#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি
২.
রূপন্তির জীবনে দীহানের আগমনটা অনেকটা ভাদ্র মাসের এক পশলা বৃষ্টির মতো। অনেকটা অনাকাঙ্ক্ষিত তবে প্রতিক্ষিত। নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ না হয়ে উড়তে থাকা কিশোরী মনটা হঠাৎ করেই যেন এক পুরুষে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। চঞ্চল কিশোরী মনে প্রথম প্রেমের দোলা লাগে। প্রথম প্রেম হয় আবেগে মাখা। একরাশ মুগ্ধতায় ঘেরা। প্রেমিক পুরুষের সব কিছুই বাড়াবাড়ি রকমের ভালো লাগে। চোখে মুখে মুগ্ধতার ছড়াছড়ি। একটুতেই মন ভেঙে আসে। আষাঢ়ের বর্ষনের মতোই এক ছুটে জল জমে চোখে। আবার অল্পতেই লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠে মুখ। প্রেমের এ অনুভূতি গুলো ভয়ংকর। সব সময় কেমন তাড়া করে বেড়ায়। রূপন্তির বেলাতেও তেমনটাই ঘটেছে। তার কিশোরী মন অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই মাস ছয়েক আগে এক গম্ভীর কঠিন পুরুষ হরণ করেছে। এতদিন দূরে দূরে থাকলেও পাক্কা চার মাস পর তার মুখোমুখি হয়। আবেগের কাছে প্রেমিক পুরুষটির রাগ কঠোরতা যেন ফিকে হয়ে পড়েছিল। এজন্যই তো এক বুক সাহস নিয়ে অমন কান্ড ঘটিয়ে এলো। এরপর থেকে দিহানের সামনে যাওয়াটা নিত্যদিনের ঘটনা। কখনো অগচরে একদম কাছ ঘেঁষে দাঁড়িনো কখনো বা চুরি করে তার সাথে সেলফি নেওয়া। এসব নিত্যকার কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রূপন্তির মতে প্রেমে পড়ে তার মাঝে কিছু আধ্যাতিক শক্তি এসে পড়েছে। সেই শক্তি হলো সাহস। তার বুকে অসীম সাহস এর যোগান হয়েছে। নয়তো ওমন দানবের মতো মানুষের সাথে পেরে ওঠা কি যেমন তেমন কথা নাকি?
_____________
রূপন্তি নওয়াজ খান। সাহেদ নওয়াজ খানের একমাত্র মেয়ে। রূপন্তির আরো দুজন চাচা রয়েছে। সাহিন নওয়াজ খান এবং সাফিন নওয়াজ খান। একই বাড়িতে থাকলেও সবার পরিবার আলাদা ভাবে থাকে। ওদের বাড়িটা তিনতলা বিশিষ্ট। যার নিচ তলায় থাকে চোট চাচা। ছোট চাচার ছোট একটা ছেলে আহান। বয়স সাত। বড় চাচা থাকেন তৃতীয় তলায়। তার দুই ছেলে মেয়ে মিলি আর মিলন। মিলন লেখাপড়া শেষ করে বর্তমানে বাপ চাচার ব্যাবসায় হাত দিয়েছে। আর মিলি রূপন্তির থেকে গুনে গুনে দু বছরের বড়ো। ইন্টার শেষ করে কলেজেই ইতিহাসে অনার্স করছে। রূপন্তির সাথে সবার বোনাবুনতি পরলেও মিলির সাথে তার কোনো সখ্যতা নেই। দুজনে দুজনের ছায়াও সহ্য করতে পারেনা টাইপ। এইযে আজ দুপুরে দেরিতে আসা নিয়ে যে ঝামেলা টুকু হল সেটাও মিলির জন্য। ও না বললে মা কি জানতে পারত?
বিকেল নেমেছে। রূপন্তির ঘুম ভাঙে পাঁচটা নাগাদ। দুপুরে নাহার অনেকবার এসে মেয়েকে ডেকে গেছে। সাড়াশব্দ না পেয়ে ফিরে গেছেন। কলেজ ড্রেস বদলে ডায়নিং এ যেতেই দেখলো টেবিলে খাবার ঢেকে রাখা। রূপন্তি মুচকি হাসলো। তার মা টা একটু রাগ করতেও জানে না। রাগ করলে যত্ন নিতে হয় বুঝি?
.
.
দিহান মির্জা এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তি রেজওয়ান মির্জার ছোট ছেলে। এলাকায় তার নাম ডাক অনেক। বড়ো ব্যাবসার সূত্রে উপর মহলের সাথে সখ্যতা রয়েছে বেশ। বড় ভাই রেহান মির্জা পেশায় একজন পুলিশ সুপার। হাস্যকর হলেও এটাই সত্যি বড় ছেলে পুলিশ আর ছোট ছেলে আসামি!
এই মারামারি,ঝামেলার জন্য কতবার দিহানকে পুলিশ কাস্টাডিতে যেতে হয়েছে তার কোনো হিসাব নেই। তবে এক ঘন্টার বেশি কেউ তাকে আটকে রাখতে পারেনি। এ নিয়ে বাপ ভাইয়ের সাথে বেশ দন্দ রয়েছে দিহানের। বাহিরের মানুষ তো আর ঘরের কথা জানে না।
আজকাল ব্যাবসার কাজ একা সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে রেজওয়ান মির্জাকে। বয়স হয়েছে। আর কত? দুটো ছেলে থাকতেও তার জেন কষ্টের শেষ নেই। সোফায় বসে গা এলিয়ে দিতেই তার চোখ বুজে আসতে চায়। গলা উঁচিয়ে স্ত্রী রেহেনাকে ডাকেন।
‘হ্যা বলেন।’
‘তোমার গুণধর ছেলে কোথায়? ডাক তাকে। তার সুদর্শন মুখটা একটু দেখি।’
স্বামীর কথায় রেহেনা কি জবাব দিবে বুঝে উঠতে পারছে না। এই বাপ ছেলে কাউকেই সে বুঝত পারে না। কেউই তার কথা শোনে না। মাঝে মধ্যে তার দম বন্ধ লাগে। মন চায় সব ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে। এসব অশান্তি তার আর সহ্য হয়না।
রেহানা ভাবলো সে বলবে দিহান ঘুমাচ্ছে। তাহলে ব্যাপারটা এখানেই চেপে যাবে। কিন্তু তার পরিকল্পনাকে পানিতে ভাসিয়ে দিয়ে দিহান এসে রেজওয়ানের সামনে বসলো। পায়ে পা তুলে দিয়ে শান্ত ও সুন্দর ভাবে বললো,
‘আপনি আমায় দেখতে চাচ্ছিলেন? দেখে নিন মন ভরে। আপনার মনের তৃষ্ণা না মেটা অবদি আমি এখান থেকে নড়ব না প্রমিস।’
রেহেনা অসহায় চোখে একবার স্বামী আর একবার ছেলের দিকে চাইল। মাঝে মধ্যে তার নিজেকে পাগল পাগল লাগে। এই বাপ ছেলের কারণে সত্যিই না সে পাগল হয়ে যায়।
দিহানের আগমনে রেজোয়ানের ভাবান্তর হলো না। সে পূর্বের ন্যায় চোখ বন্ধ করে রইলেন। দিহান তা দেখে বাঁকা হেসে বলল,
‘আমার রূপের আগুন কি আপনার চোখ ঝলসে দিচ্ছে ড্যাড? আপনিতো দেখছি চোখ খুলতেই পারছেন না।’
রেজওয়ান এবার মুখ খুললেন।
‘তোমার রূপ কেন? তোমার সকল কজ কর্মই আমায় ঝলসে দেয়। তবে আমার চোখকে না আমার সম্মানকে ঝলসে দেয়।’
দিহান ব্যাপারটায় ব্যাপক আফসোস নিয়ে বললো,
‘এমন নড়বড়ে সম্মান কেন রাখেন বলেনতো। যা অল্পতেই ঝলসে যায় তা না থাকাই শ্রেয়। এইযে আমায় দেখুন। আমার কাছে কিন্তু ঝলসানোর কোনো অপশন নেই।’
কথাটা বলেই সোফার দু পাশে হাত ছড়িয়ে ভাব নিয়ে বসলো দিহান। রেহানা এখান থেকে চলে গেছে অনেক্ষণ। এসব অযথা ঝামেলা তার ভালো লাগে না।
‘তোমার মত হতে চাইনা আমি। যাই হোক ওসব কথা বাদ দিলাম। ব্যাবসায় হাত লাগাচ্ছ কবে থেকে?’
‘ব্যাবসা করার প্রতি আগ্রহ নেই আমার।’
‘সেটা আমিও জানি। আগ্রহ নেই বললেই তো চলবে না। আগ্রহ আনো।’
‘চেষ্টা করবো।’
‘গত দু বছর ধরেই চেষ্টা করছো। লাভ তো কিছুই হলো না। একবার জোর খাটিয়ে আমার সাথে অফিসে চলো। দু একদিন গেলেই মন টিকে যাবে।’
‘আচ্ছা।’
‘যাচ্ছ তবে?’
‘ভেবে দেখব।’
এ পর্যায়ে হাল ছেড়ে দিলেন রেজওয়ান। এত বড় ছেলেকে তো আর পিটিয়ে পিটিয়ে অফিসে নেওয়া যায় না। অবশ্য যদি সম্ভব হতো তিনি সেটাই করতেন। ছেলেটা যে তার মস্ত বড় বিয়াদপ। কোথায় তার এক ধমকে ছেলে চুপসে যাবে কিন্তু ঘটে তার উল্টোটা। কথা বলার সময় তার মাথা ভার হয়ে আসে। এই বুঝি ছেলেটা রেগে গেল। রেগে গেলেই বিপর্যায় নেমে আসবে। বুক কেমন দুরুদুরু করে। এগুলো মেনে নেওয়া যায়?
__________
রূপন্তির ঘুম ভাঙে কাক ডাকা ভোরে। এ সময় বাড়ির সকলে ঘুম থাকে। তার এই অভ্যাস হয়েছে দিহানের জন্য। দিহান রোজ ভোরে ওয়াক আউট করতে বের হয়। রূপন্তি ছাদে দাঁড়িয়ে দু মিনিটের জন্য দিহানকে দেখতে পায়। এই দু মিনিটের জন্য আধঘন্টা আগে ঘুম থেকে উঠে এক মগ কফি হাতে ছাদে চলে যায়। দিহানকে দেখার পিপাসা তার কিছুতেই কাটতে চায় না। মাঝে মধ্যে তার মন চায় দিহানকে ছোট কোনো কাঁচের বোতলে বন্দি করতে। তারপর সে সারাক্ষণ দিহানকে দেখবে। অমসৃণ খোঁচা খোঁচা দাড়ি যুক্ত গালটা আলতো করে ছুঁয়ে দিবে। ভাবতেই লজ্জায় লাল হয়ে আসে মুখ। চট জলদি দু হাতে ঢেকে ফেলে মুখ। এই মানুষটা তার কবে হবে?
দিহান আজ হাঁটু পর্যন্ত প্যান্ট আর ঢোলাঢালা টিশার্ট পরেই ওয়াক আউটে বের হয়েছে। এই সময়টা সে একা থাকে। দিনের এই সময়টা খোলা পরিবেশে একা দৌড়াতে ভালো লাগে তার। কেমন ফ্রেশ ফ্রেশ একটা ভাব আছে। অযৌক্তিক কোনো ঝামেলা নেই।
ছাদ থেকে রূপন্তি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাকে দেখছে। একটা চুল ও যেন মিস না হয় তেমন ভাবে। এই যে সকাল সকাল দিহানের ঘুম থেকে উঠে আসা ফোলা ফোলা চোখ এটা তার ভিষণ পছন্দের। সারাদিন স্মোক করার পর সকাল বেলায় ঠোঁট দুঠোকে তার কাছে কিছুটা জীবন্ত মনে হয়। অযান্তেই তার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো,
‘ওরে আমার ডার্ক চকলেট। মন চায় টুপ করে খেয়ে নেই।’
কথাটা বলে নিজেই লজ্জায় মিইয়ে যায়। কিন্তু হাঁটু অবদি বের করা প্যান্ট দেখতেই মেজাজ চটে গেলো। লোকটা কি তার লোমশ সাদা পা দুটো মানুষকে দেখিয়ে বেড়াতে চাচ্ছে? এই অধিকার তাকে কে দিয়েছে? এত সাহস কোথায় পায় সে?
এক প্রকার খারাপ মেজাজ নিয়েই রুমে ফিরলো রূপন্তি। এই লোকটার ফোন নম্বর থাকলে এতক্ষণে একগাদা কথা শুনিয়ে দিত সে। এসব লুতুপুতু স্বভাব তার একদম পছন্দ না। পা দুটো সুন্দর তাই বলে সবাইকে দেখাতে হবে? কোন ধরনের ম্যানারস্ এটা? অসহ্য!
.
.
কলেজে যাওয়ার পথে আজ দিহান বাদে বাকি সবাইকে দেখলো রূপন্তি। দিহানের গাড়িটির ও নেই আশপাশে। কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ ফেলে সেদিকে পা বাড়ায় সে। এই লোক কোথায় গেল আজ?
‘দিহান মির্জা কোথায়?’
রূপন্তিকে এই গ্যাংয়ের প্রায় সকলেই চেনে। যেই মেয়ে দিহানের আশপাশে ইঁদুরের মতো ছোটাছুটি করে তাকে না চিনলে হয়?
নুহাশ এগিয়ে এসে বলে,
‘দিহানকে দিয়ে কি কাজ?’
রূপন্তি ঠোঁট টিপে হাসে। শুধায়,
‘সব কাজ তো তাকে দিয়েই। ওসব সিক্রেট। বলা যাবে না। কেবল বলুন দিহান মির্জা কোথায়?’
‘তা তো বলা যাবে না। দিহানের নিষেধ আছে।’
রূপন্তির চোখ ছোট হয়ে আসে। এদের কথা বিশ্বাস করা কি ঠিক? এর মাঝে পাশ থেকে অপর একটা ছেলে বলে ওঠে,
‘এই মেয়ে! কি নাম তোমার?’
‘নাম দিয়ে কাম কি? ভাবী বলে ডাকবেন। যার আমার নাম জানা দরকার তাকে আমি ঠিক জানিয়ে দিব। আপনারা ভাবী বলে ডাকলেই চলবে।’
কথার মাঝেই পেছন থেকে রুক্ষ কন্ঠে কেউ বলে উঠলো,
‘কে কার ভাবী?’
কি ভয়ানক কন্ঠ! মুহূর্তেই গায়ে হিম ধরিয়ে দিয়েছে যেন। রূপন্তি এলোমেলো চোখে পেছনে তাকালো। দিহান এসেছে। আজ তার শরীরে এটে আছে নীল রঙের একটা শার্ট। বরাবরের মতো উপরের দুটো বাটন খোলা। শার্টের হাতা ফোল্ড করে কনুই পর্যন্ত তুলে রাখা। পেশিবহুল লোমশ ডান হাতে কালো বেল্টের ঘড়ি। সাদা হাতে কালো ঘড়িটা কেমন ফুটে উঠেছে। রূপন্তি ছোট করে ঢোক গিলল। তার চোখ জোড়া যে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই মানুষটা তো তার চরিত্র খারাপ করে দিবে! ঐইযে তার খোলা শার্টের ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে লোমশ বুক। রূপন্তির নজর ওখানে যেয়েই আটকাচ্ছে। এতে দোষ কার? অবশ্যই দিহানের। তাছাড়া এই লোকটা সবসময় ওর বুকে আগুন লাগিয়ে দেয়। এইযে কেমন নেশাতুর চোখে তাকিয়ে আছে। এতেই রূপন্তির মনে আগুন জ্বলে উঠলো। কিন্তু হায়! এই আগুন নেভানোর যে কেউ নেই। রূপন্তির মাথায় চট করে একটা গানের লাইন মনে পড়লো।
‘তুমি জ্বালাইয়া গেলা মনের আগুন
নিভাইয়া গেলা না।’
চলবে………