#হৃদয়াক্ষী
#পর্ব_১৩
#সারিফা_তাহরিম
‘এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না।’
ইরাফের কণ্ঠে শ্রুতিমধুর গান শুনতেই দিনা ঠোঁট এলিয়ে হাসলো। কিন্তু ইরাফ আর গাইলো না। সে আনমনেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করে আছে অজানা গন্তব্যে। পেছন থেকে আরেকটু এগিয়ে এসে দিনা সুর ধরল,
এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না
শুধু সুখ চলে যায়, এমনই মায়ার ছলনা
এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না
এরা ভুলে যায়, কারে ছেড়ে কারে চায়
ভুলে যায়, কারে ছেড়ে কারে চায়
সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না
শুধু সুখ চলে যায়, এমনই মায়ার ছলনা
এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না
তাই কেঁদে কাটে নিশি, তাই দহে প্রাণ
তাই মান অভিমান, তাই এত হায় হায়
তাই কেঁদে কাটে নিশি, তাই দহে প্রাণ
তাই মান অভিমান, তাই এত হায় হায়
প্রেমে সুখ-দুঃখ ভুলে তবে সুখ পায়
প্রেমে সুখ-দুঃখ ভুলে তবে সুখ পায়
সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না
শুধু সুখ চলে যায়, এমনই মায়ার ছলনা
এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না
সখী চলো, গেলো নিশি, স্বপন ফুরালো
মিছে আর কেন বলো, মিছে আর কেন বলো?
শশী ঘুমের কুহক নিয়ে গেল অস্তাচল
সখী চলো…
দিনা থামল। ইরাফ তার দিকে তাকিয়ে আবার দৃষ্টি সরিয়ে সামনে তাকিয়েছে। দিনা তার মুখোমুখি চেয়ারটাতে গিয়ে বসলো। মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে বলল,
‘কি ব্যাপার, মি.ইরাফ? এখানে একা একা বসে আছেন? গত দুদিন আপনার কোনো খোঁজ নেই। কল দিয়েছি বেশ কয়েকবার। রিসিভ করলেন না যে?’
ইরাফ থমথমে গম্ভীর মুখে চাইলো দিনার পানে। তারপর দৃষ্টি সরিয়ে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে গম্ভীর স্বরে বলল,
‘ফোন রিসিভ করার প্রয়োজনবোধ করিনি, তাই রিসিভ করিনি।’
ইরাফের কথা বলার ভঙ্গিতে অবাক হলো দিনা। এর আগে সে কখনো ইরাফকে এমনভাবে কথা বলতে দেখেনি। ইরাফের কথায় খারাপ লাগলেও নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘আপনার কি মন খারাপ? কিছু হয়েছে?’
‘আমার জীবনে অনেক কিছুই হতে পারে। সে বিষয়ে তোমাকে জানাতে আমি বাধ্য নই। আমার সামনে থেকে যাও প্লিজ। তোমাকে সহ্য করতে পারছি না আমি। আমার চোখের সামনে থেকে দূর হও।’
দিনা অস্থির হয়ে উঠল। কিসব বলছে ইরাফ? এমন কেন করছে ও? অন্তরীক্ষে তাণ্ডব শুরু হয়েছে। অস্থির কণ্ঠে বলল,
‘ইরাফ আপনি এমন কেন করছেন? কি করেছি আমি? কেন রেগে আছেন আমার সাথে? না বললে বুঝবো কি করে?’
ইরাফ বিরক্তিকর মুখ করে উঠে চলে যেতে নিলেই দিনা উঠে পেছন থেকে তার হাত চেপে ধরল। তার চোখে পানি টইটম্বুর করছে। ইরাফ পেছন ফিরে তাকিয়ে শক্ত ও চরম বিরক্ত কণ্ঠে বলল,
‘হাত ছাড়ো। আমার সামনে থেকে যাচ্ছো না কেন?’
দিনা সিক্ত চোখে চেয়ে জড়িয়ে আসা শ্লেষাত্মক কণ্ঠে বলল,
‘আপনাকে ভালোবাসি তাই।’
এই প্রথমবারের মতো দিনা ‘ভালোবাসি’ বলেছে। ইরাফ এতদিন ধরে যে কথাটা শোনার জন্য তৃষ্ণার্ত হয়েছিল, আজ সেই বহু প্রতিক্ষিত দিনটি এসে গেছে। প্রেমের সেই যাদুমন্ত্র কি ইরাফ শুনতে পেয়েছে? এই যাত্রায় কি সব ঝামেলা শেষ হবে? নানান প্রশ্ন ঘুরছে দিনার মনে। চোখে অশ্রুকণা ভীড় করছে প্রবলভাবে। যেকোনো সময় চোখের কার্নিশ ডিঙিয়ে গড়িয়ে পড়বে। ইরাফ এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
‘কিন্তু আমি তোমায় ভালোবাসি না।’
দিনা স্তব্ধ হয়ে গেল। ইরাফ কি বলছে এসব! ভালোবাসে না মানে? যে নিজেই একটা সম্পর্ককে এতদূর গড়িয়ে এনেছে, গভীর এক পথে এসে সে নিজেই হাত ছেড়ে দিয়েছে? দিনার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে৷ কি করবে বা কি বলবে সে বুঝতে পারছে না সে। ইরাফের দিকে তাকিয়ে জড়ানো গলায় বলল,
‘ভালো বাসেন না! সত্যি ইরাফ? এই কথা আপনি বলছেন? যে ব্যক্তি ভালোবাসার আবেদন নিয়ে অসংখ্য চিরকুট লিখেছিল, যে ব্যক্তি ভালোবাসার আবদারে এতগুলো দিন রাঙিয়েছিল, সে আজ বলছে ভালোবাসি না। ব্যাপারটা অদ্ভুত না?’
‘তোমার কাছে অদ্ভুত হলেও আমার কাছে এটাই ঠিক৷ এতদিন যা ছিল তা ভুল ছিল। ক্ষণিকের আবেগ ছিল। তুমি আমার নিছক মোহ ছাড়া আর কিছুই ছিলে না। বরং তোমার পেছনে সময় দিতে গিয়ে আমার রাত দিনের হাজারো শ্রম ব্যয় হয়েছে। পড়াশোনা আর আমার মধ্যে যোজন যোজন দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। যা আমার ক্যারিয়ারের জন্য বিরাট বাঁধা। আমি আমার মাকে যে কথা দিয়েছি, তা পূরণ করতে হবে। আর তাছাড়া আমার পুরো ক্যারিয়ার পড়ে আছে। এসব আবেগী প্রেম ভালোবাসা নিয়ে পড়ে থাকলে সময় আর ক্যারিয়ারের বিনাশ ছাড়া কিছুই হবে না। যা আমি মোটেও চাই না। আমার ক্যারিয়ারের হাতে আমার জীবনের সর্বোচ্চ কাঙ্ক্ষিত বিষয়টা জড়িত, যেটা ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ। প্রেম নামক আবেগকে পাত্তা দিতে গেলে আমি আমার জীবনের সবচেয়ে দামি জিনিসটা হারাবো। কিন্তু আমার ক্যারিয়ার সুন্দর হলে জীবনের সবকিছু আমি পাব। এমনকি ভালোবাসাও। তাই শুধু শুধু তোমার সাথে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। আর যদি এতটুকু আত্মসম্মানবোধ তোমার মধ্যে থাকে তাহলে আর কখনো আমার সামনে আসবে না।’
কালবিলম্ব না করে ইরাফ দ্রুত প্রস্থান করল সেখান থেকে। রেখে গেল দিনার জন্য কিছু তিক্ত বিষধর স্মৃতি। পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো দিনা। নির্জন ক্যান্টিনে বয়ে যাওয়া এই তাণ্ডবে যেন তার সর্বস্ব অনুভূতি খুইয়েছে সে। বুকের বাঁ পাশটায় অদ্ভুত রকমের চাপ আর ব্যাথা সৃষ্টি হচ্ছে। চোখ দিয়ে অবাধে পানি ঝরছে। কিন্তু সে স্তব্ধ হয়ে আছে এখনো। জীবনের প্রথম অনুভূতির এমন পরিনাম দিল ইরাফ!
চলবে…