তাহার উম্মাদনায় মত্ত পর্ব-২৩+২৪

0
266

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

২৩.
ব্যস্ত ঢাকার সড়কে আধঘন্টা যাবত আটকে রয়েছে রেজওয়ান মির্জার আলিশান গাড়িটা। গাড়ির ভেতরে বসে থাকা অবস্থায় তার কপাল থেকে টুপটাপ করে ঘাম ঝড়ছে। এসি অন থাকা সত্ত্বেও তার শরীরের তাপ যেন প্রতিনিয়ত বেড়ে উঠছে। পাশেই তার ম্যানেজার লোকটা আশপাশে বিরক্ত ভঙ্গিতে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। আরো পনেরো বিশ মিনিটে জ্যাম ছাড়বে বলে মনে হচ্ছে না। চিন্তিত মুখে সে মির্জা সাহেবের দিকে তাকায়। ছোট করে বলে,

‘স্যার আরো কিছু সময় দরকার হবে। এই মুহূর্তে অন্য রুট নেওয়াও সম্ভব না। আমরা মাঝ রাস্তায় আটকে আছি।’

কপালের পাতলা চামরা কুঁচকে আসে রেজওয়ান মির্জার। পাশ থেকে পানির বোতলের মুখ খুলে ঢকঢক করে গিলে নেয় খানিক। অসম্ভব চিন্তায় হাত পায়ে কাঁপন ধরেছে তার। পুরুষকে কাঁদতে নেই তবুও কেন যেন তার চোখ বারবার ভিজে আসতে চাইছে। তৎক্ষণাৎ ফোনে কল আসে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ব্যস্ত গলায় অপরিচিত কন্ঠে কেউ বলে ওঠে,

‘আপনারা আসতে এত সময় কেন নিচ্ছেন? রোগীর কন্ডিশন ভালো না। তিন ব্যাগ ব্লাড ইতিমধ্যে প্রোভাইড করা হয়েছে। আরো দু একব্যাগ লাগতে পারে। আমরা রোগীকে অপারেশন থিয়েটারে নিতে পারছি না। এটা কোনো মার্ডার কেস হতে পারে। শরীরে অসংখ্য ছুড়ির আঘাত রয়েছে। কিছু ফর্মালিটিস পূরণ করা দরকার। বুঝতে পারছেন?’

রেজওয়ান মির্জার শ্বাস আটকে আসতে চায়। কন্ঠনালি শুকিয়ে আসে। গলা থেকে শব্দ গুলো যেন বের হতে চায়না। বহু কষ্টে ঠোঁট নাড়িয়ে বলে ওঠে,

‘সকল ব্যাবস্থা করুণ। আমরা আসছি। অপারেশন শুরু করুণ। অপেক্ষা করবেন না। আপনাদের সো কলড ফর্মালিটির জন্য আমার ছেলের কিছু হলে এর ফল মোটেই ভালো হবে না।’

‘কিন্তু…’

‘যেটা বলেছি সেটাই করুণ।’

কল কেটে বড় করে শ্বাস ফেলে রেজওয়ান মির্জা। লাল হয়ে আসা চোখ নিয়ে ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘অন্যকোনো ব্যাবস্তা করো মাহবুব। দু সেকেন্ড অপেক্ষা চাই না।’

মাহবুব নামের লোকটা দ্রুত মাথা নাড়ায়। কিভাবে কি ব্যাবস্থা করবে তা তার জানা নেই। তবে তাকে কিছু একটা করতে হবে। গাড়ি থেকে কোনোভাবে নেমে যায় সে। রাস্তার জ্যাম দীর্ঘ। তেমনি দীর্ঘ জ্যাম বর্তমানে তার মাথায়। দিক দিগন্ত শূন্য হয়ে পড়েছে তার। কপালে ভাঁজ ফেলে দ্রুত কোনো সুরহার কথা ভাবতে থাকে।

________________

ঘড়ির কাঁটা দুপুর একটার কাছে। সূর্যের তেজ বেড়েছে। সাথে ভাপসা গরমের উপস্থিত ও। অন্তি বর্তমানে একটা পার্কের বেঞ্চিতে বসে আছে। সবুজ গাছপালায় ঘেরা এক ছোট্ট পার্ক। এখানে খুব একটা মানুষজন নেই। পার্কের খোলা মাঠে ছোট ছেলেরা ক্রিকেট খেলছে। অল্প কিছু স্কুল পড়ুয়া ছাত্র ছাত্রীদের দেখা যাচ্ছে এক কোণে। জোড়ায় জোড়ায় তারা। নিঃসন্দেহে স্কুল পালিয়ে ঘুরতে এসেছে। অন্তি আগ্রহভরা দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। ওখানে থাকা প্রতিটা মেয়ের হাতেই একটা করে গোলাপ। তাদের প্রেমিকের তরফ থেকে পাওয়া গোলাপ। মুখে লাজুক হাসি। কি সুন্দর চোখে চোখে কথা হয় তাদের। যত্ন করে চুল গুঁজে দেওয়া হচ্ছে কানের পেছনে। অন্তির হঠাৎ করেই ভিষণ মন খারাপ হয়। ছলছল হয় চোখ। কিশোরী মনে কিছু প্রেমময় স্মৃতির অভাবে হাহাকার করে ওঠে। ব্যস্ত হাতে পুনরায় প্রেমিক পুরুষটির ইনবক্সে ম্যাসেজ পাঠানো হয়।

‘আমার একটা গোলাপ চাই। আপনার নামের গোলাপ।’

উত্তর আসবেনা জেনেই দ্বিতীয় ম্যাসেজ পাঠায়।

‘আপনি ভিষণ পাষাণ প্রেমিক। আমার কি এই মুহূর্তে রাগ করে বিচ্ছেদ ঘটানো উচিত?’

অন্তি নিজেও জানে তার দ্বারা বিচ্ছেদ কখনোই সম্ভব নয়। যাকে ছাড়া থাকার কথা ভাবতেই তার দম বন্ধ লাগে তাকে পেয়েও ছেড়ে দেওয়া যায়? কখনোই না। দিহান যেতে চাইলেও অন্তি যেতে দিবে না। সেখানে ছেড়ে দেওয়ার কথা নিতান্তই বোকামি। অন্তি ফোন রেখে চুপটি করে বসে থাকে। পেটে ক্ষুদা অনুভব হয়। দিহানের সাথে দেখা করার উত্তজনায় সকালে খাওয়া হয়নি। আর এখন মন খারাপের ভারে খাওয়া হচ্ছে না। তার আনা বাটির খাবারটাও নিশ্চই ঠান্ডা হয়ে এসেছে? হোক ঠান্ডা। এই ঠান্ডা খাবারই খেতে হবে লোকটাকে। দেরী করার শাস্তি এটা।
পার্কের এক সাইডে কিছু ছোট দোকান বসেছে। ঝালমুড়ি, ফুচকা বিক্রি হচ্ছে। খালি পেটে এসব তেলযুক্ত খাবার ভয়ংকর পতিক্রিয়া করবে যেনেও অন্তি সেদিকে পা বাড়ায়। আজ সে নিষিদ্ধ ভয়ংকর কাজ গুলোই করবে। হলে হোক কিছু ক্ষতি!

অন্তির মন খারাপের কথাগুলো কিভাবেই যেন তন্নি যেনে যায়। তার একা লাগা সময়গুলোতেই হুট করে কল করে বসে মেয়েটা। অন্যসময় তন্নির অযথা আলাপ বিরক্ত ঠেকলেও তখন কোনো বিরক্ত কাজ করে না। অন্তি খুব মনোযোগী স্রোতার মতো তন্নির প্রতিটা শব্দ মন দিয়ে শোনে। আজ ও হলো তাই। ফুচকা খেয়ে বিল মিটিয়ে পূর্বের জায়গায় এসে বসতেই কল আসে তন্নির। ঠোঁট চিড়ে হাসি ফুটে ওঠে অন্তির। কল রিসিভ করতেই তন্নি হামলে পড়ে।

‘কোথায় তুই? আমার বাড়ি কখোন আসছোস? বাই এনি চান্স পালায় যাসনিতো দোস্ত? কি ভয়ংকর কথা! আমাকে একবার ও জানানোর প্রয়োজন মনে করলি না?’

‘না।’

‘মিরজাফোর! যাই হোক বিয়ে টিয়ে করে ফেলেছিস? দিহান ভাইয়ের মতো মানুষ আসলেই এমন চমৎকার কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছে?’

অন্তি হাসে। জবাব দেয়না। তার নিরবতা অনেক কিছুই প্রকাশ করে। ফোনের ওপাশ থেকে তন্নি বলে ওঠে,

‘কোথায় তুই? আন্টি কল করেছিলো। হয়তো সন্দেহ করেছে তোকে। আমি হঠাৎ করেই ভয় পেয়ে গেছিলাম। আমাকে বলে যাবি তো যেখানেই যাস!’

‘স্যরি। মাথায় ছিলো না।’

‘হুম। এখন ঘটনা কি? কথা এমন ভার কেন? ঝগড়া হয়েছে?’

অন্তির চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। টুপ করে জল গড়িয়ে পড়ে। বাচ্চাদের মতো করে কেঁদে উঠে জানায়,

‘সে আসেনি। আমি অপেক্ষা করছি। এমন পাষাণ লোককে কেন আমি এত ভালোবাসি? আমার একদম তাকে ভালোবাসা উচিত না।’

তন্নি অবাক হয়। সাথে চিন্তিতও। বলে,

‘তুই এখন কোথায় পাখি?’

‘গুলশান। এক্সাক্ট লোকেশন জানিনা।’

‘পাগল তুই? ওদিকে কেন গেছিস? ভাইয়া জানে?’

‘ম্যাসেজ করেছি।’

‘আযব! কল করিসনি কেন? ম্যাসেজতো সে না ও দেখতে পারে। কল কাট। ভাইয়াকে কল কর কুইক। এমন বোকামি কেন করিস পাখি? দ্রুত আপডেট জানা। ওয়েট করছি আমি।’

দিহানকে কল করার কথা অন্তির মাথায় একবারের জন্যও আসেনি। নিজের এমন ছোট একটা ব্যাপারে এতবড় বোকামির জন্য আফসোস হয়। এই তন্নিটা কল না করলে হয়তো তার মাথায় এই অতি সাধারণ কথাটা কখনোই আসতো না। নিশ্চই মানুষটা ব্যাস্ততার জন্য ম্যাসেজ খেয়াল করেনি। অন্তি নিজ মাথায় চাপড় কাটে। কেঁদে কেটে লাল করে ফেলা মুখটা হঠাৎ করেই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কিন্তু এটা খানিকের জন্য। দিহানের নম্বর অফ। মুখ শুকিয়ে আসে অন্তির। সাথে এভাবে হুট করে এতদূর একা চলে আসার জন্য ও আফসোস হচ্ছে। দীর্ঘ এক ঘন্টা বাস জার্নি করে এখানে আসা মোটেই তার জন্য সহজ ছিলো না। তার উপর সবটা অপরিচিত। নিজের উপর রাগ হওয়ার সাথে দিহানের উপর ও চাপা অভিমান জমে। সে জানে না আজ অন্তি তাকে কল দিতে পারে? তবুও কেন ফোন বন্ধ রাখবে?
দিহানের জন্য কেনা এক পাউন্ডের ছোট কেকটা অন্তি মাঠে খেলা বাচ্চাদের মাঝে বিলিয়ে দেয়। তার রান্না করা খাবারের প্রথম স্বাদটাও বাচ্চারাই পায়। কিন্তু এতে তাদের রিয়্যাকশন মোটেই ভালো ছিলো না। রান্নাটা কি একটু বেশিই খারাপ হয়েছে?
দিহান আসবেনা যেনেও অন্তি তিনটা পর্যন্ত ওখানে বসে থাকে। একা একা রাস্তার পাশ ধরে হেঁটে বেড়ায়। নিজের জন্য একটা গোলাপ কিনে কানে গুঁজে নেয়। সবশেষে বাড়ি ফেরার পথে পুনরায় দিহানের নম্বরে একটা টেক্সট পাঠায়।

‘আজ দিনটা সুন্দর। ঝলমলে। ঠিক আপনার মতো। এতো সুন্দর একটা দিনে পৃথিবীতে আগমনের জন্য আপনাকে সুভেচ্ছা প্রিয়।’

পরপর দিহানের জন্য কেনা কেকটার একটা ছবি পাঠায়। সাথে বাচ্চাগুলোর ও।

‘আপনাকে ছাড়াই আপনার জন্মদিন উদযাপন করে ফেলেছি। রাগ করবেন না। রাগ করলেও আমি রাগ ভাঙাবোনা একদম। আপনি জানেন কতো অপেক্ষা করেছি?’

অন্তির হাত থামে। বাসের জানালা থেকে বাহিরে উদাস দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে রয়। মন তার হাহাকার করে বলে ওঠে,

‘আমি ভিষণ দুঃখি প্রিয়। আপনায় পাশে না পাওয়ার কষ্ট আমার গ্রাস করে নিচ্ছে। আমার বড্ড দুঃখ! বুঝলেন?’

চলবে…….

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

২৪.
মাহবুব নামের লোকটা মাঝ বয়সী। গোলগাল চেহারার স্বাস্থ্যবান লোক। রেজওয়ান মির্জার ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছেন প্রায় বছর পাঁচেক। লোকটার মাঝে কাজ করার আলাদা রকম এনার্জি রয়েছে। সেই কখন থেকে লোকটা এখানে ওখানে ছুটে বেড়াচ্ছে। তবুও তার ক্লান্তি নেই। এত ছোটাছুটির মাঝেও খানিক পরপর এসে রেজওয়ান মির্জাকে শান্তনা দেওয়ার মতো করে বলে যাচ্ছেন,

‘স্যার চিন্তা নেই। ছোট সাহেব এখন ঠিকঠাক। জ্ঞানটা ফিরলেই সব সমস্যা সমাধান।’

রেজওয়ান মির্জা মাথা নাড়ায়। নড়েচড়ে বসে ক্লান্ত প্রশ্ন করে,

‘বাড়িতে জানিয়েছ?’

‘জ্বি না স্যার। আপনি বললে জানাবো।’

‘দরকার নেই মাহবুব। তোমার ম্যাডাম জানতে পারলে অসুস্থ হয়ে পড়বে। এখনি কিছু জানিওনা।’

‘আচ্ছা স্যার।’

‘ঐ বাঁদরের দলগুলো জানে?’

মাহবুব সামান্য দ্বিধায় পড়ে যায়। মিনমিনে গলায় বলে,

‘এটা কোন দল স্যার?’

রেজওয়ান মির্জা চোখ মুখ শক্ত করে তাকান। রাগতে যেয়েও রাগেন না। শক্ত জবাব দেন,

‘তোমার ছোট সাহেবের যে নামছাড়া একটা দল আছে, সেই দলের কথা বলছি। ওদের খবর দাও। এদের জন্যই আমার ছেলেটার আজ এই দশা।’

দিহানের দলের কোনো এক সদস্যকেই তার পছন্দ নয়। বিশেষ করে নুহাশ। তার মতে নুহাশের ভোলাভালা সুন্দর মুখটার পেছনে ভয়ংকর এক রূপ আছে। যা কেউ দেখতে পায়না। কিন্তু সে উপলব্ধি করতে পারে। ঐ ছেলেটাই তো তার ছেলেটার মাথা খেয়েছে। আস্ত এক অভদ্র ছেলে!

_______________

অন্তি যখন বাসায় ফিরলো তখন প্রায় সন্ধ্যা। দিহানের আড্ডা দেওয়ার প্রতিটা জায়গায় সে গিয়েছিল। কোথাও সে দিহানকে পায়নি। চায়ের দোকানের ছেলেটাকে জিঙ্গাস করলে সে জানিয়েছে দিহান আজ সকাল থেকে এদিকে আসেনি। অন্তি বিষন্ন মন নিয়ে বাড়িতে ফিরে এসেছে। বাড়িতে ঢোকার পথে দাড়োয়ান তাকে দেখতেই ভীতু গলায় প্রশ্ন করেন,

‘কোথায় ছিলেন আপামনি?’

অন্তি ভ্রু বাঁকিয়ে তাকায়। সরল জবাব দেয়,

‘বান্ধবীর বাসায় ছিলাম। কেন?’

‘চাচি তো সেই ক্ষ্যাপছে। আপনেরে খোঁজতে সে আপনের বান্ধবীর বাড়িতে গেছিলো। আপনে ছিলেন না সেইখানে।’

অন্তির আঁতকে উঠে। গলা শুকিয়ে আসে। মা হঠাৎ খোঁজ নিতে বের হলো কেন? দুরুদুরু বুকে সহসা প্রশ্ন করে।

‘খুব সিরিয়াস কিছু হয়েছে সুরুজ ভাই? বাবা বাড়িতে?’

‘চাচা একটু আগেই আসছে। দেইখা তো সিরিয়াস মনে হইলো। আপনি ঘরে জান। দেখেন কি অবস্থা।’

অন্তি মাথা নাড়িয়ে আলতো হাসে। কিন্তু মাথায় তার হাজার খানেক চিন্তা। তন্নিও তখন কলে বললো সন্দেহের কথাটা। মা কি সত্যি কিছু সন্দেহ করেছে?

ড্রয়িংরুমের সোফায় পা তুলে বসে সাহেদ চা খাচ্ছে। চোখ তার এক হাতে ধরে রাখা পেপারে। টিভিতে একটা শো চলছে। গানের শো। টিভিতে গানের শো চালিয়ে পেপার পড়ার মধ্যে কোনো মহত্ত্ব নেই। এটা কোনো ট্যালেন্টকেও রিপ্রেজেন্ট করেনা। তবুও সাহেদ প্রায়শই এই কাজটা করে। এতে ঘরের কারো কোনো মাথা ব্যাথা না থাকলেও একজনের আছে। সে হচ্ছে পারু। এই সময়টুকু সে তার সিরিয়াল দেখায় পার করতে পারতো। কিন্তু সাহেদের জন্য তা সম্ভব হচ্ছে না। তখনি অন্তি দরজা ঠেলে ঘরে‌ প্রবেশ করে। অন্তিকে দেখতেই পারু প্রায় চিৎকার করে ওঠে,

‘আপনের আসার সময় হইলো এহন আপা?’

অন্তি ভনিতা ছাড়া জবাব দেয়,

‘কোনো ধরাবাঁধা সময় ছিল আমার আসার?’

‘না তা না..’

‘তাহলে?’

‘তাহলে কি তা তো আমার তে আপনের মা ভালো বলতে পারবে। হের কাছে যান।’

অন্তি পারুর কথায় গুরুত্ব না দিয়ে সাহেদের পাশে গিয়ে বসে। অবাক গলায় বলে,

‘বাবা আজ এসময়ে বাসায় যে?’

সাহেদ পেপার ভাঁজ করতে করতে সোজা হয়ে বসে। চায়ের কাপ টেবিলে রেখে মেয়ের দিকে ঘুরে সপ্রতিভ হাসে।

‘তোমাদের একজায়গায় নিয়ে বের হবো আজ। এজন্যই তাড়াতাড়ি বাসায় আসলাম। ফ্রেশ হয়ে তৈরি হয়ে নাও।’

অন্তি কৌতুহল প্রশ্ন করে,

‘কোথায়?’

‘গেলেই দেখতে পাবে।’

_____________

নুহাশ সাথে আরো পাঁচজন ছেলে নিয়ে হাসপাতালে যায়। দিহানের খবর শোনার পর থেকেই তার হাত পা অস্বভাবিক হারে কাঁপছে। শরীর থেকে গাম গড়াচ্ছে অনর্গল। চিন্তায় মাথা কাজ করা বন্ধ হয়ে গেছে।
রেজওয়ান মির্জা কেবিনের সামনে চেয়ার পেতে বসে রয়েছেন। ভেতরে ঢোকার অনুমতি নেই। এখনো জ্ঞান ফেরেনি দিহানের। বারোবার ছুড়ির আঘাত করা হয়েছে তার শরীরে। মাথা ফেটেছে। পায়ে খুব ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করায় ফ্র্যাকচার হয়েছে। আপাতত দৃষ্টিতে দেখতে গেলে দিহানের পুরো শরীরকে সাদা রঙের ব্যান্ডেজ দ্বারা আবদ্ধ করা হয়েছে। রেজওয়ান খানিক বাদে বাদে দরজার কাঁচের অংশ দিয়ে ভেতরে নজর বুলাচ্ছেন। যতই ছেলের সাথে তার দন্দ, মত বিরোধীতা হোক, দিনশেষে তার একটা অংশ এই ছেলেটা। কঠোর ব্যক্তিত্ব নিয়ে তার সাথে লড়াই করা ছেলেকাকে এভাবে দেখতে তার বুকটা ভিষণ জ্বলছে। কাঁদতে না চাইলেই অবাধ্য জল চোখে হামলা করছে। বাব হয়ে ছেলের এ অবস্থা কিভাবে সহ্য করবেন সে?
নুহাশকে দেখতেই রেজওয়ান মির্জার গম্ভীর মুখটায় আরো গম্ভীরতা নেমে আসে। ভিষণ অনিচ্ছা সত্ত্বেও দরজার হামনে থেকে অল্প সরে দাঁড়ান। ধারালো গলায় বলেন,

‘দেখো কি অবস্থা তোমাদের বন্ধুর। এরপর ও তোমরা নিজেদের পথ পরিবর্তন না করলে আমার সত্যিই কিছু বলার থাকবে না। তবে আমার জায়গায় তোমরাও একদিন দাঁড়াবে। বাবা হয়ে দেখো, একজন বাবার দায়িত্ব, চিন্তা ঠিক কতটা। সেদিন তোমাদের এই নিষ্ঠুর আচরণের কথাও চিন্তা করবে। আমার জায়গায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে দেখবে, আমি ঠিক‌ কতটা শান্তিতে আছি।’

কাঁচের দরজার এপাশে নুহাশ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রয়। চোখ থেকে তার টপটপ পানি পড়ছে। বিপদের কথা অনুমান
করেই সে সেদিন দিহানকে একা কোথাও যেতে মানা করেছিলো। কিছুদিন বাদে নির্বাচন। সবাই এখন ক্ষাপা ষাঁড়ের মতো এর ওর উপর হামলা করবে। কিন্তু ছেলেটা শুনলো কই? তাকে না জানিয়ে চলে গেলো।

‘কাদের কাজ জানো কিছু?’

রেজওয়ান মির্জার প্রশ্নে ঘুরে দাঁড়ায় নুহাশ। মাথা নাড়িয়ে বলে,

‘বলতে পারছি না। পার্টি ছাড়া দিহানের ব্যক্তিগত শত্রু সংখ্যা ও কোনো অংশে কম নেই কোথাও। নিজ দলে যেখানে শত্রু রয়েছে সেখানে অন্য দলে শত্রুর সংখ্যা হিসাব করা বোকামি।’

রেজওয়ান মির্জা তাচ্ছিল্য করে হাসে। কিছুটা অপমান করে বলে ওঠে,

‘শত্রু না চিনে রাজনীতিতে নামো কোন মুখে? রাজনীতিতে শুধু শত্রু কেন? শত্রুর চার বংশের খোঁজ রাখতে হয় হাতে! অবশ্য তোমাদের মতো পাতি মাস্তান এসব রাজনীতির কি বুজবে। তোমরা পার্টির কথায় ওঠো আর বসো। তাকেই রাজনীতি ভেবে বসে আছ। ডাফারের দল সব!’

নুহাশ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রয়। কোনো জবাব দেয় না। নজর তার ফ্লোরে। রেজওয়ান মির্জা আরো কিছু বলতে নিবে তার পূর্বেই মাহবুব ছুটে আসে। আর্জেন্ট কাজে তাকে বের হতে হবে। তিনি যাওয়ার পূর্বে কাঠকাঠ গলায় নুহাশকে হুকুম করে যান,

‘গাধার মতো দাঁড়িয়ে না থেকে খুঁজে বের করো কে এমন কাজ করলো। মাথাটাকে একটু কাজে লাগাও।’

নুহাশ মাথা নাড়ায়। এ কাজটা সে নিজেই করবে। খুঁজে বের করে সেই কু* কে সে নিজ হাতে শাস্তি দিবে। কত বড় কলিজা নিয়ে দিহানের দিকে হাত বাড়াইছে সে সেটা দেখে ছাড়বে।

গাড়ি ছুটছে শা করে। মাহবুব সেই কখন থেকে হাঁসফাঁস করছে কিছু বলার জন্য। রেজওয়ান তির দিকে না ফিরেই বললেন,

‘কিছু বলার থাকলে ঝটপট বলে ফেলবে। চিন্তা ভাবনা করে সময় অপচয় করবে না। সময়ের মূল্য অনেক জানো তো?’

‘জ্বি স্যার জানি।’

‘তাহলে বলো।’

মাহবুব কিছুটা আমতা আমতা করে বলে,

‘নুহাশ ছেলেটাকে আপনার এত অপছন্দ কেন? না মানে এমনি..’

‘তুমি ব্যাপারটা ভুল ধরেছ মাহবুব। আমি কাউকে অপছন্দ করি না। তাছাড়া কারো অপছন্দের কারণ হওয়ার মতো নূন্যতম জোগ্যতাও ঐ গাধার মধ্যে নেই।’

‘তাহলে আপনি তাকে সর্বদা গাধা কেন বলেন?’

‘কারণ ও আসলেই গাধা। বুঝেছ!’

‘জ্বি স্যার।’

‘কি বুঝেছ?’

‘ইয়ে মানে…’

‘আমার দেখা দ্বিতীয় গাধাটা তুমি মাহবুব।’

‘জ্বি স্যার।’

__________

দারোয়ানের থেকে শোনা পরিস্থিতির সাথে বাসার পরিস্থিতির কোনো মিল পাচ্ছেনা অন্তি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে যখন পরিস্থিতির এসব মিল অমিল খুঁজে ব্যস্ত তখনি হন্ত দন্ত হয়ে নাহার রুমে ঢোকে। পড়নে তার ইন্ডিয়া থেকে আনা ভারী কাতান। কানে সোনার বড়ো ঝুমকা। গলায় মোটা চেইন। অন্তি বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকে পর্যবেক্ষণ করে অবাক গলায় শুধায়,

‘তুমি এমন অদ্ভূত সেজেছো কেন মা?’

নাহার ভ্রু বাঁকিয়ে তকায়। গলার স্বর গম্ভীর করে বলে,

‘অদ্ভূত কেন? শাড়ি গহনা পড়ার মাঝে অদ্ভূতের কি আছে?’

‘শাড়ি গহনার মাঝে অদ্ভুত কিছু না থাকলেও তোমার মাঝে আছে। এমন সাজে অদ্ভুত লাগছে। গহনা বদলাও। এত ভারী গহনা শাড়ি পড়ে কোথায় যাবে?’

নাহার এ কথার কোনো জবাব দেয়না। বরং হালকা মেরুণ রঙের একটা জামদানী শাড়ি এগিয়ে দিয়ে বলে,

‘আজ তুই ও শাড়ি পড়ছিস। এটা সুন্দর তাই না? তোকে মানাবে। ব্লাউজ পেটিকোট পড়ে আয়। আমি সুন্দর করে শাড়ি পড়িয়ে দিচ্ছি।’

অন্তি হতবাক দৃষ্টিতে শাড়ির দিকে তাকাচ্ছে তো মায়ের দিক। এমনিতেও তার মন মেজাজ বেজায় খারাপ। তার উপর নাহারের এসব কান্ডে সে অতিষ্ঠ প্রায়।

‘আমার ভালো লাগছে না মা। আমি ভালো দেখে একটা কামিজ সেট পড়ে নিচ্ছি। জোড় করো না। শাড়ি পড়ার মুড নেই।’

নাহার এ কথায় গুরুত্ব দিলো বলে মনে হলো না। শাড়ির ভাঁজ খুলতে খুলতে তাড়া দিলেন,

‘ঝটপট ব্লাউজ পেটিকোট পড়ে আয়। সময় কম। তোর বাব তৈরি হয়ে বসে আছেন।’

অন্তি আর রা করে না। চুপচাপ মায়ের কথা মতো ব্লাউজ পেটিকোট হতে ওয়াশরুমে চলে যায়। আজকাল এ বাড়িতে তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা, পছন্দ অপছন্দের কদর খুব কমই করা হয়। তার মা তো রোজ শুক্রবার তার কি খেতে মন চাচ্ছে ত শুনে রান্না বসাতেন। আজকাল সেটাও পরিবর্তন করা হয়েছে। এ পরিবারে তার কদর সবদিক থেকেই ফুরিয়ে আসছে দিনদিন।

অন্তিকে না বললেও অন্তি বেশ বুঝেছে কাদের বাড়িতে তারা এসেছে। এটা আরাবদের বাড়ি অন্তি তা চোখ বন্ধ রেখেই বলতে পারে। তার মায়ের মাখো মাখো ভাব আর বাবার বড়ো হাসিতেই তা প্রকাশ পাচ্ছে। বিশাল আলিশান বাড়ি আরাবদের। ছোটখাটো কোনো রাজপ্রাসাদ বলা চলে। নিঃসন্দেহে ডক্তার আজিম রুচিসম্পন্ন মানুষ।
বাড়ির একপাশে ফল বাগান করা হয়েছে অল্প জায়গা নিয়ে। তাতে রয়েছে তিন চার ধরণের ফল গাছ। ড্রাগন, কমলা, দেশি মাল্টা সহ আরো কি একটা ফল গাছ। অন্তি চারপাশে নজর বুলাতে বুলাতে সামনে এগিয়ে চলছে। নাহার অন্তিকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘সৌখিন ভীষণ তাই না? আমার ও কতো সখ ছিলো বাগান করার। তোর বাপের জন্য হলো কই।’

সাহেদ চাপা ধমক দেন।

‘নাহার আস্তে। লোক জানাতে এসেছ নাকি? যত অপবাদ বাড়ি ফিরলে দিবে। এক ঘন্টা সময় দিবো তোমায় অপবাদ দেওয়ার জন্য। এখানে কোনো কথা চাই না।’

অন্তি মুচকি হাসে। নাহার মুখ বাঁকায়। কিছু বললেই অপবাদ হয়ে যায়।

চলবে……..

(ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে