শ্রাবণের এক সন্ধ্যায় পর্ব-১০

0
922

#শ্রাবণের_এক_সন্ধ্যায়
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_দশ

–এই নেশাময় প্রতিশোধের খেলা আমি তো এক বছর আগে শুরু করেছিলাম মিস্টার তাহমিদ তাজওয়ার। আপনি ভাবলেন কি করে যে আমি আপনাকে ভালোবাসবো? হাউ ফানি ম্যান……

তাজওয়ারের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে উপরোক্ত কথাগুলো বললো তারিন। তাজওয়ার বর বেশে চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। তারিনের কথা শুনে ওর মাথা ঘুরছে। তার মানে তারিন এতসব কিছু প্রতিশোধের জন্য বলেছে। তারিন তাজওয়ারের ভালোবাসা নয় শুধুই প্রতিশোধ। তারিন কথাগুলো বলেই গলার মালা’টা এক টানে ছিড়ে ফেলে তাজওয়ারের দিকে ছুঁড়ে মা/রলো। অপমানে তাজওয়ার চোখ বন্ধ করে হাত দুটো মুঠোয় বন্দি করে নিলো। তারিন হা হা করে হাসতে লাগলো। উপস্থিত সবাই যেনো ঘোরের মধ্যে আছে। রাইমা বেগম আর জহির সাহেবের বিস্ময় যেনো কিছুতে’ই কাটছে না। আর তাসনিম ভয়ে কথা অব্দি বলতে পারছে না। তারিনের হাসি সহ্য করতে না পেরে তাজওয়ার এইবার বেশ চিৎকার করে বললো…..

–স্টপ। আই স্যা স্টপ।

এইটুকু বলে তারিনের দুই বাহু চে’পে ধরলো। তারিন তাজওয়ারের চোখের দিকে তাঁকাতে’ই রক্ত বর্নের চোখ জোড়া দেখতে পেলো। তাজওয়ারের শরীর কাঁপছে তা বেশ বুঝতে পারছে তারিন। তা দেখেও তারিন বাঁকা হাসলো। তাজওয়ার এইবার আগের মতোই চেঁচিয়ে বলে উঠলো….

—এই মেয়ে মাথা খারাপ তোমার? কি শুরু করেছো এসব। এটা কোনো শ্যুটিং স্পট না যে তুমি সেখানে ড্রামা করা শুরু করে দিয়েছো। এটা আমার বিয়ে বাড়ি। আমার ধৈর্যের পরিক্ষা নিও না। ফলাফল বেশ খারাপ হবে……..

তাজওয়ারের কথা শুনে তারিন আবারো হাসলো। হঠাৎ করে’ই তারিনের চোখ ছলছল করে উঠলো…..

— আমি জানি আপনি তাসনিম ম্যাডাম’কে ভালোবাসেন না। যদি সত্যি সত্যি তাসনিম ম্যাডাম’কে ভালোবাসতেন তাহলে, এতক্ষনে সে আপনার সামনে জীবিত দাড়িয়ে থাকতে পারো না।আমি তো আপনাকে ভালোবাসতাম। ভালোবাসি শব্দ’টা কয়েকশত বার বলা হয়ে গেছে আমার। আপনি নিজের মুখেই আমাকে ভালোবাসি বললেন আর আজ এই বিয়ে কেনো? আমি জানতে চাই কেনো এই বিয়ের নাটক? কেনো হিরো কেনো?

কথাগুলো বলতে তারিনের গলা কাপছিলো। কথা ঝট পাঁকিয়ে আসচ্ছিলো। তাজওয়ার এবার যেনো শান্ত হলো। শান্ত কন্ঠে বললো….

–আমার প্রশ্নের উওর খোঁজার জন্য এই বিয়ের নাটক।

তাজওয়ার আর তারিনের কথার মানে কেউ বুঝতে পারছে না। সবাই ওদের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে আছে। তাজওয়ারের কথা শুনে তারিন ও খানিক’টা অবাক হলো। কি প্রশ্ন? তারিন প্রশ্ন’টা করে’ই ফেললো তাজওয়ার’কে….

–কি প্রশ্ন? কি এমন প্রশ্নের উওরের জন্য এই নাটক…..

তাজওয়ার এতক্ষনে তারিনের বাহু ছেড়ে দিয়ে। তারিনের চোখের দিকে তাঁকিয়ে বললো….

–আমার প্রতি কিসের এত রাগ তোমার? কিসের প্রতিশোধ নিতে চাও তুমি? কি ক্ষতি করেছি আমি তোমার? উওর গুলো জানা আমার খুব প্রয়োজন তারিন…..

তাজওয়ারের লাস্টের কথাগুলো বেশ অসহায় কন্ঠে বললো। এতক্ষনে মেয়ে’টার নাম জানতে পারলো সবাই। মেয়ে’টার নাম শুনেই রাইমা বেগম আর জহির সাহেব যেনো আকাশ থেকে পড়লো। রাইমা বেগমের বুকের ভেতর’টা মুচড়ে উঠলো। মুহূতে’ই রাগে ফেটে পড়লো। বাঘিনী’র মতো বন্ধু’কের বাঁধা অতিক্রম করে তেড়ে গেলেন তারিনের দিকে। পেছন থেকে তারিনের বাহু ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে সপা’টে থা’প্প’ড় বসিয়ে দিলেন তারিনের গালে। পর পর দুইটা থা’প্প’ড় দিয়ে তৃতীয় থা’প্প’ড়’টা মা’রার জন্য হাত উঁচু করতেই তাজওয়ার ধরে ফেললো। আর তারিন গালে হাত দিয়ে অশ্রু ভর্তি চোখে তাঁকিয়ে রইলো রাইমা বেগমের দিকে। যে মানুষ’টা তারিন’কে মেয়ের মতো ভালোবাসতো, আগলে রাখতো। সেই মানুষ’টাই আজ তারিন’কে আঘাত করছে ভাবতে পারছে না ও। তাজওয়ার ওর মায়ের হাত ধরে রাগী কন্ঠে বললো ….

–তুমি কোন অধিকারে ওর গায়ে হাত তুললে মা। চিনো না জানো না একটা মেয়ের গায়ে হাত তুলতে তোমার একবার ও বুক কাঁপলো না।

তাজওয়ারের কথা শেষ হতে না হতে’ই রাইমা বেগম চেঁচিয়ে বলে উঠলো….

—নাহ! বুক কাঁপলো না আমার। যেই মেয়ে’টা আমার থেকে আমার ছেলে’কে কেড়ে নিয়েছে তা’কে এই দুই’টা থা’প্পড় মা’রতে আমার বুক কাঁপছে না। ওর মতো অলুক্ষণে মেয়ে’কে জন্ম দেওয়াই ওর মায়ের সব থেকে বড় পাপ। ওর মতো মেয়ে যেনো কোনো মায়ের গর্ভে না হয়…..

তীব্র ঘৃনা জড়িত কথাগুলো রাইমা বেগমের মুখ থেকে শুকে তারিন কয়েক’পা পিছিয়ে গেলো। চোখের পানি যেনো কোনো কিছুতেই বাঁধ মানছে না। আর জহির সাহেব দূর থেকে ছলছল চোখে ওর দিকে তাঁকিয়ে আছে। তাজওয়ার ওর মায়ের একটা কথাও বুঝতে পারলো না। বেশ অবাক স্বরে তাজওয়ার বলে উঠলো…..

–তুমি এসব কি বলছো মা? আমি কিছু বুঝতে পারছি না….

তাজওয়ারের কথা’র মাঝে’ই জহির সাহেব এসে তারিনের সামনে দাড়ালো। তারিন ছলছল চোখে তাঁকালো তার দিকে। অস্পষ্ট স্বরে “বড়বাবা” ডেকে উঠলো। সবাই বুঝতে না পারলেও জহির সাহেব ঠিক বুঝতে পারলো। জহির ধরলো তারিন’কে। তারিন যেনো অনেকদিন পর হারানো কিছু ফিরে পেয়েছে। এমন করে’ই আকড়ে ধরলো জহির সাহেব’কে। গলা ছেড়ে কান্না করে উঠলো তারিন। এসব কিছু তাজওয়ারের মাথা’র উপর দিয়ে যাচ্ছে। তারিনের সাথে ওর বাবা-মায়ের কি সম্পর্ক বুঝতে পারলো না। চোখ গেলো মিডিয়ার লোকের দিকে। তারা সব’টা ক্যামেরায় ধারন করছে। তা দেখে তাজওয়ার ওদের সামনে গিয়ে বেশ অনুরোধ বাক্যে বলে উঠলো…..

—প্লিজ এইসব বন্ধ করুন। এটা আমাদের পারিবারিক বিষয় আমরা মিটিয়ে নিব। প্লিজ আপনারা আসুন……

আজকে মিডিয়ার লোকেরা ও জোর করলো না। কোনো প্রশ্ন করলো না। নিজেদের জীবন বাঁচাতে বেড়িয়ে গেলো বিয়ের আসর ছেড়ে। মিডিয়ার লোকেরা চলে যেতে’ই তাজওয়ার ওর বাবা’কে অবাক স্বরে বলে উঠলো….

–তোমরা ও’কে আগে থেকে চিনতে বাবা?

তাজওয়ারের প্রশ্ন শুনে তারিন ছেড়ে দিলো জহির সাহেব’কে। তাজওয়ারের প্রশ্ন শুনে রাগে শিরশির করে উঠলো সমস্ত শরীর। জহির সাহেব আর রাইম বেগম দুজনে’ই থতমত খেয়ে উঠলো। আজকে কি উওর দিবে তাজওয়ার’কে? জহির সাহেব কিছু বলতে যাবে তার আগে’ই তারিন তাজওয়ারের দিকে তেড়ে এসে ওর কলার শক্ত করে চেপে ধরলো। দাতে দাত চেপে বলতে লাগলো…..

–বাহঃ তাহমিদ তাজওয়ার আপনি দেখছি বাস্তবেও দারুন অভিনয় করতে পারেন। আপনি তো পৃথিবীর সব অভিনেতা-অভিনেত্রী’দের ছাড়িয়ে চলে গেছেন।আপনি কিছুক্ষন আগে জানতে চাইলেন না আপনাকে ঘৃনা করি কেনো? তাহলে কান খুলে শুনে রাখুন আপনার এই অসাধারণ অভিনয় দেখে’ই আপনাকে আমি ঘৃনা করি। শুনতে পেয়েছেন আপনি? শুনতে পেয়েছেন……

তাজওয়ার ওর কথা কিছু বুঝতে পারলো। নিজেকে পাগল পাগল লাগছে ওর। কি হচ্ছে ওর সাথে? কেনো হচ্ছে? কি ক্ষতি করেছিলো ও তারিনের? তারিন কথাগুলো বলে থামলো কিছুক্ষন। বড়বড় নিশ্বাস ফেলে নিজেকে একটু শান্ত করলো। রাইমা বেগম তারিনের দিকে তাঁকিয়ে চেঁচিয়ে বললো….

–তুমি আমার ছেলে’কে অভিনেতা বলছো কোন মুখে? আমি তো দেখছি তুমি আমার ছেলের থেকেও অসাধারণ অভিনয় করতে পারো। সব’টা জেনেও কোন মুখে ও’কে এইসব বলছো।

তারিন এতক্ষনে রাইমা বেগমের দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাঁকালো। আঙ্গুল তুলে বলে উঠলো….

—আপনি ও দেখছি নিজের ছেলে’কে সাধু সাজানোর জন্য বেশ ভালো অভিনয় করছেন মিসেস রাইমা সিকদার।

রাইমা বেগম পূর্নরায় কড়া কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই জহির সাহেব হাতের ইশারায় তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলো….

–ওদের মধ্যে তুমি কেনো কথা বলছো রাইমা? ওদের ব্যাপার ওদের’কে বুঝতে দাও…..

তাজওয়ার নিস্তব্দ হয়ে দাড়িয়ে রইলো কিছুক্ষন। তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো তারিনের দিকে। নিজে’ই তারিনের হাত ধরে গান’টা নিজের বুকে লাগিয়ে বলে আমি….

–আমার প্রতি অনেক ক্ষোভ তোমার তাইনা। অনেক রাগ, অনেক বেশি ঘৃনা করো তাইতো। তাহলে আজ সব ঘৃনার অবসান ঘটিয়ে শেষ করো এই ঘৃনাময় প্রতিশোধের খেলা।

তাজওয়ারের কথা শুনে তারিন হাসলো। হাতের গান’টা দিয়ে তাজওয়ারের গাল ছুয়ে নেশালো কন্ঠে বললো…..

—ইউ লুক সো নাইস হিরো…

বলেই উপস্থিত সবার সামনে তাজওয়ারের কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো। তাজওয়ার চোখ বন্ধ করে দাড়িয়ে আছে। তারিন গান’টা সোজা তাজওয়ারের বুকে তাক করে কয়েক’পা পিছিয়ে যেতে যেতে বলে উঠলো….

–শেষ হোক আমার রিভেঞ্জওয়ালা লাভ।

তারিনের হাত কাঁপছে৷ রাইমা বেগম আর জহির সাহেব ভয়ার্ত চোখে তাঁকিয়ে আছে তারিনের দিকে। জহির সাহেব জানে তারিন কিছুতেই তাজওয়ার’কে আঘাত করবে না। রাইমা বেগম তারিনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে’ই প্রচন্ড শব্দ করে একটা বুলেট গিয়ে সোজা তাজওয়ারের বুকে লাগলো। তাজওয়ার চিউকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে’ই রাইমা “তাহমিদ” বলে জোরে চেঁচিয়ে উঠলো। জহির সাহেব সামনের দৃশ্য’টা দেখে শক্তি হারিয়ে ফেললো। পা দুটো নিজের জায়গায় স্থির হয়ে রইলো। তারিন গান’টা ছুড়ে ফেলে দিয়ে হাসিতে মত্ত হয়ে পড়লো…….

#চলবে

[ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে