একটুখানি সুখ পর্ব-০৫

0
1149

#একটুখানি_সুখ
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৫

অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে মোহ। মেসেজটার থেকে চোখ সরছেই না তার। এমন অদ্ভুত ম্যাসেজ কে পাঠাতে পারে সেটা তার ভাবনাতে আসছে না। তৎক্ষনাৎ সেই প্রাইভেট নম্বরে ফোন লাগানোর চেষ্টা করে মোহ। কিন্তু নম্বরটা বন্ধ! আরো দুইবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় সে। হতাশ চোখে নম্বরটার দিকে তাকিয়ে থেকে কল লিস্টে গিয়ে আয়মানের নম্বরে কল দিল সে। তবে নেটওয়ার্ক বিজি! বেশ কয়েকবার চেষ্টা করতেই অবশেষে কোনোরকমে ফোনটা রিসিভড হয়। ওপাশ থেকে আটকা আটকা গলা ভেসে আসে।
“হ্যা…হ্যালো মোহ? আর ইউ ওকে? ঠি…ঠিক আছো তুমি?”

“হ্যাঁ আমি ঠিক আছি। তুমি কেমন আছো? আর কতদিন এই প্রবলেম চলবে আয়মান? আমার ভালো লাগছে না। অন্তত কথার বলার জন্য আমার তোমায় দরকার। তুমি আশেপাশে থাকলেও স্বস্তি পাই!”

“আ…আই নো মোহ। বাট আমায় আরো বেশ কয়েকদিন এখানে থাকতে হবে। তাছাড়া কাজ ফেলে কি করে চলে আসি বলো? জানি না স্যার আমায় প্রথম প্রথমই কেন এতো দায়িত্ব দিচ্ছেন। নিজের জায়গাটা অফিসে পাকাপোক্ত করতে হলে আই হ্যাভ টু ডু দিস ওয়ার্ক।”

মোহ বেশ কিছুক্ষণ চুপ রইল। ওর মনে সেই নম্বর থেকে আসা মেসেজের প্রশ্ন রয়ে গেছে। আয়মানকে প্রশ্নটা করা ঠিক হবে কিনা সেটাই ভাবছে সে। এক পর্যায়ে সে নিজেকে ধাতস্থ করে বলে ওঠে,
“আয়মান? একটা কথা বলো তো! তুমি কি প্রাইভেট নম্বর থেকে আমায় মেসেজ পাঠিয়েছিলে কিছুক্ষণ আগে?”

আয়মান সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট জবাব দেয়,
“আমি? না তো। প্রাইভেট নম্বর থেকে তোমায় মেসেজ কেন পাঠাতে যাব? আমার দুটো নম্বর মোহ। একটা এইটা আরেকটা অফিসের জন্য। হঠাৎ এই প্রশ্ন? কিছু হয়েছে?”

“জানি না। একটু আগেই কেউ একটা মেসেজ পাঠিয়েছে আমাকে। বুঝতে পারছি না কে এটা করেছে।”

ভাবলেশহীন হয়ে বলে মোহ। ওপাশে আয়মানকে উত্তেজিত হতে দেখা যায়।
“মানে? এসব মেসেজ কে পাঠিয়েছে তোমায়? আর কি মেসেজ…”

কথাগুলো পূর্ণ করার আগেই ফোনটা কেটে যায়। মোহ দুই-একবার হ্যালো করতে করতে খেয়াল করে কল কেটে গিয়েছে। ফোনটা রেখে দেয় মোহ। কফির মগ হাতে নেয় সে। চুমুক দেয় তাতে। প্রায় ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে কফিটা। তবুও সেই কফিই শেষ হলে রুমে চলে আসে মোহ। তার কিছুই ভালো লাগছে না। সময় কাটছে না। মা-বাবাকে ছাড়া তার এতকিছু থেকেই সবটা ফিকে। এই সবকিছুর বিনিময়ে যদি আরো একবার তাদেরকে ফিরে পাওয়া যেতো? তাহলে সেই সুযোগটা কিছুতেই হাতছাড়া করত না মোহ।

গভীর রাত। ঝিঁঝিপোকার শব্দ ছাড়া তেমন কিছুই শোনা যাচ্ছে না। মিসেস. নিরার কথায় অল্প একটু খেয়ে এসেই বেডে গা এলিয়ে দেয় মোহ। উপুড় হয়ে শুয়েছে সে। নাকটা বেডশিটের সাথে লাগতেই চোখমুখ কুঁচকে আসে তার। অদ্ভুত একটা গন্ধ। মাথা উঁচিয়ে তাকায় বেডশিটের দিকে। তার মনে পড়ে গতকাল রাতের কথা। স্বচ্ছ কতটা নেশাগ্রস্ত ছিল! তারই শরীরের মদের গন্ধ আর সেই সাথে তার পারফিউমের গন্ধ দুটো একসঙ্গে হয়ে এমন গন্ধ আসছে। গা গুলিয়ে আসে মোহের। তড়িৎ বেগে উঠে দাঁড়িয়ে বেডশিট আর বালিশের কভার চেঞ্জ করে দেয়।

“লোকটা বড্ড অসহ্যকর। বাড়িতে তো নেই। অথচ তার উপস্থিতি সবখানে। যা আমাকে ওইসব বাথরোবের ফিতা…! ঘটনাগুলো মনে করিয়ে দিচ্ছে। যে লোকটার উপস্থিতি নেই সেই লোকটার উপস্থিতি সবখানে থাকা কি গুরুত্বপূর্ণ?”

আপনমনে কথাগুলো আওড়াতে থাকল মোহ। সবকিছু চেঞ্জ করে আবারও ক্লান্ত ভঙ্গিতে শুয়ে পড়ল সে। একটা সময় ঘুম ভর করে তার চোখের পাতায়। ঘুমিয়ে পড়ে সে।

বেশ কিছুক্ষণ পর আকস্মিক ভাবে তার ঘুম ভাঙে একটা অদ্ভুত শব্দের কারণে। গভীর ঘুমের অতলে থাকা মোহ নড়েচড়ে ওঠে। হাত-পা ছড়িয়ে দিয়ে আস্তেধীরে চোখ মেলে সে। রাত প্রায় একটা বাজতে চলেছে। চারিদিকে নিস্তব্ধতা বিরাজমান। ঠান্ডা শিরশিরে বাতাস বয়ে আসছে জানালা ও খোলা বারান্দার দরজা দিয়ে। মোহ বারান্দার দরজা লাগাতে ভুলে গেছে। কারণ সবসময় মোহ ঘুমিয়ে পড়লে তার মা-ই এসে দরজা লাগিয়ে চলে যেত।

আবারও একটা উদ্ভট শব্দে চোখ কচলাতে কচলাতে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে মোহ। আওয়াজটা বারান্দা থেকেই এসেছে। খানিকটা বিচলিত হলো সে। এতো রাতে কি হচ্ছে বারান্দায়? ধীর গতিতে বেড থেকে নেমে হাই তুলে পা টিপে টিপে বারান্দার দরজার কাছে গিয়ে উপস্থিত হয় মোহ। অমাবস্যার রাতে চাঁদটাও মেঘের আড়ালে ঢাকা। বাইরের কিছুই স্পষ্ট নয়। বারান্দার সফট লাইট জ্বালিয়ে বেরিয়ে আসে মোহ সেখানে। তাদের বারান্দা লম্বালম্বি। এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত। বারান্দার সাথে এটাচড করা দোতালার বাম পাশে থাকা সব ঘর। মোহের ঘরটাও।

“কে এখানে? মিমি আছো নাকি?”
ভীত নিয়ে কথাগুলো বলল মোহ। মিসেস. নিরা এতো রাত অবধি জেগে থাকেন না। এই ভেবে কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে গেল তার। ঢোক গিলে গলা ভেজানোর বৃথা চেষ্টা করল সে। ছুটে ঘরে যাবে তার আগেই তার দৃষ্টি যায় কয়েকটা বড় বড় পাথরের দিকে। যেটা বারান্দায় পড়ে আছে। এতোসব পাথরের মধ্যে একটার মধ্যে কাগজ মোড়ানো। চোখ বড় বড় হয়ে আসে মোহের। প্রথমে কাগজ দেখবে না ভেবেও আগ্রহের সাথে কাগজে মোড়ানো পাথরটা হাতে তুলেই নিল সে। তার ভয়ও করছে সেই সঙ্গে কাজ করছে প্রচন্ডরকমের উত্তেজনা।

কাগজটা পাথর থেকে ছাড়াতেই নিজের সামনে মেলে ধরে মোহ। তার সুন্দর চোখজোড়ার সামনে ভেসে ওঠে কিছু লিখা! লিখাগুলো অন্যরকম। বেশ পেঁচিয়ে লিখা। তবে এই পেঁচিয়ে লিখার মাঝেও ফুটে উঠেছে আলাদা রকম সৌন্দর্য। টানা টানা লিখা!

“এইযে মোহময়ী নারী! আর কতভাবে নিজের মোহে আমায় বেঁধে ফেলবে তুমি? এমন কিছু করো না যাতে শেষমেশ তোমাকেই আমার মাঝে বেঁধে ফেলতে হয়। এই ভয়াবহ অনুভূতি জাগিয়ে তুলো না। এর ফল কিন্তু তোমাকেই ভোগ করতে হবে। তুমি কি জানো? তোমার আশেপাশে তোমার মোহ বেঁধে ফেলতে কতজন চেষ্টা করছে? আমি চাই না সেই জালে তুমি আটকা পড়ো যেই জালে কোনো সুখ নেই। এই মোহময়ীকে আমি বেঁচে থাকতে জালে আটকা পড়তে দিচ্ছি না। এই মোহময়ী নারীকে সুখের রানী হিসেবে দেখতে চাই।”

ধক করে উঠল মোহের ভেতরটা। বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে এসে গেল সে। এই চিঠিটার একেকটা শব্দ এতোটা ভারি কেন? মোহের এমনটা মনে হচ্ছে যে কেউ তার কানে কানে কথাগুলো বলে চলে গেল। ঘন ঘন শ্বাস পড়তে থাকল মোহের। শুঁকনো ঠোঁটজোড়া তিরতির করে কাঁপছে। চিঠিটাতে যেন শুধু কিছু শব্দই নয় এক অদ্ভুত অনুভূতিও ভর্তি করে পাঠানো হয়েছে। যা মোহের মনে প্রবেশ করছে।

বারান্দার রেলিংয়ে হাত দিয়ে ভর দিয়ে দাঁড়াল মোহ। তার চোখের পলক অবধি পড়ার নাম নেই। তখনই তার মনে হলো তার বারান্দার সামনের রাস্তায় কেউ দাঁড়িয়ে। মোহ এবার ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করল সেদিকে। বাড়ির এই বারান্দাটা পেছনদিকে। তাই বারান্দার সামনের রাস্তাটাও পেছনের। এদিকে তেমন কেউ যাওয়া আসা না করাতে ল্যাম্পপোস্টের লাইটও জ্বালানো নেই। সেই ঘুটঘুটে অন্ধকারে মানুষটা এখনো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যেন মোহের দিকেই তাকিয়ে আছে। কিছু বলতেও চাইলেও পারে না মোহ। গলায় সব কথা দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। হয়ত এই চিঠিটাও ওই আগন্তুক মানুষটাই পাঠিয়েছে। কেন পাঠিয়েছে? আর এসব রহস্য রেখেছে কেন চিঠিতে? তার উদ্দেশ্য কি?

মাথায় গিজগিজ করতে থাকল সেইসব প্রশ্ন। তার উত্তর চাই নয়ত রাতের ঘুমটাই উড়ে যাবে। এই ভেবে হাতে চিঠিটা নিয়েই বাহিরের দিকে এক ছুট দিল মোহ।

বাড়ির পেছনের গেঁটের সামনে এসে হাঁপাতে থাকে মোহ। পেছনের গেঁটে থাকা দারোয়ান টুলে ঠেস লাগিয়ে দেয়ালে মাথা দিয়ে ঘুমে ঢুলছে। মোহের জোরে জোরে নিশ্বাস নেওয়ার শব্দ শুনে হকচকিয়ে ওঠেন তিনিও। টর্চ জ্বালিয়ে দেখতে পায় মোহকে।

“ছোট সাহেবা আপনি? কি হইছে? এমন করতেছেন ক্যান? কোনো সমস্যা?”

“আপনি গে…গেঁট টা এখনই খুলুন মামা। কুইক!”

“কি হইছে? সেটাই তো বুঝতেছি না। চোর টোর ঢুকছিল নাকি?”

মোহ উত্তপ্ত হয়ে বলে,
“হু। চোরের থেকেও ভয়ানক, ডাকাতের থেকেও ভয়ানক। সবার রাজা। এখন তাড়াতাড়ি করুন।”

“বলেন কি? আমি এখনই খুলতেছি।”

বলেই তাড়াতাড়ি করে গেঁট খুলতেই বাম দিকে ছুটে যায় মোহ। পেছন পেছন ছুটে আসে রফিক(দারোয়ান)। কাউকে খুঁজে পায় না মোহ। বর্তমানে সে অস্থির হয়ে পড়েছে। কপালে হাত দিয়ে আশেপাশে তাকাচ্ছে। রফিক আশেপাশে টর্চ জ্বালিয়ে দেখে কিছু না পেয়ে বলে,
“কেউ তো নাই। আপনার কি চুরি করছে ছোট সাহেবা? দামি কিছু? কেমনে চুরি করল?”

“আপনি বুঝবেন না। আপনি ডান দিকটা দেখুন। আমি বাম দিকে আরো এগিয়ে দেখব। যেই লোককে পাবেন খপ করে ধরে আমার সামনে নিয়ে আসবেন। যে-ই হক।”

বলেই রফিকের হাত থেকে একটা টর্চ নিয়ে নেয় মোহ। রফিক প্রথমে মোহকে একা ছাড়তে না রাজি হলেও মোহ একা চলে যায়।

বেশ কিছুদূর এগিয়ে এসেছে মোহ। সামনেই একটা জগিং পার্ক। সমস্যা হচ্ছে মোহ টর্চ জ্বালাতে পারছে না। বারংবার চেষ্টা করে যাচ্ছে সে। লাভ হচ্ছে না। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করেই কারো সঙ্গে ধাক্কা লাগে মোহের।

“রাতে এভাবে একা চলাফেরা করা ঠিক নয় মোহময়ী নারী!”

‘মোহময়ী নারী’ কথাটি শুনে পেছন ফিরে তাকায় মোহ। মোটা কন্ঠস্বর! কেমন যেন চেনা চেনা। তবে ঠিক চিনতে পারছে না মোহ। লোকটা তাকে ধাক্কা দিয়ে অনেকদূরে এগিয়ে গেছে। এবার মোহ চিৎকার করে তাকে ডেকে বলে,
“এই চোর দাঁড়ান।”

থেমে যায় লোকটি। পিছু ফিরে তাকায় সে। মোহ এই অন্ধকারে কিছুই দেখতে পারছে না। শুধু অবয়বটা বুঝতে পারছে। মোহ ক্ষোভ নিয়ে বলে,
“চোরের মতো পালাচ্ছেন কেন? চিঠি দিয়ে এখন পালিয়ে গেলে তো হবে না। এখানে আসুন।”

“কোনদিকে?”
থমথমে কন্ঠ লোকটির। এটা মানুষ নাকি রোবট মোহ বুঝছে না। মোহ আগপাছ না ভেবে বলল,
“আমার দিকে আসুন।”

অবয়বটি এগিয়ে আসে। একপা একপা ফেলতে ফেলতে বলে,
“তোমার দিকে? তোমার কাছে? কত কাছে?”

থামাথামির কোনো নাম নেই আগন্তুক ব্যক্তিটির। যখন মোহ দেখে লোকটা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি এগিয়ে আসছে তখনই চোখ বড় বড় হয়ে আসে তার।

“কত কাছে বললে না তো! এত কাছে? না আরো কাছে?”

“ব্যাস…! দূর থেকে কথা বলুন।”
তিরিক্ষি হয়ে বলে মোহ। নিজের টর্চ জ্বালানোর চেষ্টা করে সে। বার বার টর্চ ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে হুট করেই টর্চলাইট ছো মেরে নিয়ে নিল লোকটা। মোহ নেওয়ার চেষ্টা করলে লোকটার সঙ্গে টানাটানি হয় তার। মোহ এবার না পেরে চিৎকার দিয়ে ওঠে,
“রফিক মা…”

সজোরে চেপে ধরে মোহের মুখ। পুরোপুরি চিৎকার দিতেই পারে না সে। নিজেকে মনে মনে হাজারো গালি দিল মোহ। একেই হয়ত বলে, নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা।

“চুপ! তুমি কি ভাবো? তুমি এভাবে হট লুক নিয়ে বের হবে আর লোকেরা তোমায় ছেড়ে দেবে?”

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে