তিনি প্রেতাত্মা। পা মাটিতে পড়ছে না এগোনোর সময়। ঘন্টার পর ঘন্টা এমনি হাঁটছে দুজন। কত বড়ো এই জঙ্গল? এখান থেকে বেরোনোর পথ আর কত দূর? পা লেগে এসেছে। বসে পড়ল বড়ো মোটা একটা বার্চ গাছের তলে, পিঠ লাগিয়ে।

“আমি আর পারছি না আগাথা। একটু জিরিয়ে নিই।”

“ঠিক আছে।” আগাথা জবাব দিলো। কিন্তু থামলেন না।

“কোথায় যাচ্ছেন আমাকে ফেলে?”

“একপাকে গিয়ে এখান থেকে বেরোনোর পথটা দেখে আসি। ততক্ষণ অপেক্ষা করো এখানে।”

ইসাবেলা আশপাশের ভূতুড়ে নির্জনতা দেখে শুকনো ঢোক গিলে বলল,

“একা বনের মধ্যে বসে থাকতে হবে? আমি পারব না।”

উঠে দাঁড়াতে পায়ে ভীষণ ব্যথা অনুভব করল। নগ্ন পায়ের তল ক্ষত বিক্ষত। তবুও খুঁড়িয়ে যাবে বলে মনস্থির করে। আগাথা রাজি হলেন না। আশ্বাস দিলেন ভয়ের কিছু নেই। খারাপ কিছু ঘটার পূর্বে ফিরে আসবেন। ইসাবেলাকে একপ্রকার জোর করে রেখে সামনের গাছের সারির আড়ালে মিলিয়ে গেলেন। ইসাবেলা ভীত চোখে চেয়ে দেখল চারপাশ। বড়ো গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে গলে পড়া চাঁদের ক্ষীণ আলোতে খুব সামান্যই দেখা যায়। কর্ণকুহর ব্যস্ত ঝিঁঝি পোকা আর পেঁচার ডাকে। হাঁটু মুড়ে মুখটা তার ওপর রেখে বসে রইল। বুক দুরুদুরু করছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি অশরীরী কিছু এসে হামলে পড়ল কিংবা ভয়ানক কোনো জন্তুর থাবার তলে পিষ্ট হলো। অসহনীয় হয়ে ওঠে ভয়ে ভয়ে এভাবে বসে থাকাটা। জঙ্গলে কত শব্দ হয়। এই মুহূর্তে সব যেন বিপদ আর ভয়ের নামান্তর। ক্লান্ত রাত ভয়, ডর উপেক্ষা করে ধীরে ধীরে টেনে নিয়ে গেল ঘুমের রাজ্যে। হঠাৎ মনে হলো কেউ যেন ডাকছে। কে ডাকছে? ঘুমের ঘোরে গলার স্বরটা চিনতে একটু সময় লাগল। নিকোলাস! ইসাবেলার ঘুম তখনও ভাঙেনি। ওর মনে হতে লাগল ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছে। নিকোলাস কোথা থেকে আসবে? সব স্বপ্ন! শয়তানটা ওর জাগ্রত মুহূর্ত দখল করেছিল এবার স্বপ্নে এসেও হানা দিয়েছে।

“বজ্জাত নিকোলাস।”

গালে টের পাচ্ছে একটা ঠাণ্ডা হাতের স্পর্শ। হাতটা রুক্ষ । মৃদু চাপড় দিলো। কুম্ভকর্ণের নিদ্রা ভাঙানোর এতই সোজা? বিরক্ত মুখে হাতটা দিয়ে সেই ঠাণ্ডা রুক্ষ হাতটা সরিয়ে দেয়। ঘুমটা আরেকটু গভীর হয় আর কোনো ব্যাঘাত না পেয়ে। আচমকা মনে হলো হাওয়ায় ভাসছে ও। ঢুলুঢুলু চোখ মেলে তাকাতে ঝাপসা একটা মুখ দেখে। মুখও নয় ঠিক। চকিতে তাকাল। তারপর আর্তচিৎকার করে ওঠে। কালো হুডি ডাকা মুখটা সম্পূর্ণ দেখতে পেল না। কেবল লাল টুকটুকে ঠোঁট আর লম্বা নাকের কিয়দংশ। ইসাবেলার চিৎকার আরো বাড়ে নিচে তাকাতে। শূন্যে ভাসছে, জমিন থেকে বেশ খানিকটা ওপরে।

“কে আছো বাঁচাও। আগআ_”

“চুপ”

নিকোলাসের ধমকে চুপ হয়ে যায় ইসাবেলা। ওর চিৎকারে রাত্রির নিস্তব্ধতায় যে অশান্তি শুরু হয়েছিল পুনরায় তা আবার শান্ত হলো। আর্ত বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে আছে ইসাবেলা। হাত দু’টো অসতর্কে নিকোলাসের গলায় জড়িয়ে আছে। নিকোলাস সেদিকে তাকাতে এমন ভাবে হাত দুটো সরিয়ে নিলো যেন আগুন ছুঁয়েছে।

“আমাকে নামান।”

“নামান! এত সম্মান?”

নিকোলাস জমিনে নেমে আসে। চোখ বন্ধ করল ইসাবেলা। কেন যে এই শয়তানটার সাথে কথা বলতে গেল? ইচ্ছে করে রাগাবে তারপর ইসাবেলা রেগে কিছু বললে দ্য গ্রেট পিশাচ রাজা নিকোলাসের অসম্মান হবে। তিনি শাস্তি নির্ধারণ করবেন। ছেড়ে দেবেন নেকড়ের দলের সামনে অথবা কোনো পিশাচের। নিকোলাস ভুরু কুঁচকায়। এই মেয়ে তুই তুকারি ছাড়া কথা বলেনি। কালেভদ্রে একটু সম্মান দেখিয়ে হয়তো তুমি বলেছিল। আজ একেবারে আপনি বলে সম্মানের চূড়ায় তুলল? বাহ! মনে মনে খুশিই হয় নিকোলাস। সম্মান পেতে কার না ভালো লাগে? এদিকে ইসাবেলা কথা না বলে কীভাবে ওর বাহু ছাড়িয়ে নিচে নামবে সেটাই ভাবছে। নিকোলাসের এত কাছে এসে কোনো কিছু ভাবার অবস্থায় নেই। সোঁদা মাটির গন্ধ তীব্রভাবে নাসারন্ধ্র ভেদ করে মস্তিষ্কের কার্যকারিতা স্থবির করে দিচ্ছে। না, এভাবে কোলে ঝুলে থাকলে চলবে না। শরীরের সমস্ত শক্তি ছেড়ে দেয় নিকোলাসের হাতে। তাতেও কোনো সমস্যা দেখাল না নিকোলাস। এবার নড়েচড়ে ইঙ্গিতে বুঝাতে চেষ্টা করে সে নামতে চায়। নিকোলাস প্রথমে ব্যাপারটা খেয়াল করেনি। ইসাবেলার সান্নিধ্য তাকে সব ভুলিয়ে দেয় যেন। আরো নিবিড় করে বেষ্টনী। ইসাবেলা ভড়কে গেল।

“কী করছেন? নামান বলছি।”

“হুশ”

নিকোলাস নাক ঠেকায় কপালে। মন ভরে নেয় ঘ্রাণ। কী সুমিষ্ট ঘ্রাণ! নিজেকে যেন প্রানবন্ত মনে হয়। কিছু উৎকট গন্ধ নাকে লাগতে সতর্ক হয়ে কান খাড়া করল। শুকতে লাগল আরো। আগুন, বারুদমাখা গায়ের গন্ধ। ক্রমশ সেগুলো এদিকেই আসছে। ইসাবেলাকে মাটিতে নামিয়ে হুডি ফেলল। দেখল অদূরে আলো। হাতে মশাল নিয়ে এদিকেই আসছে নাৎসি সৈন্য। সম্ভবত ইসাবেলার চিৎকার শুনেছে ওরা।

“শিট! দ্রুত আমার পিঠে ঝুলে পড়ো।”

“কী?”

“কানে খাটো মেয়ে, বলেছি দ্রুত আমার পিঠে ঝুলে পড়ো। তাড়াতাড়ি করো।” নিকোলাস ঘুরে দাঁড়ায়। ইসাবেলা ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রয় বোকার মতো। পিঠে উঠবে? পাগল হয়ে গেছে না কি? ইসাবেলা কোনোদিন ওর পিঠে উঠবে। সে উলটো ঘুরে দাঁড়ায়। কদম বাড়ায় সামনে। অনেকক্ষণ পরও যখন পিঠে ইসাবেলার ওঠার লক্ষণ পেল না, নিকোলাস রেগে তাকাল। পাঁচ ছ কদম এগিয়ে গেছে ইসাবেলা তখন। নিকোলাস হাওয়ায় মিলে ওর সামনে গিয়ে তাকায়। রেগে আছে। ওর রাগী চেহারা বড্ড ভয়ানক হয়। ইসাবেলার ভয় করে। আরো দু কদম পিছিয়ে যেতে বাহু চেপে ধরে নিকটে নিয়ে এলো। নিকোলাসের নিঃশ্বাস পড়ছে ইসাবেলার গালে। তারপর নাকটা হালকা ঘষল চোয়ালে। দেহে সামান্য কাঁপুনি দিয়ে স্থির হয় ইসাবেলার দৃষ্টি। নিকোলাসের হাতটা বাহু ছেড়ে কব্জির দিকে নামছে। ইচ্ছে করে স্পর্শ দিয়ে প্রলুব্ধ করছে ওকে। সহজেই বশে এসে যায় ইসাবেলা। দুচোখ বন্ধ করে আরো যেন স্পর্শ কামনা করে। নিকোলাস সেই সুযোগ কাজে লাগায়। এই মেয়েকে কিছু বলা বৃথা। যা বলবে তার উলটো করবে। তবু কেন যে বলতে যায় সে! ঘুরে দাঁড়িয়ে ওর হাতটা পেছন থেকে গলায় জড়িয়ে পিঠে তুলে নিলো। কাজটা এত দ্রুত করল যে ইসাবেলার বুঝে উঠতে সময় লাগল। যখন বুঝল চেঁচাতে লাগল,

“ছাড়ুন বলছি। নামান আমাকে।”

ঠিক তখনই একটা গান ফায়ারিং হলো। একদম পাশ দিয়ে গেল বুলেট। ইসাবেলার কন্ঠরোধ হয় ভয়ে।

“চিৎকার করো। আরো জোরে করো। নির্বোধ কোথাকার।”
দাঁত কিড়মিড় করে বলল নিকোলাস। একটার পর একটা গান ফায়ারিং হচ্ছে। ইসাবেলা শক্ত করে ধরে আছে নিকোলাসের গলা। মুখটা কাঁধে লুকিয়ে ঈশ্বরের নাম নেওয়ার ফাঁকে অনুযোগ করে বলল,

“আমার সাথেই বারবার কেন এমন হয়? ঈশ্বর রক্ষা করো। এই পিশাচকে না মেরে মরলে আমার আত্মা যে শান্তি পাবে না। রক্ষা করো এবারকার মতো।”

“কতবড়ো অকৃতজ্ঞ মেয়ে তুমি। আমি তোমাকে বাঁচাচ্ছি আর আমাকেই মারার ইচ্ছে আমারই সামনে ব্যক্ত করছ?”

“হু”

“হু কী?”

“বলব না। আপনি আমার সাথে কথা বলবেন না। একদম বলবেন না।”

“কেন?”

“আবার কথা বলছেন? নিরাপদ কোথাও নামিয়ে দিন আমাকে। এক্ষুনি।”

“আর যদি না নামিয়ে দিই?”

“আমি আবার চিৎকার করব। আবার ওরা ফায়ারিং করবে। চিন্তা কী? আমি একা মরব না। আপনাকেও সাথে নিয়ে মরব।”

“ওসব গুলিটুলিতে নিকোলাসের মৃত্যু হবে না।”

“তাহলে কীসে হবে?” আগ্রহের সাথে ঝুঁকে তাকায় নিকোলাসের মুখপানে। নিকোলাস নিঃশব্দে হাসল। তিক্ত গলায় বলল,

“মৃতকে আবার মারতে চাও?”

“হু, মৃত না ছাই। জীবন্মৃত, পিশাচ কোথাকার।”

মুখ অন্যদিকে ঘুরালো ইসাবেলা। নিকোলাস পিঠে করে হাওয়ায় ভেসে ছুটছে। গতি যেন একটু শ্লথ হলো। আশপাশের ঘন অন্ধকার আরো ঘন লাগছে দেখতে। চোখের নিমিষে সব যেন পেছনে সরে যাচ্ছে। ঠিক চলন্ত ট্রেনের বাইরের দৃশ্য যেন। ইসাবেলার শেষ কথাতে ছিল একরাশ ঘৃণা। আজ যা ভীষণভাবে আঘাত করে নিকোলাসকে। পিশাচসত্ত্বা রাগত গলায় বলছে,

“বেশ হয়েছে। আরো যা ওর ভালো করতে। ওর মন তুই কোনোদিন পাবি না। তোকে ঘৃণা করে ও। পিশাচকে ভালোবাসে না কোনো মানুষ, কেবল ঘৃণা করে।”

ঘৃণা আর ভালোবাসার পার্থক্য নিয়ে শেষ কবে ভেবেছিল নিকোলাসের মনে নেই। আজ এই পার্থক্য ওকে বেজায় অশান্তি দিলো। ইসাবেলার ঘৃণা কষ্টের ছাই হয়ে মন আকাশে উড়ে বেড়ায়।

চলবে,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে