তাহার উম্মাদনায় মত্ত পর্ব-০১

0
345

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

১.
‘আপনার মনে হয়না, আপনার টুপ করে আমার প্রেমে পড়ে যাওয়া উচিত?’

দিহান কপালে ভাঁজ ফেলে তাকায়। তার সামনে এক চঞ্চল কিশোরী মেয়ে দাড়িয়ে। পড়নে তার কলেজ ইউনিফর্ম। চুলগুলো বেণী করে দু কাঁধে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। চোখে মুখে হাসি উপচে পড়ছে। শ্যাম বর্ণের মেয়েটার স্বভাবের সাথে চোখ দুটোও ভিষণ চঞ্চল। দিহান চোখ মুখ কুঁচকে নেয়। তার হাতে থাকা আধ খাওয়া সিগারেটটা কিছুটা দূরে ছুড়ে ফেলে দিলো। তীক্ষ্ণ চোখ চেয়ে থমথমে গলায় বললো,

‘কতবার না করেছি আমার সামনে আসতে? সোজা কথা কানে যায় না?’

দিহানের এই স্বল্প পরিসরের ধমক কোনো প্রভাব ফেলতে পারলো না কিশোরীর মনে। বরং সে দূরত্ব ঘুচিয়ে দিহানের পাশে এসে দাঁড়ায়। তার মতো করেই গাড়িতে হেলান দিয়ে জবাব দেয়,

‘আপনি বললেই কেন দূরে থাকব? কাছে আসতে কি পারমিশন নিয়েছি? নেইনি তো! এখানে সব আমার মর্জিতে চলবে। যখন তখন কাছে আসবো। ইচ্ছে হলে টুপ করে চুমু খাব আপনার কি তাতে?’

দিহানের আশপাশে থাকা ছেলে পেলেরা ঠোঁট টিপে হাসছে। তাদের বসের জন্য তাদেরৎএই মেয়েকে বেশ পছন্দ হয়েছে। বসটা কেবল রাজি হলেই ভাবী কনফর্ম। কিন্তু তাদের এই আশা পন্ড করে রেষান্তিত কন্ঠে ধমকে উঠলো দিহান।

‘এই থাপ্পড়ে দাঁত ফেলে দিব। চেনো আমাকে?’

রূপন্তি কিছুটা কেঁপে উঠে। এই লোক ভয়ংকর। ভয়ংকর তার রাগ। কেমন লাল হয়ে গেছে চোখ দুটো। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসে। কিন্তু এভাবে ভয় পেলে তার প্রেমটা কিভাবে হবে? সে কথা বলার জন্য হা করে কিন্তু দিহানের রাগি রাগি মুখ আর কুঁচকে থাকা কপালের দিকে চোখ পড়তেই হা টা গিলে ফেলে। জোর করে মুখে হাসি টেনে ছোট করে বলে,

‘আজ তবে আসি। অন্যদিন কথা হবে।’

দিহানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে উল্টো পথে পা বাড়ালো রূপন্তি। তার মনটি হুট করেই খারাপ হয়ে গেছে। লোকটা শুধু ধমকায়। এত ধমকানোর কি আছে? একটু সুন্দর করে হাসলে কি হয়? লোকটা শুধু তাকে দূরে সরাতে চায়। কছাটা ভাবতেই সে দাঁড়িয়ে পড়ে। এভাবে মন খারাপ করে চলে যাওয়া মানে তো হেরে যাওয়া। এভাবে শুরুতেই হার মেনে নিলে কিভাবে চলবে? তৎক্ষণাৎ সে পেছন ফিরে চাইল। দিহান চোখে রোদ চশমা পড়ে এক আঙ্গুল চাবি ঘোরাচ্ছে। পাশের ছেলেটাকে কিছু একটা বলে সে তার কালো রঙের গাড়ির দরজা খুললো। রূপন্তি জোর গলায় ডেকে উঠলো,

‘এই ভিলেন!’

দিহান চট করে সামনে তাকালো। কিছুটা দূরে হাসি হাসি মুখ করে রূপন্তি দাঁড়িয়ে। দিহান তার দুই ভ্রুর মাঝে ভাঁজ ফেলে তাকালো। কেবল না মেয়েটা মন খারাপ করে চলে গেল? তার দেওয়া ডোজের রিয়াকশন এত দ্রুত শেষ! দিহানকে দ্বিতীয় বারের মতো চমকে দিয়ে রূপন্তি বা চোখ টিপে একটা ফ্লাইং কিস ছুঁড়ল। দিহান হতভম্ব হয়ে সেদিকে তাকিয়ে। যেখানে মানুষ জন তার সামনে দাঁড়িয়ে মাথা উঁচু করে কথা বলার সাহস পায় না সেখানে নাকের ডগায় দাঁড়িয়ে একটা মেয়ে কিস ছুঁড়ছে। সিরিয়াসলি?

দিহানের এমন গোবেচারা মুখ দেখে হেসে কুটিকুটি হচ্ছে রূপন্তি। মনের মাঝে এখন শান্তি লাগছে। এইতো সে পেরেছে। এই কঠিন মানুষটাকে পেতে হলে তাকে মানুষটার চিন্তা চেতনায় ঢুকতে হবে। তারপর নাহয় মনে ঢুকে দরজায় খিল লাগাবে!

____________

বাসায় ফিরতেই নাহার মেয়ের দিকে রাগি দৃষ্টি ছুঁড়ল। ঝাঁঝালো গলায় বললো,

‘এই এক ঘন্টা কোথায় ছিলি? মিলা তো সেই কখন বাসায় আসছে।’

রূপন্তি ঠোঁট জিভে ভেজাল। আপাতত তার মাথায় কোনো মিথ্যা আসছে না। এটা তার একটা সমস্যা। মন খুব বেশি ভালো থাকলে সে মিথ্যা বলতে পারে না। তার মিথ্যার ফ্যাক্টোরিতে তখন তালা পড়ে। অনেক কষ্টে স্বল্প হেসে বললো,

‘ফুচকা। মানে ফূচকা খাচ্ছিলাম আমি আর তন্নি। তাই দেরী হলো।’

নাহারের মেয়ের কথা একদম বিশ্বাস হলো না। সন্দিহান চোখে চেয়ে বললো,

‘তুইনা ফুচকা অপছন্দ করিস?’

রূপন্তি মাথা নাড়িয়ে না জানলো। স্বল্প হেসে বললো,

‘আমারতো ফুচকা ভিষণ পছন্দ। একদম দুই প্লেট খেয়েছি।’

নাহার আর মেয়েকে ঘাটল না। মেয়েটা তার বাঁদর হয়েছে। এত বড়ো ধিঙ্গি মেয়ে এখনো টৈটৈ করে চড়ে বেড়ায়। যত দোষ সব মেয়ের বাপের। বাপের আল্লাদেই তো এমন হয়েছে। রূপন্তি তার রূমে যেয়ে ড্রেস চেঞ্জ না করেই শুয়ে পড়ে। তার মনের আকাশে পেজা তুলোর মতো প্রেমের ভেলা ভাসছে। বুকটা কেমন অস্থির হয়ে আছে। বারবার শক্ত চোয়ালের কঠিন মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। এই মানুষটাকে সে প্রথম দেখেছিল কলেজ মাঠে। কোনো একটা ব্যাপারে প্রচুর ঝামেলা হয়েছিল দুই দলের মধ্যে। সবাই যখন মারামারি করতে ব্যস্ত এই মানুষটা তখন গাড়ির দরজায় হেলান দিয়ে সিগারেট ফুঁকতে ব্যস্ত। কালো রঙের পাতলা শার্ট পড়নে ছিল তার। বুকের কাছের তিনটা বোতাম খোলা। পুরোই ব্যাড বয় টাইপ। কিন্তু তবুও কি ভিষণ আকর্ষণীয় লাগছিল। রূপন্তির নজর আটকে যায়। খানিক বাদে বাদে সিল্কি কালো চুল গুলো হাতে দিয়ে পেছনে ঠেলে দেওয়ার দৃশ্যটা যেন তার কাছে এক মুগ্ধকর চিত্রকর্ম মনে হচ্ছিলো। সেদিন না চাইতেও সে মুখ থুবরে এই ভয়ংকর মানুষটার প্রেমে পড়েছিল। এক কথায় ভয়ংকর প্রেম। তার এই ভয়ংকর প্রেমের কথা জানতে পেরে তার অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু তন্নি আতংকিত হয়ে পড়লো। চোখে মুখে একরাশ হতাশা নিয়ে বললো,

‘তোর এই প্রেমের এখানেই বিচ্ছেদ ঘটা। দোহাই তোর এই প্রেমকে ভুলেও প্রশ্রয় দিস না।’

কিন্তু কে শোনে কার কথা? তার মনে ততদিনে পাকাপোক্ত ভাবে এই মানুষটা প্রেমিক হিসেবে সেট হয়ে গেছে। প্রথম প্রথম সে লুকিয়ে মানুষটাকে দেখতো। আড়াল থেকে মানুষটার এলোমেলো চুল, খাড়া নাক, বাদামী চোখ আর ঐ কালচে পোড়া ঠোঁট গুলোকে নিরবে পর্যবেক্ষণ করতো। রূপন্তির মতে দিহান কোনো শিল্পীর তৈরি নিখুঁত শিল্পকর্ম। যা দেখলে কেবল দেখতে মন চায়। পিপাসা বাড়িয়ে দেয়। দিহান যখন স্বল্প ঠোঁট টেনে হাঁসতো প্রিয়ন্তি তখন বুকে হাত চেপে দেয়ালে মিশে যেত। কি ভয়ংকর সে হাসি! একদম তীরের মতো বুকে এসে লাগে। কিশোরী হৃদয়ে ঝড় উঠিয়ে দেয়।

এমন বেশ চলছিল। কিন্তু মাসখানেক আগে হুট করেই তিন দিনের জন্য মানুষটা গায়েব হয়ে যায়। সাথে গায়েব হয় তার সাঙ্গপাঙ্গরা। কলেজ মোড়ের যে জায়গাটায় ওদের আড্ডা বসে যায়গাটা ফাঁকা পড়ে রয়। সাথে ফাঁকা হয়ে পড়ে অষ্টদশী এক কিশোরীর মন। বিষন্নতায় ছেয়ে ওঠে সব। দিনে দুপুরে যখন সময় পেয়েছে ছুটে এসেছে একপলক দেখার জন্য মানুষটাকে। কিন্তু দেখি পায়নি। এমন বেদনার মাঝেই কেটে গেল তিনটি দিন। বিরহ বেদনায় তখন কিশোরী মন নিশ্চুপ হয়ে পড়েছে। যাকে না দেখে এক বেলা কাটে না তাকে না দেখে তিনটা দিন পার করা কি যেমন তেমন কথা? এই তিনদিনে রূপন্তি বদলে গেলো। চোখের নিচে কালি পড়ে গেল। প্রেম শুরু হওয়ার আগেই হৃদয় বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে তার। ঠিক সেদিন কলেজে যাওয়ার পথে আবারো পরিচিত মোড়ে পরিচিত মুখ দেখে থমকে যায় সে। আবেগে চোখে পানি চলে আসে। সাথে কিছুটা রাগ ও হয়। হুট করে এভাবে হারিয়ে যাওয়ার মানে কি? এই রাগ আর আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরেই মুখোমুখি হয় দিহানের। সে তখন খুব মনোযোগ দিয়ে ফোনে কিছু করছে। রূপন্তি সামনে দাঁড়িয়েছে ব্যাপারটা তার নজরে আসেনি। এই ছোট্ট ঘটনায় রূপন্তির মেজাজ মুহূর্তেই খারাপ হয়ে যায়। সে ভয়ংকর এক কাজ করে বসে। চট করে দিহানের হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নেয়। ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটে সবাই রিয়্যাকশন দিতে ভুলে যায়। কেবল ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। এর মাঝে একটা ছেলে জিভ কামড়ে অন্যজনকে বলে,

‘এই মাইয়া আজ শেষ। সাহস দেখছিস? ভাই আজকে ওর হাতটাই না ভাইঙ্গা রাখে।’

অপরজন ও সহমত জানায়। নুহাশ দিহানের পাশেই ছিল। সে কেবল পানি মুখে দিয়েছিল। কিন্তু এমন কান্ডে পানি আর গলা দিয়ে নামলো না। অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে সে।

রূপন্তি ওসবের ধার ধারলো না। সে সরাসরি দিহানের চোখে তাকালো। শান্ত ভাবে প্রশ্ন করলো,

‘এই তিনদিন কোথায় ছিলেন?’

দিহান তখনো তার বিষ্ময় কাটিয়ে উঠতে পারেনি। একটা মেয়ে এসে তার হাত থেকে ফোন কেড়ে নিলো আবার তাকেই প্রশ্ন করছে এই তিনদিন কোথায় ছিল সে? এটা কি আদেও স্বাভাবিক কোনো ব্যাপার? এই বিষ্ময় ভাবের জন্যই অযান্তে সে ছোট করে উত্তর দিলো,

‘একটু কাজ ছিল।’

এ পর্যায়ে নুহাশ যেন আকাশ থেকে টুপ করে পড়লো। সে কি ঠিক শুনলো? দিহান উত্তর দিলো? কোই সে যখন কছু জিজ্ঞাস করলে তো এমন ভাবে তাকায় যেন এখনই টুপ করে গিলে ফেলবে। কখনো দশবার বলেও একটা উত্তর পাওয়া যায় না। তবে এখন? এখন সে কাকে দেখছে?

‘বেশ। তবে এখন থেকে কোথাও যাওয়ার হলে অবশ্যই আমাকে জানাবেন। চিন্তা হয়না বুঝি?’

এতক্ষণে দিহান তার বিষ্ময় কাটিয়ে বের হয়। একটা মেয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে চটপটে ভাবে কথা বলছে দেখতেই বেশ অবাক সে। সাথে কিছুটা বিরক্ত ও। রূপন্তির হাত থেকে ফোনটা নিয়ে পুনরায় নিজের কাজে মনোযোগ দিয়ে গম্ভীর গলায় শুধালো,

‘এখানে কি চাই?’

রূপন্তির সাবলীল জবাব,

‘আপনাকে চাই।’

এমন কথায় সবার হুশ উড়ে গেল। নুহাশ শুকনো ঢোক গিললো। মনে মনে রূপন্তির জন্য প্রার্থনা করলো। প্রেম করার জন্য দেশে কি মানুষের অভাব পড়ছে বোন? কথাটা বলতে যেয়েও বলতে পারলো না। মুখের মাঝেই আটকে রইল। এ পর্যায়ে দিহান চোখ তুলে তাকালো। চোয়াল শক্ত করে দাঁত চেপে বলল ,

‘এক থাপ্পর দিব। ফাজলামি করো?’

রূপন্তি একটু ভয় পেল। যতই হোক এই লোকতো আর পাঁচটা মানুষের মত স্বভাবিক না। তিনি অসাধারণ। তার এই অসাধারণ ব্যক্তিত্বের জন্য এ মুহূর্তে তার গালে দুই একটা থাপ্পর পড়তেও পারে। বলা যায় না। রূপন্তি কিছুটা ভিতু হয়। মনে মনে আল্লাহর নাম জপে। কিন্তু তবুও মুখে হাসি টেনে বললো,

‘তা কেন? প্রেমে পড়লে মানুষ থাপ্পর খায় শুনেছেন কখনো? আপনি চাইলে চুমু খেতে পারেন। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি কি সেটা ভালো দেখায়? ওটা নাহয় আরো কিছুদিন পরে হবে!

এখন আসছি। কলেজ টাইম হয়ে গেছে।’

কথা গুলো বলে এক প্রকার ছুটে পালায় সে। এসব কথা বলে দিহানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানে নিজেকে বলির জন্য নিজেই সঁপে দেওয়া। সে কি অত পাগল নাকি? প্রেম করার আগেই থাপ্পর খেলে প্রেম প্রেম মুডটাই নষ্ট হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে সে প্রচন্ড সচেতন।

চলবে……..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে