আমার_অভিমান_তোমাকে_নিয়ে পর্ব-৪৪

0
442

#আমার_অভিমান_তোমাকে_নিয়ে(44)

ডানহাতের মুঠোয় আদিলের চুলগুলো ভরে একগাল হাঁসে নূর। পাশে শুয়ে শুয়ে দুষ্টুমি করতে থাকা নূরের দিকে আদিল চোখ পাকিয়ে তাকাতেই মুঠোয় টান দেয় নূর।

“নূরপাখি, দিন দিন পাজি হচ্ছো তুমি। নিজে তো দুষ্টুমি করছো সাথে আমার মেয়েটাকেও দুষ্টুমি শেখাচ্ছ।”

“এই এই কই কই, আমি কই দুষ্টুমি করেছি। যা করার আপনার মেয়ে করছে। এই এক মিনিট, আপনি জানলেন কিভাবে আমাদের মেয়ে হবে?”

নূরের ভ্রু উঁচু করে তাকানো দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়ে হালকা হাঁসে আদিল। প্রথম দিনের নূর আর আজকের নূরকে চিনতে বেশ কষ্ট হয়। গুমোট, চুপচাপ স্বভাবের মেয়েটা এখন প্রানবন্ত সতেজ হয়ে থাকে। কথার পিঠে একটা জবাব না দেওয়া মেয়েটা কথার ঝুলি খুলে বসে। আজাইরা বকবক করে পাগল করে দেয় আদিলকে। সবকিছুর মাঝেও প্রাপ্তির হাঁসি ফুটে ওঠে আদিলের ঠোঁটে। এই প্রাপ্তির স্বাদ আলাদা।কয়লার মাঝে লুকিয়ে থাকা রত্নকে সযত্নে ঘষেমেজে গড়ে তোলার প্রাপ্তি, ভাঙ্গা হৃদয়ের প্রতিটা টুকরোকে সযত্নে একটু একটু করে ভালোবাসার সুতো দিয়ে বেঁধে দেওয়ার প্রাপ্তি। হৃদয়ের ক্ষতগুলো হয়তো থেকে যাবে সারাজীবন, তবুও থাকবেনা কোনো ফাঁকফোকর। থাকবেনা আর এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা হৃদয়ের টুকরোগুলো। এখন মাঝরাতে ঘুম ভাঙ্গলে কান্নারত তাহাজ্জুতের সিজদায় নূরকে দেখতে হয়না, দেখতে হয়না হুটহাট চোখ ভরা অশ্রু নিয়ে একাকি মত্ত নূরকে। এই প্রাপ্তি অন্যরকম। প্রিয়জনের সব গ্লানি মুছে ফেলে তাকে নিজের করে রাখার প্রাপ্তি।

“আমার ঘর আলো করে আরও খানিকটা জান্নাতের নূর আল্লাহ পাঠাচ্ছেন আমার আঙিনায়। সে ইশারা তিনিই দিয়েছেন।”

“আপনি এতো ভালো কেনো?”

“তাই নাকি? কতো ভালো আমি?”

“এইযে এত্তোওওওও ভালো”

দুইহাত দুদিকে যতোটা বিস্তৃত হয় ততোটা খেলিয়ে বলা নূরের কথায় বেশ জোরে হেঁসে উঠলো আদিল। দুইহাতের আজলায় নূরের মুখ ধরে খানিকটা কাছে টেনে নিলো। খানিকটা এগিয়ে কপালে ছুঁইয়ে দিলো ঠোঁট। দুই চোখের পাতা বন্ধ করে বেশ সময় নিয়ে গভীর এক চুমু একে দিল প্রিয়তমার কপালে। নূরের বন্ধ চোখের গা বেয়ে গড়িয়ে পরলো একফোঁটা অশ্রু, দুই ঠোঁটের মাঝে খেলে গেলো প্রাপ্তির হাঁসি।

হটাৎ ফোনের মেসেজ টোনে ধ্যানভঙ্গ হলো দুজনের। রাত বেশ গভীর হওয়ায় আলতো করে শুইয়ে দিল নূরকে। গায়ের উপরের কম্বলটা গলা পর্যন্ত টেনে দিয়ে আরোও একটা চুমু এঁকে দিলো নূরের কপালে। হালকা হেসে ঢুলুঢুলু চোখে তাকালো নূর তরপর একসময় ঘুমিয়ে পড়লো।

“আই মিস হার ভেরি ব্যাডলি। ওয়ান্না টক উইথ ইউ। প্লীজ! ”

মেসেজটা দেখে খুব একটা অবাক হলোনা আদিল। নূরের মুখের কাছে ঝুঁকে ঘুমিয়েছে কিনা চেক করে ফোন হাতে চলে গেলো ব্যালকনিতে। পুরোনো কল লিষ্ট ঘেঁটে “বুদ্ধু” নামে সেভ করা নম্বরটা ডায়াল করলো। সাথে সাথে রিসিভ হলো কল।

“কেমন আছো? এতো রাতে বিরক্ত করলাম কি?”

“এই কথা কতোবার আর বলতে বারণ করবো তোকে?”

“কি করবো বলো মাঝরাতে বিবাহিত কাপলের মাঝে কাবাব মে হাড্ডি হয়ে বাঁধা সৃষ্টি করি বারবার, খারাপ লাগা তো থাকবেই তাইনা?”

“নিজেকে যে কাবাবের হাড্ডি বলছিস সেই কাবাব আমার জীবনে শুধু তোর জন্যই। আমার সমস্ত প্রাপ্তির আসল কারণ তুই আদিত্য।”

কথার পিঠে বেদনামিশ্রিত হাঁসি উপহার দিলো আদিত্য। দুদিকের নিস্তব্ধতায় কেটে গেলো বেশ কিছুটা সময়।

“নূর কেমন আছে? ওর তো নয় মাস রানিং চলছে। রেগুলার চেকআপ করাচ্ছ তো? কোনো রকম প্রবলেম দেখতে পেলে সাথে সাথে ডক্টর দেখাবে।”

“আমি সত্যি ভেবে পাইনা মানুষ এতটা পাগল কিভাবে হয়? কাউকে ভালোবেসে এতটাও পাগলামি করা যায় আদিত্য? মনে আছে মেসে থাকাকালীন তুই আমাকে বলতিস শুধুমাত্র নূরের জন্য তুই ডক্টর হবি। নূরকে যেনো কখনও অন্য কেউ ছুঁয়েও না দেখে সেজন্য তুই ডাক্তারি পড়বি। দেখ আজ তুই নামকরা গাইনোকোলজিস্ট। কিন্তু যার জন্য এই পাগলামি সেই আর তোর নেই। তবুও পাগলামি করে যাস। আচ্ছা অন্যের বউকেও এতটা ভালোবাসা যায়? কষ্ট হয়না তোর নূরকে আমার সাথে দেখে? কষ্ট হয়না বলতে যে নূরকে এটা দেবে, ওটা দেবেনা। খারাপ লাগেনা বলতে যে নূর ঝাল খেতে পারেনা একদম, ওর ফুচকার চেয়ে চটপটি বেশি পছন্দ, তুমি এমনভাবে ওর খেয়াল রাখবে, এটা করবে সেটা করবে দেখবে নূর তোমাকে ভালোবেসে ফেলবে। শুধু নূর কেনো পৃথিবীর যে কোনো মেয়েই ভালোবাসার কাঙাল। আর সেখানে তার স্বামী যদি প্রতিটা ছোটোখাটো জিনিস বলার আগেই হাজির করে দেয়, মুখ ফুটে না বলা সব কথা বুঝে নেয় তাহলে কোনো মানুষই না ভালোবেসে থাকতে পারবেনা। মনে আছে? আমাকে সারাদিন বেরসিক বলে মাথা খারাপ করে দিতিস। অথচ আজ দেখ নূর আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ওকে ছাড়া একটা মুহূর্ত বেঁচে থাকার কথা ভাবতে পারিনা আমি। বেরসিক আদিল আর বেঁচে নেই। যে আছে সে নূরের প্রেমে পাগল এক প্রেমীক।”

“আচ্ছা তুমি কেমন হাসবেন্ড বলোতো? নিজের ওয়াইফকে তার এক্স প্রেমিকের সাথে দেখা করানোর তোড়জোড় করলে। কি দরকার ছিল এমন করার?”

“আমি তোকে নিজের ছোটো ভাইয়ের থেকে কম নজরে দেখিনি কখনও। রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও তুই আমার ছোটো ভাই। যেদিন রাগ করে বাড়ি ছেড়ে মেসে উঠেছিলাম, ঠিক তোর পাশের রুমে থাকতে শুরু করেছিলাম সেদিন থেকে নিজে থেকেই আমার সুখ দুঃখের ভাগীদার হয়েছিস তুই। আর আজও পর্যন্ত তুই আমাকে শুধু দিয়েই গেলি।”

“ভাইয়া! এই মাঝরাতে কি শুরু করেছ বলোতো। হুট করেই তুমি যেদিন নূরের ছবি দেখালে আমি থমকে গেছিলাম। অদৃষ্টকে বারবার দোষারোপ করেছি। প্রশ্ন করেছি সৃষ্টিকর্তাকে, আমার সাথেই এমন কেনো হলো? নূরের বিয়ে তো অন্য কারোর সাথে হলেও পারতো। তাহলে অন্তত ওর মুখও আমাকে দেখতে হতনা। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। নূরকে তো তোমার বাম পাঁজরের হাড় দিয়ে সৃষ্টি করেছেন তিনি, সেখানে চাইলেও সে অন্য কারোর হতে পারবেনা।”

“এখনও ভালবাসিস নূরকে?”

“প্রশ্নটা একটু ভুল হয়ে গেলো তোমার। নূর আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসা। ভালোবাসার হাতেখড়ি ওর হাত ধরে। কতশত সৃতি আমাদের দুজনের একসাথে। নূর আমার অতীত, এমন এক অতীত যার বর্তমানের উপর কোনো দাবি নেই। অতীত হয়েই থেকে যাবে আজীবন। হ্যা আমি ভালোবাসি নূরকে, আমার সেই প্রেমিকা নূরকে। ভালোবাসি আমার হাতে হাত রেখে হাঁটা নূরকে, শান্ত, স্নিগ্ধ নূরকে। সেই নূর আর বেঁচে নেই। এখন যে আছে সে তোমার নূর, যে তোমার সংস্পর্শে হয়ে উঠেছে দুষ্টু পাখি। যে নূরের শান্তির যায়গা তোমার বুক। এই নূর আমার নূর নয়, একে আমি ভালোবাসিনা।”

আদিত্যের কথায় হালকা হাসলো আদিল। ব্যালকনির থাই গ্লাস থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে নূরকে। ডান হাত মাথার নীচে রেখে বাচ্চাদের মতো গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে। একটা বাচ্চার গর্ভে আর এক বাচ্ছা বেড়ে উঠছে ভাবলেই হাঁসি পায় আদিলের।

“ভাইয়া আসলে তোমাকে কিছু বলার ছিলো। না মানে আসলে একটা অনুমতি।”

“এতো আমতা আমতা করছিস কেনো? তুই চাইলে আমি আমার প্রাণটুকুও দিয়ে দিতে রাজি।”

“উহু। এতকিছু চাইনা। আসলে আমি চাই নূরের ডেলিভারি আমি করি। তোমার নূরপাখির ছোট্টো পাখিটাকে আমি নিজের দুইহাতের মাঝে নিয়। তার কান্না, তার স্পর্শ, তার চাঞ্চল্যতা সবকিছুর প্রথম ভাগীদার আমি হই। ছোট্টো ছোট্টো চোখে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকুক আমার দিকে। ললাটের প্রথম চুম্বনের স্পর্শটা আমিই দিতে চাই।”

দুই চোখের কোন থেকে গড়িয়ে পড়া অশ্রু একহাতে মুছে কানের সাথে ফোনটা চেপে রাখলো আদিত্য, উত্তরের আশায়। ফিচেল হেঁসে কিছু বলতে যাবে তার আগেই শুনতে পেলো ফোনের ওপারের মানুষটার কণ্ঠস্বর।

“আমার মেয়েকে পাপ্পা বলার অধিকার দিবি আদিত্য?”

হাঁ করা মুখে একহাত চেপে ডুকরে কেঁদে উঠলো আদিত্য। দৃষ্টি উপরের দিকে করে ঠোঁট কামড়ে আপ্রাণ চেষ্টা করলো কান্না থামানোর। এ যে সুখের কান্না। অসামান্য এক প্রাপ্তির অশ্রু। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে কানের থেকে ফোনটা নামিয়ে একটা ফাঁকা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো আদিল। তারপর শূন্যের দিকে তাকিয়ে মলিন হেঁসে পা বাড়ালো রুমের দিকে। বুকের মাঝে শক্ত করে চেপে ধরলো নূরের মাথা। অশান্ত বুকটা এভাবেই শান্ত করে আদিল। পরপর কয়েকটা চুমু এঁকে দিলো প্রিয়তমার সারা মুখে। ঠোঁটে আলতো করে চুমু এঁকে সস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বুঁজে ফেললো আঁখিপল্লব।

চলবে?
#Fiza Siddique

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে