শ্রাবণ মেঘের ভেলা ১৪তম পর্ব

0
1321

#শ্রাবণ_মেঘের_ভেলা
#১৪তম_পর্ব

বসার ঘরের দিকে চা হাতে যেতেই পা আটকে গেলো তার। তার সামনে নীল শার্ট পরিহিত অভ্র বসে রয়েছে। লোকটা এতো শান্ত হয়ে বসে রয়েছে যে বলার মতো নয়, কিন্তু এই লোকটার এখানে আসার কথা তো নয়। তাহলে! সে কি ঐন্দ্রিলার দুর্ভোগের মজা নিতে এসেছে এটা হওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ। ওইন্দ্রিলা ধীর পায়ে হেটে বদরুল সাহেবের পাশে বসলো। চাঁদনি বেগমের প্রথম দেখায় ঐন্দ্রিলাকে খুব মনে ধরেছে। দেখতে অপরুপ সুন্দরী না হলেও কি মায়াবী চেহারা, একটা শীতল স্নিগ্ধতা রয়েছে মুখে। সবাইকে সালাম দিলো ঐন্দ্রিলা। অভ্র এক দৃষ্টিতে ঐন্দ্রিলাকেই দেখে যাচ্ছে। এই কয়দিনে মেয়েটা অনেক পালটে গেছে, মুখে বিষন্নতার ছাপটি লেগেই আছে। কোথাও না কোথাও এর পেছনের কারণটাও সেই। আজ তার আসার কথা ছিলো না, কিন্তু সে এসেছে একমাত্র ঐন্দ্রিলাকে দেখতে। মেয়েটা তার ঘুম হারাম করে দিয়েছে। অবশ্য আরো একটা কারণ রয়েছে সেটা হলো ঐন্দিলাকে তার সিদ্ধান্ত জানানো। যদি ঐন্দ্রিলা চায় তবে সে তাকে কোনোরকমই জোর করবে না। কথা বলতে কথা বলতে চাঁদনি বেগম বললেন,
– শরীফুল ভাই, আমি চাচ্ছি ছেলে মেয়ে দুজন নিজেদের মধ্যে একটু কথা বলে নিক। সংসার তো তাদের করতে হবে তাই তাদের কথা বলাটা দরকার।
– জ্বী, আমার আপত্তি নেই।

একটু ইতস্ততার সাথেই শরীফুল সাহেব কথাটা বললেন। পিউ তাদের দুজনকে ছাদে দিয়ে আসলো। পিউ এর কেনো জানে খুব ভালো লাগছে ঐন্দ্রিলা তার বাসুরের বউ হতে চলেছে এটা ভেবে। ঐন্দ্রিলা এবং অভ্রকে ছাদে দিয়ে নিচে নামতে নামতে দেখলো নীলাদ্রি বিষন্নতার সাথে সিগারেটে টান দিয়ে যাচ্ছে। খানিকটা চড়া গলায় ই পিউ বললো তাকে,
– নিকোটিনের ধোয়ায় নিজের লিভারের বারোটা না বাজালে নয়?
– ………
– আপনাকে কাল থেকেই খুব চিন্তিত লাগছে, কি নিয়ে ভাবছেন?
– কেনো জানে এই বিয়ের প্রপোজালটা আমার হজম হচ্ছে না।
– মানে? আপনার অভ্র ভাইয়াকে পছন্দ নয়?
– কথাটা সেটা না, আসলে ঐন্দ্রিলাকে ছোটবেলা থেকেই বাবা আগলে রেখেছে। মেয়েটা বাহিরের থেকে কনফিডেন্ট, চতুর, শক্ত দেখালেও ভেতর থেকে অনেক ভঙুর। খুব ইমোশোনাল। অভ্র সম্পর্কে যতটা জানি সে খুব রাগী, কাউকে পরোয়া করে না। সে কি আমার বোনকে সামলে রাখতে পারবে? ঐন্দ্রিলা তোমার মতো নয় মোবাশশিরা
– ঐন্দ্রিলা আমার মতো নয় এটা যেমন ঠিক, এটাও ঠিক অভ্র ভাই পাঁচটা মানুষের মতো নয়। উনার কাছে সম্পর্কের দাম অনেক বেশি। আমাকে বা আহানাকেই দেখুন। আহানা তার আপন বোন নয়, কিন্তু সে আহানা চাইলে তাকে চাঁদ এনে দেবার মতো দূর্ল্ভ জিনিস ও সে করতে রাজী। আমি তার ভাইয়ের বউ, অথচ আমাকে সে আহানার থেকে কম ভালোবাসে নি। একটা ছোট বোনের মত আমাকে এই আড়াই বছর ট্রিট করেছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার, বাবার কাছে আমার দ্বিতীয় বিয়ের জন্য ও সুপারিশ করেছেন। অভ্র ভাইয়া মানুষটা অন্যরকম। উনার কিছু তিক্ত অতীতের কারণে আজকে উনি এতোটা রাগী, বেপরোয়া। তবে আমার কেনো জানে মনে হয় উনি ঐন্দ্রিলাকে একটু ও কষ্ট পেতে দিবেন না।
– তাই যেনো হয়, সেটা নাহলে আমিও ছেড়ে কথা বলবো না অভ্রকে।
– এবার সিগারেটটা ফেলুন। চলুন বসার ঘরে যাওয়া যাক।

বলেই পিউ ভেতরের দিকে যাওয়া শুরু করলো। নীলাদ্রি অবাক নয়নে পিউকেই দেখছে। মেয়েটার মাঝে একটা অদ্ভুত মায়াবী শক্রি আছে। নীলাদ্রি যখনই টেনশনে থাকে মেয়েটা তার সাহসে পরিণত হয়। আচ্ছা মেয়েটা কি তবে তার মনে কোথাও জায়গা করে নিচ্ছে নিজের? নাকি সেই পুরোনো জায়গাটাই আবার সজীব করে তুলছে!!

এদিকে,
ছাদে পাশাপাশি দঁড়িয়ে আছে ঐন্দ্রিলা এবং অভ্র। দুজনের মুখে কোনো কথা নেই। অভ্র বারংবার চেষ্টা করছে কিছু বলার কিন্তু কেনো জানে চেয়েও কিছু বলতে পারছে না। ঐন্দ্রিলার চোখ বাহিরের দিকে, আর অভ্রের নজর স্থির ঐন্দ্রিলার দিকে। গোধুলীর আলোতে তাকে ভীষণ মায়াবী লাগছে। বাতাসের সাথে অবাধ্য চুলগুলোও উড়ছে। অভ্রের কাছে লাগছে যেনো কোনো ভাস্কর্যের হাতের নিপুণ শিল্পকর্ম তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। বাহিরের দিকে তাকিয়েই ঐন্দ্রিলা বললো,
– আপনি নাকি কোনোদিন বিয়েই করতে চাচ্ছিলেন না তবে এই বিয়ের এতো তোড়জোরের কারণ কি শুধু নিজের অপমানের প্রতিশোধ?
– তুমি যদি চাও তাহলে বিয়েতে মানা করে দিতে পারো আমি তোমাকে আটকাবো না বরং তোমাকে ডিভোর্সের ব্যবস্থা করে দিবো।
– আপনার কাছে কোনোকিছুরই কোনো দাম নেই না? এতো সেলফ সেন্টারড কেনো আপনি?
– আমি? আমি সেলফ সেন্টারড?
– নয়তো কি বলুন তো? আপনার মনে হয়েছে বিয়ে করবেন করলেন, এখন আপনার মনে হচ্ছে ডিভোর্স দিবেন সেজন্য ডিভোর্সের ব্যবস্থা করবেন। আচ্ছা আমি কি আপনার হাতের পুতুল। শুনে রাখুন বিয়ে যখন করেছেন তবে সেটাকে পালন করার মতো সৎ সাহস রাখুন।
– মানে?
– মানে ব্যাপারটা স্পষ্ট। আমাকে একবার যখন বিয়ে করেই ফেলেছেন তাহলে সেটাই সারাজীবন আপনাকে বয়ে নিয়ে যেতে হবে। আমার এই বিয়েতে কোনো আপত্তি নেই।

ঐন্দ্রিলার কথায় অভ্র অনেকটা অবাক হয়। ঐন্দ্রিলার চোখ এখনো বাহিরেই স্থির। চোয়াল তার শক্ত। তবে কি ঐন্দ্রিলাও অন্য নারীদের মতই। সে তো অভ্রকে ভালোবাসে না তবে কেনো সে বিয়েটা করতে চাচ্ছে! কেবল অভ্রের টাকার প্রতি ই তার লোভ! হয়তো সেটাই, নয়তো অভ্র তাকে ডিভোর্সের অপশন দেবার পর ও কেনো এই বিয়েটাকে টিকিয়ে রাখতে চাচ্ছে! বাকা হেসে টিটকারির স্বরেই অভ্র বলে,
– আমি কেনো এতো দিন বিয়ে করতে চাই নি কারণটা কি তোমার জানা আছে?
– …………
– নারীকে আজকাল শুধু বিছানাতেই ভালো লাগে। ক্ষণিকের কামনা মাত্র। তার প্রতি মায়াটুকু জন্মায় কিন্তু ভালোবাসতে ইচ্ছে হয় না। টাকার বিনিময়ে সব করতে পারে এই নারী। তুমি নিজেকেই দেখো ঐন্দ্রিলা, আজ আমাকে বিয়েতে রাজী হয়েছো তার কারণ কি টাকা নয়? অবশ্যই টাকা। নয়তো আমার মতো একটা মানুষকে বিয়ে করতে রাজী হবার কোনো উপলক্ষ্য অন্ততঃ আমি খুজে পাই না।

অভ্রের কথায় ঐন্দ্রিলা চোয়াল যেনো আরো ও শক্ত হয়ে যায়। একটা লোকের মেয়েদের চিন্তা এতোটা খারাপ হতে পারে! সে ঐন্দ্রিলাকে ও অন্য মেয়েদের মতো টাকার লোভী ভাবছে। রাগ সামলে খানিকটা ক্ষুদ্ধ গলায় বলে সে,
– আপনি নারীকে চিনেন ই না অভ্র। চিনলে হয়তো এমন কথাগুলো আসতোই না। নারী শক্তির রুপ হয়। হয়তো এমন নারীর সাথে আপনার এখনো পরিচয় হয় নি। মনে রাখবেন, পতিতারা আপনার সাথে টাকার বিনিময়ে শরীর বিকিয়ে দেয় ঠিকই কিন্তু সেই টাকা তার নিজের জন্য সে কামাই করে না। হয়তো সেই অনৈতিক টাকাটা দিয়েও সে তার পরিবারকে দুমুঠো অন্ন জোগাড় করে দেয়। অভ্র সাহেব আপনি নারীর মায়াখেলা কখনো বুঝবেন ই না। যেদিন একজন সত্যিকারের নারীর সাথে আপনার পরিচয় হবে সেদিন নাহয় এ ব্যাপারে কথা বলবো।
– তাহলে তুমি বলছো নারীকেও ভালোবাসা যায়? আচ্ছা তুমি কি নিজেকে সত্যিকারের নারীর স্বরুপ ভাবছো?
– সত্যিকারের নারী হলে বোধহয় আপনার কুরুচিপূর্ণ কথাগুলো শুনতাম না, বরং আপনার গালে ঠাস করে চড় বসিয়ে চিনিয়ে দিতাম নারী শুধু বেড পার্টনার হয় না।

বলেই ঐন্দ্রিলা সেখান থেকে প্রস্থানের জন্য পা বাড়ায়। আবার থেমে পেছনে ফিরে বলে,
– আমি আপনাকে আপনার টাকার জন্য বিয়ে করতে রাজী হই নি। আপনি যদি আমাকে টাকায় মুড়িয়েও রাখেন তাতেও আমার সত্ত্বাটাকে বদলাতে পারবেন না, না আমার চিন্তাধারা। আমি আপনাকে বিয়ে করতে রাজী হয়েছি কেবলমাত্র আমার বাবা এবং ভাইয়ের কথা ভেবে। একটা কেনো দশটা ডিভোর্স হলেও আপনার কিছু যায় আসবে না তবে আমার যায় আসবে। আমার ভাইয়ের যায় আসবে, আমার বাবার সম্মানহানি হবে। বৃষ্টির দিনও আমি কেবলমাত্র আমার বাবার সম্মানহানির ভয়েই আপনাকে বিয়েটা করেছিলাম। তাই আপনার এক্স গার্লফ্রেন্ডদের সাথে আমাকে গুলিয়ে ফেলবেন না।

অভ্র বেকুবের মতো তাকিয়ে আছে, ঐন্দ্রিলা তার কথা বলে সেখান থেকে চলে গেলো। নাহ অভ্র ভুল করে নি, সে ভুল নারীকে নিজের জীবনসাথী হিসেবে বেছে নেয় নি। এমন কাউকেই তো চেয়েছিলো সে যার কাছে সম্পর্কের দাম টাকার থেকে বেশি হবে। ঐন্দ্রিলা নামক মেয়েটা নেশার মতো হয়ে উঠেছে যত দেখছে ততো তার জালে আটকে যাচ্ছে। তাহলে অভ্র চৌধুরীকে ও এই সংসার জীবন পালন করতে হবে।

১৬.
রাত ১১টা,
বারান্দার এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে ঐন্দ্রিলা। হাতের অনামিকা আঙ্গুলের সোনার আংটিটা এই রাতেও জ্বলজ্বল করছে। অভ্রের ফ্যামিলি আংটি পড়িয়ে দিয়ে গেছে। বাবা এবং দাদাভাই ঘুরে এসেছে। না জানে কি জাদু করেছে অভ্র, বাবা খুব খুশি। ডেট ফিক্স সামনের শুক্রবার তাদের বিয়ে। আচ্ছা কোনো ভুল করছে না তো। জিদের বশে অভ্র তাকে বিয়ে করেছে, এখন সে এই বিয়েটা বয়ে নিয়ে যাবে সেটাও জিদের বশে। একটা সম্পর্ক শুধু জিদের বশেই তৈরি হচ্ছে, এটার পরিনামটা কি সুখময় হবে! কতদিন লড়বে একে অপরের বিরুদ্ধে!
– ঐন্দ্রি আসবো?

শরীফুল সাহেবের কথায় ঐন্দ্রিলার ভাবনায় ছেদ পড়ে। পেছনে তাকিয়ে দেখে শরীফুল সাহেব দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। মুচক হেসে বলে,
– বাবা, দাঁড়িয়ে আছো কেনো আসো না।
– তোমার সাথে কিছু কথা বলার ছিলো
– হ্যা বলো না বাবা
– তুমি খুশি তো মা? এই বিয়েতে সত্যি তোমার কোনো আপত্তি নেই তো?

ঐন্দ্রিলার চোখ ছলছল করছে, কি বলবে বাবা ভেবে পাচ্ছে না। ঠিক তখন…………

চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে