#প্রাণ_বসন্ত
#পর্ব৬
#রাউফুন
“তাওহীদা,এই তাওহীদা? আমি কি আমার সকালের লেবুর চা পাবো না? তুমি কি জানো না, আমি সকাল সকাল লেবু চা খাই?”
তাওহীদা রান্নার প্রসেস শুরু করছে, হাতে মাছ মাখানোর মশলা লেগে আছে৷ তাই সে একটু উচ্চ স্বরেই জবাব দিলো,“আপু একটু পরেই দিচ্ছি, বসুন আপনি!”
রিমি ড্রয়িংরুমে বসে কর্কশ কন্ঠে বললো,
“তুমি কি এমন করছো যে আমার চা দিতে দেরি হচ্ছে? নাকি আমার সুন্দর ফিটনেস দেখে হিংসে করো? সেজন্যই আমার সকালের চা দিতে চাও না? আমি যেনো তোমার মতো মুটিয়ে যাই এটাই চাও আমি বুঝি না মনে করেছো?”
তাওহীদা হতভম্ব হয়ে গেলো। অবাক হয়ে বলল,“কোন কথার জন্য কোন কি কথা বলছেন আপু? আমি আপনাকে হিংসে করবো কোন দুঃখে?”
“আমার মতো সুন্দরী কে যে সবাই হিংসে করে তা আমি জানি। যাই হোক দ্রুত চা দাও!”
পারভীন ভেজা চুলে তোয়ালে পেঁচিয়ে বের হলো। বললো,“তাওহীদা, আমার মাথা টা খুব ব্যথা করছে কড়া এক কাপ আদা চা দে!”
তাওহীদা রিমির লেবু চা দিতে দিতে লক্ষ্য করলো পারভীনকে বেশ স্নিগ্ধ লাগছে। সদ্য গোসল করে আসায় নাকি সামী সোহাগে রূপ চকচক করছে তাওহীদা বুঝলো না। আহসান আর তার সুন্দর কোনো দিন এমন মূহুর্ত আসবে ভেবেই লজ্জায় নতজানু হয়ে গেলো তাওহীদা। ইশ, কি অবস্থা হয়েছে তার। কি সব ভাবছে। পারভীন ওকে লজ্জা পেতে দেখে বললো,“তুই আমাকে দেখে এমন লজ্জা পাচ্ছিস কেন? সমস্যা কি?”
“মেজো ভাবি আপনাকে খুব সুন্দর লাগছে!”
পারভীন এ কথা শুনে নিজেও খানিক লজ্জা পেলো। পরক্ষণেই চেহেরায় কাঠিন্যতা এনে বললো, “আমাকে এতো পাম দিতে হবে না। কাজ কর যাহ! তুই ভেবেছিস আমাকে একটু মিষ্টি কথা বলবি আর আমি গলে যাবো? আসলে এসব কিছুই না, আমার ভেজা চুল দেখে তোর হিংসা হচ্ছে। নিজে তো এমন সকাল কখনো পাস নি। খবরদার আমার সুখে নজর লাগাস তো।”
তাওহীদার হাসি হাসি মুখটা মুহুর্তেই পাংশুটে বর্ণ ধারণ করলো। মিইয়ে যাওয়া গলায় বললো,“আমি নজর লাগাবো কেন? আপনাকে সুন্দর লাগছে এটা বলেছি শুধু!”
“এতো বলতে হবে না যাহ, আমি জানি আমি সুন্দরী!”
এই কথা শুনে রিমি একবার পারভীনের দিকে তাকালো। ঠোঁট বাকিয়ে ওখান থেকে উঠে নিজের ঘরে চলে গেলো। যে করেই হোক নিজের পরিকল্পনা ও ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেবেই সে। পরিকল্পনা টা আরও জোড়ালো করতে হবে যেনো তার নিজের ঘাড়ে কোনো ভাবেই দোষ না পড়ে। ক্রুর হাসলো সে নিজের মাথায় সর্ব নিম্নমানের একটা বুদ্ধি আসায়।
তাওহীদার বুকের ভেতর টা কেমন খাঁ খাঁ করে উঠলো। সবাই কেন তাকে এতো বেশি অবহেলা করে? গ্রামের মেয়েরা কি মানুষ না? গ্রামের মেয়ে বলে বুঝি এতো কূটক্তি শুনতে হয় তাকে? আড়ালে চোখ মুছে নিলো তাওহীদা! রান্নায় মনোযোগ দিলো সে সবকিছু ভুলে।
আনোয়ার সালমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,“আহসানের বউকে তো দেখালে না। তোমরা চাইলেই কিন্তু সুযোগ করে দিতে পারবে। অথচ সেটা একবারও করলে না।”
সালমা হাত এক ঝটকায় সরিয়ে দিলো। রেগে বললো,“লজ্জা করে না, নিজের বউ থাকতে অন্যের বউকে দেখার জন্য উতলা হচ্ছো? তোমার ঐ মেয়েকে দেখতেই হবে এমন তো কোনো কথা নেই।”
“আরে রাগো করো না লক্ষীটি। আমি শুধু এই জন্য দেখতে চাচ্ছি যে আমার বউয়ের থেকে ঐ মেয়ে কি এমন স্মার্ট যে ওমন রূপের বহর করে?”
“ও হিংসা করার মতোই রূপবতী। আমি মেয়ে হয়েই ওকে আড়াল থেকে দেখি। মুখে ওর আলাদা একটা লাবন্যময়, আলাদা একটা গ্লো কাজ করে। যেনো নূর ভাসছে মুখে।”
আনোয়ারের যেনো এবারে আরও লোভ জাগলো তাওহীদাকে দেখার। সে অন্য ভঙ্গিমায় বললো,“আমার বউয়ের চাইতে কেউ সুন্দরী হতেই পারে না। আমি এটা বিশ্বাস করিই না বুঝলে?”
“ছাড়ো, এতো পাম দেবে না। আমি জানি কেন এসব বলছো!”
“তুমি আমাকে এই চিনলে? আচ্ছা আগে আহসানের বউকে দেখানোর সুযোগ করে দাও পরে আমি দেখবো আসলেই আমার বউয়ের চাইতে ঐ মেয়েটা সুন্দরী কিনা।”
“আচ্ছা আমি ব্যবস্থা করবো। এখন সরো।”
সানোয়ার মিনমিন করে পারভীনের কাছে গেলো। বললো, ”মা আর রিমির জন্য যে দুটো চেইন এনেছিলাম ওঁদের দিলে ভালো হয় না?”
“এতো দরদ কেন? তোমার বিদেশ যাওয়ার সময় তোমাকে আমার বাপের বাড়ি থেকে পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছিলো। তোমার বাপের বিজনেস ত তখন ডুবতে বসেছিলো মনে নেই? তাই বিদেশ থেকে আনা কোনো কিছুই আমি তাদের দেবো না। চেইন দুটো আমি আমার মা বোনকে দেবো। আমি কথা দিয়েছি তাদের।”
“তাদের জন্য তো আমি আলাদা করে গিফট এনেছি, ওগুলোই দাও।”
“তোমার ঐ দুটো চিকন চিকন চেনের দাম কি পাঁচ লাখ টাকা হবে? সরো চোখের সামনে থেকে। তোমাকে দেখলেই গা জ্বলে যাচ্ছে আমার!”
আজ সালমা আর পারভীন একে অন্যের সঙ্গে যুক্তি করে একটা নিকৃষ্ট পরিকল্পনা করলো। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে কি যেন চক্রান্তের ইঙ্গিত করলো। তাওহীদা তখন টেবিলে সকালের খাবার রাখছিলো৷ আনোয়ার আর সানোয়ার দুজন রুম থেকে বের হচ্ছে বুঝতে পেরে তাওহীদা দ্রুত প্রস্থানের সিদ্ধান্ত নিলো। তখনই সালমা আর পারভীন তারা দুজন মিলে তাওহীদার কাছে এসে তার পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে বললো,
“ চেহেরা নিয়ে এতো বড়াই কেন তোর? আজ তোর মুখের কাপড় সরিয়েই দেবো। এতো কিসের রূপের অহংকার তোর যে আমার স্বামী দেখতে পারবে না?”
তাওহীদার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। হতচকিত হয়ে অন্য রাস্তা ধরলো। মুখের নিকাব দুই হাতে চেপে ধরলো। তারা জোর করে তাওহীদার মুখ থেকে কাপড় সরানোর চেষ্টা করলো। তাওহীদা এক হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে তার নিকাব। কিন্তু দুই জা’র চেষ্টায় সে যেন বিপর্যস্ত হয়ে পড়লো। বিধ্বস্ত কন্ঠে বললো,“আমি আপনাদের ছোটো বোনের মতো ভাবি, আমার উপর নোংরা জুলুম চালাবেন না। আমাকে যেতে দিন এখান থেকে!”
“জুলুম করছি না তো, তোর পর্দা, আবেদগিরি ছুটাচ্ছি! খুব নাটক হয়েছে তোর, সব ভন্ডামি আমি ছুটাবো।”
“আমার আত্মসম্মানে আপনারা হাত দিলে আল্লাহ্ সইবে না। আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠবে ভাবি। দোহাই লাগে আমাকে ছাড়ুন।”
আনোয়ার আর সানোয়ার দুইজন উৎসুক জনতা হিসেবে সবটা উপভোগ করছে। তাদের বউদের নিয়ে মনে মনে একটু গর্ব করছে। ওদের দৌলতে আহসানের কুমারী বউটাকে একবার অন্তত দেখতে পারবে। তাদের চোখে যেনো লালসায় চকচক করছিলো। সালমা আর পারভীন পৈশাচিক আনন্দে কুটিল হাসছে শব্দ করে। তাওহীদা দু হাত জোর করে মিনতি করছে। দু চোখে তার পানি ঝড়ছে অনবরত এই ভয়ে যে আজ বুঝি তার পর্দা ছুটে যাবে। ছোটো বেলা থেকে মায়ের শিক্ষায় সে বড়ো হয়েছে। মা আয়েশা (রাঃ), মা ফাতেমা (রাঃ) আর রাবেয়া বসরীর আদর্শকে নিজের মনে লালন করেছে। আজ বুঝি তা ভঙ্গ হবে? সে আল্লাহকে ডেকে যাচ্ছে। হঠাৎই এমন আক্রমনাত্মক কিছু ঘটবে তা বিন্দুমাত্র ঠাহরও করতে পারেনি তাওহীদা। যখন সবকিছুই হাতের বাহিরে চলে যাওয়ার উপক্রম ঠিক তখনই আহসান ছুটে এলো। তার বাচ্চাদের মতো সরল চেহারায় এক গভীর উত্তেজনা। সে সালমা আর পারভীনকে সরিয়ে দিয়ে তাওহীদার সামনে দাঁড়ালো। দুই হাত মেলে তাওহীদাকে আড়াল করলো। তার চোখে একরকম শিশুসুলভ জেদ আর সতর্কতা।
“বউকে কেউ হাত দিবি না! এটা আমার বউ!” আহসান চিৎকার করে বললো।
সবার কুৎসিত, বিকৃত, অত্যন্ত নোংরা আনন্দে যেনো ভাটা পড়লো, পরিবেশ যেনো থমকে গেলো। যে আহসান বছর তিনের মধ্যেও নিচে নামেনি সে কি না এতো বছর পর নিচে নেমেছে বউকে বাঁচাতে? এতক্ষণের ঝামেলা আর আহাজারিতে রিমিও বেরিয়ে এসেছিলো। আর রওশন আরা ছিলেন ওয়াশরুম। নিজের কার্য সম্পন্ন না করেই চেঁচামেচি শুনে জলদি বেরিয়ে এসেছেন ঘরের বাইরে। রিমি মুখ টিপে হেসে বললো,
“দেখেছো? এই পাগল মানুষটা এখন বউয়ের বডিগার্ড হয়ে গেছে!”
পারভীন বিরক্ত হয়ে বললো,
“তাওহীদা কী এমন মন্ত্র দিয়েছে এই পাগলকে, যে ওর জন্য এত বড় কাণ্ড করছে, সোজা আমাদের ধাক্কা দিলো? অথচ এতো বছরেও বাইরে আসেনি সে কি না বউকে বাঁচাতে ছুটে এসেছে!”
সালমা খানিকটা সন্দিহান হয়ে বললো,“তুমি আসলেই পাগল তো আহসান?”
ঠিক সেই সময় মফিজ উদ্দিনও আক্রোশে হুংকার ছুড়লেন। পুরো দৃশ্য দেখে তার চেহারা রাগে ফুঁসে উঠেছে। তিনি গর্জে উঠলেন,
“এটা কী হচ্ছে? তাওহীদাকে জোর করে ওর পর্দা সরানোর সাহস হলো কার? বাড়িতে এতটা নোংরামি কখনো বরদাস্ত করবো না! আমি না থাকাই কি ভেবেছো তোমরা যা খুশি করবে? ছিঃ তোমাদের অধঃপতন দেখে আমার ঘেন্না হচ্ছে। দুদিন পর বাইরে থেকে ফিরে যে এমন জঘন্যরকম দৃশ্য আমাকে দেখতে হবে কল্পনাও করিনি।”
সবাই চুপ হয়ে গেলো। মফিজ উদ্দিন তাওহীদার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললেন,
“তুমি যাও, তোমার ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নাও। আর কেউ তোমাকে বিরক্ত করবে না।”
তাওহীদা মাথা নিচু করে দ্রুত সরে গেলো। আহসান পাগলামী ভঙ্গিতে হাত বেকিয়ে বললো,
“ওরা সন্ত্রাসী, আমার তাওহীদাকে, আমার বউকে, ওরা, ওরা মারছিলো।”
আহসানকে ধরে মফিজ উদ্দিন উপরে নিয়ে গেলেন। তাওহীদা দরজা আঁটকে হামলে কেঁদে উঠলো। এমন জঘন্যতম একটা দিন কেন আসলো তার জীবনে? বাইরে থেকে মফিজ উদ্দিন তাওহীদার কাঁন্না শুনে নিজেকে আরও অপরাধী ভাবতে লাগলেন৷ এই নিরীহ মেয়েটার জীবন তিনি কতটা নরকে পরিনত করেছেন। নিজেকে ধিক জানাতে লাগলেন। কতটা স্বার্থপর তিনি নিজের ছেলের জন্য ভালো একটা মেয়ের জীবন অন্ধকার করে তুলেছেন। তার জন্যই মেয়েটার জীবন এমন অন্ধকারে নিমজ্জিত।
#চলবে