তাহার উম্মাদনায় মত্ত পর্ব-০৩

0
260

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

৩.
রূপন্তি যতই ছটফটে মাছ হোক দিহাকে দেখলেই তার বুক মুচড়ে ওঠে। এই বুঝি লোকটা তার দানবীয় হাতের থাপ্পর লাগিয়ে দিল। এই বুঝি হুংকার ছাড়লো। এমন চিন্তায় তার ভেতরের আত্মা শুকিয়ে আসে। সামনে অনেক সাহস দেখালেও ভেতরে কাচুমাচু হয়ে থাকে। এখনো তেমনটা হচ্ছে। এই যে লোকটা তার দুই ভ্রুর মাঝে ভাঁজ ফেলে কেমন করে তাকিয়ে আছে। রূপন্তির বুক কাঁপছে।

‘কে কার ভাবী এখনো বুজতে পারলাম না!’

নুহাশ হেসে রূপন্তির পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালো। কন্ঠে রসিকতা ধরে রেখে বলল,

‘সেকি নিজের বউকে নিজেই চিনতে পারছিস না?’

ব্যাপারটা একটু বেশি গভীর হয়ে গেল না? রূপন্তি ফাঁকা ঢোক গিলল। লোকটা রেগে না যায়। কিন্তু দিহান রাগলো না। মুচকি হাসলো। শুধালো,

‘আমাকে কি খুব বেশি পছন্দ?’

এ যেন না চাইতেই মরুর বুকে টুপ করে এক ফোঁটা বৃষ্টির মতো শোনালো অন্তির(রূপন্তি) কাছে। সে তার বড় বড় চোখ দু তিন বার ঝাপটালো। দিহান তখনো উত্তরের জন্য তার দিকে তাকিয়ে। অন্তির মনে লাড্ডু ফুটলো। শ্যাম গালে লালা আভা ছড়ালো। মাথা উপর নিচ করে বললো,

‘ভিষণ!’

কথাটা বলেই সে দিহানের দিকে তাকালো। দিহানের রিয়্যাকশন দেখতে হবে না?
দিহানের মুখে আগের মতোই মুচকি হাসি। অন্তি চোখ বুজে নিল। খুন করে দিবে নাকি লোকটা? এভাবে কেন হাসে?

‘বেশ। নুহাশ ওর কাছে একটা খাতা আর কলম দে।’

অন্তির কপালে ভাঁজ পড়লো। ভালোবাসার সাথে খাতা কলমের কি সম্পর্ক? আশ্চর্য!
নুহাশ যেন এর জন্য প্রস্তুত ছিল। বলা মাত্রই ছোট একটা ডায়েরি আর কলম এগিয়ে দিল। চোখে মুখে তার লেপ্টে আছে হাসি। অন্তি সন্দিহান নজরে আড় চোখে দেখলো দিহানকে। সে আপাতত কালো রঙের বাইকটার উপর উঠে বসেছে। অন্তির ধৈর্য্যর বাঁধ ভাঙলো। সে চটপটে ভাবে বললো,

‘আপনার কি ভালোবাসার লিখিত ডকুমেন্ট চাই? সেটা আগে বললেই হতো। আমি বাসা থেকে সুন্দর করে লিখে নিয়ে আসবো কেমন? এখন চলি।’

এটুকু বলে বোকা হেসে অন্তি ছুট লাগালো। দিহানের চাহনি অন্তির একদম সুবিধার মনে হচ্ছে না। প্রেমে অন্ধ হলেও লোকটার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তো তার ধারণা আছে। এই ভয়ংকর লোক এমন মিষ্টি করে হাসছে মানে তার মাথার ভেতরের চিন্তা চেতনা কোনো ভয়ংকর ফন্দি আটছে। আপাতত এখান থেকে কেটে পরতে পারলেই বাঁচে সে। অন্তির মাঝে মধ্যে আফসোস হয়। দিহান কেন গোবেচারা টাইপের হলো না? হলেকি খুব ক্ষতি হতো? অন্তি তো তার খুব যত্ন নিত। রাজার আসনে বসিয়ে রাখত। দিনভর সেবা করত। কিন্তু তা তো সম্ভব নয়। দিহান একদম গোবেচারা ধরণের না। লোকটা নাকের ডগায় রাগ নিয়ে ঘোরে। এত রাগ আসে কোথা থেকে? অন্তিয মন চায় দিহানের রাগের গোডাউনে আগুন জ্বেলে দিতে। জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাক ঐ রাগ।
পেছন থেকে দিহান রেগে ডাক দিলো,

‘এই মেয়ে দাড়াও। এখনি থাম। পা ভেঙে রেখে দিব কিন্তু।’

কিন্তু ততক্ষণে অন্তি চলে গেছে সীমানার বাহিরে। দিহান প্রচন্ড রেগে গেছে। এতটুকু একটা মেয়ের সাহস দেখে রীতিমত সে অবাক। এত সাহস পায় কোথায় মেয়েটা?

এদিকে আশপাশের সবগুলো হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। নুহাশ পেট চেপে নিচে বসে পড়েছে। তার কাছে অন্তিকে চরম লেগেছে। এই মহল্লায় যে এমন একটা সাহসী মেয়ে আছে তার জানা ছিল না। তাহলে সে নিজ দায়িত্বে মেয়েটাকে খুঁজে তার বন্ধুর দায়িত্ব চাপিয়ে দিত।
_______________

অন্তিদের কলেজটা বেশ বড়। অনার্স পর্যন্ত পড়াশোনার ব্যবস্থা রয়েছে। ছেলে মেয়ে উভয়েই আছে কলেজে। সেই হিসেবে ছাত্র ছাত্রী সংখ্যা ও অনেক। অন্তি এবার একাদশ শ্রেণিতে পড়ছে। বানিজ্য বিভাগে। অন্তির ক্লাসরুম তৃতীয় তলায়। ওজের ক্লাস সংলগ্ন জানালাটা থেকে কলেজ মোড়টা স্পষ্ট দেখা যায়। কোনো গাছপালা না থাকার দরুন সব একদম ফকফকা। জানালার পাশের বেঞ্চটা অন্তির জন্য বরাদ্দ। কলেজে এলে এই সিটটা তার। অন্যকেউ বসলে হামলা চালিয়ে হলেও আদায় করে ছাড়ে। আজ ও এক বিপত্তি ঘটেছে। দিহানের প্রশ্ন উত্তর পর্বের জন্য অন্তির পৌঁছাতে সামান্য দেরী হয়েছে। ফলস্বর জানালার পাশের বেঞ্চটা অন্যকারো দখলে চলে গেছে। তন্নি পেছনের দিকের একটা সিটে বসে আছে। সে ভেবেই নিয়েছিল আজ অন্তি আসবে না। কিন্তু অন্তিকে দেখে তার খুশি হওয়ার বদলে মুখ খানা আরো চুপসে এলো। জানালার পাশে আজ তুলি বসেছে। মেয়েটার সাথে তার বা অন্তির কারো সাথেই বোনাবুনতি পরে না। ওর বাবা এ কলেজের ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক। যে কারণে তার ভাব আকাশ সমান। পান থেকে চুন খসলেই খ্যাপা ষাঁড়ের মত গর্জে ওঠে। স্যারের মেয়ে হওয়ায় কেউ অযথা ঝামেলা করতে চায়না বলেই পাশ কাটিয়ে চলে সর্বদা। কিন্তু আজ কি হবে? অন্তি তো দমে যাওয়ার মেয়ে না! তার তো ঐ সিট না হলে চলবেই না! তার গুন্ডা প্রেমিককে না দেখলে যে তার ছটফটানি বেড়ে যায়!

তন্নি ফাঁকা ঢোক গিলল। বেঞ্চ থেকে বেরিয়ে অন্তির কাছ ঘেঁষে দাঁড়ালো। কাঁধে হাত রেখে নরম কন্ঠে শুধালো,

‘দোস্ত আজ পেছনে বসি আমরা? আমার খুব পেছনে বসতে মন চাইছে। বসি?’

তন্নির কথা যেন শুনতে পায়নি এমন ভাব করে এগিয়ে গেল অন্তি। তুলির সামনে যেয়ে মুচকি হেসে বললো,

‘তুমি কিছু মনে না করলে এই সিটটা আমি পেতে পারি?’

‘না।’

এমন জবাব আসবে সেটা অন্তি আগে থেকেই জানত। জানালা গলিয়ে বাহিরে চোখ যেতেই দেখলো দিহান তার ছেলেপেলের সাথে কিছু নিয়ে খুব গভীর আলোচনা করছে। চোখের সানগ্লাসটা স্থান পেয়েছে বুকে। যা শার্টের সাথে ঝুলে আছে। চোখ মুখে সিরিয়াস ভাব। হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কিসব বলছে। পাশেই সিরিয়াস মুখ করে নুহাশ মনোযোগ সহকারে সবটি শুনছে। খানিক বাদে মাথা নাড়িয়ে সায় জানাচ্ছে। অন্তি চোখ ঘুরিয়ে তুলির দিকে তাকালো। মেয়েটা গল্পের একটা বই মেলে বসে আছে। অন্তির রাগ হচ্ছে ভিষণ। কিন্তু রাগলে তো চলবে না। সে নরম গলায় বললো,

‘প্লিজ তুলি! ফ্রেন্ড হিসেবে এতটুকু সাহায্য কর প্লিজ। সামনের সিটটা ফাঁকা রয়েছে। তুমিতো রোজ ওখানেই বসো!’

‘তো? আজ আমি এখানে বসবো।’

কতবড় শয়তান মেয়ে ভাবা যায়? অন্তির বুঝতে বাকি নেই তুলি কাজটা শয়তানি করেই করেছে। ওর মাথায় ধপ করে আগুন জ্বলে উঠলো। এদিকে তার হিরো আজ কিলার লুকে হাজির। কোথায় সে একটু মন ভরে দেখবে! কিন্তু এই বজ্জাত মাইয়া…
তন্নি পেছন থেকে অন্তির জামা ধরে টানল। করুণ সুরে বলল,

‘বাদ দে না দোস্ত! আজ একদিনই তো।’

ইতিমধ্যে ক্লাসে স্যার চলে এসেছে। অন্তি বাধ্য হয়ে পেছনে তন্নির পাশে ধপ করে বসে পড়লো। তার রাগের থেকে দুঃখ হচ্ছে বেশি। ক্লাসে মন বসলো না। পুরো ক্লাস উদাসীনতায় কাটলো। মাঝখানে দু তিনবার স্যারের ধমক খেতে হয়েছে। অন্তি বুঝে না, ঘুরেফিরে স্যার ওকেই কেন প্রশ্ন করে? ক্লাসে কি মানুষের অভাব আছে? আশ্চর্য!

______________

ভর দুপুরে গরম গরম চা খাওয়ার ব্যাপারটা আজাইরা মনে হয় নুহাশের কাছে। এই গরমে মানুষের কলিজা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। কোথায় সবাই এক গ্লাস ঠান্ডা পানি খাওয়ার জন্য ছটফট করছে সেখানে দিহান এই এক ঘন্টায় চার কাপ চা খেয়েছে। দোকানদার ছেলেটা অল্প বয়স্ক। এই বিশ কি বাইশ বছরের হবে হয়তো। নাম তামিম। দিহানের ডাইহার্ট ফ্যান। দোকানে আসলে ভাই ভাই করে পাগল বানাই ফেলায়। এই ব্যাপারটাও নুহাশের অসহ্য লাগে। মানুষ এত গায়ে পড়া টাইপ কেন হবে?

ইতিমধ্যে দিহানের চতুর্থ নম্বর কাপটাও ফাঁকা হয়ে পড়েছে। তারেক এগিয়ে এলো। এক গাল হেসে বললো,

‘ভাই আর এক কাপ দেই?’

দিহান কিছু বলার পূর্বেই নুহাশ চোখ নাক কুঁচকে ধমকে উঠলো।

‘এই গরমের মধ্যে আলগা ভালোবাসা দেখাইয়া কি মারতে চাইতাছোস?’

তামিমের মুখটা চুপসে এলো। ছোট করে বললো,

‘না ভাই।’

‘তাইলে আর এক কাপ দেই মানে কি?’

তামিম তার জায়গা থেকে কিছুটা পিছিয়ে গেল। মুখ কাচুমাচু করে বললো,

‘সরি ভাই।’

দিহান চুপচাপ সব দেখলো। হাত উঁচু করে বললো,

‘একটা সিগারেট দে তো।’

‘কোন ব্রান্ডের ভাই?’

কথাটা বলেই দাঁত দিয়ে জিভ কাটলো তামিম। আড় চোখে নুহাশের দিকে তাকালো। যে আপাতত চরম বিরক্তি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তারিম বোকা হাসলো। বলল,

‘খালি ভুইলা যাই ভাই। দাড়ান এখনি দিতাছি।’

সিগারেট ধরাতে ধরাতেই দিহান দোকান থেকে বাহিরে বের হলো। সিগারেটে এক টান দিতে না দিতেই কেউ একজন তা কেড়ে নিয়ে দূরে ছুড়ে ফেলল। এই ঘটনায় সবথেকে বেশি যে চমকালো সে হচ্ছে তামিম। তার চোখের সামনে এমন ঘটনা এখন পর্মন্ত ঘটেনি। সে বড় চোখ করে অন্তির দিকে তাকালো। এই মাইয়ার এত সাহস? ভাইয়ের সিগারেট টান মারে! কিছু বলার জন্য উদ্যোগ নিতেই নুহাশ তার হাত টেনে পাশে বসাই দিলো। এতক্ষণে নুহাশের মুখে হাসি ফুটেছে। তামিম অবাক হয়ে গেল। ভাইয়ের সাথে একটা মেয়ে বিয়াদপি করতিছে আর এই মানুষটা এইখানে বসে হাসতিছে! কতবড় বেইমান! তার ক্ষমতা থাকলে দিহানকে সে চাদর দিয়ে মুড়িয়ে রাখত যাতে কেউ টোকা পর্যন্ত দিতে না পারে। কিন্তু তারতো ক্ষমতা নেই। তাই বিরস মুখে সামনে তাকালো।

হঠাৎ আক্রমনে দিহান চমকে উঠেছে। অন্তিকে দেখতেই বিরক্তে কপাল কুঁচকে এলো। ঝাঁঝালো গলায় বললো ,

‘মাথায় সমস্যা আছে নাকি?’

‘আছে হয়তো। নয়তো আপনার মতো পাথরের প্রেমে পড়ি?’

এমন কথার পিঠে কি জবাব দিবে খুঁজে পেল না সে। নিজেই তাজ্জব হয়ে গেল এমন কান্ডে। একটা পুঁচকে মেয়ের কথায় কিনা তার জবান বন্ধ হয়ে গেল?

‘বলি আপনি কি চোখে পট্টি বেঁধে রেখেছেন? এইযে আপনার সামনে কিউট একটা মেয়ে ছোটাছুটি করে বেড়ায় আপনার নজরে পড়ে না?’

অন্তির এই কথার জবাবে দিহান বাঁকা হাসলো। কিছুটা ঝুঁকে ফিসফিস করে বললো,

‘আমার চোখ কেবল আগুনে আটকায়। বাচ্চা, কিউট এসব আমার টাইপের না!’

অন্তি নাক কুঁচকালো। কিছুটা পেছনে সরে বললো,

‘আপনি কি খারাপ! ছিঃ ‘

‘এই ছোট ব্যাপারটা বুঝতে এত সময় লাগলো!’

অন্তি বুঝলো লোকটা তাকে বোকা বানিয়ে দূরে সরাতে চাইছে। এত সহজ নাকি? এই পাথরে ফুল ফুটিয়ে তবেই সে খান্ত হবে।

‘কিন্তু আমার এই খারাপ আপনি টাকেই ভালো লাগে। একদম ডেইরি মিল্কের মত। মন চায়…..’

অন্তি কথা শেষ করতে পারলো না। তার আগেই দিহান ধমকে উঠলো,

‘যাবে এখান থেকে? নাকি থাপ্পর লাগাবো?’

অন্তির মুখটা চুপসে এলো। কথাটা এত জোরে বলার কি আছে?
সবাই মুখ টিপে হাসছে। বিশেষ করে তামিম। সে বেজায় আনন্দ পেয়েছে। অন্তির অপমান বোধ হলো। সে দু পা এগিয়ে দিহানের বরাবর দাঁড়ালো। জোর গলায় বললো,

‘আমাকে একদম এভাবে ধমকাবেন না। ভবিষ্যতে সংসারটা আমার সাথেই করতে হবে কথাটা মাথায় রাখবেন। খারাপ লোক একটা। আপনি ধমকালেও আমি আপনাকেই ভালোবাসব। একশো বার বাসব।’

কথা শেষ করেই ছুট লাগালো সে। আজ সে কষ্ট পেয়েছে। দিহান কেনো সবার সামনে এত জোরে ধমক দিবে? তার বুঝি খারাপ লাগে না?
এদিকে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দিহান। পেছন ফিরে নুহাশকে বললো,

‘মেয়েটা কি হুমকি দিয়ে গেল?’

‘তাই তো মনে হচ্ছে!’

চলবে……….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে