শূণ্যতায় পূর্ণতা পর্ব -০৩

0
1426

#শূণ্যতায় পূর্ণতা
#নুরুন্নাহার তিথি
#পর্ব-৩

দ্বিতীয়বারের মতো মিসক্যারেজের পর অদ্রির অবস্থা অনেকটা খারাপ হয়েছিল। যেমনটা শারীরিক তেমনটা মানসিক। দুইদিন পর বাড়ি ফিরে এলে একমাসের মতো যেনো ট্রমাতেই ছিল। অদ্রির শাশুড়ির মনটা খারাপ হয়েছিল কিন্তু তিনি অদ্রিকে কোনো খারাপ কথা বা কষ্ট দিয়ে কিছু বলেনি। একমাস পর বিভানের জোরাজুরিতে অদ্রি জব শুরু করে। বিভান অদ্রিকে জানে। অদ্রি যদি পড়ালেখা ও কাজের মধ্যে থাকে তো মন ভালো থাকবে। অদ্রি জবে জয়েন করে “রিসার্চ এন্ড ডেভলপমেন্ট” সেক্টরে। বিভিন্ন নিও ড্রা/গ ও মেডিসিন নিয়ে কাজ করতে করতে আস্তে আস্তে নিজেকে সামলে নিয়েছে।
দ্বিতীয় মিসক্যারেজের ৭ মাস পর অদ্রি আবারো কনসিভ করে। অদ্রির বাবা-মা বলেছিল প্রেগনেন্সির ৯ মাস যেনো তাদের ওখানে থাকে। অদ্রির বাবা-মায়ের মতে,

“তোর শ্বশুরবাড়িতে তোর পরপর দুইবার অনাকাঙ্ক্ষিত মিসক্যারেজ হলো অথচ প্রতিবারের কিছুদিন আগে ডাক্তার বলেছিল, বেবি ফিট এন্ড ফাইন! তাহলে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা মানা যায় না। তুই আমাদের বাড়িতে চলে আয়।”

অদ্রি যেতে চায়নি। না যাওয়ার কারন আছে,
*শিমু এখন বিভানদের বাড়িতে ঘন ঘন আসা যাওয়া করছে।
*অদ্রি বিভানকে ছাড়া থাকতে চায় না।
*অদ্রির অফিস তার শ্বশুরবাড়ি থেকে কাছে। বেশি জার্নি করতে হয়না।

তাই যায় না অদ্রি। এবারো মিসক্যারেজ হয়। সেদিন সকাল সকাল বিভান ঘুম থেকে উঠে দেখে অদ্রি কেমন নিস্তেজ হয়ে শুয়ে আছে। বিভান অদ্রির গায়ে হাত দিয়ে ও পালস চেক করে দেখে মেয়েটা সেন্সলেস। তারপর উপর থেকে কাথা সরিয়ে যা বুঝার বুঝে গেছে। ওই মূহুর্তে বিভানের নিজেকে কেমন লাগছিল তা কল্পনা করার সাধ্য নেই। বিভান চোখ মুখ মুছে অদ্রিকে কোলে তুলে নেয় তারপর নিজের নতুন কেনা গাড়ি বের করে একাই অদ্রিকে নিয়ে হসপিটালে যায়। বিভান অদ্রির প্রেগনেন্ট হবার পরই গাড়ি কিনেছিল। তার খুব শখ ছিলো একদিন মা, বউ-বাচ্চা নিয়ে কোথাও ঘুরতে যাবে। নিয়তি সেটা অনিশ্চিত করে দিলো!

রিমু ও শিমুও সাথে যেতে চেয়েছিল কিন্তু বিভান ওদের নেয়নি কারন, বিভান জানে তার অনাগত সন্তানটা আর বেঁচে নেই কিন্তু মৃত সন্তানটা এখনো তার স্ত্রীর গর্ভে আছে। তাকে নিয়ে কিছুটা মনের ইচ্ছা তো পূরণ করা যাবে!
হসপিটালে ডাক্তার বলে,
–কোনো বেবি এবোর্ট হওয়ার পিল তাকে দেওয়া হয়েছিল।

বিভান অবাক হয়ে বলে,
–আমরা বেবি এবোর্টের কথা চিন্তাও করিনি। কেনই বা করবো? এটা অদ্রির থার্ড কনসিভ। এর আগের দুইটা বেবি এবোর্ট হয়ে গেছে।

ডাক্তার দুই হাত মুঠো বন্ধি করে টেবিলে রেখে বলে,
–উনার জরায়ুতে এতে অনেকটা ক্ষতি হয়েছে। চতুর্থ বার বেবি নেওয়া রিস্কি।

ভেঙে পরে বিভান। একজন বাবা ও স্বামীর কাছে তা কতটা কষ্টদায়ক তা যে সহ্য করো সেই বুঝে। অদ্রিকে সেই সময় হসপিটালে দুইদিন থাকতে হয়। বিভান এরপর থেকে সবসময় সচেতন থাকে যাতে অদ্রি কনসিভ না করে। অনেক উন্নত পদ্ধতি আছে বাচ্চা নেওয়ার বা একটা বাচ্চা এডপ্ট করলেই বা ক্ষতি কি!

________
এসব দুঃসহ স্মৃতি থেকে অদ্রির ঘোর কাটে জাবিরের কথায়। জাবির বলে,

–কই হারালে অদ্রি? ক্যামিকেলটার এন্ড পয়েন্ট তো দিয়ে দিয়েছে। তুমি কি নোট করেছো?

অদ্রি তাড়াহুড়া করে বলে,
–ইশ! বেখেয়ালি হয়ে গেছিলাম। এখন আবার এক্সপেরিমেন্টটাকে করতে হবে। শুধু শুধু নষ্ট হলো।

জাবির স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
–বেঁচে গেছো এটা শুধু ট্রায়াল ছিলো বলে। যদি বাল্ক ম্যানুফেকচার হতো তবে অনেক লস হতো। জলদি করো আর রিপোর্টে লিখে দিয়ো এন্ড পয়েন্ট ডিটেক্ট করতে পারোনি বলে ৫০ মিলিলিটার করে এসিড-বেস নষ্ট হয়েছে।

অদ্রি এরপর মনোযোগ দিয়ে এক্সপেরিমেন্টটা করলো। আগেরবার এক্সপেরিমেন্ট করার সময় তার ১ বছর আগের স্মৃতি মনে চলে এসেছিল। না আর এরকম করা যাবে না। একটা এক্সপেরিমেন্ট যদি ভুল হয় তবে লাখো মানুষের লাইফ রিস্ক হতে পারে। অদ্রি এরপর এক্সপেরিমেন্টটা ঠিক ভাবে করে রিপোর্ট তৈরি করে ফেলে।

_________
–এখন কি হবে আপু? অদ্রি তো নিজেই বিভানের দ্বিতীয় বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজে ফেলেছে।

–তাই তো দেখছি।

শিমুর কথার প্রতিউত্তরে রিমু বলে। শিমু বিরক্তির সাথে বলে,
–ভেবেছিলাম এই মেয়েটা পাগল হয়ে বলেছিল নিজের স্বামীর জন্য দ্বিতীয় বউ খুঁজবে! এখন দেখি খুঁজেও ফেলেছে। মেয়ের মধ্যে কি দুঃখ, কষ্ট কিছু নাই নাকি!

রিমু চিন্তিত স্বরে বলে,
–আমিও তো তাই ভেবেছিলাম। কয়দিন টালবাহানা করে হাতে-পায়ে ধরবে যেনো বিভানকে আবার বিয়ে না দেই! কিন্তু আমরা কেনো শুনতাম? শুনবো না তো। এরপর শাশুড়ির কানে তোর কথা তুলতাম। তুই অদ্রিকে মানিয়ে নিবি তাও বলতাম। কি সুন্দর একটা পরিকল্পনা ছিল।

শিমু ভেঙচি কেটে বলে,
–ইশ! অদ্রিকে মানিয়ে নিবো! বললেই হলো নাকি? আমি বিভানের বউ হবার পর অদ্রিকে বিভানের জীবন থেকে সরিয়ে দিবো। বিভান ও আমার জীবনে অদ্রি নামক কোনো ছায়াও রাখতাম না।

রিমু হাই তুলে বলে,
–ওই দিবা স্বপ্নতেই থাকো! অদ্রিতো নিজের চাল দিয়ে ফেলেছে। নিশ্চই ওর সুবিধামতো মেয়ে খুঁজেছে। যাতে অদ্রি নিজে ওই মেয়ের উপর রাজ করতে পারে।

শিমু এবার রিমুর পাশে বসে রিমুর হাত ধরে বলে,
–এখন তাহলে কি করবো? অদ্রিকে হারাতেই হবে।

রিমু ভাবলেশহীন ভাবে বলে,
–মেয়ে দেখতে যাবো পরশু সবাই মিলে। তখন মেয়ের মায়ের কানে অদ্রির ব্যাপারে বলতে হবে। এটাও বলবো, তার মেয়ের সাথে বিয়ে হলে তার মেয়ের অবস্থা হবে আমের আঁটির মতো! “আমে দুধে মিলে গিয়ে মাঝে আঁটি গড়াগড়ি খাবে।” এরপর মেয়ের মাই সব করবে। নিজের মেয়ের জীবন তো আর নষ্ট করতে পারবে না!

শিমুরও এটাই ঠিক মনে হয় তাই সম্মতি দেয়।

_________
রাতে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে অদ্রি ওর ক্লাশমেট রিয়ানের সাথে কথা বলছে। অদ্রি বলছে,

–দোস্ত, ডোন্ট বি প্যানিক! এভরিথিং উইল বি ফাইন।

ফোনের অপরপাশ থেকে রিয়ান বলে,
–তুই যতই বল না কেনো, আমার ভয় লাগছেই।

অদ্রি বলে,
–টাইমিং ঠিক থাকলে সব ঠিক। তোকে নিজ থেকে কিছু করতে হবে না। সব আমিই করবো। তোকে যা বলবো শুধু সেটুকু করবি।

রিয়ান বলে,
–কোনো মিসটেক হবে না তো!

অদ্রি এবার খানিকটা বিরক্ত হয়ে বলে,
–তুই আর জাবির ভাই দুইটাই ভীতুর ডি/ম! তোরা ছেলে মানুষ। হবি সাহসী। আর তোরা হচ্ছিস ভীতু!

রিয়ান মলিন কন্ঠে বলে,
–তোর মতো ভয়ংকর বুদ্ধিসম্পন্ন নারীর সামনে আমরা ভীতুই হবো! আমাদের কথা ছাড়। তোর জামাইরে কেমনে ম্যানেজ করবি?

অদ্রি বাঁকা হেসে বলে,
–ওটা আমি বুঝে নিবো। তুই ওইদিকের খবর নে। কেউ যদি অন্যরকম বিহেভ করে তো তোরে আমি..। থাক বললাম না। রাখ ফোন।

ফোন রেখে দেয়। পেছোন ঘুরে দেখে বিভান দুই হাত আড়াআড়ি ভাবে ভাজ করে ব্যালকনির দরজার সাথে হেলান দিয়ে ভাবলেশহীন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। অদ্রি মুচকি হেসে বিভানের সামনে গিয়ে দুই হাত দিয়ে বিভানের গলা জড়িয়ে ধরে। বিভান এখনো ভাবলেশহীন ভাবে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অদ্রি বিভানের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,

–কি দেখছো?

প্রশ্নটা শুনেও বিভান কিয়ৎক্ষণ মৌন রয় তারপর মৌনতা ভেঙে বলে,
–তোমার প্ল্যান কি? তোমাকে আমি ভালো করে চিনি। তোমার অদ্ভুত ভাবে শান্ত থাকাটাই বোঝায় কিছু তো ভেবেছো! কি ভাবছো তুমি?

অদ্রি বিভানের চোখের দিকে তাকিয়েই হাসে। তারপর বলে,
–তা তোমার এখন না জানা থাক। সময় হলে তোমাকে বলবো তখন তোমার স্টেপ তুমি নিবে। এখন সেসব চিন্তাও করো না। আমার পাশে থাকবে তো?

বিভান এখনো একই ভাবে চেয়ে আছে। অদ্রির প্রশ্নসূচক দৃষ্টিকে শান্ত করতে বলে,
–যাই করো না কেনো এতে যেনো কারো ক্ষ/তি না হয়। তোমার পাশে আমি ছিলাম, আছি ও থাকবো।

অদ্রি এবার রম্য স্বরে বলে,
–পরশু তো মেয়ে দেখতে যাবো!

বিভান ভ্রুঁ কুঁচকে তাকায় অদ্রির কথার প্রেক্ষিতে। অদ্রি দাঁত বের করে হেসে বিভানের বুকের সাথে মিশে যায়। বিভানো জড়িয়ে নেয় তার মায়াবতী রহস্যময়ীকে। বিভানের বুকে নিজের অধর জোড়ার আলতো স্পর্শ করিয়ে ঘোর লাগা কন্ঠে বলে,

–লেটস মেক সাম লাভ এন্ড মেক সাম প্রিসিয়াস মেমোরি!

পরিবেশে এখন শীতল হাওয়া। বসন্তের প্রথম বৃষ্টিতে আবারো প্রকৃতিতে শীতের রানী ঝেঁকে বসেছে। এই মনোমুগ্ধকর আবহাওয়া যেনো দুটো মানব-মানবীর কাছে ভালোবাসার শূণ্যতাকে পূর্ণ করে যায়।
চলবে ইনশাআল্লাহ,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে