এক শহর প্রেম পর্ব-৩৮+৩৯

0
1260

#এক_শহর_প্রেম💓
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩৮
মারসাদ হতবুদ্ধির মতো আদিরার দিকে তাকিয়ে রইল। আদিরার সেদিকে কোনো ধ্যান নেই। সে তো মারসাদের হাত ধরে পথ চলছে। মারসাদ হুট করে থেমে গেল। হাতে টান লাগায় আদিরাও থামতে বাধ্য হলো। মারসাদ গম্ভীর কন্ঠে বলে,

–এসবের মানে কী?

আদিরা দাঁত কেলিয়ে বলল,
–কিছুই না। আমার আজ খুব ইচ্ছে শ্বশুরবাড়ি যাব। মাহিকে আমি কথা দিয়েছি আর শ্বশুরবাড়ি স্বামী ছাড়া গেলে খারাপ দেখায় তো। প্লিজ! প্লিজ! না করবেন না।

মারসাদ শান্ত স্বরে আদিরার কাছে গিয়ে বলে,
–তোমাকে ওখানে বাকিরা ভালো ভাবে নাও নিতে পারে। একটু বুঝো। তখন তোমারই খারাপ লাগবে।

আদিরা অসন্তোষ প্রকাশ করে বলে,
–না না না। আমি যাবোই। আপনিও যাবেন। আমি টেনে নিয়ে যাব। নয়তো রাস্তার মাঝে বসে কান্না শুরু করব। তখন থামিয়েন।

মারসাদ দুহাত দিয়ে নিজের মুখমণ্ডল মুছে নিয়ে আদিরার হাত ধরে বলল,
–সময় করে অন্যদিন দেখিয়ে আনব। আজ একটু পর সন্ধ্যা নামবে।

আদিরা মারসাদের হাত ঝাড়া দিয়ে ফেলে সামনের দিকে হাঁটতে লাগল। মারসাদ অগ্যতা আদিরার পেছোনে গেল। আদিরা মুখ ফুলিয়ে হেঁটে চলেছে। মারসাদ বার কয়েক ডাক দিয়েও যখন দেখল শুনছে না তখন দৌঁড়ে গিয়ে আদিরার হাত ধরে পাশাপাশি হাঁটতে লাগল। আদিরা নিঃশব্দে হাসল।

মারসাদ ও আদিরা চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আছে। মাহি ও ওর দাদী ওদের সাদরে গ্রহণ করল। মাহি এক ছুটে তার বাবার কাছে গেল বলতে। মারসাদের দাদী আদিরাকে হাত ধরে সোফায় বসিয়ে টুকটুক করে কথা বলছে। আদিরার সম্পর্কে জানছে। মারসাদ অপরপাশের সোফায় বসে তা হাসিমুখে দেখছে। বাড়ির পুরোনো কাজের লোক ট্রেতে করে নাস্তা ও জুস আনল। মারসাদের দাদী মিষ্টির প্লেটটা হাতে নিয়ে মারসাদকে বললেন,

–এদিকে আয় তুই। অতো দূরে বসেছিস কোনো? একে তো আমাকে না জানিয়ে বিয়ে করেছিস আর এখন আসার পর থেকে কথাই বলছিস না।

মারসাদ উঠে গিয়ে তার দাদীর পাশে বসল তারপর দাদীকে জড়িয়ে ধরল। মারসাদের দাদী তার কপালে চুমু দিয়ে আদিরাকে প্রথমে মিষ্টি মুখ করালো তারপর মারসাদকে করালো। আদিরার কপালে চুমু দিয়ে তিনি বলেন,

–ভারী মিষ্টি মেয়েগো। আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আমার দাদুভাইয়ের পছন্দ খারাপ হতেই পারেনা।

আদিরা ও মারসাদ দুইজনে আলতো হাসল। দাদী আদিরার হাতে সেমাইয়ের প্লেট দিয়ে বলেন,

–আগে সেমাই খাও। আজকে সব নাস্তা আমি রান্না করেছি। হরেক রকম পিঠাও আছে।

মারসাদ আগে পাটিসাপটা পিঠা নিল। মাহি কিছুক্ষণ পর ওর বাবাকে অনেক জোর করে নিয়ে এসেছে। মিস্টার আরসাদ দরজার কাছে এসে দূর থেকে ছেলের পিছন সাইড দেখছেন। তার চোখে পানি টলমল করছে। মিস্টার আরসাদকে মাহি টেনে নিয়ে আসেন। আদিরা শ্বশুরকে দেখে সেমাইয়ের খালি প্লেট রেখে সালাম দেন। মিস্টার আরসাদ খুব খুশি হোন। আদিরা দাঁড়িয়ে বলে,

–বাবা বসেন।

মিস্টার আরসাদ বসেন। মারসাদ নিচের দিকে চেয়ে আছে। আদিরা তার শ্বশুরের সাথে কথা বলছে। শরীর কেমন এখন এসব জিজ্ঞাসা করছে। মিস্টার আরসাদও আদিরার সম্পর্কে টুকটাক জিজ্ঞাসা করল। মাহি তো তাকে সবই বলেছে। মাগরিবের আজান হলে মারসাদ বেরিয়ে যায় নামাজ পড়তে। আদিরাও এখানে নামাজ পড়ে দাদীর ঘরে বসে আছে। মাহি নিজে সকাল থেকে মারসাদের ঘরটা ঠিক করেছে কাজের লোকের সাহায্য নিয়ে। মাহি এখন মারসাদের রুমে গিয়ে কাজের মহিলাকে বলে,

–আন্টি, ড্রাইভার আঙ্কেলকে বলেন তো ফুল গুলো দিয়ে যেতে। আমি ফ্লাওয়ার ভাষে ফুল গুলো রাখব। সাথে ওই বড়ো পাত্রটাতেও মোমবাতির সাথে কাঠগোলাপ, পদ্ম, বেলি ফুল রাখব।

কাজের মহিলাটি ফুল আনতে চলে গেল। মাহি যা যা বাকি সব করে ফেলেছে। মাহির মা দরজায় দাঁড়িয়ে এসব দেখছিল। তার ভাবভঙ্গিতে বিরক্তির ছাঁপ। তিনি বলেন,

–এসব করছ শুধু শুধু। টাইম ওয়েস্ট। ওই বে*য়াদ*বটা এসবের তোয়াক্কাই করবে না। আর বিয়ে করেছে এক গ্রামের মেয়েকে। সামিরা কী খারাপ ছিল নাকি! যতসব ন্যাকা।

মাহি জোরপূর্বক হেসে বলে,
–তোমার অপিনিয়ন কেউ চায়নি মম। প্লিজ নিজের মতো থাকো। কারও কোনো কিছুতে নাক গলিও না। তোমার কথা শোনার মতো টাইম আমাদের নেই। আর হ্যাঁ, আমার দাভাই ও ভাবিকে একটা বাজে কথাও বলবে না। বললে কিন্তু আমিও সবার সামনে মুখ খুলব।

মিসেস মনিকা রেগে বলেন,
–দিন দিন বে*য়া*দব হচ্ছো তুমি।

তিনি চলে গেলে মাহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের কাজ করতে থাকে। নামাজ পড়ে মারসাদ আদিরাকে ফোন করে বাইরে আসতে। তাদের ফিরতে হবে। আদিরা সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে সে আজ ফিরবে না। আজ এখানেই থাকবে। মারসাদ আদিরাকে কয়েকবার বলেছে চলে আসতে কিন্তু আদিরা আসবে না বরং মারসাদকে বাড়িতে আসতে বলছে। মারসাদ শেষমেশ রাগে আদিরাকে থাকতে বলে সেখান থেকে হোস্টেলে চলে গেছে। আদিরা ফোন হাতে নিয়ে মন খারাপ করে বসে আছে। মারসাদের দাদী ও মাহিও মন খারাপ করে আছে।

_________

মারসাদ একটা টিউশন করিয়ে হোস্টেলে ফিরে চোখের উপর হাত রেখে শুয়ে আছে। রাত ৯টার কিছুটা বেশি বাজে। আদিরার নাম্বার থেকে কয়েকটা কল এসেছে কিন্তু মারসাদ রিসিভ করেনি। মেসেজ করে দিয়েছে, যদি ফিরতে চায় তাহলে বলতে। রবিন এসে মারসাদকে বলে,

–যা না। মেয়েটা প্রথম শ্বশুরবাড়ি গিয়েছে আর তুই জেদ ধরে রেখে চলে আসলি। মিসেস মনিকা এখন কথা শোনাবে মেয়েটাকে।

মারসাদ ভাবলেশহীন ভাবে বলে,
–উনার তো ভালো লাগবে আমি না থাকাতে। আদিরাকে আমি বলেছি চলে আসতে চাইলে বলতে। আমি রাস্তায় অপেক্ষা করব ওর জন্য।

রবিন বলে,
–আজ ওখানে থাকলে কী এমন হতো? ওটা তোরও বাড়ি। তোর ছোটোবেলা সেখানে। তোর মায়ের ও আপিলির স্মৃতি সেখানে।

মারসাদ কিছু বলল না। রবিন কিছুক্ষণ মারসাদের দিকে চেয়ে থেকে মৃদুলদের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ে। ওরা প্রত্যেকে মারসাদকে বলেছে ওই বাড়িতে যেতে কিন্তু মারসাদ যাবে না।

ঘড়ির কাটা যখন দশটার ঘরে তখন আহনাফের ফোন বেজে উঠে। আহনাফ স্ক্রিনে মাহির নাম্বার দেখে রিসিভ করলে মাহি হড়বড়িয়ে বলে,

–আদু ছাদে গিয়ে একা একা বসে আছে অনেকক্ষণ হলো। আর দাভাই চলে যাবার পর বাবা ও দাদী অনেক কস্ট পেয়েছে। দুইজনেই নিজেদের রুমে দরজা লাগিয়ে বসে আছে। আদিরাকে ডাকতে গেলাম তাও আসল না। তার এক কথা সে দাভাই না আসলে সারারাত ছাদেই বসে থাকবে। শীতকাল চলে গেলেও রাতের বেলা শীততো পড়েই তাই না?

আহনাফ চিন্তিত সুরে বলে,
–আমি মারসাদকে বলছি। দেখি রাজি হয় কীনা। তুমি তাও একটু চেষ্টা করো তাদের মানাতে।

মাহি সম্মতি দিয়ে ফোন রেখে দেয়। আহনাফ মারসাদের পাশে বসে। তারপর মারসাদকে টেনে তুলে বলে,

–এখুনি ওই বাড়িতে যাবি। আদিরা অনেকক্ষণ যাবত ছাদে বসে আছে। সারারাত সেখানেই থাকবে তুই না গেলে। আর তোর বাবা ও দাদীর কথা নাই বা বলি। তোর তো ওদের কেয়ার নেই। তারা দুইটা বছর ধরে তোকে এতো বলল শুনলি না। এবার নিজের বউয়ের জন্য নাহয় যা! দাদী বৃদ্ধা মানুষ। তুই যখন সেখানে গিয়ে না থেকে ফিরে আসিস তখন তার কেমন লাগে? ভাব একটু। যা চলে গেছে তা কী ফিরবে? তোর সকলের শাস্তি দেওয়াও তো শেষ। তাহলে? কেনো সম্পর্কের দূরত্ব আরও বাড়াচ্ছিস? আমরা চারজন জানি তুই তোর পরিবারকে কতোটা ভালোবাসিস। ভালো না বাসলে কী মাহি তোর সৎ বোন! মিসেস মনিকার উপর রাগটা ওর উপর ঝাড়তে পারতি না? জবাব দে!

মারসাদ চুপ করে আছে। তার মনের অভ্যন্তরে ঝড় বয়ে চলেছে। পুরোনো সকল কিছু তাকে এতোটাই স্পর্শ করে যে সে কিছু ভাবতে পারেনা। আহনাফকে প্রতিউত্তর না করে সে শার্ট গায়ে দিয়ে বেরিয়ে পরে। প্রায় রাত এগারোটা নাগাদ সে তার বাড়ির বাহিরে দাঁড়িয়ে। মারসাদ লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে আদিরাকে মেসেজ করে,

“ছাদ থেকে নেমে দরজা খুলো। তোমার দাদী শাশুড়িকে বলো, তুমি পেরেছ। তোমার জেদের কাছে এই মারসাদ আজ পরাজিত হয়েছে দেখবে না!”

আদিরা মেসেজটা দেখে তৎক্ষণাৎ দৌঁড়ে ছাদ থেকে নেমে দাদীর দরজার সামনে গিয়ে মারসাদের আসার কথা জানিয়ে মুখ ভর্তি হাসির ফোয়ারা তুলে দরজা খুলে। মারসাদ ভেতরে আসে। মারসাদকে আসতে দেখে সবাই খুশি হলেও মিসেস মনিকা খুশি হলেন না। তার কাছে মারসাদকে নিজের সুখের অন্তরায় মনে হয়। তার স্বামী, সন্তান তার হয়েও যেন তার না! আদিরার দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মিসেস মনিকা নিজের রুমে ঢোকে দরজা লাগিয়ে দেয়। মারসাদের দাদী মারসাদকে টেনে ডাইনিং টেবিলে নিয়ে যায়। মাহি ও আদিরা গিয়ে মিস্টার আরসাদকে জোর করে ডেকে নিয়ে আসেন। সবাই একসাথে ডাইনিং টেবিলে বসে। মারসাদের দাদী তাকে নিজ হাতে খাইয়ে দেয়। মারসাদ নিশ্চুপে খেয়ে নেয়। দাদী কাঁদছে বলে মারসাদ তাকে বসিয়ে চোখ মুছিয়ে নিজে দাদীকে খাইয়ে দেয়। মিস্টার আরসাদ আড়ালে নিজের চোখ মুছে নেন।

মাহি মারসাদ ও আদিরাকে ওদের ঘরে দিয়ে আসে। যাওয়ার সময় মাহি দাঁত কে*লিয়ে বলে যায়,

–হ্যাপি ফার্স্ট নাইট ইন দিস হোম! ভাইয়া এন্ড ভাবী!

মারসাদ চোখ রাঙালে মাহি দৌঁড়ে চলে যায়। মারসাদ ঘড়ি খুলতে খুলতে ড্রেসিংটেবিলের সামনে গিয়ে বলে,

–ননদ-ভাবী মিলে দারুন প্ল্যানিং করেছ! দিন দিন আরও জেদি হচ্ছো তুমি।

আদিরা মুচকি হাসে। তারপর বলে,
–দেখলেন, দাদী ও বাবা কতো খুশি হয়েছে। তাদের চোখে আনন্দ অশ্রু ছিল। আর এতোদিন পর নিজের বাড়িতে নিজের রুমে থাকবেন। রুমটাও আপনাকে মিস করছিল। আমার কিন্তু রুমটা খুব পছন্দ হয়েছে।

মারসাদ ওয়াশরুম থেকে হাত-মুখ ধুয়ে এসে বলল,
–কাল আমরা চলে যাচ্ছি। সবার খুশি দেখলাম কিন্তু যার জন্য বাড়ি ছাড়লাম সে তো একবারও আমায় কিছু বলল না। ঘরছাড়া পাখি সহসা ঘরে ফেরেনা।

আদিরার মন আবার খারাপ হয়ে গেল। মারসাদ ব্যালকনিতে চলে গেল। তার পিছু পিছু আদিরাও গেল। মারসাদের পাশে বসল আদিরা। আদিরাকে বসতে দেখে মারসাদ আদিরার কোলে মাথা রেখে ব্যালকনিতেই শুয়ে পরল। আকাশে অর্ধ চন্দ্র অন্ধকার পৃথিবী আলোকিত করার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টারত। নিরবতায় সকল না বলা অনুভূতি রাতের আঁধারে বিলীন হচ্ছে।

___________
সকালে আদিরা ঘুম থেকে নামাজ পড়ে উঠে রান্নাঘরে চলে গেছে। মারসাদ নামাজ পড়ে ঘুমোচ্ছে। রাতে ওরা অনেকটা সময় ব্যালকনিতে চন্দ্রবিলাশ করে রুমে এসে ঘুমিয়েছে। আদিরা রান্নাঘরে খুঁজে খুঁজে প্রয়োজনীয় সব বের করে নাস্তা বানালো। সাধারণ নাস্তা। রুটি ও সবজি সাথে ডিম ভাজি। তারপর চা বানিয়ে সবাইকে দিতে গেল। সবার জন্য লেবুচা করল। লেবুচা হার্টের জন্য ভালো। মারসাদ ও মাহির জন্য কফি। মাহিকে কফি দিয়ে এখন গেছে মারসাদকে ডাকতে। রুমে গিয়ে আদিরা কফির মগটা বেড সাইড টেবিলে রেখে জানালার পর্দা সরিয়ে গ্লাস খুলে দিল। পর্দা সরানোর সাথে সাথে রোদের ঝিলিক গ্রিলের ফাঁক গলিয়ে এখন ঘুমন্ত মারসাদের মুখের উপর পরছে। আদিরা মারসাদের পাশে বসে মারসাদকে আস্তে আস্তে ডাকছে। ঘুমন্ত ব্যাক্তিকে জোরে ডাকা ঠিক না। এতে স্ট্রোকের সম্ভাবনা থাকে। মানুষের ঘুমের মধ্যে স্ট্রোক করার হার বেশি থাকে।

মারসাদ চোখে হাত দিয়ে আড়মোড়া ভেঙে আদিরার দিকে তাকালে আদিরা বিনিময়ে মিষ্টি হেসে মারসাদকে কফির মগটা দেখায়। আদিরা এরপর উঠে যেতে নিলে মারসাদ ওর হাত টেনে ধরে বলে,

–থ্যাংকিউ ফর কামিং ইন মাই লাইফ। থ্যাংকিউ ফর এভরিথিং মাই লাভ।

আদিরা মারসাদের ঘুমে ভাব ধরা চুল কপারে পরে থাকা মুখাবয়বে খানিক চাইল অতঃপর চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে মারসাদের কপালে নিজের ওষ্ঠদ্বয় স্পর্শ করাল। তারপর মিষ্টি হেসে চলে গেল।

সকালের নাস্তার টেবিলে সকলে উপস্থিত হলেও মিসেস মনিকা এলো না। সবাই আদিরার রান্নার প্রশংসা করল। নাস্তা খেয়ে ওরা ভার্সিটির জন্য চলে গেল। আদিরা তার দাদীশাশুড়ি ও শ্বশুরকে বলে গেল খুব জলদি ওরা আবার আসবে। দাদী আদিরার মাথায় হাত রেখে কপারে চুমু দিলেন। এরপর ওরা চলে আসল।

_________
আরও কয়েকদিন কেটে গেল। হুট করে একদিন রাত এগারোটায় মাহি মারসাদকে ফোন করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

–দাভাই বাবা!

চলবে ইনশাআল্লাহ,

#এক_শহর_প্রেম💓
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩৯
মারসাদের বুক কেঁপে উঠল। একে তো মাহি কাঁদছে তারউপর বাবা বলে থেমে আছে। মারসাদ ভীত কন্ঠে সুধালো,

–কী হয়েছে বাবার?

মাহি ঢোক গিলে বলে,
–বাবার… বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে মনে হচ্ছে। আমি..আমি একটু আগে স্টাডিরুমে গিয়ে দেখি..

মারসাদ যা বুঝার বুঝে গেছে। গ্রীষ্মের গরমেও তার হাত-পা কেমন জমে যাচ্ছে। শরীর বেয়ে শীতল স্বেদধারা নেমে গেল। মারসাদ কোনোমতে হসপিটালের ঠিকানা নিয়ে দ্রুতবেগে বেড়িয়ে গেল। আহনাফ, মৃদুলরা ব্যাপারটা না বুঝে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ কী এমন হলো যার জন্য এই ক্ষিপ্রতা! আহনাফরা হুট করে একে অপরের দিকে তাকিয়ে মারসাদের পেছোনে ছুটে হোস্টেলের দারোয়ানকে জিজ্ঞেসা করলে দারোয়ান মারসাদ কোন দিকে গিয়েছে জানিয়ে দেয়। কিন্তু কোথায় যাচ্ছে তা জানার জন্য আহনাফ আদিরাকে ফোন করল। আদিরা এতো রাতে আহনাফের ফোন দেখে অবাক হলো খানিকটা। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ফোন রিসিভ করলে আহনাফ দ্রুত বলে,

–একটু আগে তুমি মারসাদকে ফোন করেছিলে? এই পাঁচ মিনিট আগে?

আদিরা বিচলিত স্বরে বলল,
–নাতো। কেনো কী হয়েছে ভাইয়া?

আহনাফ কথা কা*টানোর জন্য হাসার চেষ্টা করে বলল,
–আরে না। কিছু না। এমনিই। রাখি। আল্লাহ হাফেজ।

ফোন রেখে দিলে আদিরা ভাবনায় পরে গেল। হুট করে কী এমন হলো যে আহনাফ ভাইয়া তাকে ফোন করে জানতে চাইল? উনার কন্ঠও কেমন অগোছালো শোনাচ্ছিল।
আহনাফ এবার মাহিকে ফোন করলে রিং কয়েকবার বাজার পর শেষ সময়ে মাহি ফোন রিসিভ করলে আহনাফ মাহির কান্না জড়িত “হ্যালো” শুনে বিচলিত হলো প্রচণ্ড। আহনাফ উৎকণ্ঠিত হয়ে বলল,

–কী হয়েছে তোমার? কন্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেনো? মারসাদকেও দেখলাম দৌঁড়ে চলে গেল। কী হয়েছে বলো?

মাহি ফুঁপিয়ে উঠল। আহনাফ ব্যতিব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করল,
–কী হয়েছে বলবে তো? কান্না থামাও? কী হয়েছে? দাদীর কিছু হয়েছে? আঙ্কেলের কিছু নয়তো?

মাহি নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। কান্নামাখা কন্ঠে বলল,
–বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। আমি হসপিটালে আছি। দাদীও কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল তাই তাকে ঘুমের ইন*জে*কশন দেয়া হয়েছে।

আহনাফ বেশি কথা না বাড়িয়ে হসপিটালের ঠিকানা নিয়ে মৃদুলদের নিয়ে বেরিয়ে পরল।

_________

মারসাদ হসপিটালের রিসেপশনে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে এসে জিজ্ঞাসা করে,
–আমার বাবা কোথায়? মানে মিস্টার আরসাদ খান কোথায়?

রিসিপশনিষ্ট তাকে আইসিউর দিক দেখিয়ে দিলে মারসাদ ছুটে যায়। আইসিউর বাহিরে কান্নারত মাহিকে দেখে। মাহি মারসাদকে দেখে দৌঁড়ে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকে,

–দাভাই! দাভাই! বাবাও আমাকে ছেড়ে চলে যাবে? বল না?

মাহি প্রশ্ন করে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মিসেস মনিকা মলিন দৃষ্টিতে বেঞ্চে বসে মাহি ও মারসাদকে দেখছে। মিস্টার আরসাদ বুকে প্রচণ্ড ব্যাথা নিয়েও গাড়িতে যতক্ষণ জ্ঞান ছিল তখন বলেছিল,

“আমার জীবনটাকে বিষাদময় করতে তুমি অন্যতম মনিকা। তোমার স্বার্থপরতা আমায় নরকতূল্য যন্ত্রনা দিয়েছে।”

মিসেস মনিকা তারপর থেকে একদম নিশ্চুপ হয়ে আছে। তার ২২ বছরে করা সবকিছু তার চোখে ভাসছে। মানুষটা তাকে সুস্থ অবস্থায় সারাদিন বাজে বললেও সে গায়ে মাখে না কিন্তু গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় বলা কথা গুলো তার ভাবান্তর করাচ্ছে। সে কী সত্যি স্বার্থপর হয়ে গেছে? নিজেকে নিজের কাছে খুব হীন লাগছে। এই লোকটাকে ভালোবাসেন তিনি। নয়তো বিয়ে করতেন কেনো! কিন্তু নিজের মধ্যে স্বার্থপরতার বিজ কবে গাছে পরিনত হয়েছে তা সে বুঝতেই পারেনি তখন। তার নিজের মেয়েও তাকে এই দুঃখের দিনে আশ্রয় ভাবে না। মিসেস মনিকা পাথরের মূর্তির মতো বসে আছে। তার দৃষ্টিতে কোনো ভাষা নেই।

ডাক্তার বের হলে মাহি ও মারসাদ তার কাছে যায়। ডাক্তার হতাশ স্বরে বলেন,
–দেখুন, মিস্টার আরসাদের হার্টে দুইটা ধমনিতে অনেকটা ব্লক ছিল। সে মেডিকেশন নিচ্ছিল। এখন ব্লক আরও বেড়ে গেছে। আমরা এনজিওপ্লাস্টি করব। কিছুটা রিস্ক আছে। আশকরি আল্লাহর রহমতে ঠিক হয়ে যাবে।

রাত বারোটার মতো বাজে। মারসাদ পকেট থেকে ফোন বের করে দেখে আদিরা ও আহনাফদের অনেকগুলো মিসডকল। সাইলেন্ট থাকার দরুন শুনতে পায়নি। ফোন কিভাবে সাইলেন্ট হলো সে নিজেও জানে না। আহনাফরাও এসে পৌঁছাল। ওরা এখন মাহি ও মারসাদের পাশে আছে। আদিরার অনবরত ফোন করা দেখে মারসাদ তাকে ফোন করে সবটা জানাল। আদিরা চাইছিল এখুনি আসতে কিন্তু মারসাদ মানা করল। রাতের বেলা আসার দরকার নেই। কাল সকালে মারসাদ আনতে যাবে।
মারসাদের বাবার খবর শুনে মারসাদের ফুপিরাও চলে এসেছে। মারসাদের দাদীকে তো ঘুম পারিয়ে রাখা হয়েছে।

সকাল বেলা আদিরা রাস্তায় জনমানবের সমাগম শুরু হতেই নিজেই হসপিটালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরে। ঠিকঠাক চিনে না বিধায় রিকশায় উঠে ঠিকানা বলে দিয়েছে। পথিমধ্যে ঘটে এক দুর্ঘটনা। এক মাইক্রো রিকশাটাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে চলে গেছে। আদিরা রিকশার ভেতরে থাকায় হুকে লেগে হাতে অনেকটা কে*টে গেছে আর মাথার বাম পাশে কিছুটা ব্যাথা ও পায়েও ছিলে গেছে কাত হয়ে পরাতে। রিকশাওয়ালা পায়ে ব্যাথা পেয়েছে। আশেপাশের লোকজন জড়ো হয়ে আগে আদিরাকে উঠায় তারপর রিকশাটাকে সোজা করে। সামনে কিছুটা দূরে হসপিটালে এক মহিলা আদিরাকে নিয়ে যায়। আদিরা রিকশাওয়ালাকে তার নায্য ভাড়ার সাথে অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে আসে। রিকশাওয়ালাকে বলেছিল সাথে আসতে কিন্তু তিনি আসলেন না।

হসপিটালে পৌঁছানোর পর আদিরাকে যিনি নিয়ে এসেছেন তিনি নার্স ডেকে আদিরার ড্রেসিং করিয়ে দিতে বলেন। মারসাদ তখন করিডরে হাঁটছিল হঠাৎ আদিরার মতো কাউকে দেখে এগিয়ে গিয়ে দেখে ওটা আদিরাই। আদিরার সামনে যেতেই তার রাগ উঠে গেল। এতোটা কেয়ারলেস কেনো এই মেয়ে! একটা কথাও শোনেনা। মারসাদ পেছোন থেকে রূঢ় শব্দে বলে,

–তোমাকে মানা করেছিলাম না? একা আসতে গেলে কেনো? আর অ্যাকসিডেন্ট কিভাবে করেছ? একটুও কেয়ার নেই নিজের প্রতি!

আদিরা ভড়কে গেল। এক সপ্তাহ আগেও একটা অ্যাকসিডেন্ট হতে হতে বেঁচেছে সে। মারসাদ সেদিন দূর থেকে দেখে দৌঁড়ে এসেছিল আর আজ তো হয়েই গেল। আদিরা আমতা আমতা করে বলে,

–না মানে। মানে আমার কোনো দোষ ছিল না সত্যি। আমিতো রিকশায় ছিলাম। মাইক্রোটা ধা*ক্কা দিয়ে চলে গেল। আমি তো আর জানতাম না এটা হবে।

রাগে মারসাদের নাক লাল হয়ে গেছে। আদিরা ব্যান্ডেজ করা হাত উঠিয়ে কিছু বলতে নিবে তার আগেই মারসাদ বলে,

–একটু পর আমি গিয়ে তোমায় নিয়ে আসতাম তো। তাই না? কাল বলেছিলাম তো? কিন্তু না! তুমি তো নাছোড়বান্দা! আমার কথা কী তুমি শুনবে! নিজের মনে হয়েছে চলে এসেছ সাথে হাত-পায়ের বেহাল দশা করে বসেছ।

আদিরা মিনমিন করে বলে,
–সরি। আমি বুঝিনি। আর হবে না। সরি।

মারসাদ পাশের চেয়ারটাতে বসে হাত দিয়ে নিজের মুখমণ্ডল ঢেকে রেখেছে। আদিরা কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভীরু কন্ঠে সুধায়,

–বাবা কেমন আছেন? ডাক্তার কী বলেছে?

মারসাদ প্রতিউত্তর করল না। গতকাল রাতে এনজিওপ্লাস্টির পর ঘুমের ইনজেকশন দেয়া হয়েছিল। মাহি মারসাদকে খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসে আদিরার এঅবস্থা দেখে বিচলিত হয়ে তাড়াহুড়ো করে এসে বলে,

–কিভাবে হলো এসব? তুই অ্যাকসিডেন্ট করলি কী করে?

আদিরা শান্ত স্বরে সবটা বলে মাহিকে। মাহিও মারসাদের মতো আদিরাকে ব*কাঝ*কা করে। মাহি এবার ওদের বাবার ঘুম ভাঙার কথা বলে। মিস্টার আরসাদ প্রথমেই মারসাদের নাম বলেছে। মারসাদ এটা শুনে দৌঁড়ে চলে যায়। বাবার কেবিনের সামনে গিয়ে হাত দিয়ে ভালো করে চোখ মুছে ভিতরে ঢোকে। কেবিনে নাকে নল, হাতে ক্যানুলা লাগানো সাদা বেডে শোয়া অবস্থায় নিজের জন্মদাতাকে দেখে মন কেঁদে উঠছে বারবার। দুইটা বছর এই মানুষটা খবরও নেয়নি সে। মনে মনে অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছে বারংবার। অভিমানের পাল্লাটা ভারীই ছিল। মারসাদকে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মারসাদের বাবা ছেলেকে আস্তে ডাক দিলেন,

–মারসাদ!

মারসাদ লম্বা শ্বাস নিয়ে বাবার বেডের কাছে টুলে বসে। মিস্টার আরসাদ ছেলের হাত ধরার জন্য হাত উঠাচ্ছিলেন তৎক্ষণাৎ মারসাদ তার হাত ধরে ফেলল। তিনি আস্তে আস্তে বললেন,

–আর কতো শাস্তি দিবি বাবা? এবারও কী মাফ করা যায় না? আমিও হয়তো কিছুদিন পর তোর মা ও আপিলির কাছে চলে যাব।

মারসাদের বুক ধক করে উঠল। সে তৎক্ষণাৎ বলল,
–না। একদম না। তুমি কোথাও যাবা না। আমার সাথে থাকবে। আমাকে ক্ষমা করে দেও। তোমাকে এতোদিন অনেক কস্ট দিয়েছি বাবা। সরি ফর এভরিথিং।

মিস্টার আরসাদের নেত্র কোন বেয়ে নোনাজল গড়ালো। মারসাদ তার বাবাকে আলতে জড়িয়ে ধরল। দরজার বাহির থেকে আদিরা, মাহি, আহনাফ, মৃদুলরা ও মারসাদের ফুফি এই দৃশ্য দেখে নিজেদের চোখ মুছল। বাবা-ছেলের মনমালিন্য দূর হলো অবশেষে।

________

সামিরা নিজের ঘরের ভিতর উচ্চস্বরে পাগলের মতো হাসছে। অস্বাভাবিক সেই হাসি। ফোনের অপরপাশে থাকা সাগরও সামিরার হাসিতে খানিকটা ভড়কে গেল। সামিরা হুট করে হাসি থামিয়ে ভয়ংকর স্বরে হিসহিসিয়ে বলে,

–আজকেরটাও জাস্ট ট্রেইলার ছিল। পরেরবার আমি নিজে ওকে গাড়ি চাপা দিবো। আমার চোখের সামনে ওর মৃ*ত্যু দেখতে চাই আমি। হা হা হা!

চলবে ইনশাআল্লাহ,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে