শ্রাবণ মেঘের ভেলা ১৩তম পর্ব

0
1307

#শ্রাবণ_মেঘের_ভেলা
#১৩তম_পর্ব

হঠাৎ খেয়াল করলো ঐন্দ্রিলা কেউ বেল বাজাচ্ছে। পিউ ছুটে যেয়ে দরজা খুলতেই দেখলো। ঐন্দ্রি দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। ঐন্দ্রিলার উপর দিয়ে ঝড় চলে গেছে এমন মনে হচ্ছে। চুল উসখো খুসখো, চোখের নিচে কালি, গর্তে ডুকে গেছে এমন লাগছে, মুখ ফোলা। মুখ ফসকেই বেরিয়ে গেলো পিউ এর,
– ঐন্দ্রি

পিউ এর কথা শুনে সবাই দরজার কাছে ছুটে যায়। ঐন্দ্রিকে দেখে যেনো ধরে প্রাওণ আসে শরীফুল সাহেবের। মেয়েকে জড়িয়ে চোখের পানি ছেড়ে দেয় তিনি। ভাঙা গলায় বলতে থাকেন,
– মারে কোথায় ছিলি? তোকে কোথায় না খুজেছি। একটা ফোন তো ধরতে হয় নাকি? ফোন কেনো ধরলি না?
– আ…আসলে বাবা
– তুই ঠিক আছিস তো মা?

বাবার মুখে এমন কথা শুনে কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। কালকের কথা যদি বাবা জানে কি উত্তর দিবে। একটা সামান্য ঠাট্টা-মজার মাশুল তাকে এভাবে দিতে হবে বুঝতেই পারে নি। নিজেকে কোনো মতে সামলে ধীর গলায় বললো,
– বাবা সাইটে যাওয়া লেগেছে। বৃষ্টিতে আটকে গেছিলাম। ফোনটা চুরি হয়ে গেছে। আর কোনোভাবে তোমাকে জানানোর উপায় ও ছিলো না। সব নাম্বার ফোনে আমি ভেবে পাই নি কি করবো। সরি বাবা, আর এমন হবে না। আমাকে ক্ষমা করে দাও

বলেই ঐন্দ্রিলা কেঁদে দিলো। নিজেকে ধরে রাখাই দুষ্কর হয়ে পড়েছে তার কাছে। এই প্রথম বাবাকে মিথ্যে বলেছে, নিজের ভেতরটা যেনো তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। অভ্র চৌধুরীর জন্য আজ তার এই পরিস্থিতি। কেনো এই লোকটা তার জীবনে এলো। না এলে তো এমনটা হবার কথা ছিলো না। বাবাকে জরড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে ঐন্দ্রিলা। শরীফুল সাহেব সান্তনা দিয়ে বললেন,
– হয়েছে, হয়েছে। তুই তোর ভুলটা বুঝেছিস এই অনেক। আর কাঁদতে হবে না। যা ফ্রেস হয়ে নে।

বাসার আর কেউ ঐন্দ্রিলাকে কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে না। ঐন্দ্রিলাকে সবাই ছোটবেলা থেকে দেখে আসছে। শরীফুল সাহেবকে সে কোনোদিনই মিথ্যে কথা বলে নি। যতবড় দোষ ক্রুক না কেনো বাবা যদি জিজ্ঞেস করে তবে সে সত্যি কথাটাই বলে এসেছে। যেহেতু সে বলছে বৃষ্টির জন্য আটকে পড়েছে, তাহলে আসলেই তাই হয়েছিলো। এসবের মধ্যে নীলাদ্রির চোখ ঐন্দ্রিলার দিকে স্থির। কিছু তো হয়েছে, ঐন্দ্রিলা সবার চোখ ফাকি দিলেও তার চোখকে ফাকি দিতে পারবে না। এবং বিষয়টা খুব বড় একটা ইস্যু। ঐন্দ্রিলা যদি এখন না বলতে চায়, তবে থাক পরে তার থেকে শুনে নেওয়া যাবে। ঐন্দ্রিলাকে খুব এলোমেলো লাগছে নীলাদ্রির কাছে। কিছু একটা তো হয়েছে যেটা তাকে খুব কষ্ট দিচ্ছে। নীলাদ্রি শূধু একটা কথাই বললো,
– ঐন্দ্রি তুই ঠিক আছিস তো?
– হ্যা দাদাভাই। আমার কি হবে। একটু ক্লান্ত এই আর কি
– আচ্ছা তুই রেস্ট নে
– হুম

ঐন্দ্রিলা তার রুমে চলে যায়। শাওয়ারটা ছেড়ে বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকে শাওয়ারের নিচে। সে এখন আর আগের ঐন্দ্রিলা নয় সে এখন এমন একটা মানুষের স্ত্রী যাকে সে ঘৃণা করে। অভ্রের এক কথার মানুষ, সে যেহেতু বলেছে সে এক সপ্তাহের মধ্যে তার বাবা-মাকে পাঠাবে তাহলে তাই। বাড়ির সামনে পৌছে দেবার সময় ও সে সেটাই বলেছে। শুধু রাতের কথাগুলোর থেকে একটাই পার্থক্য, যদি ঐন্দ্রিলা চায় তবে সে বিয়েতে রাজী নাও হতে পারে। কিন্তু এটা কোনো সলুশন নয়। এক দিনের জন্য হলেও বিয়েটা তো হয়েছে, আর এটা কোনো ফাজলামি নয়। বেশ বিয়ে যখন হয়েছে তবে সেটাই হবে। অভ্র চৌধুরী এবং তার মাঝের দাবার গুটির খেলাটা একটু পালটে গেছে। ঐন্দ্রিলার সৈন্য এখন পরাজিত। তা বলে কি ঐন্দ্রিলা হার মেনে নিবে কখনোই না, বিয়ের এই খেলাটার যদি শুরুটা অভ্র চৌধুরী করে তবে শেষটা ঐন্দ্রিলা করবে। আজ সে ভাবছে সে ঐন্দ্রিলাকে হারিয়ে ফেলেছে, ঐন্দ্রিলার সব শেষ করে ফেলেছে। কিন্তু না, সেটা হবে না। বিয়ে করতে চান তিনি, ঐন্দ্রিলা বিয়ে করবে কিন্তু সেই বিয়েটা কোনো কাগজের বিয়ে হবে না। সঠিক অর্থে স্বামী-স্ত্রীর বিয়ে হবে। এটা ঐন্দ্রিলার ভাগ্য, ঐন্দ্রিলা চাইলেও এই ভাগ্যটিকে অস্বীকার করতে পারবে না। কিন্তু সে কেনো একা সাফারার হবে, অভ্র চৌধুরীকেও সাফার করতে হবে। একই আগুনে জ্বলতে হবে। এটা যদি ঐন্দ্রিলা করতে না পারে তবে তার নাম ঐন্দ্রিলা আহমেদ থুক্কু ঐন্দ্রিলা চৌধুরী নয়।

ওয়াশরুম থেকে বের হতেই থেকে নীলাদ্রি সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। নীলাদ্রি সুক্ষ্ণ চোখ আশার পর থেকেই ঐন্দ্রিলা নিপুণভাবে দেখে যাচ্ছে। চোখে যে তার অনেক প্রশ্ন এটা বুঝতে বাকি নেই ঐন্দ্রিলার। মুচকি হেসে নীলাদ্রিকে বললো,
– দাদাভাই কিছু বলবি?
– কাল কোথায় ছিলি?
– বললাম তো সাইটে
– কিভাবে গিয়েছিলি?

নীলাদ্রির প্রশ্নগুলো জেরার রুপ নিয়েছে। ঐন্দ্রিলার বুঝতে বাকি নেই নীলাদ্রি কেনো এভাবে জেরা করছে। নীলাদ্রি কিছুটা হলেও তার মিথ্যাটাকে বুঝে ফেলেছে কিন্তু কালকের ঘটনাগুলো সে চাইলেও নীলাদ্রিকে ব্যাখ্যা করতে পারবে না।
– কি হলো বল, কিভাবে গিয়েছিস?
– গাড়িতে, অফিসের গাড়িতে।
– কিন্তু দারোয়ান তো তোকে নাকি ব্যাগ মাথায় করে বেড়িয়ে যেতে দেখেছে। এবং অফিস থেকে নাকি কোনো গাড়িতে তোকে যেতে দেখে নি।
– দাদাভাই, আমি ক্রিমিনাল নই যে এভাবে তোকে প্রশ্নউত্তর করতে হচ্ছে।
– আমি আমাকে বোনকে সামান্য প্রশ্নটুকু করতে পারি না?
– পারবি না কেনো? তবে এভাবে? যেনো আমি একটা ক্রিমিনাল। ক্রাইম করে বাড়ি ফিরেছি। কাল আমি বাসায় আসছিলাম। তখন বস ফোন দেয়, ক্লাইন্টের সাথে সাইটে যেতে হবে নাকি। আমি তো বলেছি আমার ফোনটা হারিয়ে ফেলেছি।

ঐন্দ্রিলা এক রকম জোর দিয়েই কথাগুলো বলে। আসলেই ফোনটা কোথায় সে জানে না। অভ্রের সাথে ধস্তাদস্তিতে হয়তো গাড়িতে পড়ে গেছে। নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলো ওইন্দ্রিলা তখন নীলাদ্রি স্বাভাবিক ভয়েজে বলে,
– মিথ্যাকথা যারা বলে তারা কারোর সাথে আই কনট্যাক্ট করতে পারে না। মিথ্যা বলার সময় এ কথাটা মাথায় রাখা উচিত। তুই যে মিথ্যে বলায় প্রো নস সেটার প্রমাণ তোর চোখ। বারবার আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে যে তুই আমাকে মিথ্যে বলেছিস। ব্যাপার না, আমি তোকে বিশ্বাস করি, এমন কোনো কাজ তুই করবি না যার জন্য বাবাকে সম্মানহানির সম্মুখীন হতে হয়। রেস্ট নে।

বলেই নীলাদ্রি রুম থেকে বেরিয়ে যায়। নিজেকে আজ অনেক অসহায় লাগছে ঐন্দ্রিলার। নিজের ভাইয়ের সাথে চোখ এড়িয়ে কথা বলতে হবে এটা কখনো ভাবে নি সে। এটার মাশুল অভ্র চৌধুরীকে দিতেই হবে।

১৬.
ঐন্দ্রিলাদের বসার রুমে শওকত সাহেব এবং শারমিন বেগম বসা। শওকত সাহেবের বড় বোন চাঁদনি বেগও এসেছে। অভ্রকে নিজের ছেলের মতোই ভালোবাসেন তিনি। এই ভাতিজাগুলো তার প্রাণ, একজন তো নেই তাই অভ্রের প্রতি তার ভালোবাসা যেনো আরো ও বেড়ে গেছে। অভ্র বিয়ে করতে চায় এটা ভেবেই যেনো খুশিতে তার মাথা ঠিক নেই। দুই দিন পর আসার কথা ছিলো ঐন্দ্রিলাদের বাড়ি, তিনি আজ ই চলে এসেছে। কি এমন আছে এই মেয়ের ভেতর, যে সে ভাতিজা সারাজীবন বিয়ে করবে না বলে সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছিলো সে কিনা এই এক মাসের ভেতর তাকে বিয়ে করতে চায়। শাওকত সাহেবের অপজিটে বদরুল এবং শরীফুল সাহেব বসা। বদরুল সাহেব একরকম শরীফুল সাহেবের সব সুখে দুখের সাথী। হঠাৎ করে মেয়ের এমন সম্বন্ধের কথা শুনে শরীফুল সাহেব যেনো আকাশ থেকে পড়ে। তাই বদরুল সাহেব কে ফোন করে আনিয়েছেন। শরীফুল সাহেব কি বলবেন বুঝতে পারছেন না।

এদিকে, ঐন্দ্রিলা সুন্দর করে সাজিয়ে যাচ্ছে পিউ। অভ্রের মতো মানুষ তাকে বিয়ে করতে চাবে এটা যেনো ভাবনা বাহিরে তার কাছে। কিছুটা আচ করেছিলো কিন্তু ভেবেছিলো এটা হয়তো অভ্রের ক্ষণিকের ভালোলাগা। সাজাতে সাজাতে বলেই ফেললো,
– আচ্ছা, ভাইয়া যে তোকে পছন্দ করে সেটার আচ তুই পেয়েছিল?
– মানে?
– মানে আর কি! তা ভালো লাগলে কি কেউ এভাবে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়? তাও ভাইয়ার মতো মানুষ? যে কিনা বিয়ের নাম শুনলেই দশ হাত পেছনে ছুটে

পিউ এর কথা শুনে নিজের ভাগ্যের উপর হাসি পাচ্ছে ঐন্দ্রিলার। এরা ভাবছে অভ্র তাকে ভালোবাসে বিধায় বিয়ে করতে চাচ্ছে। এরা তো জানে না অভ্রের সুপ্ত ইচ্ছা কি! আর ঐন্দ্রিলাকে সে কেনো বিয়ে করতে চাচ্ছে। এটা তার প্রতিশোধ কেবল!
– কি রে এখন ই ভাইয়ার কথা ভাবছিস?
– না না, আচ্ছা উনি বিয়ে কেনো করতে চান না?

ঐন্দ্রিলার কথায় পিউ খানিকটা চুপ মেরে যায়। তারপর বলে,
– আমি তো সঠিকটা জানি না, তবে যতটুকু জানি উনি মেয়েদের পছন্দ করেন না। উনার মনে হয় মেয়েরা টাকাকেই বেশি প্রাধান্য দেয়। উনার মা মে বি উনাকে খুব ছোট অবস্থাতে ছাড়ে চলে গিয়েছিলেন
– কিহ!
– হুম
– তাহলে যে এতো গার্লফ্রেন্ড তার
– ওহ ওগুলা টাইম পাস। ভাইয়ার নারী সঙ্গ থাকা লাগে তাই থাকে। অথচ দেহ উনি কি তোকে বিয়ে করতে চায়। ভাবা যায়?

পিউ এর কথার উত্তরে ঐন্দ্রিলা কিছুই বললো না। সেও তো টাইম পাস। নারী সঙ্গ থাকা লাগে তাই তাকে বিয়ে করা, একঢিলে দুই পাখি মারা। কিন্তু এ বিয়েতে মানা করাটাও সম্ভব নয়। বাবা-ভাইয়ের সম্মানের ব্যাপার। হঠাৎ খালার ডাক পড়ে, এখন বাহিরে যেতে হবে। ঐন্দ্রিলা উঠে দাঁড়ালো। আয়নায় নিজেকে দেখে নিলো। লাল শাড়িতে তাকে অনেক সুন্দর লাগছে, চাপা রঙে রঙটা বেমানান লাগছে না। পিউ ও বেশ সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে। চুল বেধে দিয়েছে, চোখের কাজল এবং ঠোঁটের লাল লিপস্টিকটাও বেশ মানিয়েছে। কিন্তু সবই মিথ্যা, মিথ্যাকে সত্যি প্রমাণের চেষ্টা মাত্র।

বসার ঘরের দিকে চা হাতে যেতেই পা আটকে গেলো তার। তার সামনে…………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে