শ্রাবণ মেঘের ভেলা ৯ম পর্ব

0
1306

#শ্রাবণ_মেঘের_ভেলা
#৯ম_পর্ব

আচ্ছা এই বিধবা হলে কি জীবনে হাসতে মানা! নাকি জীবন বাঁচতে মানা! চোখ বন্ধ করে যখন পিউ কথাগুলো ভাবছিলো তখন কারোর পায়ের আওয়াজ শুনতে পায় সে। পেছনে ফিরেই দেখে বদরুল সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। মুচকি হেসে পিউ তাকে বলে,
– কি বলবে মামু?
– রাত তো অনেক হয়েছে মা, তুই এখানে কি করছিস?
– ঘুম আসছে না, তুমি ও তো জেগে আছো
– ঐ ঘুম আসছে না
– দিশার মনে পড়ছে?
– ফাঁকা ফাঁকা লাগছে রে মা, কিছুই করার নেই। মেয়ের বাবা হলে এটা মেনে নিতেই হবে

মামুর কথায় আশ্বাস দিয়ে পিউ বলে,
– তুমি চিন্তা করো না, দেখবে তোমার মেয়েটা অনেক সুখে থাকবে ইনশাআল্লাহ
– চিন্তা কি এক মেয়েকে নিয়ে আমার কতোগুলো মেয়ে বল

মামুর মাঝে পিউ তার বাবার প্রতিচ্ছবি দেখতে পারে। তার বাবা মারা পর থেকে তিনি পিউকে নিজের মেয়ের মতো আগলে রেখেছেন। আহাশের মৃত্যুর পর থেকে উনি পিউ এর জীবনটাকে আবার সাজানোর জন্য কম চেষ্টা করেন নি। কিন্তু পিউ এর জিদের কাছে তাকে হার মানতে হয়েছে তাকে। পিউ মুচকি হেসে আবেদনের সুরে বলে,
– মামু একটা কথা বলার ছিলো
– হুম বল শুনছি
– আমি ও বাড়ি যেতে চাচ্ছিলাম। কাল যেতে চাচ্ছিলাম, পরসু বৌভাতের দিন ওখান থেকেই না হয় আসবো। বাবা বলছিলেন মার শরীরটা ভালো নেই, যদিও বলেছেন আমার যেতে হবে না। কিন্তু ব্যাপারটা খারাপ দেখায়।
– আমি শওকত ভাই এর কথা বলেছি। তুমি আমাদের বাসায় থাকবে

বদরুল সাহেবের কঠোর উত্তরের পর পিউ এর কিছু বলার থাকে না। তবুও খানিকটা নম্রস্বরে বলে,
– এক সপ্তাহ থেকেছি মামু, এতোদিন বাপের বাড়ি পড়ে থাকাটা বোধ হয় ঠিক লাগে না
– বাপের বাড়ি মানো এবাড়িকে তুমি?
– মামু…….
– তাহলে আর কোনো কথা শুনতে চাচ্ছি না। আচ্ছা কিসের শ্বশুর বাড়ির কথা বলিস তুই আমআর মাথায় আসে না। যে মানুষটার জন্য সে বাড়ির সাথে জরিত ছিলে সেই মানুষটাই তো নেই, তাহলে কিসের শ্বশুর বাড়ি? কি যায় আসে তুই এবাড়িতে থাকলে? কি যায় আসে তুই তোর বউ মার দায়িত্বগুলো না মানলে? শোন আড়াইটা বছর তুই নষ্ট করেছিস কিছু বলি নি। আর না
– আমি আহাশের স্ত্রী মামু, এগুলো আমার দায়িত্ব
– জানো তুমি যখন হয়েছিলে আমি তখন ভার্সিটিতে পড়তাম। বলতে গেলে তোমার বয়সী, আর ছেলেদের এমনেই ম্যাচুরিটি দেরিতে আসে। বাবা হওয়াটা কি সেটা আমার কল্পনাতেও ছিলো না। কিন্তু যখন তুমি হয়েছিলে এবং দুলাভাই আমার কোলে প্রথম তোমাকে দিয়েছিলো তখন আমার মনে হয়েছিলো তুমি আমার মেয়ে। দুলাভাই এর সাথে সাথে আমার ও একটি মেয়ে হয়েছে। আমার খুব লাগে যখন তোকে এভাবে কষ্ট পেতে দেখি। আমার একটা কথা রাখবি মা? জীবনটাকে একটা দ্বিতীয় সুযোগ কি দিবি?
– মামু
– আমি তোকে বলছি না এখন ই আবার বিয়ে কর, সংসার কর। আমি চাচ্ছি আহাশের স্মৃতি থেকে বের হ। যে চলে গেছে, সে চলে গেছে।
– মামু আমার জীবন কিন্তু থেমে নেই
– তাহলে কেনো আহাশের বিধবাকে আমি তোর মধ্যে দেখতে পাই, কেনো আমার সেই প্রাণচ্ছ্বল পিউ মাকে দেখতে পাই না। যেদিন আমি আবার আমার পিউ মাকে দেখতে পাবো সেদিন আমি মেনে নিবো তোর জীবন থেমে নেই। যা ঘুমিয়ে পড়।

মামুর কথাগুলোর প্রতিউত্তর পিউ এর ছিলো না। বদরুল সাহেব কথাগুলো বলে সেখান থেকে প্রস্থান নেন। পিউ সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,
– দ্বিতীয় সুযোগ তাও কি সম্ভব! আমি জীবনকে দ্বিতীয় সুযোগ দিতে রাজী হলেও কি জীবন আমাকে দ্বিতীয় সুযোগ দিবে?

১১.
আশ্বিন মাস চলছে, অথচ বৃষ্টির বেগ দেখে মনে হচ্ছে আষাঢ়। আজ সারাদিন মুষুল্ধারে বৃষ্টি হয়েছে। এক মিনিট বিশ্রাম নেই। অফিসের গেটে দাঁড়িয়ে আছে ঐন্দ্রিলা। কোথায় এতোক্ষণে তার বাড়ি যাওয়া হয়ে যেত কিন্তু মরার বৃষ্টি তাকে এখানেই আটকে রেখেছে, একটা রিক্সা নেই রাস্তায়। আরো মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে বৃষ্টির দাপটে চশমাটা বারবার মুছা লাগছে। বারবার পানি পড়ে ঘোলা করে দিচ্ছে দৃষ্টি। না এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে আর বাড়ি যাওয়া হবে না আজ। এদিকে শরীফ সাহেব আধা ঘন্টা যাবৎ ফোন করে যাচ্ছেন। এবার ব্যাগটা মাথায় দিয়েই রাস্তার ধার দিয়ে হাটা শুরু করলো ঐন্দ্রিলা। হঠাৎ কোথা থেকে একটি গাড়ি শা করে এসে তার সামনে দাঁড়ায়। আচমকা এভাবে গাড়িটা সামনে এসে ব্রেক করায় একটু হলেও ভয় পেয়ে যায় ঐন্দ্রিলা। ওর মনে হয়েছিলো এই বুঝি ওর গায়ের উপর চালিয়ে দিবে গাড়িটি। বুকে ফু দিয়ে নিজেকে শান্ত করলো। এবার খানিকটা চড়া গলায় বললো,
– চোখ কি পকেটে রাখেন নাকি? এতো জায়গা থাকতে গায়ের উপর দিয়ে চালানোটা কি খুব প্রয়োজন? আরেকটু হলে তো আমাকে উপরে পাঠানোর পুরো ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। যতসব ফালতু পাবলিক

এবার গাড়ির দরজা খুলে ড্রাইভিং সিটের মানুষটি বেরিয়ে আসে এবং খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিমাতে বলে,
– এতো সহজে তোমাকে উপরে দিলে যে তোমার শাস্তিটা অনেক কম হয়ে যাবে।

ঐন্দ্রিলার সামনে অভ্র দাঁড়িয়ে আছে, অভ্রের চোখের দিকে তাকাতেও ঐন্দ্রিলার ভয় লাগছিলো। চোখ দিয়ে যেনো তাকে ভস্ম করে দিবে। ঐন্দ্রিলার বুঝা হয়ে গেছে লোকটা তার কান্ডের ব্যাপারে জেনে গেছে। তাও নিজেকে শান্ত রেখে অভ্রকে জিজ্ঞেস করে,
– আপনি এখানে? কি চাই?
– আমি তোমাকে বিবাহিত মহিলাদের আমার নাম্বার দিতে বলেছি?
– আমি কাকে আপনার নাম্বার দিয়েছি?
– তাই? তাহলে আমার নাম্বারে এই সপ্তাহ জুড়ে কেনো বিভিন্ন পুরুষেরা ফোন দিচ্ছে এবং বলছেন আমি নাকি তাদের ওয়াইফদের ডিস্টার্ব করেছি। চিরকুট পাঠিয়ে প্রেম নিবেদন করেছি, আমার নাম্বার দিয়েছি দিশার বিয়ের দিন। একজন তো আমার নামে থানাতেও জি.ডি করে দিয়েছেন
– আপনি যে পরিমাণ লুইচ্চা করতেই পারেন! আ…আমাকে কে…কেনো এগুলো শুনাচ্ছেন
– তুমি সত্যি ই কিছু জানো না?
– না আমি জানি না
– বিয়ের দিন তোমার ফোন পাচ্ছিলে না বলে আমার ফোন তুমি নাও নি? আমার নাম্বার থেকে এই ম্যাসেজগুলো তুমি করো নি? ওই মহিলাদের হাসবেন্ডদের কাছে আমার কথা বলে চিরকুট পাস করো নি?

ঐন্দ্রিলার হাত শক্ত করে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে কথাগুলো বলে অভ্র। এখন কিভাবে নিজেকে ছাড়াবে কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিলো না। এইসব কাজ সে অভ্রকে মজা দেখানোর জন্য করেছিলো। কিন্তু এতোটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে এটা বুঝতে পারে নি। এতোটা শক্ত করে হাতটা ধরেছিলো ওভ্র যে এক সময় ব্যাথায় কুকিয়ে উঠে ঐন্দ্রিলা। অভ্রের রাগ থেকে বাঁচার কোনো উপায় না দেখে একটা সময় একটা সাংঘাতিক কাজের সিদ্ধান্ত নেয় ঐন্দ্রিলা। খুব জোরে চিৎকার করে উঠে সে। আশেপাশের লোক জড় হলে বলে,
– এই লোকটা আমাকে ডিসটার্ব করছেন, আমি চিনিও না ইনাকে।

আর এদেশের লোকের একটা খুব ভালো স্বভাব আছে, যখন ই শুনে কোনো মেয়েকে উত্যোক্ত করা হচ্ছে কোনোকিছু না ভেবেই ঝাপিয়ে পড়বে। নিজেকে হিরো যে প্রমাণ করতে হবে। আশেপাশের লোকগুলো ঐন্দ্রিলার কথা শুনে বেশ রেগে হুক্কা হুয়া করতে আরম্ভ করে। ঐন্দ্রিলার এমন একটা কাজের জন্য আগ থেকেই প্রস্তুত ছিলো অভ্র। এবার হ্যাচকা টানে নিজের সাথে ঐন্দ্রিলাকে নিজের সাথে মিশিয়ে বলে,
– বাবু, বুঝছি তো তুমি রাগ করেছো। তাই বলে সবার সামনে আমাকে চিনতে মানা করবে। দেখো স্বামী স্ত্রীর মাঝে এমন ভুল বুঝাবুঝি তো হয় বলো। তাই বলে এভাবে রাস্তায় সিন ক্রিয়েট করো না।
– হ্যা??
– দেখুন আমরা স্বামী স্ত্রী মিটমাট করে নিবো। প্লিজ ভাববেন না

বলেই অতর্কিতে ঐন্দ্রিলাকে কোলে তুলে নেয় এবং গাড়িতে বসিয়ে গাড়ির দরজাটা আটকে দেয়। আশেপাশের লোকগুলো ও বেশ ঠাট্টার ছলে বলে,
– আজকালের ছেলে মেয়েরা এতো বেশি নকরা করে আর বলতে। আমরা তো ভাবছ আসলেই না কি ডিসটার্ব করতেছে। চলেন চলেন আমাদের কাজে যাই।

গাড়িতে বসে ইচ্ছামত ছটফট করতে থাকে ঐন্দ্রিলা। মেজাজটা তিরিক্ষি হয়ে আছে, কোথায় লোকটাকে শায়েস্তা করতে চেয়েছিলো এখন নিজেই শায়েস্তা হচ্ছে।
– আপনি গাড়ি থামাবেন নাকি আমি চিৎকার করবো?
– করেছিলে তো কিছু হয়েছে?
– দেখুন আপনি কিন্তু মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। গাড়ি থামান বলছি
– আরেকবার যদি কথা বলেছো তাহলে এই মুখ কিভাবে বন্ধ করা যায় আমার জানা আছে
– কি করবেন হ্যা কি করবেন?

এবার গাড়িটা থামিয়ে আচমকা ঐন্দ্রিলার চুল মুঠো করে নিজের কাছে টেনে নিজের ঠোঁট জোড়া দিয়ে চেপে ধরে। ঘটনার আকর্ষিকতায়…………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে