শরতের শুভ্র মেঘের ভেলায় পর্ব-১৩

0
988

#শরতের_শুভ্র_মেঘের_ভেলায়(১৩)
Sadia afrin nishi
____________________________

“আপনি রাঁধতে জানেন?”

_নাহ তবে চেষ্টা করছি আরকি। বউকে তো আর বাহিরের খাবার খাওয়াতে পারি না। বউকে নিজে রান্না করে খেতেও বলতে পারি না। আবার না খাইয়েও তো রাখা যায় না। তাই নিজেই চেষ্টা করছি রান্না করে বউকে খাইয়ে তার মান ভাঙাবার

_”তা আপনার বউ কী আপনার হাতের রান্না খেতে চেয়েছে। নাকি সে নিজে রান্না করে খেলে হাতে ফোঁসকা পড়বে এটা বলেছে।আর আপনি যখন রাঁধতে পারেনই না তাহলে এতোদিন নানা পদের সুস্বাদু খাবারগুলো কে রান্না করল শুনি?এ বাড়িতে আপনি আমি বাদেও কী ভুতের আশ্রয় আছে নাকি?”

_উউউহহ থাকলে থাকতেও পারে ভুত কিংবা পেত্নী।সেটা নিয়ে আপনার ভাববার প্রয়োজন নেই মিসেস লাল লঙ্কা। আপনি এখন এখান থেকে যান আমি আপনার জন্য খাবার তৈরি করে নিয়ে আসছি।

_হয়েছে হয়েছে এতো ঢং না করে সরুন তো রান্নাটা আমিই করে নিচ্ছি। শেষে দেখা যাবে হাত-পা কেটে নিয়ে আমাকেই দোষারোপ করছেন। তাছাড়াও তখন তো আবার আমাকেই সেবা যত্ন করতে হবে।

সাক্ষরের হাত থেকে সবজি কাটা ছুরিটা টেনে নিয়ে নিলাম। তারপর ওনাকে ঠেলেঠুলে কিচেন থেকে বের করে দিলাম।এবার নিশ্চিন্ত রান্নাটা কম্পিলিট করবো। এমনিতেই অনেক দিন হলো রান্না করি না আজ রান্নার সুযোগ পেয়ে ভালোই লাগছে।খুব গুছিয়ে রান্নাগুলো সম্পন্ন করলাম।রান্নার প্রতি সবসময়ই আমার একটা অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করে।রান্না শেষে চলে গেলাম শাওয়ার নিতে। এখন আমার ফ্রেশ হওয়া খুবই জরুরি।

খাবার টেবিলে বসে আছে সাক্ষর।আমি খাবারের আইটেম গুলো একে একে টেবিলে এনে সজ্জিত করছি।ঘড়ির কাঁটায় এখন দুপুর দুটো বেজে পয়ত্রিশ মিনিট।সাক্ষরকে খাবার গুলো সার্ভ করে দিয়ে নিজের প্লেটেও খাবার নিয়ে বসলাম।খুব ক্ষুধা লেগেছে।দু’জনে মনোযোগ দিয়ে খাবার খাচ্ছি। কারও মুখে রা শব্দ টুকুও কাটছি না।আমি মাঝে মধ্যে সাক্ষরকে পর্যবেক্ষণ করলেও সে আমার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। গপগপিয়ে খাবারগুলো গলাধঃকরণ করছে।

————-

এই প্রথম আমি এ বাড়ির ছাদে পাঁ রাখলাম। ছাঁদটা বেশ ভালোই বড়।সারা ছাঁদ ঘিরে আমার পছন্দের নানারকম ফুল গাছ,বাহারি গাছে আচ্ছাদিত ছোট্ট একটা নার্সারি।মনটা নিমেষেই ভালো হয়ে গেল আমার।এতদিন পর ফুল গাছের সংস্পর্শে আসতে পেরে নিজেকে অনেক আনন্দিত লাগছে।আজ দিনটি আমার জন্য হয়তো শুভ। তাই তো সবকিছু আমার মনের সাপেক্ষে হচ্ছে।

বরাবরের মতো একটি “হোয়াইট রোজ” ছিঁড়ে নিজের বাম কানের উপরিভাগে গুজে নিলাম।তারপর আকাশের দিকে চেয়ে ওষ্ঠদ্বয়ে মৃদু হাসির রেখা টেনে দুহাত প্রসারিত করে ঘুরতে লাগলাম। মুখ দিয়ে আপনা হতেই বেড়িয়ে এলো একটি প্রাণবন্ত গানের লাইন_”আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে”

সন্ধ্যা নেমে এলো। পশ্চিম আকাশে এখন সূর্যের লালচে আভা বিরাজমান।পাক-পাখালিদেরও এখন বাড়ি ফেরার তাড়া।হয়তো এখুনি মাগরিবের আজান পরবে। কিন্তু আমার সেদিকে কোনো হেলদোল নেই। আমি তো গাছে পানি দিয়ে গাছ পরিচর্যার কাজে মগ্ন।কাজের মাঝে ব্যঘাত ঘটানো মানুষদের প্রতি আমার বরাবরই চরম আক্রোশ। আমার এই আক্রোশকে আরও বাড়িয়ে দিতে আগমন ঘটল সাক্ষরের।আমার গাছের পরিচর্যা করার মাঝেই সে এসে হাজির।এসেই গাম্ভীর্যের সাথে বলে উঠল,,

_”সন্ধ্যা নেমে এসেছে অথচ তুমি এখনো ছাদে। এর কারন?”

আমি একটু মুখ তুলে জবাব দিলাম,,

_”গাছ গুলোতে পানি দিয়েই নেমে যাব”

_ওকে তাড়াতাড়ি করো আমি এখানে আছি

_আপনি চলে যান। আমি একাই পারবো

_চুপপপপপপপপ, দিন দিন খুব বেশি বেয়াদবে পরিণত হচ্ছ তুমি। এর শাস্তিও অতীব শীঘ্রই প্রকাশ্য।

ওনার ধমকে আমি হালকা অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। জবাব দেওয়ার জন্য আর কোনো দিরুক্তি প্রকাশ করলাম না। চুপচাপ গাছে পানি দিয়ে নেমে এলাম ছাঁদ থেকে। উনিও আমার পেছন পেছন চলে এলো।লোকটা দিনদিন একটু বেশিই খিটখিটে হয়ে পরছে যেটা আমার বিরক্তির কারণ।কী এমন ক্ষতি হয় একটু মিষ্টি করে কথা বললে।আচ্ছা আবার এমনটা নয়তো যে আমিই ইদানীং সবকিছুতেই একটু বেশিই চেয়ে বসছি।

—————-

দিনগুলো বেশ ভালোই চলছে। সাক্ষর আর আমার মধ্যে দুরত্ব এখন আর আগের মতো অতটা প্রগাঢ় নেই।বেশ আছি দু’জনে।কলেজে যাই এখন আবার আগের মতো। সাক্ষর আমাকে রোজ দিয়ে আসে আবার নিয়ে আসে।মিতালী মাঝে মধ্যে আমাদের বাড়িতে আসে।সাক্ষরের সাথে মিতালীর সম্পর্কটা অনেকটা ভাই-বোনের পর্যায়ে রুপ নিয়েছে। দু’জনে ভীষণ ফ্রেন্ডলি। এতকিছুর পরেও কোথাও একটা খটকা থেকেই যায়।সেদিনের পর কলেজে গিয়ে মিতালীকে সবকিছু খুলে বলেছিলাম। সবটা শুনে মিতালীও প্রচুর অবাক হয়।মিতালী আমাকে অনেকবার জোর করেছে সাক্ষরের কাছ থেকে সবটা জেনে নিতে কিন্তু আমি সাহস করে কিছুই জিজ্ঞেস করতে পারিনি।

রাত সাড়ে তিনটে,
ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে বিছানায় শুয়ে বাম পাশের শূন্যস্থান হাতড়ে অবিরত কাউকে খোঁজার চেষ্টা করছি আমি।অনেকক্ষণ হাতাহাতির পর আমার ঘুমটা আলগা হয়ে এলো।হুঁশ ফিরতেই তাড়াতাড়ি শোয়া থেকে উঠে বসে টেবিল ল্যাম্পের আলোয় ঘরটা আলোকিত করলাম।আমার ভাবনাই সঠিক। সাক্ষর রুমে নেই। ওয়াশরুম আর বেলকনির দরজাও তো এদিক দিয়ে বন্ধ তারমানে সাক্ষর ঘর থেকে বাহিরে বের হয়েছে।এতো রাতে কোথায় গেল লোকটা।পানি খেতেও তো যেতে হবে না কারণ পানি তো আমি ঘরে এনে রেখেছি।তাহলে গেল টা কই?

বিছানা ছেড়ে গুটিগুটি পায়ে নেমে পরলাম অনুসন্ধানে।চুপি চুপি পুরো বাড়িটায় তল্লাশি চালাচ্ছি।ওপর তলার প্রতিটি কক্ষ তন্ব্য তন্ব্য করে খুঁজেও যখন কোনো লাভ হল না তখন আমি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলাম।পুরো বাড়িতে এখন ডিম লাইট জ্বলছে।ডিম লাইটের হালকা আলোয় আশেপাশের সবকিছুই প্রায় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।নিচ তলার কোথাও সাক্ষর নেই।মিশনে ব্যর্থ হয়ে আমি যখন ফিরে আসতে যাব ঠিক তখনই আমার মনে হলো সেই তালাবদ্ধ ঘরটার কথা। তাড়াহুড়ো করে দৌড়ে ওই ঘরটির সামনে গিয়ে দাড়ালাম। হুম যা ভেবেছি তাই। এই বৃহৎ তালা আজ দরজায় ঝুলছে না, দরজার পাশে পড়ে আছে। তারমানে সাক্ষর এই কক্ষেই আছে। খুব জানার কৌতুহল হচ্ছে এই ঘরের তালার পেছনের রহস্য। কিন্তু কীভাবে জানব কিছুই বুঝতে পারছি না। দরজাটাও তো ভেতর থেকে বন্ধ।

নাহহ কোনো রুপ কোনো উপায় অন্তর না পেয়ে আমি রুমে চলে এলাম।কিছুই ভালো লাগছে না। লোকটা কী ঘোট পাকাচ্ছে কে জানে?কীছু তো একটা ব্যপার আছেই।

রুমে এসে সোজা চলে এলাম বেলকনিতে। দক্ষিণা বাতাসে মনটা ফুরফুরে লাগছে খুব। আকাশে ভারী মেঘের ঘনঘটা। হয়তো আকাশের বুক চিঁড়ে খুব শীঘ্রই আছড়ে পরবে বিন্দু বিন্দু জলরাশি এই ধরনীর বুকে।চোখ বুজে সময়টা উপভোগ করছি।এমন সময় এক মগ কফি হলে ব্যাপারটা একদম জমে ক্ষীর। আহা আহা এমন মনোমুগ্ধকর পরিবেশ সাথে বৃষ্টি তারাসাথে আবার কফি।কী সুন্দর যুগলবন্দী।

কারও হিমশীতল স্পর্শ পেটে পশ্চাৎভাগে পরতেই আমার হুঁশ ফিরল। সারা শরীরে যেন কারেন্টের শক লাগল এমন মনে হচ্ছে। পেছন ফিরে দেখতে যাব তার আগেই পেছনের মানুষটি আমার কাঁধে মুখ গুজে দিয়ে খুব গম্ভীরভাবে বলল,,

_”ডিস্টার্ব কোরো না প্লিজ।আজ মনটা অন্যসুরে গাইতে চাইছে। কিছু নিয়মের বাঁধ ভাঙতে চাইছে।হোক না আজকের রাতটা একটু অন্যরকম। প্রতিরাতের চেয়ে খানিকটা আলাদা।থাক না মনের কোণে কিছু স্মৃতি ভালবাসা হয়ে।তবে কী খুব বেশি ক্ষতি হবে নীহুপাখি?”

ওনার মুখে এসব কথা শুনে যতটা না শক খেয়েছি তারথেকে অনেক বেশি শক খেয়েছি ওনার মুখে “নীহুপাখি” নামটা শুনে।সে আমার স্বামী। আমার অন্তরের মাঝে তার বসবাস।তার প্রতিটি চলন-বলন,ইশারা-ইঙ্গিত আমার বুঝতে তেমন একটা বেগ পেতে হয়না। ঠিক তেমনই আজও বুঝে গেলাম তার ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলা কথাটি। এই মুহুর্তে আমি এক অজানা অনুভূতির মাঝে ডুবে আছি।তাকে কী থামানো উচিত নাকি তার কাজে সায় দেওয়া উচিত এটাই বুঝতে পারছি না।আমার দিক থেকে কোনো বাঁধাসূচক উত্তর না পেয়ে সে আমাকে কোলে তুলে বেলকনি থেকে রুমে নিয়ে আসল।তারপর পরম যত্নে বিছানায় সঁপে দিল। আমি এবার কেমন একটা দিশেহারা হয়ে পরলাম।অজানা এক অনুভূতিতে নিজেকে ধীরে ধীরে বিলীন হতে দেখেও কিছুই বলতে বা করতে পারলাম না। হয়তো সে আমার স্বামী বলেই আমার এমন অপারগতা।তার তো পূর্ণ অধিকার আছে আমার প্রতি।বরং আমারই তাকে বাঁধা দেওয়ার কোনো রাইট নেই।তাই তো চুপচাপ মুখ বুঝে সহ্য করে নিলাম তার প্রেমময়ী অত্যাচার।

—————

ভোরের উষ্ণ রোদ গাঁয়ে মাখার মজা বরাবরই অন্যরকম।কফির মগ হাতে বেলকনির একটি চেয়ারে বসে রোদবিলাস করছি।হাতে বরাবরের মতোই বই গুজে নিয়েছি।কফিতে চুমুক দিচ্ছি আর বইয়ের পাতায় চোখ বুলাচ্ছি।আজ সকালটা আমার কাছে স্পেশাল, খুবই স্পেশাল। চাইলেও কখনো এমন মুহুর্ত ভোলা সম্ভব নয়।সাক্ষর এখনো ঘুমে বিভোর। ইস কী করে ওই অসভ্য লোকটার সামনে যাব আমি আজকে।লজ্জায় মরেই তো যাব।

কফির মগটা টি-টেবিলে রেখে বইয়ের পাতা বন্ধ করে আকাশের দিকে দৃষ্টি দিলাম।আকাশটাও আজকে ঝকঝকে।এই ঝকঝকে আকাশে দৃষ্টি দিয়ে অনায়াসে ভেবে ফেলা যায় কতশত চিন্তাধারা।

শহরের অবস্থা ততটা ভালো নয়।খুন খারাবি বেড়েই চলেছে। এই নিয়ে ছয়টা খুন হলো।অথচ প্রতিটি খুনের রহস্যই এখনো অজানা।অদ্ভুতভাবে প্রতিটি খুন একইভাবে করা হচ্ছে আবার একইভাবেই গায়েব হয়ে যাচ্ছে।আমার মনে হচ্ছে এটা কোনো সিরিয়াল কিলারের কাজ।কিন্তু সেই কিলার কে?কেন তাকে পুলিশ এরেস্ট করতে পারছে না?কেন সে সবাইকে এভাবে মারছে?সবটাই আমার অজানা। জানতে হলে হয়তো ডুব দিতে হবে রহস্যের অতলে।

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে