একটুখানি সুখ পর্ব-০৩

0
1221

#একটুখানি_সুখ
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩

“তাছাড়া, কাল যে ড্রাংক হয়ে তোমার বাড়ি গেছিলাম। তুমি বের করে দাওনি কেন তোমার ঘর থেকে? তোমার বাড়িতে এতো সার্ভেন্ট কাজ করে। তাদের দিয়ে তো বের করে দিতে পারতে। দাওনি কেন বলো বলো?”

ভ্রু বাঁকিয়ে স্বচ্ছ প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় মোহের দিকে। মোহ ইতস্তত বোধ করে জবাব দেয়,
“রাতে বাড়িতে কোনো সার্ভেন্ট থাকে না। নাহলে আপনাকে তো আমার ঘরে ঘুমোতেও দিতাম না। আমার ঘর এলোমেলো করে এসে আপনি বলছেন আপনার ঘুম ভালো হয়নি?”

“যদি ঘুম ভালো হতো তোমার বেড এলোমেলো হত না নিশ্চয়। ভালো হয়নি তাই বেড এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। তাছাড়া তোমার কথাবার্তা শুনে তো মনে হচ্ছে না আমায় রুম থেকে বের করার কোনোরকম ইটেনশন তোমার ছিল। হয়, হয়। এমনই হয়। যখন হ্যান্ডসাম ছেলে নিজে থেকে এসে পড়ে তখন তো চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো হয়। এখন আমাকে সরি বলো। আর বেরিয়ে যাও।”

থম মেরে চেয়ে রইল মোহ। স্বচ্ছের উল্টোপাল্টা কথায় বাকরুদ্ধ সে। মানে একটা মানুষ কি করে একটা কথাকে এতোটা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে নিয়ে এসে ওপর মানুষকে দোষারোপ করতে পারে? হাউ? মেজাজটা আবারও তুঙ্গে উঠে গেল মোহের। সে তর্জনী আঙ্গুল উঠাতে গেলেই স্বচ্ছ ইশারা করে সেটা নামাতে বলে বাঁকা হেঁসে বলে,
“সরি বিনয়ের সাথে বলতে হয় মিস. মোহ। আঙ্গুল উঁচিয়ে নয়। তাছাড়া আমি তো বুঝতেই পারছি না কাল রাতে আমার সাথে ঠিক কি কি হয়েছিল!”

মোহ সরু চোখে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,
“কি হয়েছিল মানে?”

“মানেটা তো তুমি জানো মিস. মোহ। এমনিতে আমার তো ডাউট হচ্ছে। কাল আমি যে হারে ড্রিংক করেছিলাম চোখের সামনে শুধু নিজের সুন্দর সুন্দর এক্স গার্লফ্রেন্ডদের দেখছিলাম। সো সেই সুযোগ নিয়ে অনেক মেয়েই তো আমার কাছে আসতেই পারে। তুমিও আসতে পারো। আবার তোমার বেডও নাকি এলোমেলো করে রাখা ছিল সকালে। সেটা তুমি নিজে বলছো। দ্যাটস হুয়াই আমার ডাউট এখন বিশ্বাসে পরিণত হচ্ছে।”

মোহ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। আসলে সে স্বচ্ছের কথার মানে বুঝতে পারেনি। স্বচ্ছ নির্বিঘ্নে তার মাঝারি আকারের ঘন চুল মুছে যাচ্ছে যা তার চোখজোড়া প্রায় ঢেকে দিয়েছে। মোহের কয়েক সেকেন্ড পর মনে হলো স্বচ্ছ কি বলতে চেয়েছে আসলে। চক্ষুদ্বয় চড়কগাছে পরিণত হলো তার। দাঁত কিড়মিড় করে তাকালো মোহ স্বচ্ছের দিকে। মোহের হাত দুটো মুঠো করল। যেন এক্ষুনি যাবে আর এই বেয়াদব লোকটার গলা চেপে ধরবে। স্বচ্ছ টাওয়াল বেডে রাখতে রাখতে বলল,
“আমার বাড়িতে আমার রুমে আমার গলা চেপে ধরার পরিকল্পনা মোটেও করবে না। ফলস্বরূপ জেল বা ফাঁসির থেকেও ভয়াবহ শাস্তি হতে পারে।”

কোনোরকমে দমিয়ে রাখল মোহ নিজেকে। এমন অসহ্য টাইপের লোকের সঙ্গে যত কম মুখ লাগাবে ততই ভালো। তার চেয়ে ভালো ঔষধ নিয়ে চলে যাওয়া। যেই ভাবা সেই কাজ। গলা খাঁকিয়ে শান্ত রূপে মোহ স্বচ্ছের উদ্দেশ্যে বলে,
“ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাখা ঔষধের ব্যাগ কি নানিমার?”

স্বচ্ছ এক পলক তাকালো ব্যাগের দিকে। তারপর মাথা নাড়াতেই মোহ এগিয়ে গেল ব্যাগটা নিতে। ড্রেসিং টেবিলের কাছে গিয়ে ব্যাগ হাতে নিয়ে জয়ের হাসি হেঁসে পা বাড়ালো বাহিরে যাবার জন্য। নাকে মাটি তার। আর জীবনে এই রুমে পা রাখার মতো ভয়াবহ কাজ সে করবে না। দরজার কাছাকাছি যেতেই তৎক্ষনাৎ পিছু ডাকে স্বচ্ছ।

“হেই লিসেন! ব্যাস… ঔষধ নিয়ে চলে যাবে তা কি করে হয়? টেল মি সরি!”

খিটখিটে মেজাজের সাথে পিছু ফিরে তাকায় মোহ।
“সরি আপনাকে? আমি আজেবাজে রিজনের জন্য সরি বলছি না আপনাকে এটা মাথায় ঢুকিয়ে রাখুন।”

“ইট মিনস তুমি আমাকে সরি বলছো না?”

“নেভার। ওয়েট অ্যা মিনিট।”

স্বচ্ছ ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে নিজের ফোনটা হাতে নেয়। কিছু একটা ঘেঁটেঘুঁটে বের করে। ওপরদিকে মোহও ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে ঘর থেকে বাহিরে বের হতে নেয়। কিন্তু নিজের কন্ঠস্বর শুনে কপালে ভাঁজ পড়ে তার। পেছন ঘুরে তাকাতেই নজরে আসে স্বচ্ছের ফোনের একটা ভিডিও ক্লিপ যেখানে মোহ একনাগাড়ে চোখ বন্ধ করে কথা বলেই যাচ্ছে। স্বচ্ছ ফোনটা মোহের দিকে ধরে ভ্রু নাচিয়ে তাকায়। মোহের মনে পড়ে এটা সকাল বেলার ঘটনা। যখন সে অতিমাত্রায় রেগে নিজের রুমে গিয়ে স্বচ্ছের ওপর রাগ ঝাড়ছিল অথচ স্বচ্ছ সেখানে উপস্থিত ছিলই না।

মোহ আগপাছ না ভেবে ছুটে গিয়ে ছো মেরে ফোনটা নেওয়ার আগেই ফোন সরিয়ে নিল স্বচ্ছ। বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,
“এইটা যদি ভাইরাল হয় তাহলে আমি বেশ ফেমাস হয়ে যাব কি বলো মিস. মোহ? আর ক্যাপশন যদি এমন থাকে যে ‘অতিরিক্ত একটা সুন্দরী মেয়ে নিজের বয়ফ্রেন্ডকে হারিয়ে পাগলপ্রায়’ তখন কি হবে?”

উদ্ভ্রান্তের মতো তাকিয়ে রইল মোহ। সে জানে স্বচ্ছ যেমন মানুষ তার পক্ষে এটা করা অসম্ভব কিছু না। সে থেমে থেমে প্রশ্ন করল,
“এ…এটা কখন ভিডিও করলেন আপনি?”

“তোমার বাড়িতে তো দুদিক দিয়ে সিঁড়ি। সো আমি যেটা দিয়ে বাড়িতে যাওয়ার জন্য নামছিলাম তুমি অন্যটা দিয়ে উঠছিলে। তখন আমার হাতে ঘড়ি ছিল না। মানে তোমার ঘরে হয়ত খুলে পড়ে টড়ে গিয়েছিল। তাই সেটা নিতে আমি ব্যাক করি। আর দেখি তুমিও ঘরে ঢুকছো। তুমি যেদিক হয়ে চেঁচিয়ে যাচ্ছিলে তার বিপরীতে আমি এই সুন্দর ভিডিওটা করে ফেললাম। ইন্টারেস্টিং না? বাই দ্যা ওয়ে, তোমার তো ডাবল সরি বলা উচিত। একে তো কাল রাতে তোমার ঘরে ঘুমিয়েছি, ঘুমটা ভালো হয়নি। তার ওপর তোমার মতো একটা মিস. বকবকানির সাথে নিজেও এতো কথা খরচ করে ফেলছি। এতো কথা তো আমি বাড়িতেও বলি না। সরি বলো ফাস্ট!”

মোহ এখনো টু শব্দ অবধি বলতে পারল না। তার নজর ফোনের দিকে। স্বচ্ছ ফোনটা হাতে নিয়ে পেটের কাছে ধরে আছে। স্বচ্ছ খেয়াল করল মোহের মনোযোগ অন্যদিকে। সে চুটকি বাজাতে নিতেই ফোনটা ছো মেরে নিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল মোহ। কিন্তু পারলে তো! এমন শক্ত, বলশালী লোকের হাত থেকে কিছু ছিনিয়ে নেওয়া একটু কষ্ট রয়েছে বটে। এক পর্যায়ে দুইহাত দিয়ে ফোনটা টানতে লাগল মোহ। অন্যদিকে স্বচ্ছের অবস্থা বেগতিক। সে এক হাতে বাথরোবের ফিতা ধরে আছে অন্যহাতে ফোন। এখন যদি বাথরোবের ফিতা খুলে টুলে যায় বিচ্ছিরি অবস্থা হবে।

মোহও ছাড়ার পাত্রী নয়। সে একপ্রকার হুমকি দিয়ে বলে ওঠে,
“ভিডিও যদি ডিলেট না করেন স্বচ্ছ ভাই তাহলে কিন্তু আমি পুলিশে কমপ্লেন করব।”

স্বচ্ছ কিছু বলার আগেই সেই বিচ্ছিরি কান্ডটা ঘটেই গেল। খুলে গেল বাথরোবের ফিতা। থেমে গেল মোহ। রোবটের ন্যায় তাকালো স্বচ্ছের দিকে। স্বচ্ছ ফিট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হেলদোল নেই। কয়েক সেকেন্ড পরই একবার মোহ আরেকবার হা হয়ে খোলা বাথরোবের দিকে তাকালো স্বচ্ছ। মোহের কান দিয়ে যেন ধোঁয়া বের হচ্ছে। চোখমুখ কাঁচুমাচু করে ছিটকে দূরে চলে আসে সে। আশেপাশে কিছু না দেখেই চোখমুখ খিঁচেই লাগায় এক দৌড়। তাকে আর পায় কে?

স্বচ্ছ বোকা বনে গেল। একটা মেয়ে তাকে এই অবস্থায় দেখে ফেলল ভাবতেই বাকহারা হয়ে পড়ল সে। আচমকা চিৎকার করে মোহের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
“এই শোনো, তুমি কিছু দেখো নি তো? বলে যাও কিছু দেখো নি। এই মেয়ে দাঁড়াও! আমার ইজ্জত লুট করে পালাচ্ছো? স্টুপিড গার্ল!”
হা হয়ে কিছুক্ষণ ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে স্বচ্ছ। তার ইজ্জত একটা মেয়ের সামনে শেষ ভাবতেই চারিদিকে অন্ধকার হয়ে আসে তার।

নানিমাকে কাঁপা কাঁপা হাতে খাইয়ে দিচ্ছে মোহ। তার গোলাপি ফর্সা গালে পড়েছে লাল রঙের আস্তরণ যেটা সরছে না। ঠিকঠাক ভাবে নানিমাকে খাওয়াতেও পারছে না মোহ। দরদর করে ঘামছে সে। এমতাবস্থায় নাফিসা বেগমে হুট করে প্রশ্ন করেন।
“মোহ? তুই ঠিক আছিস? এমন লাগছে কেন তোকে?”

“কিছু না নানিমা। গরম তো তাই।”

“তাহলে তোর হাত কাঁপছে কেন? আর স্বচ্ছের ঘর থেকে আসতে এতো দেরি করলি যে? কিছু কি বলেছে স্বচ্ছ? ওর তো আবার মুখ ঠিক নয়। যা ইচ্ছে বলে ফেলে।”

“শুধু বলেছে? উনি তো…”

অন্যমনস্ক হয়ে কথা বলতেই হুঁশ আসে মোহের। জ্বিহ্বা কেটে চুপ হয়ে যায় সে। এই ভয়াবহ ঘটনা নাফিসা বেগমকে বলা যাবে না। ইভেন কাউকে বলা যাবে না। নাফিসা বেগম দুর্বল কন্ঠে বলার চেষ্টা করে,
“কি হয়েছে বল তো? ও তোকে কি বলেছে?”

“কি বলবে আবার? কিছু না। স্বচ্ছ ভাই ওয়াশরুমে ছিলেন তুমি খাও তো।”

নাফিসা বেগম আর প্রশ্ন করতে পারলেন না। মোহের দিকে তাকিয়ে কষ্ট করে খেতে থাকলেন। মেয়েটার চোখমুখ একদিনের ব্যবধানে কতটা শুকিয়ে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে যেন চোখের নিচে কালো দাগ করে ফেলেছে। রুগ্ন হয়ে গিয়েছে মেয়েটার চেহারা। অথচ সে আগে আরো রূপবতী ছিল। মোহ হয়েছে একদম ওর নানাভাইয়ের মতো। যৌবনকালে ওর নানাভাই ছিলেন ধবধবে ফর্সা এবং সুদর্শন পুরুষ। তার এলাকার অনেক নারীর স্বপ্ন ছিলেন উনি। ঠিক তেমনই হয়েছে মোহ।

নাফিসা বেগমের খাওয়া শেষে ঔষধ খাইয়ে দিল মোহ। উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। এবার শুধু মিসেস. রেবা অর্থাৎ তার মামির সাথে কথা বলবে আর নাফিসা বেগমকে নিয়ে চলে যাবে সে। এই ভাবতেই মিসেস. রেবা নিজ থেকে উপস্থিত হন ঘরে। মোহ সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রতার খাতিরে সালাম দেয়। মিসেস. রেবা সালাম নিতেই মোহ সোজাভাবে বলে,
“আসলে মামি, আজ আমি নানিমাকে নিতে এসেছি। উনাকে বাড়ি যাব আমি। আশা করছি এতে আপনার কোনো আপত্তি নেই।”

মিসেস. রেবা ভ্রু কুঁচকান। যেন কথাটা তার মোটেও পছন্দ হয়নি। দাম্ভিকতা নিয়ে বলেন,
“মানে? মা কেন নিজের ছেলের বাড়ি থাকতে মেয়ের বাড়িতে যাবেন? এখানে কি উনার দেখাশোনার কমতি হয়?”

“হয় বলেই তো নিয়ে যেতে চাচ্ছি। যদি কমতি না-ই হতো তাহলে নানিমা এতো সকালে না খেয়ে থাকতেন না। আমি উনাকে নিয়ে যেতে চাই। আপনারা তো একটা সার্ভেন্টও উনার জন্য ঠিক করে রাখতে পারেননি।”

“আর বাইরের মানুষ তাতে যে আমাদের দিকে আঙ্গুল তুলবে যে ছেলে মাকে রাখতে পারেনি এতো অবস্থা ভালো হওয়া সত্ত্বেও? মা কোথাও যাবে না। এখানেই থাকবে। মা আপনার নাতনিকে বলে দিন আপনি কোথাও যাচ্ছেন না।”

মোহ কিছু বলতে নিলেই বাঁধ সাধেন নাফিসা বেগম।
“মোহ! থাক কথা বাড়াস না। তোর মামি তোর বড় না? এভাবে কথা বলছিস কেন?”

“কিন্তু… ”

“তুই এখন যা। আমার সময় হলে ওরা ঠিকই আমায় খেতে দেবে আর ঔষধও দেবে। ঝামেলা করিস না।”

মোহ বেশ আশাহত হলো। যার জন্য সে এতোক্ষণ কথা কাটাকাটি করল এখন সে-ই মানা করছে? কিন্তু তার নানিমা মানা করছে কেন? এটাই ভেবে পাচ্ছে না মোহ। নানিমার ওপর বেশ অভিমান হলো তার। অভিমান নিয়ে বলল,
“ঠিক আছে। তাহলে তুমি যখন বলছ আমি যাচ্ছি নানিমা।”

আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না সে। গটগট করে বেরিয়ে এলো হাতে ব্যাগ নিয়ে।

চলবে…

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে