কাগজের নৌকা পর্ব-৪

0
800

# কাগজের নৌকা
# লেখা: সাজ্জাদ আলম বিন সাইফুল ইসলাম
# পর্ব: ০৪
.
.
‘আচ্ছা আপন, মানুষ মইরা না গেলে হয় না? ক্যান মইরা যায়?’
আনমনে কথাটা বললো মালা। আমি ওর দিকে তাকাই। মুখটা কত শুকনো! ওর কথার কোনো জবাব নেই আমার কাছে। আমিও ছোট মানুষ। এত কথা বুঝি না। মানুষ যদি মরেই যাবে তাহলে ঘটা করে তাদের পৃথিবীতে পাঠালো কেন? কেনই বা এত কষ্ট দিয়ে আবার দুনিয়া থেকে তুলে নেয়। মাঝখান থেকে আমরা যাদের ভালোবাসি তারা মারা গেলে আমাদের দুঃখের সীমা থাকে না। মালার দাদী মারা যাবার পর মালার দুঃখের সীমা নেই। আমার আব্বা মারা যাবার পর আমার দুঃখের সীমা নেই।
‘আমি জানি না রে।’
একট ইট নিয়ে পুকুরে ছুঁড়ে মারলাম। স্টেশনের পাশের নোংরা পুকুরপাড়ে দুজনে বসে আছি। আমাদের মন খারাপ হলে এখানেই আসি। আজও এসেছি।
‘চল বড়ই পাড়ি।’
‘না রে, ভাল্লাগে না।’
আমি মালাকে কতভাবে আনন্দ দেয়ার চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। ও আর আগের মতো হাসে না। চুপচাপ থাকে। কাজও ঠিকমতো করে না। খাবারের জন্য যতটুকু দরকার ঠিক ততটুকু। মাঝেমাঝে মা ডেকে ওকে ভাত খাওয়ায়। আমি এখন মায়ের হাতের ভাত খাই না। ঘেন্না লাগে। বাঁচার জন্য শুধু মায়ের রান্না করা খাবার খাই। মাকে প্রচণ্ড ভালোবাসি তাই তাকে ছেড়েও যেতে পারি না।
‘আপন, চল এই স্টেশন থাইকা দূরে কোথাও চইলা যাই।’
‘দূরে!’
মালার কথা শুনে আমি অবাক হই। কী বলে মেয়েটা?
‘হ দূরে।’
‘ক্যান?’
‘এইখানে আর আমার ভাল্লাগে না। সবকিছু ফাঁকা ফাঁকা লাগে।’
‘মাকে আমি খুব ভালোবাসি রে মালা।’
‘আমি জানি। চাচীকেও সঙ্গে নেব আমরা।’
মালার এ কথার উত্তর দেয়ার ভাষা নেই। আমিও এই কোলাহলপূর্ণ স্টেশন ছেড়ে চলে যেতে চাই। দূর থেকে দূরে, বহূ দূরে। যেখানে বারবার স্টেশন আসার শব্দ নেই, সাহেবদের লাত্থি খাবার জো নেই, যেখানে বাবুল চাচাদের মতো সুবিধাবাদী লোকজন নেই। কিন্তু মা কি যেতে রাজি হবে? আমার মনে হয় না। কারণটা হয়তো আমি মালাকে বলতেই পারব না।
‘কী খাইছিস সকালে?’ আমি প্রশ্ন করলাম।
‘মুড়ি পানি দিয়া ভিজা খাইছি।’
‘এখন তো দুপুর গড়াই গেল। চল কিছু কিন্না খাই।’
‘খিদা নাই রে।’
‘তুই কত শুকাই গেছিস তুই নিজেও জানিস না।’
‘তোর মতো এভাবে কেউ বলে না রে। বলার লোকও নাই। আমি মইরা গেলে ভালা হইত।’
আমার চোখে পানি চলে আসে। কী সব আবল তাবল বলে মেয়েটা! এভাবে কথা বলতে আজকেই প্রথম দেখতেছি।
‘তুই মইরা গেলে আমার কী হইব রে মালা?’
‘আমার তো কেউ নাই।’
‘আমি আছি না? তোর বন্ধু?
‘আমাকে ছাইড়া যাস না কখনও আপন। তুই না থাকলে আমি একেবারে মইরা যামু।’
আমি মেয়েটার দিকে তাকাই। আজকে তার কষ্টগুলো বলে উড়িয়ে দিচ্ছে। আমার ভেতরটাও ফেটে যাচ্ছে। আমিও ওকে ছাড়া থাকতে পারব না। ওকে ছাড়া একটা মুহূর্ত আমার ভালো লাগে না। আমি প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললাম,
‘চল, এখন উঠি। ঝুপড়িতে যাইতে হইব।’
দুজনে উঠে স্টেশনের দিকে আসলাম। ভাংড়ির মহাজন আমাকে দেখে চিৎকার করে বললো,
‘কী রে আপন, আইজকাল কই থাকোস? ভাংড়ি বেঁচতে আসোস না। ঘটনা কী?’
‘মন ভালা নাই মহাজন সাব। ভাংড়ি কুড়াইতাছি না। কুড়াইলে নিয়া আসমু নে।’
‘এসব কথা কইলে হইব? প্যাটে ভাত জুটব ক্যামনে?’
‘জুটব মহাজন সাব। নাইলে প্যাট খালি রাখমু। সেই অভ্যাস তো আছেই।’
এ কথা বলেই আবার হাঁটা দিলাম। শালা শয়তানের বাচ্চা। এতগুলা করে ভাংড়ি দেই আর টাকা দেয় যাচ্ছেতাই। ঠকিয়ে খাওয়া এদের স্বভাব। একে না দিয়েও উপায় নেই। এখানে আর এমন কেউ নাই যার কাছে ভাংড়ি দেব। শালারা আমাদের চুষে খাচ্ছে। আল্লাহয় বিচার করবে নিশ্চয়ই।
.
ঝুপড়িতে ফিরে দেখলাম অনেক লোকজন। ঘটনা কী কিছুই বুঝতে পারলাম না। লোকজন ছি ছি করছে। ঘরের ভেতর মা কাঁদছে। বাবুল চাচাকে বেঁধে রাখা হয়েছে। আমাকে দেখে মায়ের কান্না যেন বেড়ে গেল। আমার বুঝার বাকি রইলো না কী ঘটেছে। একজন এসে আমাকে বললো,
‘আপন তোর মায়েরে ভালা ভাবছিলাম। কিন্তু দিনেদুপুরে এসব খাবার কাম কইরা বেড়াইব ভাবতে পারি নাই। ছিহ, ছিহ। ওয়াক থু।’
আমার মেজাজ গরম হয়ে গেল। রাগে বললাম,
‘তাতে আপনাগো কী? ভাবতে কেডায় কইছে? আপনাগো কাম কাজ নাই? মাইষে ঘরের ভেতর কী করে সেসব দেইখা বেড়ান। শরম লজ্জা নাই আপনাগো?’
‘যেমন মা তার পোলাও তেমন। ওয়াক থু।’
‘থুথু অন্যখানে গিয়া ফেলেন। এইখানে ভিড় করবেন না। যান ভাগেন তো।’
আমার কথা শুনে মাহিম চাচা এসে একটা কষে থাপ্পড় দিয়ে বললো,
‘আমাগো এ বস্তিতে এসব খারাপি চলব না। খুব বড়বড় কথা শিখা গেছস না?’
থাপ্পড়টা এত জোরে দিলো যে আমার গালে পাঁচটা আঙুল মনে হয় বসে গেছে। কতদিন পর কেউ আমাকে মারলো। থাপ্পড়টা খেয়ে আমি চুপ করে গেলাম। আমার চোখের কোনে পানি জমতে লাগল। আমি নিজেকে সংবরণ করলাম।
‘আব্বা মরার পর যখন না খাইয়া আছিলাম কেউ কি আসছিলেন এক প্লেট খাবার নিয়া? কেউ কি একবারও বলছিলেন, আমি আর আমার মা খাইছে কিনা? বলছিলেন কেউ? অহন আসছেন সাধু সাজতে?’
মাহিম চাচা বললো, ‘তোর এসব কথা আমি শুনমু না। আমরা সবাই মিলা একটা সিদ্ধান্ত নিছি।’
‘আপনারা কেডা? ক্যান আপনাগো সিদ্ধান্ত মাইনা নিমু?’
‘নইলে বস্তি থাইকা বাইর কইরা দিমু তোগোরে। বুঝলি?
আশেপাশের জড়ো মানুষগুলা বলে উঠলো, ‘হ ঠিক ঠিক।’
মাহিম চাচা এ বস্তির দাপুটে লোক। সবাই ভয় পায় তাকে। তার সামনে এসব বলছি দেখে মালা আমারে হাত টেনে ধরে বলছিল বারবার,
‘চুপ কর আপন।’
আমি থামি নাই।
মাহিম চাচা বলে উঠলো, ‘দেখ জমিলা, তোর পোলার লগে আমার কোনো কথা নাই। যা কথা সব তোর আর বাবুল মিয়ার লগে।’
বাবুল চাচা সাথে সাথে বললো, ‘আপনারা কী বলতে চান?’
‘হয় তুমি জমিলা রে বিয়া করো নাহয় জমিলারা বস্তি ছাড়ুক। বাবুল মিয়া তুমি কয়েক মাস ধইরা খুব যাওয়া আসা করতাছ। আমরা সব দেখছি, খালি হাতেনাতে ধরার অপেক্ষায় আছিলাম।’
‘আমি জমিলারে বিয়া করুম।’
বাবুল চাচার মুখে এসব কথা শুনে মা চমকে উঠলো। এ চমকানোর অর্থ আমি বুঝি নাই। একথা শুনে আমি কী বলব তা ভাবিও নাই। কোনো উত্তরও নাই আমার কাছে। আমি শুধু নিথর হয়ে বসে পড়লাম। আব্বার জায়গায় অন্য কাউকে আমি কখনও কল্পনাও করি না। তবে মায়ের সুখের জন্য সব পারব। মা যাতে সুখে থাকে, ভালো খেতে পারে, ভালো পরতে পারে।
মা উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
‘বাপ, কী চাস তুই?’
‘আমি কী কমু মা?’
‘তুই যা বলবি তাই হইব। তুই যদি বলিস আমরা বস্তি ছাইড়া চইলা যাই তাইলে চল বাপ। আর যদি…….!’
মা কাঁদছে। সবাই আজকের নাটক দেখছে। জীবনে কখনও এমন পরিস্থিতি আসবে ভাবতেও পারি নাই। আমি মেকি হেসে বললাম,
”তুই সুখে থাকলে আমি সুখী হমু মা।’
মা আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো। কে যেন একজন বলে উঠলো,
‘কাজী ডাকো। ময়নার মা, জমিলারে সাজাও, বিয়ের সাজে সাজাও।’
একথা শুনে আমরা কলিজাটা কাঁপা শুরু করলো। কী যে আমার হলো ঠিক বুঝতেছি না। আমি মাকে ছেড়ে উঠলাম। বস্তির এক কোনে গিয়ে বসলাম। মালা আমার পাশে বসে বলল,
‘মন খারাপ করিস না আপন।’
আমি ওর দিকে তাকিয়ে মেকি হাসি। মানুষ কত তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছে। তাতে আমার কী। আজকের এ ঘটনা হয়তো দুদিন পর সবাই ভুলে যাবে। কিন্তু যদি আমার মা ভালো থাকে, থাকুক না। সমস্যা কী! আমার তো কোনো সমস্যা নাই।
.
দ্বিতীয়বার মাকে বধূবেশে দেখার কোনো ইচ্ছে আমার ছিল না। আমরা যেভাবে ছিলাম সেটাই ভালো ছিল। একবেলা অভুক্ত থাকতাম সেটাই ভালো ছিল। কিন্তু তাতে সুখ ছিল, শান্তি ছিল। রাতে ট্রেন আসার শব্দেও আমাদের শান্তির ঘুম হতো। কিন্ত শেষ কয়েকমাস ধরে আমার চোখে ঘুম নেই, শান্তি নেই। বাড়িতে হরহামেশাই মাছ নাহলে গোস্ত ঠিকই রান্না হয়। এসব খেয়ে আমি তৃপ্তি পাই না, পেট ভরে না। সেই পান্তা মরিচ-পেঁয়াজ দিয়ে ডলে ডলে খেতে মন চায়। যাতে সুখের ঢেকুর ওঠে। খাওয়ার পর আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে মুখ থেকে অস্ফুটভাবে বলে বলে উঠতাম,
‘আলহামদুলিল্লাহ।’
(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে