আমার_অভিমান_তোমাকে_নিয়ে পর্ব-১৯+২০

0
430

#আমার_অভিমান_তোমাকে_নিয়ে(19)

“প্রেমদহন বোঝো? প্রেমের অনলে পুড়ে এক প্রেমিকের দহন ব্যাথা বোঝো? তবে কেনো এতো দূরত্বের সমাহার প্রাণপাখি?”

সামনে দাঁড়ানো প্রেমিক পুরুষের চোখে চোখ মিলিয়ে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না অরুনিকা। অস্বস্তির সাথে ভালো লাগার এক মিলবন্ধনে শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি দ্রুত উঠানামা করছে। প্রবাহমান শীতল হাওয়ার সাথে লজ্জার রেশ ক্রমে বেড়েই চলেছে। কোমরে অবস্থিত হাতদুটোর পাকড়াও আরো নিবিড় হতেই কেঁপে উঠলো অরুনিকা। থরথর করে কাঁপতে থাকা দেহটা লুকোনোর কোনো স্থান না পেয়ে আখিপল্লব বন্ধ করে ফেললো। ক্ষুদ্র এক চেষ্টা লজ্জায় রাঙ্গা নিজেকে লুকানোর।

“আপেল পছন্দ করিনা বলে খাওয়া হয়নি কখনও, তবে এই কাশ্মীরি আপেল আমার চাই। আই হ্যাভ টু টেষ্ট ইট প্রাণপাখি।”

কানের কাছে মিহি কন্ঠে উচ্চারিত শব্দগুচ্ছ যথেষ্ট ছিলো অরুনিকার কাঁপাকাঁপি বাড়িয়ে ফেলার জন্য। দুইচোখ আরও খিঁচে বন্ধ করার সাথে কামড়ে ধরলো নিজের ওষ্ঠপল্লব। দুইহাতের মুঠোয় দলাইমলাই হচ্ছে শাড়ির কিছু অংশ।

“প্রাণপাখি!”

কোমল মোহময়ী কণ্ঠের ডাককে উপেক্ষা করতে না পেরে পিটপিট করে চোখ খুলে সামনে তাকায় অরুনিকা। চোখের সামনে আদাভানের হাস্যোজ্বল চেহারা দেখে বেশ কিছুটা ভড়কে গেলো অরুনিকা।

“হৃদযের সীমানায় রেখেছি যারে, হয়নি বলা আজও ভালবাসি তারে। ভালবাসি বলতে গিয়ে ফিরে ফিরে আসি। কি করে বুঝাবো তারে আমি কতটা ভালবাসি!”

আদাভানের বুকের মাঝে মুখ লুকিয়ে দাড়িয়ে আছে অরুনিকা। আদাভানও দুইহাতে জাপটে ধরে রেখেছে তার প্রাণপাখিকে। এক প্রশান্তির নীড়ের মাঝে বিরাজ করছে দুজনে। আদাভানের খুব করে মনে পড়ছে কোথাও একটা পড়েছিলো,

” ভালোবাসা শুধু দেওয়ার জিনিস, নেওয়ার নাহ। ভালোবাসা পাওয়ার চেয়ে বেশি সুখ তো একবুক উজাড় করে ভালোবাসা দেওয়াতে। কোনো চাওয়া পাওয়া ছাড়া একটা মানুষকে এক আকাশ সমান ভালোবাসা উজাড় করে দেওয়ার মধ্যে যে আত্মতৃপ্তি আছে, সেটা আর কোথাও নেই। এটাই ভালোবাসার গভীরতা। গভীরভাবে কাউকে ভালোবেসে যে সুখ তা এই ধরনীর দ্বিতীয় কিছুতে নেই।”

তিন বছরের একতরফা ভালোবাসায় আজ প্রথম সাড়া পেলো আদাভান। খুশিতে নিজেই বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি ব্যাক্তির তালিকাভুক্ত মনে হচ্ছে নিজেকে। অরুনিকাও তাকে ভালোবাসে, এই শব্দটা শোনার জন্য কতোগুলো বছর অপেক্ষায় ছিলো সে তার সবটাই অজানা অরুনিকার কাছে। বিগত তিনটে বছরে ঘটে যাওয়া কিছু তিক্ত সত্য থেকে অজানা সে। মাঝে মধ্যেই ভীষণ ভাবে ভয় জেঁকে ধরে তাকে, সব রহস্যের খোলাসা হওয়ার ভয়। যে রহস্যের মায়াজাল থেকে দূরে দূরে সরিয়ে রেখেছে অরুনিকাকে এতবছর হুট করেই না উন্মোচিত হয়ে পড়ে। অবশ্য রহস্যের শেষটা কোথায় তা আদাভানেরও অজানা। ইচ্ছে করেই আর গভীরে প্রবেশ করেনি সে, কারণ যা ঘটার ঘটে গেছে, এখন সেটা অতীত। আর অতীত ঘাঁটতে গিয়ে বর্তমানকে কখনও হারাতে পারবেনা সে। তার ভালোবাসা, তার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন এই অরুনিকা। অরুনিকার চোখে নিজের জন্য সন্দেহ কখনও সহ্য করতে পারবেনা সে। মনে মনে একটাই জিনিস চায় সবসময়, অতীত যেনো আজীবন মাটি চাপা পরে থেকে যায়। কিন্তু কিছু ভয়ংকর অতীত যে বর্তমানকে নির্মূলে নিঃশেষ করতেও সক্ষম তা হয়তো অজানা আদাভানের কাছে।
__________

স্নিগ্ধ আবহাওয়ার সাথে শীতের কুয়াশা মিশ্রিত সকালটা বেশ মনোরম দেখায়। ধীরে ধীরে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে সকালের মিষ্টি সোনালী রোদের ঝলক। আড়মোড়া ভেঙে ঘুম থেকে উঠতে গিয়েই অরুনিকার মনে পড়ে গেলো কাল রাতের ঘটনা। লজ্জায় শিউরে উঠে দুইহাতে চাদর টেনে পুরো মুখ ঢেকে নিতে গেলে বাধ সাধলো আদাভান। একহাতে খামচে ধরে আছে চাদরের অংশ। মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই আসলে ঘুমের মাঝেই ধরেছে নাকি জাগন্ত। তবে জেগে থাকলে বেশ অস্বস্তিতে পড়তে হবে অরুনিকাকে। ডান হাতে আলতো করে জড়িয়ে রাখা হাতটা সরিয়ে উঠে যেতে নিলেই ঝট করে নিজের আরও কাছে টেনে নেয় আদাভান।

“সকাল সকাল এতো তাড়া কিসের প্রাণপাখি? বরকে একা ফেলে কোথায় যাওয়া হচ্ছিল শুনি?”

“আরে সকাল কোথায় দেখুন নয়টা বেজে গেছে। কত্তো বেলা হয়ে গেছে উঠতে, ইশ।”

“তো এতো বেলা করে উঠলে কেনো?”

“কেনো আবার কাল সারারাত ঘুমাতে দিয়েছেন আমাকে আপনি? ভোরের দিকেই তো মাত্র…….”

বলতে বলতে ঠিক কী বলে ফেলেছে বুঝতে পেরে আবারো লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে পড়লো অরুনিকা। এদিকে আদাভান বেশ কিছুটা ঝুঁকে পড়ে আবারো বললো,

“কেনো কাল রাতে ঘুমাওনি কেনো? আমি কিছু করেছি নাকি?”

“দেখুন”

“দেখাও। আই অ্যাম রেডি বেইইইইবি।”

“অসভ্য।”

“শুধু তোমার জন্য।”

“উঠবো আমি।”

“উঠে?”

” সরুন গসুলে যাবো।”

“এতো সকালে গোসুল করার কি দরকার?”

“উফ্! সব আপনার জন্য। এই শীতের দিনে আমাকে এতো সকাল সকাল গোশুল করতে হচ্ছে এখন। সরুণ দেখি!”

“অভ্যেস করে নাও। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা রোজ সকালে এভাবেই গোসল করাবো আমি।” বলেই অরুনিকাকে ছেড়ে আবারো শুয়ে পড়লো আদাভান। অরুনিকা মনে মনে বেশ কিছু গালি দিয়ে চলে গেলো ওয়াশরুমে।

কলেজে আজ একসাথেই এসেছে দুজনে। পুরো কলেজ প্রাঙ্গণের বেশিরভাগ মানুষের নজর তাদের দিকেই। কারোর দৃষ্টিতে রয়েছে চরম অবাকের আভাস তো কারোর ক্রোধের দৃষ্টি। সবার দৃষ্টি উপেক্ষা করে অরুনিকা নেমে পড়লো বাইকের পিছন থেকে। আদাভানকে বিদায় জানিয়ে চলে গেলো ক্লাসরুমের দিকে। আজ অনেকদিন পর কলেজে এসেছে অরুনিকা। পুরো কলেজ যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার কাছে। কলেজ ভর্তি মানুষের মাঝেও নিজেকে ভীষণ একা একা মনে হচ্ছে। যেখানেই তাকাচ্ছে ভেসে উঠছে তাদের চার বন্ধুর স্মৃতির মুহূর্ত। কিছুদিনের ব্যবধানে সম্পর্ক গুলো কেমন বদলে গেল ভাবতেই ভীষণ ভার অনুভব করলো নিজের মনে।

মনে পড়ে গেল আদিত্য আর আলেয়ার ঝগড়া, নূরের সাথে খুনসুটির মুহূর্ত। বিগত পাঁচ বছরের বন্ধুত্ব তাদের। স্কুল লাইফ থেকে একসাথে থাকার সিদ্ধান্তে একই কলেজে ভর্তি হওয়া। কেউ কারুর সঙ্গ না ছাড়ার ওয়াদা করা মানুষগুলোও একদিন ছেড়ে যায়, রেখে যায় গভীর কিছু স্মৃতি। হয়তো সারা জীবন সেগুলো আকড়ে ধরে বেঁচে থাকার জন্যই রেখে যায়। কি এমন ক্ষতি হতো যদি মানুষগুলোর যাওয়ার সাথে নিয়ে চলে যেত স্মৃতিগুলোকেও!

গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুকুরপাড় থেকে উঠে যেতে গেলে পাশে কারোর উপস্থিতি অনুভব করে সেদিকে তাকাই অরুণিকা। পূরবকে এই অসময়ে এখানে আসতে দেখে বেশ অবাক হয়। নিজের অনুভূতিগুলো আড়ালে রেখে এক মিষ্টি হাসি উপহার দেয় অরুনিকা। এতক্ষণে ইতস্তত বোধ করে এগিয়ে আসা পূরবও সম্মতি পেয়ে অরুনিকার পাশে বসে। দুজনের মাঝে বিরাজমান নীরবতাকে দূরে সরাতে হালকা শব্দ করে পূরব।

“মিস করছো?”

সবেমাত্র গলা পূরবের কথায় অবাক নয়নে সে দিকে তাকায় অরণিকা। তবে কি পূরব সবটা জানে?

“তুমি কিভাবে জানলে? আমাদের মাঝে ঘটে যাওয়া ঘটনার কোনো কিছুর সাক্ষী তো তুমি ছিলেনা।”

অরুনিকার চিন্তা মিশ্রিত কন্ঠ শুনে হালকা হাসলো পুরব।

“আলেয়া বলেছে।”

“আলেয়া! কোথায় সে?”

“বেশ কিছুদিন তুমি কলেজে আসোনি অরুনিকা। এই কয়েকদিনে আলেয়াকে প্রতিদিন ঠিক এই জায়গায় বসে থাকতে দেখতাম। ক্লাসের মাঝেও তেমন মনোযোগ ছিল না ওর, সবসময় মনমরা কিছু একটা চিন্তাতে ডুবে থাকতো। পাশের জায়গা গুলো ফাঁকা দেখে আন্দাজ করেছিলাম তোমাদের মাঝে হয়তো কিছু ঝামেলা চলছে। তবে হঠাৎ করে একদিন ওকে ক্লাসে আসতে না দেখে চিন্তায় পড়ে যাই। হঠাৎ করে তোমাদের সবার মাঝে এমন পরিবর্তন কেমন যেন ঘোলাটে লাগে ব্যাপারটা। কোনো কিছু চিন্তা না করে ছুটে আসি এই পুকুর পাড়ে, আর আমার ধারণা ঠিক হয়। এখানেই একা একা বসে থাকতে পাই আলেয়াকে। সেদিন জানতে পারলাম তোমাদের মাঝে ঘটা ভুল বোঝাবুঝির কাহিনী।”

” বাদ দাও পুরব। তোমার আম্মু এখন কেমন আছেন বলো।”

“আম্মু আলহামদুলিল্লাহ ভালোই আছেন। জানোই তো আমার আম্মু ছাড়া আর কেউ নেই। আম্মুর কিছু হয়ে গেলে আমি বাঁচার আসাটাই হারিয়ে ফেলবো অরুনিকা। এজন্য তো আমার সবকিছুর আগে আম্মুর সুস্থতা। এবারে হয়তো আমাকে পরীক্ষায় বসতে দেবেনা, তাও কোনো আফসোস নেই আমার কারন আমার আম্মুকে আমি সুস্থ করে তুলতে পেরেছি।”

পূরবের কথায় আরো বেশি কান্না পেয়ে গেল অরণিকার। ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না করলো গিলে ফেললো সে। মনে পড়ে গেল আব্বু আম্মুর কথা, না জানি তারা কেমন আছেন।

“জানো পূরব, বাবা-মা এমন এক জিনিস যা থাকতে আমরা মূল্য দিই না, অথচ হারিয়ে ফেললে বুঝতে পারি জীবনের ঠিক কতটা মূল্যবান জিনিস হারিয়ে ফেলেছি। এদিক থেকে তুমি ভীষণ লাকি, হারানোর আগেই মূল্য বুঝেছো। কিছু মানুষের তো সেই সৌভাগ্য হয়না।”

বাইকের পিছনে বসে আছে বেশ অনেক্ষণ হলো, অথচ রাস্তা যেনো এখনও শেষ হচ্ছেনা। আশেপাশে তাকাতেই চমকে উঠলো অরুনিকা। এটা তো তার বাড়ীর রাস্তা। এতক্ষণ মন খারাপের ভিড়ে আদাভানের পিঠে মাথা এলিয়ে বসে ছিলো বিধায় এতকিছু লক্ষ্যই করেনি। মনের মাঝে ভয়ের সঞ্চার হতেই পিঠে রাখা হাতটা আঁকড়ে ধরলো অরুনিকা।

“জ্ঞান ফিরেছে তবে আপনার মহারানী!”

এই অসময়ে ঠাট্টা করা দেখে ভিশন রাগ হলো অরুনিকার। কড়া করে কয়েকটা কথা শুনিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিতেই ভেসে এলো আদাভানের কণ্ঠস্বর।

“আই অ্যাম সরি”

“মানে?”

“আমি জানি আমি ভুল করেছি অরুনিকা। আসলে ঠিকভুলের খেয়ালে আমি তখন ছিলাম না। তোমাকে হারিয়ে ফেলার ভয় আমাকে এভাবে তাড়া করে বেরিয়েছিলো যে সেই মুহূর্তে তোমাকে নিজের করে নেওয়া ছাড়া আর কিছু মাথায় আসেনি। তার উপর বেশ কিছুদিন ধরে তোমার করা অবহেলায় আমার মনে তোমাকে হারানোর ভয়টা আরও জেঁকে বসেছিলো। প্লীজ আমাকে কি মাফ করা যায়না?”

“যাদের মেয়েকে এভাবে জোর করে বিয়ে করেছেন তারা মাফ করলেই হয়। আমার তরফ থেকেও মাফ।”

মুখে হাঁসি থাকেলও মনের মধ্যে আবারো ভয় বাসা বাঁধছে আদাভানের। তবে অরুনিকার মন খারাপ যে নিমেষেই গায়েব হয়ে গেছে ভেবেই পাপ্তির হাসি হাসলো।

“এতো দূরে দূরে বসেছো কেনো বলোতো? একটু কাছে এসো না পানপাখী”

“ওই মিষ্টার লুচ্চা, ঠিকভাবে বাইক চালান। সবসময় খালি লুচ্চামু।”

“ইশ তুমি তোমার হ্যান্ডসাম রোম্যান্টিক জামাইকে এভাবে অপমান করতে পারলে?”

“ঠিকই বলেছি আমি মিষ্টার।”

“কাল ফেসবুকে একটা মেয়ে রিকুয়েস্ট দিয়েছে, কি যে কিউট দেখতে, পুরোই হহহহট।”

অরুনিকার রাগী ফেসটা দেখার আদাভানের ভীষণ ইচ্ছে হলো, কিন্তু বাইকে সামনে ঘুরে থাকায় তা আর সম্ভবপর হলোনা। মনে মনে অরুনিকার রাগান্বিত চেহারা কল্পনা করে ডেভিল হাসতেই পিছনে বসে থাকা মানুষটার কাজে বেকুব বনে গেলো। অরুনিকা যে এমন কিছু করবে তার কল্পনার বাইরে ছিলো।

চলবে?
#Fiza siddique

#আমার_অভিমান_তোমাকে_নিয়ে(20)

“নূর আমার ব্ল্যাক ফাইলটা পাচ্ছিনা, দাওতো একটু।”

সদ্য গোসুল করে রুমে আসতেই আদিলের কথায় হালকা হাঁসে নূর। এই কয়েকদিনে দুজনের মাঝে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক না হলেও বেশ বন্ধুত্ত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তবে সবটার কৃতিত্ব আদিলের। আদিলের ব্যাবহারে একপ্রকার মুগ্ধ হয়েই তার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে নূর। টেবিলের উপর থেকে ফাইলটা আদিলের হাতে দিয়ে মুচকি হাসলো নূর। আদিল অপলক নয়নে তাকিয়ে থাকলো নূরের দিকে। সদ্যস্নাত নূরকে কোনো হুরপরীর থেকে কম লাগছেনা। পরনে একটা কালো পাড়ের সাদা শাড়ি, ভিজে চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পুরো পিঠে ছড়ানো, মুখের কোনো কোনো অংশে এখনও পানির ফোঁটা লেগে আছে। মুহুর্তেই মুচকি হাসলো আদিল। রোজ অফিসে যাওয়ার আগে কোনো এক বাহানায় নূরকে ডেকে এভাবেই কয়েক পলক তাকিয়ে থাকে সে।

“কি মায়ায়, বেঁধেছো আমায়,
বুকে ধরে রাখো আরও কাছে থাকো
বুকে ধরে রাখো আরও কাছে থাকো,
ভালোবেসে ফেলেছি তোমায়,
ওগো পিয়া”

মনের সুখে গুনগুন করে গান করতে করতে বেরিয়ে গেলো আদিল অফিসের উদ্দেশ্যে।

শাশুড়ির আর ফুফুশাশুড়ির মন রাখতে গিয়ে বাড়ীর প্রায় সবকাজই নিজের হাতেই করে নূর। এই নিয়ে বেশ ঝক্কি পোহাতে হয় তাকে। বাড়ীতে কাজের লোক থাকা সত্ত্বেও নিজের হাতে এতগুলো মানুষের রান্না সেই সাথে সবার জন্য আলাদা রকম আইটেম। তবে আদিল এসবকিছু থেকে অজানা। নূর কখনও জানতে দেয়নি নিজেদের মধ্যের বিবাদ। সম্পর্কের মাঝে একটুও ফাটল আসুক কোনোক্রমে চায়না নূর। আদিল কখনোই অন্যায় সমর্থন করেনা, আর কথা যদি হয় নূরের ক্ষেত্রে তবে আদিল ঢাল হয়ে দাড়ায় সবসময়। l

দুপুরের রান্নার প্রস্তুতি করতে ব্যাস্ত থাকার মাঝে পাশে রাখা ফোনের শব্দে সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে নূর। হাতের কাজটা শেষ করতে করতে শব্দটা হারিয়ে যায়, তবে সাথে সাথে আবারো সশব্দে জানান তার উপস্থিতি। কানের সাথে ফোনটা চেপে ধরতেই অপর পাশের মানুষটার উৎকণ্ঠাময় কণ্ঠ শুনে হালকা হাসে নূর।

“ঠিক আছো তুমি? এতো দেরি হলো ফোন রিসিভ করতে?”

“জ্বী, ঠিক আমি আমি। একটু ব্যাস্ত ছিলাম তাই দেরী হলো।”

নূরের মিনমিন করে বলা কথা শুনে মুচকি হাসলো আদিল। ভীষন অবাক হয়ে এই যুগের মেয়ে হয়েও নূরকে এতো মার্জিত স্বভাবের হতে দেখে। কথার মাধ্যমে ক্ষত বিক্ষত করে দিলেও একটুও টু শব্দও করেনা সে।

“কী কাজ করছিলে? ফুফু আম্মু কি তোমাকে দিয়ে কিছু কাজ করাচ্ছে নাকি?”

“নাহ নাহ। একদম এমন ভাববেন না। উনি আমাকে কিছুই বলেননি। আমি নিজের ইচ্ছেতে একটু কিচেনে এসেছি। আর ফুফি কিছু বললেও আমি খুশি মনেই করবো সেটা।”

“জ্বী বুঝেছি। আপনি এতো মহান বলেই তো আপনার জন্য আমাকে পাঠিয়েছেন উপরওয়ালা।”

“………….”

“এই শোনো, বিকালে তৈরি হয়ে থেকো। আমি এসে এক জায়গায় নিয়ে যাবো।”

“কোথায়”

“সেটা সারপ্রাইজ। গেলেই দেখতে পাবেন ম্যাম।”

“আচ্ছা রাখি”

“এতো তাড়া? এই যাহ কেটে দিলো।”

____________

অরুনিকার বাড়ীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে আদাভান আর অরুনিকা। মনের মাঝে ভয় আর শঙ্কা নিয়ে কলিংবেল চাপ দিলো আদাভান। ভয়ে অরুনিকার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। কথায় আছে যে মানুষ যত শান্ত রেগে গেলে ততো ভয়ংকর হয়ে ওঠে। ভাবনার মাঝেই দরজা খোলার আওয়াজে সেদিকে তাকায় দুজনে। রুবিনা বেগমকে দেখে কান্না ভেজা চোখে তাকিয়ে থাকে অরুনিকা।

দরজার ওপারে অরুনিকাকে দেখে ভীষণ আবেগী হয়ে পড়েন রুবিনা বেগম। কিছু না বলে ভেতরে ঢুকে পড়েন তিনি। অরুনিকার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ভরসাময় আশ্বাসে এগিয়ে যায় ভেতরে।

সোফায় বসে চা খাচ্ছিলেন তাহসান সাহেব। এতদিন পর অরুনিকাকে দেখে তার দুই নয়ন ভরে ওঠে। মুহুর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে উচ্চস্বরে বলে ওঠেন,

“রুবিনা, ওদেরকে ভেতরে আসতে কে দিয়েছে? অচেনা কাউকে বাড়ীর মধ্যে আসতে দিচ্ছ কবে থেকে তুমি?”

“আব্বু!”

“এই কে তোমার আব্বু? তোমার আব্বু এখানে থাকেনা। আমাদের কোনো মেয়ে নেই।”

“আব্বু প্লীজ মাফ করে দাওনা। আমি একটুও ভালো নেই তোমাদের ছাড়া। অনেক ভালবাসি তোমাদেরকে।”

তাহসান সাহেবের পা জড়িয়ে ধরে অরুনিকাকে আকুতি করতে দেখে আদাভানের চোখের কোনেও জল জমে ওঠে। তার ভুলের জন্য অরুনিকার চোঁখের পানি কিছুতেই সহ্য হয়না আদাভানের।

“আঙ্কেল আমার আপনাকে কিছু সত্যি বলার আছে। এসবকিছুতে অরুনিকার কোনো দোষ নেই। সব দোষ আমার। আমিই জোর করে বিয়ে করেছিলাম অরুনিকাকে।”

আদাভানের কথা শুনে অবাক নয়নে সেদিকে তাকান তাহসান সাহেব। অরুনিকাও কান্নাভেজা চোখে তাকায় সেদিকে। আদাভান যে এভাবে নিজের ভুল স্বীকার করে নেবে তা ভাবেনি অরুনিকা।

“এসব কি বলছো তুমি? সেদিন তুমিই বলেছিলে যে তোমরা একে অপরকে ভালোবাসো।”

“আঙ্কেল এটা ঠিক যে আমি অরুনিকাকে ভালোবাসি। আর সেই ভালোবাসা থেকেই এই ভুল পদক্ষেপ। আপনাদেরকে কষ্ট দেওয়ার কোনো উদ্দেশ্য আমার ছিলোনা। আমি জানতাম আপনারা কখনও সহজে অরুনিকার সাথে আমার বিয়ে দিতেন না। সাথে দিনের পর দিন অরুনিকার আমাকে এড়িয়ে চলা, কাব্যের সাথে মেলামেশা সবকিছু আমাকে ভীষণ ভাবিয়ে তোলে। মণের মাঝে এক অশান্ত ঝড় ওঠে। অরুনিকাকে হারিয়ে ফেলার তীব্র যন্ত্রনা আমাকে নিঃশেষ করে দেয়। জোর করে সেদিন বাধ্য করেছিলাম আমি অরুনিকাকে আমাকে বিয়ে করতে।”

মাথা নিচু করে অনুশোচনার স্বরে বিশ্লেষণ করা সবটা শুনে তেড়ে আসেন তাহসান সাহেব। দুইহাতে আদাভানের কলার ধরে রোষের অনলে পুড়ে বলে ওঠেন,

“তোমার সাহস কী করে হয় আমার সামনে দাঁড়িয়ে এসব কিছু বলার? শুধু তোমার জন্য আমি আমতা মেয়েকে ভুল বুঝেছি। আমার মেয়ের জীবন নিয়ে খেলে কি লাভ পেলে তুমি?”

চলবে?
#Fiza Siddique

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে