#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৩৫
জাওয়াদ জামী জামী
” তাহমিদ, তুমি এসব কি বলছ! কাল এই মেয়েকে তুমি বিয়ে করেছ! এজন্যই আমার বাসার মানুষদের এত রাখঢাক ছিল কালকে! কিন্তু তুমি এটা কিভাবে করতে পারলে? তারা নাহয় এই মেয়েকে তোমার ঘাড়ে গুছিয়ে দিয়েছে। তাই বলে তুমিও ওকে বিয়ে করে নিলে! তোমার রুচি এতটা জঘন্য হতে পারেনা। আমাদের লুকিয়ে তুমি এভাবে বিয়ে করতে পারোনা। তোমার বাবা-মা’কে না জানিয়ে তুমি এই থার্ড ক্লাস মেয়েকে বিয়ে করলে? ”
নায়লা আঞ্জুমের কথা শুনে রুমে উপস্থিত সকলে সকলে স্তম্ভিত হয়ে গেছে। কুহু মাথা নিচু করল তার কথা শুনে। ওর দুচোখে মুহূর্তেই শ্রাবনের মেঘ জমে।
রায়হান আহমেদ তার স্ত্রী’র দিকে আ’গু’ন চোখে তাকিয়ে থাকেন। কিন্তু নায়লা আঞ্জুম তার অগ্নি দৃষ্টিকে পরোয়া করলে তো।
” আমি নিজের রুচি নিয়ে কখনোই চিন্তিত নই। আমি চিন্তিত রায়হান আহমেদের রুচি নিয়ে। তার রুচি যদি নিচু পর্যায়ের নাই-ই হবে, তবে তোমাকে বিয়ে করতে পারতনা। আর রইল আমার বাবা-মা ‘ কে না জানানোর বিষয়। সেক্ষেত্রে তুমি আগে থেকেই অবগত আছ, আমি মিথিলা আরজুমান্দকে মা বলে স্বীকার করতে লজ্জাবোধ করি। এবং রাশেদ কুরাইশি আমার শুধু নামমাত্র বাবা। তাই তাদের জানানোর প্রয়োজনবোধ করিনি। ”
” তাহমিদ, তুমি বেয়াদবির সীমা অতিক্রম করছ বলে দিলাম। কার সাথে কার তুলনা করছ তুমি? এই সামান্য মেয়ের সাথে আমার তুলনা করছ! একটা ফকিন্নি ঘরের মেয়ের জন্য নিজের খালামনির সাথে দুর্বব্যহার করছ? তোমার বউ হবার কোন যোগ্যতা আছে এর? কোথায় তোমার বাবার স্ট্যাটাস আর কোথায় এই ফকিন্নির মেয়ের স্ট্যাটাস! সে নাহয় বামন হয়ে চাঁদের দিকে হাত বাড়াতেই পারে। তাই বলে তুমিও বামনকে কাছে টেনে নিবে! ”
নায়লা আঞ্জুমের কথা শেষ হওয়া মাত্রই রায়হান আহমেদ তার কাছে এসে সপাটে চড় বসালেন তার স্ত্রী’ র গালে। পরপর তিনি কয়েকটা থাপ্পড় মে’রে’ই তবে ক্ষান্ত দিলেন।
” তোমার সাহস তো কম নয়, তুমি আমার পরিবারকে আবার নিচু করছ? তোমার কথামত কুহু যদি ফকিন্নি ঘরের মেয়ে হয়, তবে আমিও সেই ঘরেই ছেলে। আমি সেই ঘরের ছেলে হয়ে যদি তোমাকে বিয়ে করতে পারি, তবে কুহুও পারে কোন ভালো ঘরে সংসার পাততে। কান খুলে শুনে রাখ আমি বা আমরা নিজেদের যোগ্যতায় এতদূর এসেছি। কারও দয়া আমাদের প্রয়োজন পরেনি। আমার আব্বা একজন শিক্ষক ছিলেন। আমার আম্মাও তোমার মা’য়ের থেকে কোন অংশে কম ছিলেননা। গরীব আমরা কোনকালেই ছিলামনা। তুমি ভালো করে ভেবে দেখতো, তোমার কি কুহুর সামনে দাঁড়ানোর যোগ্যতা আছে? কিংবা আমার স্ত্রী হওয়ার কোনও যোগ্যতা তোমার আদৌ আছে? যেখানে আমার কলিগদের স্ত্রী একেকজন ডক্টর, প্রফেসর কিংবা ব্যাংকার। সেখানে তুমি আ বিগ জিরো। সারাজীবন বাপের অর্থ সম্পদের বড়াই করে গেছ। একবারও ভাবোনি বিয়ের পর মেয়েদের বাপের বাড়ি ফুটানি দেখালে চলেনা। কতদিন আর বড়াই করবে? এবার নিজের অবস্থান কি সেটা ভাব। ” রায়হান আহমেদের কথা শুনে রে’গে উঠল নায়লা আঞ্জুম।
” তুমি আবার আমার গায়ে হাত তুললে? তোমার সাহস দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি। তোমার মত ছোট ঘরের মানুষদের ম্যানার্স জানা হয়ে গেছে আমার। কোন সাহসে তুমি আমাকে থাপ্পড় মারলে? আজ এর একটা বিহিত আমি করেই ছাড়ব। নিজে যেমন ছোট ঘর থেকে উঠে এসে জাতে উঠেছ, তেমনি ভাইয়ের এই কুশ্রী মেয়েকেও জাতে তুলতে চাইছ? তা আমি কখনোই হতে দেবনা। তোমাদের দু’জনকেই আমি জেলের ভাত খাওয়াব। চাকরির বড়াই দেখাও? নারী নির্যাতনের কেইস দিয়ে প্রথমে আমি তোমার চাকরি খাব। তখন দেখব কেমন করে বড়াই কর। এরপর ধরব এই মেয়েকে। ওর নামে ফ্রড কেইস করব। তোমাদেরকে আমি দেখে নিব। আমার বাবার বাড়িতে এসে আমাকেই অপমান করছ? ”
” কাকে ভয় দেখাচ্ছ তুমি? তুমি কেইস করবে আর আমি বসে থাকব? তোমার এতক্ষণের সব কথা আমি রেকর্ড করে রেখেছি। খুব তো উঁচু জাতের বড়াই দেখাও। তোমাকে এবার টেনে নিচে নামানোর সময় এসেছে। তোমাকে দেখিয়ে দেব কে কোন জাতে বিলং করেছে। তোমাকে ডিভোর্স দেয়ার এটাই উপযুক্ত সময়। আজ থেকে তুমি এখানেই থাকবে। আমার বাড়িতে তোমার কোন ঠাঁই নেই। অবশ্য তোমার সকল জিনিসপত্র নেয়ার জন্য শুধু ঐ বাসায় যেতে পারবে। কালই আমি ডিভোর্সের জন্য আবেদন করব। এবং সেই সাথে আমার ছেলেমেয়েদের নিজের কাছে রাখার সব ব্যবস্থাই আমি করব। আমি দেখব, তুমি তোমার বাবার বাড়িতে কতদিন থাকতে পার। ” রায়হান আহমেদের রা’গে’র পারদ তরতর করে বাড়ছে।
” কি বললে! তুমি আমাকে ডিভোর্স দেবে? তবে শুনে রাখ, আমিও তোমার সংসার করতে চাইনা। আমি এই বাড়িতেই থাকব। এবং রিশা, নিশো আমার কাছেই থাকবে। রিশা, নিশো তোমরা আমার কাছে থাকবেতো? ”
নায়লা আঞ্জুম খেঁকিয়ে উঠে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করছে রায়হান আহমেদের সাথে। একসময় সে তার ছেলেমেয়ের কাছে জানতে চায় তারা কার সাথে থাকবে।
” সরি আম্মু, আমি বাবার সাথে থাকতে চাই। তোমার মত মা আমার প্রয়োজন নেই। যে মা’য়ের কাছে তার ইগো বড়, যে স্বামী, স্বামীর পরিবারকে আপন করতে পারেনা, সেই মা’কে আমার চাইনা। আর তুমি যে বারবার আমার দাদুর বংশকে ছোট বলছ, তোমাকে ঘৃণা করার জন্য এই একটা কারনই যথেষ্ট। জেনে রাখ, আমার বাবা যদি ছোট জাতের হয়, তবে আমি আর নিশো ও ছোট জাতেরই। কারন আমরাও বাবার সন্তান। ঐ বংশের র’ক্ত বইছে আমাদের শরীরে। বাবার ডি এন এ বহন করছি আমরা। তাই আমার মনে হয় এমন ছোট জাতের ডি এন এ নিয়ে তোমার মত উঁচু বংশের কারও সাথে না বাস করাই আমার জন্য মঙ্গল। কখন যে তুমিই আমাদের ছোট জাত বলে দূরদূর করে তাড়িয়ে দেবে এই ভয়ই হয় সব সময়। বড় হওয়ার পর থেকেই তোমার মুখে এসব কথা শুনতে শুনতে আমার কান পঁচে গেছে। এসব আর শুনতে চাইনা আমি। কুহুপু এই বাসায় আসার পর থেকেই তুমি তার সাথে দূর্বব্যহার করেছ। আপু কখনোই প্রতিবাদ করেনি। বাবাকে পর্যন্ত জানায়নি। আমিও নীরবে সব দেখে গেছি। ভেবেছি তুমি এক সময় মানিয়ে নিবে। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। তুমি শোধরাবার মানুষ নও। নিশো যদি তোমার সাথে থাকতে চায় থাকবে। আমি তোমার সাথে থাকছিনা, এটাই ফাইনাল। ” রিশা ঘৃণাভরে বলল।
রিশার কথা শুনে এবার নায়লা আঞ্জুম থমকায়। সে কল্পনাই করতে পারেনি রিশা তাকে এতটা ঘৃণা করে।
” আমিও তোমার সাথে থাকবনা, আম্মু। তোমার এমন অহংকারী ভাব আমার ভালো লাগেনা। তুমি আমাদের গ্রামে যেতে দিতে চাওনা। কুহুপু, সৃজনের সাথে মিশতে দিতে চাওনা। এটা আমার ভালো লাগেনা। তাহমিদ ভাইয়া কুহুপুকে বিয়ে করলে তোমার সমস্যা কোথায়? তুমি কি ভাইয়াকে খাওয়াচ্ছ, পড়াচ্ছ? এছাড়া বারবার তুমি কুহুপুকে ফকিন্নির মেয়ে বল। আপু কি ফকিন্নির মেয়ে? আমার দাদুর অনেক সম্পত্তি আছে। বড় চাচ্চু অসুস্থতার জন্য তারা সব বিক্রি করেছে ঠিকই, কিন্তু তাই বলে তারা গরীব নয়। আর আমার সাইদ চাচ্চুও গরীব নয়। তোমার এসব কথা শুনতে বিরক্ত লাগে। তুমি বাবার নামে কেইস করলে, আমি তোমার বিপক্ষে সাক্ষী দেব। তোমার বলা সব কথাই আদালতে বলব। ” এবার নিশো ও রিশার কথার সাথে সায় দেয়।
ছেলের মুখে এমন কথা শুনে নায়লা আঞ্জুম স্তম্ভিত। সে ভাবতেই পারেনি তার ছেলেমেয়েরা তারই বিপক্ষে যাবে। তার মুখে কোন কথা জোগায়না। নির্বাক চেয়ে থাকল ছেলেমেয়ের মুখের দিকে।
কুহু রিশা, নিশোর কথা শুনে অবাক হয়ে গেছে। ওরা যে কুহুর জন্য ভাবে, সেটা ও চিন্তাই করতে পারেনি।
সৈকত আহমেদ এবং তার স্ত্রী ‘ও সব চুপচাপ শুনল।
তাহমিদ এতক্ষণ চুপচাপ সবার কথা শুনছিল। এবার তার মুখ না খুললেই নয়। ও একটু হেসে এগিয়ে যায় নায়লা আঞ্জুমের দিকে।
” দেখলে, একটা ফকিন্নি ঘরের মেয়ের জন্য তোমার ছেলেমেয়েরাও তোমার বিপক্ষে কথা বলছে? কারন কি জানো? কারন, ওদের মধ্যে একতা আছে। একে-অপরের প্রতি ভালোবাসা আছে। আর ওরাই সত্যিকারের মানুষ। আজ তোমার নিজেকে নিজের কাছে ছোট মনে হচ্ছেনা? কেউ নেই তোমার পাশে। যে ছোট ভাইকে তার বউসহ এই বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলে, এবার তাদেরই দয়ায় এই বাড়িতেই তাদের আশ্রিতা হয়ে থাকতে তোমাকে। এই বাড়ি অনেক আগেই নানাভাই তার ছেলের নামে দিয়েছিলেন। এখন যদি তোমার ভাই তোমাকে এখানে থাকতে না দেয়, তবে তুমি কোথায় যাবে? তাই আমি বলি কি, এমন জীবন গড়ে তোল, যেখানে সংসারে তোমার অনুপস্থিতিতে তোমার জন্য চোখের পানি ফেলার মানুষের অভাব থাকবেনা। ”
নায়লা আঞ্জুম জানতনা এই বাড়ি তার বাবা নিজের ছেলেকে দিয়ে গেছেন। তাহমিদের মুখে শোনার পর সে চিৎকার করে উঠল।
” মিথ্যা বলছ তুমি। এই বাড়ি আমার। আমি আব্বাকে সব সময়ই বলতাম এই বাড়ি আমাকে লিখে দিতে। আব্বাও আমাকেই দিতে চেয়েছিল। এখন তুমি আমাকে কোনঠাসা করতে এমন চাল চালছ। আমি সব বুঝি। ”
” তোমাকে কোনঠাসা করে আমার কোনই লাভ নেই। নানাভাই যে তার ছেলেকে এই বাড়ি দিয়ে গেছেন, সেটা আর কেউ না জানুক, নানিমা জানে। তার ইচ্ছানুযায়ী নানাভাই মামাকে এই বাড়ি দিয়েছেন। তোমাদের তিন বোনের জন্য একটা নির্দিষ্ট পরিমানে টাকা তিনি রেখেছেন। তার সব পেপার নানিমার কাছে গচ্ছিত আছে। ”
তাহমিদের কথা শুনে নায়লা আঞ্জুম তার মায়ের কাছে ছুটে যায়।
” আম্মা, সত্যিই কি আব্বা সৈকতকে এই বাড়ি দিয়েছে? তুমি আজ মিথ্যা বলোনা। আব্বা আমাকে এভাবে ঠকালো কেন? আর তুমিই বা আমার সাথে বেইমানী কররে কেন? কি করিনি আমি তোমার জন্য? এতদিন আমি তোমার সেবা করেছি এই জন্য! ” নায়লা আঞ্জুম তার মা’কে ঝাঁকুনি দিয়ে জিজ্ঞেস করছে। তার মাথায় এই কথা নেই যে, তার মা অসুস্থ। তার এমনভাবে ঝাঁকুনিতে বৃদ্ধার কষ্ট হতে পারে।
মেয়ের এমন কাজে অসুস্থ মা’য়ের চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। তিনি কল্পনা করতে পারেননি, তার মেয়ে এতটা নিচ, এতটা লোভী। তিনি ভালো করেই জানতেন, তার মেয়ে এখানে থাকত শুধু নিজের স্বার্থে। আজ সেটা তার মেয়ে আজ প্রমান করে দিল। তিনি মাথা ঝাঁকিয়ে মেয়ের প্রশ্নের উত্তর দিলেন।
” ভুল বললে, খালামনি। তুমি নানিমার বিন্দুমাত্র সেবা করোনি। তাকে দেখার জন্য দুইজন নার্স থাকে সর্বদাই। সার্ভেন্ট থাকে, রাজিয়া খালা থাকে। তুমি নানিমার জন্য কিছুই করোনি। সে এখনও তার স্বামীর টাকায় খেয়েপড়ে বেঁচে আছে। ”
” তুমি চুপ কর বেইমান ছেলে। তুমিই আমার আব্বা-আম্মার মাথা খেয়েছ। তোমার জন্য আজ আমার এই অবস্থা। তুমিই আবার সৈকতকে ফিরিয়ে এনেছ। তুমি সব ইচ্ছে করে করেছ। তুমি চাওনি আমি এখানে থাকি। ”
এবার তাহমিদ সত্যি অবাক হয়ে গেছে। ওকে এভাবে দোষারোপ করতে দেখে একটু হাসিও পায়।
” তুমি মেয়ে হয়ে কখনো মা’য়ের মন বোঝার চেষ্টা করেছ? তোমার মা তার ছেলের জন্য দিনরাত তড়পাচ্ছিল, সেটা কি কখনো তোমার চোখে পরেছে? একটা ছেলে বছরের পর বছর, তার পরিবার বাবা-মায়ের কাছ থেকে দূরে থাকছে। এটা যে কত কষ্টের তা কি তুমি বোঝ? আমি শুধু নানিমার মুখের হাসি দেখতে, মামাকে তার পরিবার ফিরিয়ে দিতে এখানে এনেছি। ”
তাহমিদ কথা বলতে বলতে আলমারি খুলে একটা ফাইল বের করল। সে ফাইলটা সৈকত আহমেদের কাছে দেয়।
” মামা, তোমাদের প্রপার্টির পেপারস এখানে আছে। তুমি চলে যাওয়ার পর এটার কথা আমি জানতে পারি। তুমি না থাকায় কারও কাছেই এটা দেইনি। এবার তোমার প্রপার্টি তুমি বুঝে নাও, আর বোনদেরকেও বুঝিয়ে দাও। ”
সৈকত আহমেদ হাত বাড়িয়ে ফাইলটা নেয়।
চলবে…
#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৩৬
জাওয়াদ জামী জামী
” আপনি কি সত্যিই খালামনিকে ডিভোর্স দেবেন! বিষয়টা আরেকবার চিন্তা করে দেখলে হতোনা। আরেকটা সুযোগ তাকে দিতে পারেননা? লাস্ট একটা সুযোগ। ” তাহমিদ অনুনয় করে বলল রায়হান আহমেদকে।
ওরা দু’জন বাগানের এক কোনায় বসে কথা বলছে। নায়লা আঞ্জুমের সাথে কথা কাটাকাটির পর রায়হান আহমেদ ছেলেমেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে যেতে চাইলে সৈকত ও তার স্ত্রী স্মৃতি তাকে জোড় করে আটকে রেখেছে।
” তুমি কি আমাকে এতটাই বোকা আর নির্দয় মনে কর, তাহমিদ! আর যাইহোক নিজের সংসার নিজের হাতে নষ্ট করার মত মানুষ আমি নই। আমি শুধু নায়লাকে একটু শিক্ষা দিতে চাই। ওকে সংসারের মায়া বুঝতে হবে, দ্বায়িত্ব পালন করতে শিখতে হবে। এতদিন যা যা ভুল করেছি সেসব শুধরে নিতে চাই। আর সেই সাথে নায়লাকেও তার ভুলগুলো উপলব্ধি করাতে চাই। নায়লাকে তার ভুলগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চাই। আমার সন্তানদের একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ উপহার দিতে চাই। ”
রায়হান আহমেদের কথা শুনে তাহমিদ মৃদু হাসল। ওর পাশে বসে থাকা মানুষটা যে নিজের পরিবারের প্রতি সদয়, সেটা আরেকবার উপলব্ধি করল।
” আপনি আজ খালামনিকে নিজের সাথে নিয়ে যাবেননা। তাকে এখানেই রেখে যান। আর এই বিষয়ে মামা কিংবা মামীকে কিছুই বলার দরকার নেই। তাদেরকে আগে কিছু বললে, খালামনির আপ্যায়ন ঠিকঠাক হবেনা। তাকে আগে কিছুদিন বাবার বাড়িতে রাজকীয়ভাবে কাটাতে দিন। ”
” তুমি ঠিকই বলেছ। সৈকত যদি জানে, আমি নায়লাকে শিক্ষা দিতে এখানে রেখে যাচ্ছি, তবে তারা হয়তো নায়লার প্রতি নমনীয় হবে। কিন্তু আমি এটা হতে দেবনা। এমনকি এই কথাটা রিশা , নিশোকেও জানানো যাবেনা। এসব কথা এখন থাক। এক কাজ কর, আগামীকাল তুমি কুহু, আপা, সৃজনকে নিয়ে আমার বাসায় চলে এস। কাল সারাদিন তোমরা সেখানে আনন্দ কর। ”
” মেয়ে আর জামাইকে কেউ এভাবে দাওয়াত দেয়, সেটাতো জানতামনা! কোথায় বংশের একমাত্র জামাইকে ইনিয়েবিনিয়ে দাওয়াত করবেন। কিন্তু সেটা না করে মুখে নিমপাতা ঢেলে কথা বলছেন। এটাই বুঝি চাচা শ্বশুরের আসল রূপ! ”
তাহমিদের এমন অভিযোগ শুনে হো হো করে হেসে উঠলেন রায়হান আহমেদ। তবে তাহমিদ যে তার সাথে মজা করেছে, এটা তিনি বুঝতে পারছেন।
” ভুল হয়ে গেছে, জামাইবাবা। তুমি আগামীকাল সকালে তোমার স্ত্রী, শালাবাবু আর ফুপু শ্বাশুড়িকে নিয়ে আমার বাসায় চলে এস। সারাদিন সেখানে খাওয়াদাওয়া কর, আনন্দ উল্লাস কর। তোমার পছন্দের খাবার রান্না করতে বলব আমার বড় বোনকে। তুমি কবজি ডুবিয়ে খেও। ” রায়হান আহমেদও ঠাট্টার ছলে বললেন।
” সাব্বাশ। এই না হলে শ্বশুর মশাই। তবে একটু বেশি করে বাজার করবেন। জামাইতো আর আপনার বাসায় খালি হাতে যাবেনা। ফল-মিষ্টি, ঠান্ডা, গরম কত কিছুই নিতে হবে। জামাই অনেক কিছু নিয়ে যাবে, কিন্তু শ্বশুর বাজার কম করল। বিষয়টা একটু দৃষ্টিকটু। ”
” জামাইকে আর কষ্ট করে ফল মিষ্টি নিতে হবেনা। শুধু তারা গেলেই চলবে। প্রয়োজনে আমি জামাইকে সাথে করে বাজারে নিয়ে গিয়ে, তার পছন্দমত বাজার করব। ভালো হবেনা? ”
” আমরা যে এত প্ল্যান করছি, আপনার স্ত্রী জানলে কি হবে বলুনতো? ভদ্রমহিলা শোকে যদি স্ট্রোক করে বসে! ” ভাবুক চেহারায় জিজ্ঞেস করল তাহমিদ।
” তার কলিজা নরমাল মানুষের মত নয়। তার কৈ মাছের কলিজা। সহজে কিছু হবেনা। আমাদের তো কলিজা নয় যেন চায়না প্রোডাক্ট। ওয়ারেন্টি, গ্যারান্টি কিছুই নেই। সেক্ষেত্রে আমার বউয়ের কলিজায় দম আছে। আজ সতের বছর ধরে সংসার করছি, কিন্তু এক সেকেন্ডের জন্যও মনে হয়নি তার কলিজায় কোনও আঁচড় পরেছে। তাই তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পার। ভালো কথা মনে হয়েছে, তুমি কি তোমার বাবাকে বিয়ের কথা জানিয়েছ? ”
” নাহ্, এখোনো জানাইনি। ভাবছি কুহুকে ঢাকায় নিয়ে গিয়েই তাকে সারপ্রাইজ দেব। আগেই তার ব্লাড প্রেশার বাড়াতে চাইনা। আমি সামনাসামনি দেখতে চাই, আমার বউ দেখে তার অবস্থা কেমন হয়। ”
” আমার কিন্তু টেনশন হচ্ছে। সে যদি কুহুকে মেনে না নেয়? মেয়েটা জীবনে কম কষ্ট পায়নি। আমি আর ওকে কষ্ট পেতে দেখতে পারবনা। ”
” কুহু আমার স্ত্রী। আর স্ত্রী’কে সকল দুঃখ-কষ্ট, অপমান, অসম্মানের হাত থেকে হেফাজত করার দ্বায়িত্ব তার স্বামীকেই পালন করতে হয়। এই বিষয়ে আশা করছি আমি আপনাকে নিরাশ করবনা। ”
” আমি জানি তুমি যা করবে ভেবেচিন্তে করবে। তোমার ওপর এই বিশ্বাস আমার আছে। তাই একবাক্যে কুহুকে তোমার হাতে তুলে দিয়েছি। আমি জানি তুমিই ওর উপযুক্ত। তো ঢাকা ফিরছ কবে? ”
” আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন। কুহুর কোন অমর্যাদা হতে আমি দেবনা। তিনদিন পর কুহুকে নিয়ে ঢাকা যাব। ওকে ওর শ্বশুর বাড়ি দেখিয়ে নিয়ে আসব। ”
দুপুর বেলা সবাই মিলে খেতে বসলে নায়লা আঞ্জুমকে ডাকতে যান রাজিয়া খালা। নায়লা আঞ্জুম তার পূর্বের রুমেই ছিল। রাজিয়া খালাকে দেখামাত্রই সে খেঁকিয়ে উঠল। সে সাফ জানিয়ে দেয়, কারও সাথে সে খাবেনা। রাজিয়া খালা সেকথা বাহিরে এসে জানালে নায়লা আঞ্জুমকে ছাড়াই সবাই খেয়ে নেয়।
রিশা, নিশো সকালের পর মায়ের কাছে ঘেঁষেনি। এখন আবার রাজিয়া খালার কাছে সব শুনে ওদের ভিষণ রা’গ হয়। রিশা মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়, ও আর মা’য়ের আশেপাশে যাবেনা।
সন্ধ্যার পরে সবাই বিদায় নেয়। তাহমিদ কুহুকে নিয়ে চলে যায়। আর রায়হান আহমেদ তার ছেলেমেয়েকে নিয়ে চলে যান নিজের বাসায়। তিনি যাবার আগে তাহমিদকে আগামীকাল তার বাসায় যাওয়ার কথা আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিলেন। তিনি এ-ও বললেন, তাহমিদ যেন বাসায় পৌঁছেই সোহানী পারভিন আর সৃজনকে তার বাসায় পাঠিয়ে দেয়। তিনি সোহানী পারভিনের সাথে আগেই কথা বলেছেন। আগামীকাল তার বাসায় সোহানী পারভিন না থাকলে চলবেনা। তাহমিদ তার কথায় রাজি হয়।
বাসায় এসে তাহমিদ নিজে সোহানী পারভিন আর সৃজনকে রায়হান আহমেদের বাসায় পৌঁছে দেয়। সোহানী পারভিন তাহমিদকে খুব পছন্দ করেছেন। তিনি মন থেকে ওকে দোয়া করলেন।
কুহু বাসায় এসে দেখল ফুপু রাতের খাবার রান্না করেই রেখেছেন। ওকে আর কষ্ট করে রান্না করতে হলোনা।
নায়লা আঞ্জুম সেইযে সকালে রুমে ঢুকেছে, সারাদিন বের হয়নি। রাতে সবার খাওয়া শেষ হলেই তবে সে রুম থেকে বের হয়। রাজিয়া খালা তার জন্য খাবার টেবিলেই রেখেছেন। সে রুম থেকে বেরিয়ে খাবার খেয়ে আবার রুমে চলে যায়। দুপুরে স্মৃতি তাকে খাওয়ার জন্য রাজিয়া খালাকে ডাকতে পাঠালেও, রাতে তাকে কেউ-ই ডাকতে যায়নি। এই বিষয় নিয়েও নায়লা আঞ্জুম রে’গে আছে। এত বছরেও তার সাথে যা ঘটেনি, আজ তা-ই ঘটেছে। এ কথা যখনই তার মনে হচ্ছে, ততবারই সে সৈকত, স্মৃতি আর কুহুকে অভিশাপ দিচ্ছে। সেই সাথে তাহমিদকেও লাগাতার গালিগালাজ করেই যাচ্ছে। সে সব কিছুর জন্য তাহমিদকে একতরফা দায়ী করছে।
কুহু অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে বিছানার উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাপড়চোপড় আর জুয়েলারির দিকে। তাহমিদ সোহানী পারভিনকে রেখে আসার পথে কুহুর জন্য শাড়ি, থ্রিপিস, জুয়েলারি কিনে এনেছে।
” এসব কি করেছেন! গতকালই না কত শপিং করেছেন। আবার আজকে কেন? ”
” আমার একটা বউয়ের জন্য সামান্য কিছুই এনেছি। এতে তোমার এত কথা কেন? বিয়ের দুইদিন পূর্তি উপলক্ষ্যে সামান্য কেনাকাটা করেছি। দশটা নয় পাঁচটা নয়, একটামাত্র বউ আমার। তার এতটুকু তো করতেই পারি। ”
” আজকে দুইদিন, তাহলে কালকে তো তিনদিন হবে। তিনদিন পূর্তি উপলক্ষ্যেও কি তবে কেনাকাটা করবেন? এরপর চারদিন, পাঁচদিন, এভাবে একমাস, পাঁচমাস, দশমাস। এভাবে চলতেই থাকবে? আর মানুষের বউ কয়টা হয় শুনি? ”
” ভালো আইডিয়া দিলে তো। আমার কাছে প্রতিদিনই স্পেশাল। তাই প্রতিদিনই এমন শপিং চলতেই থাকবে। যদিও আমাদের প্রতিবেশি আংকেলের তিনটা বউ। তবে সে কিন্তু তিন বউকেই সমান প্রাধান্য দেয়। কিন্তু আমার আপাতত একটা। তাই একটার জন্যই যথাসাধ্য করার চেষ্টা করছি, করব। ”
” আপাতত একটা মানে? আপনার কি আরও কয়েকটা বিয়ে করার ইচ্ছে আছে! ” কুহু সবিস্ময়ে জানতে চাইল।
” আপাতত সেরকম কোন ইচ্ছেই নেই। ইন ফিউচার বউ যদি কম কম ভালোবাসে তবে করতেই পারি। আমার মনে হয় কপালে আরেকটা বউয়ের আদর আছে। এই বউটা আমাকে একদমই ভালোবাসেনা। ” তাহমিদ ভয়ে ভয়ে বলল।
” কিহ্! আপনি আবার বিয়ে করবেন? আমি আপনাকে ভালোবাসিনা! ” কুহুর গলা ভয়ে কাঁপছে।
” এখন করব সেটা বলিনি তো। বলেছি ভবিষ্যৎ করতেও পারি। তোমাকে রাতে কতবার করে বললাম, একটা চুমু দাও। তুমি কি আমার কথা শুনেছ? আবার এখন বাহিরে এসে তোমাকে চুমু দিলাম, বিনিময়ে তুমি কি আমাকে কিছু দিয়েছ? আমারও তো আদর পেতে ইচ্ছে করে। এখন আমার সেই প্রাপ্য আদর যদি তুমি না দাও, তবে আমাকে বাধ্য হয়েই আরেকবার শুভ কাজ করতে হবে। ”
তাহমিদের কথা শুনে কুহু কিছু বলার ভাষা হারিয়েছে। ওর বরটা যে একটা বেশরম সেটা বুঝতে ওর বাকি নেই। তাই ও তাহমিদের কথার উত্তর না দিয়ে চুপচাপ কাপড়চোপড় গোছাতে শুরু করল।
এদিকে তাহমিদ কুহুকে নিরুত্তর থাকতে দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসল। হঠাৎই ও এক ঝটকায় কুহুর হাত থেকে কাপড়গুলো নিয়ে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলল। পরক্ষণেই কুহুকে নিজের কাছে টেনে ওর অধরে অধর মিশিয়ে দেয়। অনেকক্ষণ পর তাহমিদের আক্রমন থেকে মুক্তি পেয়ে কুহু হাঁপাতে থাকে। কিন্তু তাহমিদ এখনও ওকে জাপ্টে ধরে রেখেছে। কুহু ছাড়া পেতে মোচড়ামুচড়ি করলেও তাহমিদের মনে একটুও দয়া হয়না। বরং ও আরও শক্ত করে ধরে কুহুকে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। ঘোর লাগা গলায় বলে,
” আমার বউ পাখিটা বুঝি রা ‘ গ করেছে? রাগলে তাকে ব্যাপক এ্যাট্রাকটিভ লাগে, সেটা কি সে জানে? মনে হয়, আস্ত একটা রসগোল্লা আমার সামনে এসে বলছে ‘ ভক্ষণ কর ‘। আমি আবার ভিষণ দয়ালু। তার এমন নিরব আবদার ফেলতে কষ্ট হয়। তাইতো সময়ে-অসময়ে তাকে রা’ গি ‘য়ে দিয়ে রসগোল্লা ভক্ষণের পায়তারা করি। ”
তাহমিদের এহেন নির্লজ্জ বাক্যে কুহু লজ্জায় মাথা নিচু করে। লজ্জায় আরক্তিম মুখে সে তাহমিদ আচমকা অত্যাচারের হাত থেকে নিস্তার পেতে চাইল। কিন্তু ওর যে নিস্তার নেই, তা বোধহয় এখনও বুঝতে পারেনি। ও এখন সম্পূর্ণরূপে তাহমিদের অধীনে। মোচড়ামুচড়ি করেও লাভ হলোনা। তাহমিদ ওকে জড়িয়ে নিল মধুমাখা ভালোবাসার চাদরে। যে ভালোবাসায় কোন খাঁদ নেই। যে ভালোবাসা পেলে কোন নারী কখনো ছেড়ে যাবেনা। একান্ত পুরুষের কাছ থেকে যে ভালোবাসা পেতে উদগ্রীব হয়ে থাকে হাজারও রমনী। কুহুও না চাইতেই আরেকবার পেতে চলেছে সেই ভালোবাসা।
চলেছে…