চুপিসারে ভালবাসি পর্ব-০১

0
5495

চুপিসারে ভালবাসি
–পর্বঃ১
সাদিয়া আফরিন নিশি
__________________

পুরো সিক্ত শরীরে আহমেদ বাড়ির সদর দরজায় এসে দাড়িয়ে আছে নীল। কলিংবেল চাপতেই খনেকের মধ্যে তার ফুপ্পি এসে দরজা খুলে দিল। নীলের শরীর থেকে বৃষ্টির পানি চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। একদম কাঁকভেজা হয়ে আছে সে। নীলকে এমন অবস্থায় দেখে তার ফুপির উদ্বীগ্ন কন্ঠ,

“তোর এমন অবস্থা কেন আব্বা। জলদি ভেতরে আয় নয়তো ঠান্ডা গায়ে বসে জ্বর চলে আসবে।”

নীল কোনো প্রতিত্তোরে করল না। চুপচাপ ভেতরে ঢুকে গেল। তার ফুপি দরজা লাগাতে লাগাতে বলল,

“যাহ ঘরে গিয়ে ভেজা কাপড় চেঞ্জ করে নে।”

এটা নীলের ফুপির বাড়ি হলেও এখানে তারজন্য আলাদা রুম বরাদ্দ আছে। কারণ এখানে তার নিত্য যাতায়াত।সে রুমে তার যাবতীয় প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র আছে। নীল গায়ের ভেজা কাপড় চেঞ্জ করে একটা কালো কালার গেঞ্জি আর একটা এ্যাস কালারের ট্রাউজার পড়ে নিল। অতঃপর ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গাঁ এলিয়ে দিল।

___

খানিকক্ষণ বাদেই ফের কলিংবেলের শব্দ শোনা গেল। মালিহা আহমেদ দ্রুত কিচেন থেকে বেড়িয়ে দরজা খুলতে গেলেন। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড় করে ঘরের মধ্যে ঢুকে পরল আরও তিনজন যুবক। এরা সবাই তার ভাই-পো। নীল হলো তার বড় ভাইয়ের ছেলে। মেঝ ভাইয়ের দুই ছেলে জিসান আর ইশান। ছোট ভাইয়ের এক ছেলে নাম সূর্য। এদের মধ্যে নীল সবার থেকে বড় আর সূর্য সবার ছোট। জিসান আর ইশান পরেছে মাঝ বরাবর। ছোট তিন ভাই-ই বড় ভাই নীল বলতে অজ্ঞান। নীলের সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে থাকাই তাদের নিত্যদিনের কর্ম।

“সানাই এর পো ধরে সকলে হাজির হয়ে গিয়েছ?”

হাসতে হাসতে কথাটি বলল মালিহা আহমেদ।

জিসান আর ইশান নিরবে হাসল। কিন্তু চুপ থাকল না সূর্য। সে বরাবরই ভীষণ দুষ্টু। সে লাফিয়ে এসে মালিহা আহমেদের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,

“হ্যাঁ কুপ্পী চলে এসেছি তো। তোমার হাতের টেস্টি, টেস্টি খাবার কী আর মিস করা যায়।”

সূর্য দুষ্টু প্রকৃতির হওয়ায় তার সবেতেই দুষ্টামি। মালিহা আহমেদকে সকলে ফুপ্পি বললেও সে বলে কুপ্পী। ছোট থেকেই এমন স্বভাব তার।

সূর্যের কথার পরিপ্রেক্ষিতে মালিহা আহমেদ বললেন,

“তুই কী করে জানলি আমি টেস্টি টেস্টি খাবার রান্না করছি?”

“আরেহ কী বল এসব? ভাই এসেছে আর তুমি টেস্টি খাবার রান্না করবে না এটা আগে কখনো হয়েছে আর না কোনোদিন হবে। ভাইয়ের জন্য তো তোমার সব কিছুই স্পেশাল। শুধু আমরাই পরগাছা।”

শেষ কথাটি রসিকতার ছলে বলল সূর্য। কিন্তু মালিহা আহমেদ স্বজোরে তার কান মলে দিয়ে বললেন,

“পাঁজি ছেলে খুব বেড়েছিস তাই না। দাড়া ভাবিকে ফোন করে এখনই নালিশ ঠুকব।”

“আরেহ আরেহ কানটা ছাড়ো না। লাগছে তো ভীষণ।”

“লাগুক আরও লাগুক। কানটা ছিড়ে হাতে না আসা পর্যন্ত আজ একদমই ছাড়ব না।”

“প্লিজ লক্ষী, সোনা কুপ্পী এমন করে না। প্লিজ ছেড়ে দাও আর কখনো এমন মজা করব না।”

“সত্যি তো?”

“সত্যি, সত্যি তিন সত্যি।”

অতঃপর মালিহা আহমেদ সূর্যের কান ছেড়ে দিলেন। ওদের কান্ড দেখে জিসান, ইশান পেট চেপে ধরে হাসছে। মালিহা আহমেদ ওদের থেকে বয়সে আহামরি বড় নয়। ভাইদের থেকে সবচেয়ে ছোট হওয়ায় তার বয়স তুলনামূলক কমই। আর উনি এ যুগের সঙ্গে বেশ তাল মিলিয়ে চলতে পারেন। এজন্য ভাই-পো দের সঙ্গে তার বন্ডিং টা একটু বেশিই। মালিহা আহমেদ তড়িঘড়ি করে কিচেনে চলে গেলেন।ওদিকে তার তরকারি পুড়তে বসেছে।

___

“কী ব্যাপার এই ঝড়,বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সকলে আমাদের বাড়িতে হাজির। মতলব টা কী তোমাদের? নিশ্চয়ই তোমাদের ওই পাগলা ভাইয়ের পাগলামিতে সাথ দিতে তোমরাও তার পেছন পেছন লেজ নাড়তে নাড়তে চলে এসেছ?”

কথা শেষ করতে করতে সোফায় এসে ধপাস করে বসে পড়ল সোহা। সোহা হলো মালিহা আহমেদের একমাত্র কন্যা। সে এ বছর নিউ টেনে পড়ছে। সূর্যের মতো সেও দুষ্টামিতে কোনো অংশে কম অবদান রাখে না। আর রুপের কথা বলতে গেলে তো এক কথায় অপ্সরী। জিসান,ইশান আর সূর্যের কোনো বোন না থাকায় তারা সবাই সোহা বলতে অজ্ঞান। ছোট থেকেই কোলে পিঠে করে ওরাই মানুষ করেছে সোহাকে। নীলের ব্যাপারটা ভিন্ন। সে আবার সবক্ষেত্রেই অন্য ধাঁচের। সোহা সকলের সঙ্গে ফ্রী হলেও নীলের সামনে ভেজা বেড়াল। নীলকে দেখলে এমন ভাব ধরে যেন সে ভাজা মাছটি উল্টে খেতেও জানে না। অপরদিকে নীলের অগোচর রাষ্ট্র উদ্ধার করে ফেলে। সোহার পছন্দের একটি জিনিস আছে এ বাড়িতে। সেটি হলো তার ওয়ান এন্ড ওয়ানলি টিয়া পাখি টুশি। টুশিকে ঘিরেই সোহার সকল সুখ,দুঃখ। সোহার ভালো লাগা,মন্দ লাগা সবকিছুই সে তার টুশির সঙ্গে শেয়ার করে। টুশি এখনো বাচ্চা। সবে আধো আধো বুলিতে ছোট্ট বাচ্চাদের মতো সোহা উচ্চারণ করতে শিখেছে। এর বাহিরে সে এখনো কোনো শিক্ষাই রপ্ত করতে পারে নি। তবে সোহা সর্বক্ষণ আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তাকে কথা শেখানোর জন্য।

সোহা বসতেই জিসান আর ইশান তার সঙ্গে নানারকম স্নেহমূলক কথা বলছে।তারা তেমন একটা সোহার কথা গায়ে মাখেনি। কারণ তারা জানে সোহা মজা করে বলেছে। এমনটা সে প্রায়শই করে থাকে। কিন্তু সূর্য, সে তো আর ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। সোহার কথার সে অভিনয়ী সুরে প্রতিত্তোরে করল,

“হ্যাঁ ঠিকই বলেছিস। আমাদের ওই পাগলাটে ভাইটি এই ঝড়,বৃষ্টির মধ্যে বাইক হাঁকিয়ে কাউকে দেখতে চলে এসেছে। এখন আমাদের আর কী করণীয় বল তার সঙ্গে আসা ছাড়া?আমরা ছাড়া তো আর তার কেউ নেই।”

সোহা কপাল কুঁচকে বলল,

“রাখো তো তোমার এক্টিং। এসব নাটক আমার ভালোই জানা আছে। তা সে কই? নিশ্চয়ই তার ফুপিকে দেখার জন্য তার এই পাগলামি?”

সূর্য রসিকতার ছলে বলল,

“ফুপিকে দেখার জন্য না কাকে দেখার জন্য সেসব তো আর আমরা জানি না তবে এসেছে এটুকুই শুধু জানি। তা সুয়োরানী, এখন বল তোর খবর কী? কূটনৈতিক চর্চা কেমন চলছে? বিয়ের পর দুয়োরাণীকে ঠিক কত রকম ভাবে জ্বালাবি বলে ঠিক করেছিস?”

সূর্য মজা করে সবসময় সোহাকে সুয়োরানী বলে ডাকে। এতে অবশ্য সোহা বেশ ক্ষেপে যায়। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সূর্যের কথায় সে সূর্যেকে সোফার কুশন দিয়ে মা’র’তে আরম্ভ করে আর বলে,

“সুয়োরানী তোমার বউ। আমি মোটেই সুয়োরানী নই। আমি একটা ইনোসেন্ট, কিউট,সুইট, নিষ্পাপ ভদ্র মেয়ে। সুয়োরানী হবে তোমার বউ। আর তোমার কপালে বহুত দুঃখ আছে সেই বউ নিয়ে দেখে নিও। এটা আমার অভিশাপ।”

সূর্য মা’র খেতে খেতে বলছে,

“শকুনের দোয়ায় গরু মরে না।”

সোহা আরও ক্ষেপে গেল।সে কুশন ফেলে দু-হাতে সূর্যের চুল মুঠো করে ধরে জোরে টানতে টানতে ক্ষিপ্র কন্ঠে বলল,

“আমি শকুন। তুমি শকুন। তোমার চৌদ্দ গুষ্টি শকুন।”

চুলের ব্যথায় সূর্য আহহ বলে আর্তনাদ করে সোহার হাত চেপে ধরল। ততক্ষণাৎ পেছন থেকে শোনা গেল কারো রাশভারি কন্ঠস্বর,

“কী হচ্ছে এখানে?”

ভয় পেয়ে গেল সূর্য, সোহা দুজনেই। সূর্য সোহার হাত ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসে পরল। সোহাও ভেতরে ভেতরে ভয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে তবুও কোনো রকমে নিজেকে শক্ত করে মাথা নিচু করে চুপচাপ এসে সোফায় বসে পরল। নীল দাড়িয়ে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করল সকলকে। তারপর কিচেনের দিকে মুখ করে কিছুটা জোরে সুর টেনে বলল,

“ফুপ্পি আমাকে এক কাপ কফি দিও তো প্লিজ। মাথাটা যন্ত্রণা করে আসছে।”

ওপাশ থেকে শোনা গেল,তুই ঘরে গিয়ে রেস্ট নে আমি এখনই পাঠাচ্ছি।

নীল আরচোখে আরও একবার ওদেরকে পর্যবেক্ষণ করে কপাল ডলতে ডলতে রুমে চলে গেল। নীল চলে যেতেই সবাই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। একত্রে হাসির আওয়াজ শোনা গেল পুরো ড্রইংরুম জুড়ে।

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে