অতঃপর দুজনে একা পর্ব-০৪

0
1358

#অতঃপর দুজনে একা – [০৪]
লাবিবা ওয়াহিদ

————————
উৎসবমুখর পরিবেশ। লাল, নীল, সবুজ ইত্যাদি রঙের মরিচবাতিতে বাড়িটা উজ্জ্বল হয়ে আছে। অসময়ের বৃষ্টিতে আবহাওয়া মুখোরিত। বৃষ্টি থেমেছে ঘন্টাখানেক হলো। অদূর থেকে সফট মিউজিকও শোনা যাচ্ছে। নানান মানুষের আনাগোনা চলছে আয়ন্তির বাড়িতে। আয়ন্তির বাবা নুরুল আলম এবং ওয়াসিফের বাবা মেহমানদের স্বাগতম জানাচ্ছে এবং তাদের সাথে কুশল বিনিময় করছে। আজ আয়ন্তি এবং ওয়াসিফের এঙ্গেজমেন্ট পার্টি। ওয়াসিফের বন্ধু এবং আয়ন্তির কাজিনরা অনুষ্ঠানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ওয়াসিফ কিছুক্ষণ বাদেই আসলো মেহমানদের মাঝে। সে ফর্মাল সুট পরেছে। আয়ন্তি আশেপাশে নেই।

আয়ন্তি বেলকনি দিয়ে মাহবিনের রুমে উঁকিঝুঁকি মারছে। এখনো আয়ন্তি তৈরি হয়নি। মাহবিন জ্বরে কাত। আপাতত গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মাহবিনের চিন্তায় আয়ন্তির ভ্রু কিঞ্চিৎ কুচকে এলো। ইচ্ছা করছে মাহবিনের রুমে গিয়ে মাহবিনকে দেখে আসতে। মাহবিনের শরীরের তাপমাত্রা পর্যবেক্ষণ করতে। ছেলেটা যে এভাবে পরে আছে সেই খবর নেয়ার প্রয়োজন কারো নেই। আয়ন্তির মনে পরে যায় কয়েক ঘন্টা আগের ঘটনাগুলো।

আয়ন্তি এবং ওর সকল কাজিনরা পার্লার গিয়েছিলো সাজতে। এর মাঝে নামে ধুম বৃষ্টি, অপ্রত্যাশিত বৃষ্টি। আয়ন্তির পার্লারের থাই গ্লাসটা কিছুটা ফাঁক করে বৃষ্টি দেখছিলো। বাকি’রা ভেতরে সাজতে ব্যস্ত হয়ে পরেছিলো। আয়ন্তির কোনোরূপ তাড়া ছিলো না সাজ নিয়ে। তাই ওদের বসিয়ে সে নিজে এখানে আরাম করে বসেছিলো। হঠাৎ পার্লারের থাই গ্লাসটাতে কেউ জোরে জোরে থাবা বসালো। আয়ন্তি চমকে উঠলো। ভেতরে বেশ কড়া শব্দে গান বাজছে, সাউন্ড বক্সে। তাই ওরা সেই শব্দ উপলব্ধি করতে পারলো না। আবারও একই থাবার শব্দ। একবার, দুইবার, ঘনঘন। আয়ন্তি আতঙ্কের সাথে উঠে দাঁড়ায় এবং অল্প করে খোলা থাই গ্লাসটা আরেকটু ফাঁক করে শুধু মাথা বের করলো এবং দেখার চেষ্টা করলো মানুষটা কে? আয়ন্তি যেন অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। মাহবিন কাকভেঁজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ-মুখ তার অসম্ভব লাল হয়ে আছে! ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে আয়ন্তির দিকে তাকালো মাহবিন। আয়ন্তিকে চিনতে না পেরে নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলে,
–“আয়ন্তিকে ডেকে দিবেন প্লিজ?”

আয়ন্তি চমকায়, ভিষণরকম। এবার আয়ন্তি বেরিয়ে আসলো পার্লার থেকে। মাহবিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। উপরে ছাদ আছে দেখে মাথায় বৃষ্টি পানি লাগছে না। তবে পায়ের দিকে বৃষ্টির ঝাপটা লাগছে। আয়ন্তিকে এবার চিনলো মাহবিন।
–“ওহ তুমি ছিলে? তোমার গাড়িটা কোথায়?”
–“আপনার কী হয়েছে মাহবিন? এমন এলোমেলো লাগছে কেন?”
–“জানি না। তোমাদের গাড়ি করে আমায় বাসায় দিয়ে আসবে প্লিজ? আমার মাথা কেমন ভার হয়ে আছে। মানিব্যাগটাও বাসাতে ফেলে এসেছি আমি। দিক-নির্দেশনা না পেয়ে তোমার কাছে এসেছি। আশেপাশেই ছিলাম আমি!”
–“আমি পার্লারে তা আপনি জানলেন কী করে?”

বেশ অবাক হয়ে বললো আয়ন্তি। মাহবিন রুদ্ধশ্বাস ফেলে বলে,
–“তোমায় দেখেছি পার্লারের ভেতরে।”

মাহবিন যেন আরও কিছু বলতে নিচ্ছিলো। ঠিক তখনই তার চোখ বুজে এলো। ঢুলতে ঢুলতে আয়ন্তির উপর গিয়ে পরলো। আয়ন্তি মাহবিনের ভার সামলাতে না পেরে দেয়ালের সাথে লেপ্টে গেলো। মাহবিনের হাত ধরতেই আয়ন্তি আঁতকে উঠলো। মাহবিনের শরীর অসম্ভব গরম। এই অসময়ের বৃষ্টির কারণে মাহবিনকে জ্বর কাবু করে ফেলেছে। আয়ন্তি কোনো দিকে না তাকিয়ে দ্রুত মাহবিনকে ধরে ধরে তাদের গাড়ির কাছে চলে গেলো। গাড়ির ভেতরে ড্রাইভার ছিলো। আয়ন্তিকে ওই অবস্থায় আসতে দেখে হাতে ছাতা নিয়ে ড্রাইভার বেরিয়ে আসলো। দ্রুত আয়ন্তির মাথার উপর ছাতা মেলে দিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো,
–“কী হয়েছে স্যারের?”
–“এতকিছু বলার সময় নেই চাচা। দ্রুত ওনাকে ধরে গাড়িতে বসান এবং বাসায় চলেন!”

ড্রাইভার ইতিবাচক মাথা নাড়ায়। মাহবিনকে দুইজন ধরে পিছের সিটে বসিয়ে দেয় এবং আয়ন্তিও উঠে বসে। ড্রাইভার উঠে বসতেই গাড়ি স্টার্ট দেয়া হয়। আয়ন্তি সারা রাস্তায় নিজের ওড়না দিয়ে মাহবিনের মাথা, কপাল, গাল মুখ মুছে দিয়েছে। মাহবিন এখন জ্ঞানহীন। ঘোরের মাঝে উল্টো পাল্টা বকছে। আয়ন্তি বেশ ঘাবড়ে আছে মাহবিনকে নিয়ে। আল্লাহ জানে কীভাবে সুস্থ হবে সে। আয়ন্তি বারংবার ড্রাইভারকে তাড়া দিয়ে বলছে,
–“জলদি চাচা!”

ড্রাইভার স্পিড বাড়িয়ে দিয়েছে। যেহেতু বৃষ্টি হচ্ছে তাই রাস্তা মোটামুটি ফাঁকা। আয়ন্তি মনে মনে আল্লাহ্ কে স্মরণ করছে এবং এই বিপদে সাহায্য চাইছে। গাড়ির বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই ড্রাইভার মাহবিনকে ধরে ধরে ভেতরে নিয়ে গেলো। সকলে বাড়ির পেছনদিকে ছিলো বিধায় কেউ ওদের দুজনকে দেখেনি। আয়ন্তি ড্রাইভারকে মাহবিনের রুমের অবস্থান জানিয়ে ফোনে মেসেজ করে দিলো নিলাকে। বলে দিলো আয়ন্তি কিছুটা অসুস্থ বোধ করছিলো তাই সে চলে এসেছে। আয়ন্তি মাহবিনের রুমে আসতেই দেখলো ড্রাইভার মাহবিনকে শুয়ে দিচ্ছে। আয়ন্তি আটকালো তাকে।
–“চাচা আগে ওনার ড্রেস চেঞ্জ করে দিন আপনি। এভাবে ভেঁজা কাপড়ে বিছানায় শুইয়ে দিলে আরও অসুস্থ হয়ে পরবে। এছাড়া বিছানাও ভিঁজে যাবে।”

ড্রাইভার মাথা নাড়ায়। মাহবিনকে একটি চেয়ারে বসিয়ে দিতেই আয়ন্তি মাহবিনের জন্যে টিশার্ট এবং টাউজার দিলো। ড্রাইভার সেগুলো নিতেই আয়ন্তি রুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। অতঃপর নিজেও চেঞ্জ হয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয় আয়ন্তি। ততক্ষণে ড্রাইভার মাহবিনের ড্রেস চেঞ্জ করে বেরিয়ে আসে।
–“ড্রাইভার চাচা, আপনি এক কাজ করেন। আবারও পার্লারে চলে যান। ওরাও তো আসবে তাই না!”
–“তুমি চিন্তা করো না মা, আমি যাচ্ছি!”
–“আর হ্যাঁ চাচা। ওনার কথা কাউকে কিছু বলবেন না প্লিজ!”

ড্রাউভার হাসলো। হাসি-মুখে জবাব দিলো,
–“কোনো ব্যাপার না!”

————————-
আয়ন্তি বেশ সুন্দর করে রেডি হয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছে। সকল গেস্ট আপাতত আয়ন্তির দিকে তাকিয়ে। আয়ন্তির তার বাবার দিকে তাকিয়ে একটি শক্ত হাসি দিলো। সেই হাসির মানে কেউ বুঝলো না, কেউ না। আয়ন্তি নামতেই ওয়াসিফ আসলো, আয়ন্তির সম্মুখে। আয়ন্তিকে চোখ জুড়িয়ে দেখে নিলো। আয়ন্তি একবারের জন্যেও ওয়াসিফকে দেখার প্রয়োজন বোধ করলো না। তার নজর আশেপাশে যাচ্ছে। মুখে বরাবরের মতোই জোরপূর্বক হাসি। আয়ন্তি একটি সুন্দর গাউন পরেছে। সাদা রঙের। মাথায় সাদা দোপাট্টা। আয়ন্তির জন্যে ওয়াসিফের হাতে রিং দেয়া হলো। অর্থাৎ এখনই ওদের এঙ্গেজমেন্ট হিয়ে যাবে। ওয়াসিফের মা ছেলেকে ইশারা করলেন যাতে আয়ন্তিকে পরিয়ে দেয়। আয়ন্তির এবার অস্বস্তি হতে শুরু করলো। যদু সত্যি সত্যি এঙ্গেজমেন্ট হয়ে যায়? তখন? ভয়ে একপ্রকার ঘামতে শুরু করলো সে। ওয়াসিফ রিং নিয়ে এগোচ্ছে। ধীরে ধীরে আয়ন্তির খুব কাছে এসে দাঁড়ায়। সকলে হাসি-মুখে হাত তালি দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। যেন এই শুভক্ষণে-ই শুভ কাজটি হয়ে যাবে। আয়ন্তির মা আয়েশা পাশ থেকে মেয়ের বাম হাতটা এগিয়ে দিলো।

কিন্তু ঘটনা ঘটলো একদম ব্যতিক্রম। ওয়াসিফ আয়ন্তিকে পাশ কাটিয়ে কিছুটা দূরে গিয়ে জয়ার হাতে রিং পরালো। রিং পরিয়ে জয়ার হাতে একটি চুমু খেয়ে ওয়াসিফ বললো,
–“উইল ইউ ম্যারি মি সুইটি?”

জয়া অমায়িক হাসি দিলো। হাসতে হাসতে বললো,
–“ইয়েস!”

পরিবেশ মুহূর্তে-ই স্তব্ধ হয়ে গেলো। সকলে যেন নড়তে, শব্দ করতে, কথা বলতে ভুলে গেলো। হতবুদ্ধি হারিয়ে ফেললো তারা। শূণ্য চোখে তাকিয়ে রয় সকলে ওদের দিকে। তার চেয়েও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটালো ওরা। ওয়াসিফ জনসম্মুখে জয়াকে কি’স করে বসলো। দু’জন যেন পরম খুশির সাগরে ভাসছে। এরকম একটি দৃশ্য দেখে আয়ন্তি তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো। ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো তার বাবার পানে। একটু বুঝতে চেষ্টা করলো তার বাবার মুখ-ভঙ্গি! ভিষণ হাসি পাচ্ছে আয়ন্তির, ভিষণ। ওয়াসিফ যে এরকম হবে সেটা জানারই ছিলো। চাইলে গতকালই সে বিয়েটা ভাঙ্গতে পারতো কিন্তু বিয়ে ভাঙ্গতে গেলে তার বাবা তাকে ভুল বুঝতো। তার চোখে সত্যতা তুলে ধরতে না পারলে কখনোই মানতেন না, বিশ্বাস করতেন না তিনি। তাইতো চুপ থেকেছে আয়ন্তি। নিরবতা অনেককিছু মানুষের চোখে আঙুল দিয়ে প্রকাশ করে।

ওয়াসিফ জয়ার কোমড় জড়িয়ে আয়ন্তির সামনে এসে দাঁড়ালো। ওয়াসিফ শ’য়’তানি হাসি দিয়ে বলে,
–“এই হচ্ছে আমার রিভেঞ্জ। খুব না তোমার নিজেকে নিয়ে বড়াই? নাও?”

ঘর কাঁপিয়ে হেসে ওঠে ওয়াসিফ। নুরুল আলমের এবার ধ্যান ভাঙ্গে। চোখ-মুখ অসম্ভব লাল হয়ে আসে তার। ওয়াসিফ এত গুলো মানুষের সামনে তার মান-সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিলো। নুরুল আলম ওয়াসিফকে কঠিন গলায় ডেকে ওয়াসিফের কলার গিয়ে ধরলো,
–“তোর এত বড়ো সাহস! তুই আমার মেয়েকে নিয়ে খেললি? নিজের এই রূপ দেখালি? জা’ নো’ য়া’রের বাচ্চা! তোকে তো আজ আমি খুন করে ফেলবো!”

কয়েকজন দ্রুত নুরুল আলমকে টেনে ওয়াসিফের কাছ থেকে সরালো। ওয়াসিফ হাসতে হাসতে তার কলার ঠিক করলো। নুরুল আলম আবার তেড়ে যেতে চাইলে বাকিরা তাকে আবার আটকালো। আয়েশা চোখেতে পানি জমেছে সেই কখনই। আঁচলে মুখ গুঁজে কাঁদছে সে। এজন্যই বুঝি মেয়েটা তার সবসময় মনমরা হয়ে থাকতো? এর মাঝে হাই তুলতে তুলতে মাহবিন উপস্থিত হলো। ওয়াসিফ ততক্ষণে তার বাবার উদ্দেশ্যে বলতে লাগলো,
–“ও পাপা! ড্রামা তো শেষ। চলো আমরা যাই, এখন এ বাড়িতে থেকে কাজ কী?”

ওয়াসিফের বাবা লজ্জিত ভঙ্গিতে নুরুল আলমের দিকে তাকালো। ছেলের বেহায়াপনা কর্মকান্ডে তিনি ভিষণরকম লজ্জিত। নুরুল আলম অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেই চলেছে ওয়াসিফকে। জয়ার মা এসে জয়াকে থাপ্পড় দিতে চাইলে ওয়াসিফ জয়ার সামনে এসে দাঁড়ায়। অতঃপর জয়ার মায়ের মুখে আঙুল তুলে একপ্রকার হুমকি দিয়ে বলে,
–“ভুল করেও এই স্পর্ধা দেখাবেন না। বেইবি, চলো! আমাদের এখানে থেকে কাজ নেই!”

জয়া ওয়াসিফের সাথে যেতে যেতে একবার ঘুরে আয়ন্তির দিকে তাকালো। আয়ন্তির চোখে-মুখে দেখতে চেয়েছিলো একরাশ দুঃখ। ভেঙ্গে যাওয়া আয়ন্তির মুখখানা দেখার খুব ইচ্ছে ছিলো তার। কিন্তু ঘটনা উল্টো। আয়ন্তির চোখে-মুখে একরাশ প্রফুল্লতা। টাস্কি খেলো জয়া। একসময় ওরা চলে গেলো। সব ঘটনা মাহবিন সিঁড়ির রেলিঙ এ ভর দিয়ে দায় সাড়া ভাব নিয়ে দেখছিলো। ওরা চলে যেতেই মাহবিন পুণরায় হাই তুললো। যেন আগে থেকেই ইঙ্গিত পেয়েছিলো এই ঘটনার। মাহবিনের জ্বরটা এখনো পুরোপুরি ভাবে সারেনি। মাহবিন বর্তমানে আয়ন্তির ভাব-ভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করলো। নাহ! মেয়েটা স্বাভাবিক হয়ে আছে।

—————————-
~চলবে, ইনশা আল্লাহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে