একটুখানি সুখ পর্ব-০২

0
1601

#একটুখানি_সুখ
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২

“আবার আমার কাছে এগিয়ে আসছেন স্বচ্ছে ভাই? দূরে সরুন। দূর থেকেও কথা বলা যায়। আপনি আমায় স্পর্শ করবেন না খবরদার। সরুন বলছি!”

চিৎকার দিয়ে বলে উঠল মোহ। কিন্তু স্বচ্ছ তার কথা কানে নিলে তো! বেডে বসে থাকা মোহ শুধু পিছিয়েই যাচ্ছে। অথচ সে কিনারায় এসে গেছে তার খেয়াল নেই কোনো। শেষ মাথায় এসে হাতটা যখন আর বেডে রাখা উদ্দেশ্যে নিতেই আচমকা খেয়াল হলো মোহ পড়ে যাচ্ছে। টাল সামলাতে না পেরে পড়তে নিলেই তাকে ধরে নিল দুটো হাত। কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধ হয়ে রইলে মোহের বুঝতে বাকি রইল না হাতজোড়া কার! হকচকিয়ে উঠতে নিলেই তাকে ছাড়ল না স্বচ্ছ। অতিরিক্ত নেশা করার ফলে চোখজোড়া তার লাল রঙে ছেয়ে গেছে। সেই লাল রঙে অনেক রকম ভাষা। কিন্তু পড়তে পারছে না মোহ। নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ছটফট করতে করতেই হঠাৎ তার কানে এল এক বিকট শব্দ।

হুড়মুড়িয়ে চোখ মেলে তাকাতেই মোহ আশপাশটা পর্যবেক্ষণ করে দেখল সে তার বাবা-মায়ের রুমে আছে। তার মানে এতক্ষণ সে স্বপ্ন দেখছিল? হাফ ছেড়ে বাঁচল মোহ। বড় বড় নিশ্বাস ফেলতেই কানে এল ফোনের রিংটোন। ঘাড় ঘুড়িয়ে ল্যাম্পশিট টেবিলের দিকে তাকাতেই দেখলে পেলো তার ফোন বাজছে। হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিতেই তার নজর গেল স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নম্বরের দিকে। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল মোহের। বিড়বিড়িয়ে বলে উঠল,
“আয়মান!”

উঠে বসতে বসতে দেরি না করে ফোনটা রিসিভ করে ফেলল মোহ। ওপাশ থেকে আটকা আটকা একটা কন্ঠস্বর ভেসে উঠল,
“হ…হ্যালো, মোহ! শুনতে পা…পাচ্ছো তুমি?”

“হ্যাঁ শুনতে পাচ্ছি আমি বলো।”

মলিন কন্ঠে উত্তর দেয় মোহ। ওপাশ থেকে আয়মান চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন করে,
“এসব কখন হলো মোহ? মানে আমি কি ঠিক দেখছি? আচমকা এসব…”

আয়মানকে থামিয়ে মোহ কাতর হয়ে বলে,
“ঘটনাটা গতকালের আগের দিনের আয়মান। নানিমাকে নিতে যাচ্ছিল মা-বাবা। আচমকা ট্রাক আমাদের গাড়ি সহ উল্টে ফেলল। কতটা যন্ত্রণাদায়ক ছিল! আমার গায়ের লোম এখনো শিউরে উঠছে। আমার ভাগ্য কি খেলা খেলল বলতে পারো? একেবারে আমাকে এতিম করে দিয়ে চলে গেল দুজনেই! আমি সইতে পারছি না। একটা মূহুর্তও থাকতে পারছি না। মনে হচ্ছে কানের সামনে এখুনি মায়ের ডাক ভেসে আসবে আর বলবে, ‘মোহ, উঠবি না?’ আমি তাদের ডাক আর কখনো শুনতে পারব না আয়মান!”

কথাটুকু বলেই কান্নায় ভেঙে পড়ল মোহ। শব্দ করে কাঁদতে লাগল সে। পুরো ঘর জুড়ে তার কান্নার আওয়াজ! তার সুন্দর কন্ঠে কান্নার আওয়াজে যেন গমগমে পরিবেশে স্তব্ধতা ছেয়ে গেল। আয়মান দ্রুত আশ্বাস দিয়ে বলে উঠল,
“আমি এসময় তোমার পাশে থাকতে পারছি না মোহ। আমায় ক্ষমা করো। কিন্তু আমি যত দ্রুত সম্ভব কাজ শেষ করে ফিরে আসব। আর বান্দরবানে এত নেট প্রবলেম যে কথায় বলা যাচ্ছে না।”

কান্না থামালো মোহ। নাক টেনে শান্ত হয়ে বলার চেষ্টা করল,
“তুমি তোমার কাজ ধীরেসুস্থে শেষ করে তবেই এসো। নিজেকে সামলে নিতে জানে এই মোহ। তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই।”

আরো বেশ কিছু কথা বলার আগেই আয়মানের আটকা আটকা গলা শুনতে পেলো মোহ। হয়ত নেটওয়ার্ক আবার প্রবলেম শুরু করে দিয়েছে। এক পর্যায়ে কেটে যায় ফোন। দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে ফোন কান থেকে সরিয়ে রেখে দেয় সে। আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়াতেই তার মনে পড়ে স্বচ্ছের কথা। কাল রাতে কি চরম অসভ্যতায় না করেছিল ছেলেটা! ভাবতেই রাগে ফুঁসে ওঠে মোহ। আর সকালে কি বিচ্ছিরি স্বপ্ন দেখল? ভেবেই তার চোখমুখ জড়িয়ে এল। চোখ ডলে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেল সে।

আয়মান হচ্ছে সেই মানুষ যাকে মোহ ভালোবাসে। তারা একে ওপরকে ভালোবাসে প্রায় ২ বছর ধরে। আয়মান সবে সবে জব পেয়েছে। আয়মান উচ্চ মধ্যবিত্ত হলেও মোহের বাবার মতো এত টাকা-পয়সা নেই। তবুও মোহের কোনো আপত্তি নেই সম্পর্কে। সে অল্পতেই খুশি। সে শুধু চায় ভালোবাসা আর একটুখানি সুখ।
জব পেতে না পেতেই কাজের জন্য বান্দরবান যেতে হলো আয়মানকে। তারপর তাদের বিয়ের কথাবার্তা বলার আগেই ঘটে গেল দুর্ঘটনা! পরপারে চলে গেলেন মোহের মা-বাবা।

ফ্রেশ হয়েই মুখ মুছে হাঁটা ধরল নিজের রুমের উদ্দেশ্যে। বেয়াদব লোকটা কি উঠেছে ঘুম থেকে? না উঠলেও বা কি? এবার হয় চুল ধরে টেনে নয়ত এক বালতি পানি ঢেলে দেবো লোকটার ওপর। অতঃপর চরম ভাবে ঝাড়বে স্বচ্ছকে। এই ভেবেই পা দ্রুত চালানো শুরু করল সে। রুমের সামনে গিয়ে থামল মোহ। একটা শুকনো ঢক গিলে উঁকি দিল ভেতরে। তারপরেই সে বিড়বিড় করে বলল,
“ওহ হো মোহ! ইটস ইউর রুম। নিজের রুমে নিজে চোরের মতো উঁকিঝুঁকি মারছিস কেন?”

সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে স্ট্রেট ভেতরে ঢুকে গেল মোহ। আশেপাশে না তাকিয়েই চোখ খিঁচে চিল্লিয়ে বলতে শুরু করল,
“এটা ভদ্রলোকের বাড়ি। যখন-তখন নেশা করে এসে একটা মেয়ের বেডরুমে এসে ঘুমিয়ে পড়া কেমন অসভ্যতা? এসব করতে হলে নিজের বাড়িতে গিয়ে করবেন। আমার বাড়িতে এসব চলবে না বুঝলেন? অন্যকেউ হলে আপনাকে সেই অবস্থাতেই বাড়ি থেকে বের করে দিতো। কিন্তু আমি তা ভদ্রতার খাতিরে করিনি। কিন্তু এটা ভাববেন না পরের বার এমন করলে মেনে নেব আর…”

কথা বলার মাঝপথে যখন মোহ চোখ খোলে তখন স্বচ্ছকে দেখতে পায় না। অগোছালো বেডে স্বচ্ছ অনুপস্থিত। এতগুলো কথা সব বেকার হয়ে গেল ভাবতেই মেজাজ বিগড়ে গেল মোহের। অস্থির হয়ে আশেপাশে তাকাল স্বচ্ছের দেখা পাওয়ার আশায়। কিন্তু লোকটা আসলেই নেই। রুমের ডানদিকে তিনটে সিঁড়ি বেয়ে উঠে ওয়াশরুমের সামনে দাঁড়াল মোহ। ওয়াশরুমের দরজা খোলা। এরমানে এখানেও স্বচ্ছ নেই! কোথায় গেল সে? হাওয়ার সাথে গায়েব হয়ে গেল?

খাবার টেবিলে বসেছেন মিসেস. নিরা। মুখে এখনো বড় বোনকে হারানোর যন্ত্রণা স্পষ্ট। মলিন মুখ নিয়ে ফোন কাটলেন উনি। এতোক্ষণ নিজের স্বামীর সঙ্গে কথা বলছিলেন। উনার স্বামী বিজিবি অফিসার হওয়ায় খাগড়াছড়িতে নিজের ডিউটি পালন করছেন। ফলস্বরূপ মোহের মা-বাবা মারা গেলে উনিও উপস্থিত থাকতে পারেননি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে খাবারের টেবিলে মোহকে না পেয়ে ডাক ছাড়লেন উনি।
“মোহ! নিচে আয়। খেয়ে নিবি।”

মোহের সাড়া না পেয়ে আরো কয়েকবার ডাকলেন মিসেস. নিরা। তবুও মোহের সাড়া পাওয়া গেল না। কাল থেকে তেমন কিছু খাইনি মেয়েটা। মা-বাবাকে হারানোর শোক আঁকড়ে ধরেছে তাকে। প্লেটে তরকারি তুলে নিলেন মিসেস. নিরা। দুটো রুটি নিলেন সাথে। প্লেট হাতে নিয়ে চেয়ার থেকে উঠতেই পায়ের শব্দে সিঁড়ির দিকে তাকালেন উনি। ওড়না ঠিক করতে করতে নামছে মোহ। মনে হচ্ছে কোথাও বের হবে সে।

মোহ খাবার টেবিলের সামনে আসতেই মিসেস. নিরা ভ্রু কুঁচকে মলিন কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন,
“কোথায় যাচ্ছিস?”

“মামার বাড়িতে যাচ্ছি। নানিমাকে আনতে।”

সাবলীলভাবে ভাবে উত্তর দিতেই ভড়কে উঠলেন মিসেস. নিরা। কন্ঠস্বর দৃঢ় করে বললেন,
“নেহাল ভাইয়ের বাড়ি যাবি এখন? পাগল হয়েছিস? তাও মাকে আনতে যাচ্ছিস? তোর কি মনে হয় ওরা তোর সঙ্গে মাকে আসতে দেবে?”

মোহ অকপটে জবাব দিল,
“কেন দেবে না? নানিমাকে আমি নিয়ে আসি তাহলে তো ওদেরই সুবিধা। নানিমা অসুস্থ মিমি! কিডনি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এখন লাস্ট স্টেজে রয়েছে। উঠে নিজে পানি খাবার ক্ষমতা পর্যন্ত নেই। এই সময় উনার যত্ন প্রয়োজন। আর ওই বাড়িতে তো নানিমা খাবারও ঠিকঠাক পায় না। যেদিন মা-বাবার এক্সিডেন্ট হলো সেদিন তো ওরা নানিমাকেই আনতে যাচ্ছিল। তাদের কাজ আমি করব। তাছাড়া এটা মায়ের শেষ ইচ্ছে ছিল। মা যেই কাজ করে যেতে পারেনি সেই দায়িত্ব আমায় দিয়েছিল। সেই শেষ ইচ্ছে কি পূরণ করব না? আমি আজই যাব আর নানিমাকে নিয়ে আসব। তাও যেকোনো মূল্যে!”

মিসেস. নিরা আর কিছু বলতে পারলেন না। মোহের মাথায় জেদ চেপেছে মানে সেটা সে করবেই। হতাশ হয়ে বললেন,
“চল আমিও যাই তোর সাথে।”

“তার কোনো দরকার নেই। তোমার হাত-পায়ে ধরার স্বভাব রয়েছে। আর অনুরোধ করার বিষয় আমি মোটেও পছন্দ নয়। আমি নানিমাকে অধিকারবোধ থেকে আমার বাড়িতে আনব। অনুরোধ করে নয়।”

“অন্তত খেয়ে যা।”

“মা বানিয়েছে খাবার?”

থেমে থেমে মিসেস. নিরার দিকে চোখ রেখে প্রশ্ন করল মোহ। ছলছল নয়ন দুটো বলে দিচ্ছে সে মাকে বড্ড মিস করছে। মায়ের হাতের খাবারকেও। মিসেস. নিরা মোহের মাথায় টোকা মেরে বলেন,
“কোথায় পাব এখন তোর মায়ের হাতে বানানো খাবার? এবার না হয় মায়ের বোনের হাতে বানানোর খাবারই খেলি!”

মোহকে দুই-তিনবারের বেশি খাওয়ানো গেল না। হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল সে। মিসেস. নিরা অসহায় ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলেন। না জানি মেয়েটা কি ঘটিয়ে ফেলে!

স্বচ্ছের বাড়িতে পা রাখল মোহ। চারিদিকে শান্ত পরিবেশ বিরাজ করছে। সকাল সকাল সকল সার্ভেন্ট এদিক-ওদিক নিজেদের কাজ করলেও মামি বা মামা কাউকেই দেখতে পেল না মোহ। ভ্রুকুটি কুঁচকে একজন সার্ভেন্টকে জিজ্ঞেস করল,
“মামি বা মামা নেই বাড়িতে? মানে তোমাদের স্যার বা ম্যাডাম নেই?”

“স্যার তো বাড়িতে নেই। সকাল সকাল অফিসের জন্য বের হন। আর ম্যাডাম তো ঘুমোচ্ছেন প্রতিদিনের মতো।”

চোখ বড় বড় হয়ে এল মোহের। এত সকাল অবধি ঘুম? কথা না বাড়িয়ে এলোমেলো পায়ে নাফিসা বেগমের(মোহের নানিমা) ঘরের দিকে এগিয়ে গেল সে। মোহ হাঁটছে আর চোরের মতো আশেপাশে তাকাচ্ছে। যদি স্বচ্ছের সামনে পড়ে যায়? এই ভেবেই হাঁটছে সে। সকালে দারোয়ান মামা বলেছেন মোহ বের হবার কিছুক্ষণ আগেই বেরিয়ে গেছে স্বচ্ছ। অবশেষে নাফিসা বেগমের ঘরের তড়িঘড়ি করে ঢুকে পড়ে মোহ।

বাম দিকে বিছানায় চোখ বন্ধ করে আছেন নাফিসা বেগম। চোখের কোণা দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানি। মোহ সালাম দিতেই চোখ খুলে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকান উনি। হাফ ছেড়ে জোরে কেঁদে উঠে বলেন,
“মোহ রে! আমার মেয়ে আর জামাইটার কি হয়ে গেল রে!”

মোহ কিছু না বলে এগিয়ে এলো। নাফিসা বেগম আবারও বলে উঠলেন,
“আমি মরলাম না। অথচ আমার মেয়ে আর মেয়ের স্বামী মরে গেল। এই দিন দেখার জন্য বেঁচে ছিলাম? শেষ দেখাটা দেখতেও পারলাম না। এতোটাই অধম হয়ে গিয়েছি আমি। আমায় তুলে নেয় না কেন আল্লাহ্?”

“নানিমা, তুমিও এসব কথা বললে আমি কি করব বলতে পারো? দোহায় লাগে এসব কথা বলবে না।”

নাফিসা বেগম নিজের নাতনির দিকে তাকিয়ে চুপ করলেও উনার কষ্টটা কমল না। নিজের সন্তানের মৃত্যু একজন মাকে কতটা কষ্ট দেয় সেটা প্রকাশ করা কোনো শব্দ বা কথার ক্ষমতা নেই। মোহ গিয়ে তার নানিমার পাশে বসে উনার হাত দুটো ধরল। বেশ কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করল তারা। অবশেষে নিজেকে শান্ত করেও ফেলল মোহ। কাঁদতে কাঁদতেও একসময় চোখের পানি শুকিয়ে আসে। সেটাই ঘটেছে মোহের ক্ষেত্রেও। নাফিসা বেগমকে শান্তনা দিয়ে প্রশ্ন করল,
“সকালে কিছু খেয়েছো?”

নাফিসা বেগম মুখ কালো করে ফেললেন। মানেটা মোহের বুঝতে বেশি সময় লাগল না। ক্ষোভ নিয়ে ধীর গলায় বলল,
“খাবেই বা কি করে? এই বাড়ির কারোর খেয়াল আছে? যে বাড়িতে একজন অসুস্থ মানুষ পড়ে রয়েছেন? বাড়ির প্রধান যিনি উনিই তো ঘুমোচ্ছেন নাকে তেল দিয়ে।”

“চুপ চুপ! এসব কথা শুনে ফেললে হুলস্থুল কান্ড বাঁধিয়ে ফেলবে রেবা।”

“তার জন্য সত্যি কথা বলা যাবে না?”

ফুঁসে উঠে বলল মোহ। তারপর সে আবারও বলে,
“তোমায় আমি খাওয়াব। ওয়েট, এর আগের বার যখন এসেছিলাম তখন তোমার প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী তোমার খাওয়ার আগে কিছু মেডিসিনস ছিল আমার মনে আছে। আগে বলো মেডিসিনগুলো কথায় রাখা আছে?”

“ওটা বোধহয় স্বচ্ছের ঘরে। ঔষধ শেষ হয়েছিল তাই ওকে আনতে বলেছিলাম। এনেছে কিনা কে জানে!”

চোখ বড় বড় করে তাকালো মোহ। থতমত খেয়ে বলল,
“অন্য কেউ কি আর ছিল না? শেষমেশ উনার ঘরে?”

নাফিসা বেগম ক্ষীণ দৃষ্টিতে তাকাতেই মোহ নিরুপায় হয়ে বলে,
“ঠিক আছে আমি নিয়ে আসছি।”

ঘর থেকে বেরিয়ে মার্বেল সাদা পাথরের তৈরিকৃত বড় বড় সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে চোরের মতো এদিক-ওদিক তাকালো মোহ। প্রথম প্রথম বড্ড সাহস মনে জমা হলেও তা যেন মিহিয়ে গেছে। এখন স্বচ্ছ সামন-সামনি দাঁড়ালে একটা কথাও বলতে পারবে কিনা তা সন্দেহ! সিঁড়ি বেয়ে উঠে করিডোর ধরে শেষ প্রান্তে খোলা বারান্দার পাশের রুমের এসে দাঁড়াল সে। তার জানামতে এটাই স্বচ্ছের ঘর। দরজায় হাত দিয়ে আবারও সরিয়ে নিল হাতটা। দরজায় কয়েকবার টোকা দিয়েও স্বচ্ছের যখন কোনো সাড়া পাওয়া গেল না দরজা খুলতেই উঁকি দিল মোহ। আশেপাশে কেউ নেই। ওয়াশরুম থেকে আসছে পানির কলকল শব্দ। এর মানে হয়ত স্বচ্ছ ওয়াশরুমে।

বিজয়ের হাসি দিয়ে সুরসুর করে রুমে ঢুকল সে। এর আগে দুবার স্বচ্ছের রুমে ঢুকেছিল মোহ। কিন্তু একবারও স্বচ্ছ উপস্থিত ছিল না। নাফিসা বেগমের ঔষধ নেওয়ার জন্য এদিক ওদিক খুঁজল মোহ। রুমটা বড্ড অগোছালো। এতো সুন্দর রুম অগোছালো থাকলে মানায়? পুরো রুমটাই সাদা রঙের। রুমের আসবাবপত্রে থেকে শুরু করে বেড কভার, পর্দা এবং দেয়ালও সাদা। সাদা রঙটা মোহের বড্ড পছন্দের। কিন্তু সমস্যা হলো বেডে যত প্রকার কাপড় এলিয়ে রাখা, ড্রেসিংটেবিলের একটা জিনিসও ঠিক নেই, বেডের বালিশ, চাদর সেখানে যেখানে রাখা। এসব দেখে মোহ অজান্তেই বলে দিল,
“এতো অগোছালো হয়ত একটা বান্দরের থাকার জায়গাও হয় না।”

বলেই ড্রেসিংটেবিলের দিকে এগিয়ে গেল মোহ। সেখানে একটা ঔষধের ব্যাগ দেখা যাচ্ছে। দুইধাপ এগোতেই একটা গমগমে কন্ঠে আঁতকে তাকাল সে।

“হেই ইউ! আমার ঘরে তোমার কি কাজ? কি চুরি করতে এসেছো?”

ভ্রু কুঁচকে পিছু ফিরে তাকায় মোহ। তার পেছনে ওয়াশরুমের দরজার থেকে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে স্বচ্ছ। গায়ে বাথরোব জড়ানো। ভাগ্যিস বাথরোবটা পড়েছে। নয়ত এতোক্ষণে হয়তবা মোহ নিজেই লজ্জায় মরে যেতো। মোহ আশ্চর্য হয়ে বলল…..
“আ…আমি আপনার ঘরে চুরি করতে আসব কেন? আপনার ঘ…ঘরে এমন কি আছে? আ…আমি তো শুধু নানীমার ঔষুধ নিতে এসেছিলাম।”

কথাগুলো কড়া গলায় বলতে চেয়েও মোহের কন্ঠ মিইয়ে গেল। কারণ সামনে থাকা স্বচ্ছের সঙ্গে তার আগাগোড়ার সাপেনেউলে সম্পর্ক। দুজন দুটো মেরুর প্রান্ত!

“কারো রুমে বিনা পারমিশনে আসতে নেই এই ভদ্রতা তোমার মা-বাবা শিখিয়ে দেয়নি?”

“কাল তো আপনিও আমার রুমে বিনা পারমিশন ঢুকে পড়েছিলেন।”

মিনমিন করে কথাগুলো বলে স্বচ্ছের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখে চুপ হয়ে গেল মোহ। স্বচ্ছ অন্যদিকে তাকিয়ে বলল….
“কাল ওটা মিস্টেক ছিল। সজ্ঞানে ছিলাম না। তাই বুঝতে পারিনি।”

“এখন তো সব মনে পড়েছে! সরি বলা উচিত আপনার।”

“হোয়াট?”

স্বচ্ছের ক্রুদ্ধ কন্ঠ শুনে মোহ চমকালেও দমলো না।
“হ্যাঁ। আপনি আমার রুমে ঢুকে যা তামাশা করেছিলেন!”

“সরি তো তোমার বলা উচিত।”

মোহ হা করে তাকালো। সে কি ভুল করেছে? অবাক কন্ঠে বলল….
“আমি কেন?”

স্বচ্ছ নিজের ঘাড়ে থাকা টাওয়াল দিয়ে নিজের মাথা মুছতে মুছতে ব্যস্ত হয়ে বলল…..
“কাল রাতে আমি তোমার ঘরে ঘুমিয়েছি রাইট? তোমার ঘরে কি গন্ধ! বালিশ – বিছানা থেকে শুরু করে তোমার ঘরের সবজায়গায় বিদঘুটে গন্ধ। এতো গন্ধে ঘুমাতে তো আমার কষ্ট হয়েছে নাকি? সরি বলো! আর গেট আউট ফ্রম মাই রুম!”

ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল মোহ। তার ঘরে বিদঘুটে গন্ধ? স্বচ্ছ ইন্ডাইরেক্টলি তার অপমান করছে? তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল দূরে দাড়িয়ে থাকা স্বচ্ছের দিকে।

চলবে….?

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে