যেমন শাশুড়ি তেমন বউ (পর্ব- ৩)

0
1252

যেমন শাশুড়ি তেমন বউ
(পর্ব- ৩)

শাশুড়ি আমাকে দেখে আরো জোরে জোরে চিৎকার শুরু করলেন। আমাকে দেখেই তার শক্তি যেন দুইগুণ বেড়ে গেছে! বাবার দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে নেড়ে চিল্লাচ্ছে,
– কোন রাজা-বাদশার মেয়ে কে জানে! এতো বেলা হয়েছে তবু তার ঘুম ছাড়েনা। এতোই জমিদারি করার শখ তো যাওনা বাপের বাড়ি, আমার পরিবারের মাথাটা কেন খাচ্ছ? প্রয়োজন হলে আমি পুলিশের কাছে যাব, আদালতে যাব তবুও তোমাকে ঠিক বের করবো এই বাড়ি থেকে, বলে রাখলাম।
– মা, চলে যাব বলে তো আসিনি! আর হ্যা আমি কোন রাজা-বাদশার মেয়ে না, আমি খুব সাধারণ ঘরের একটা মেয়ে। মধ্যবিত্ত ঘরের সাধারণ জীবনযাপনে আমি অভ্যস্ত। তাই আপনি যদি আমাকে রাজা-বাদশার মেয়ে বানিয়ে ফেলেন, তাহলে রাজা-বাদশাদের অপমান করা হবে আর সাথে আমার মধ্যবিত্ত বাবা-মাকেও। যাদের শ্রম, ভালোবাসার স্পর্শ, যাদের সারাদিনের ধুলোবালি মাখা হাতের ছোঁয়া আমাকে আজকের আমি করে তুলেছে। তবে হ্যা, আমার বাবা-মা আমার কাছে রাজা-বাদশারও অনেক উপরে। জানেন তো মা, রাজা-বাদশারা আজ আছে তো কাল নেই, কিন্তু মা-বাবা সন্তানের হৃদয়ের সিংহাসনে যুগ যুগ থাকবে। যার কোন ক্ষয় নেই, ধ্বংস নেই, প্রতিযোগিতা কিংবা পরাজয় নেই! আচ্ছা মা, একবার আপনি ভাবুন তো আপনিও তো বউ হয়েই এই বাড়িতে এসেছিলেন নিজের সংসার মনে করে। এই বাড়ি আসার সময় একবার ও কি ভেবেছিলেন যে এই বাড়িতে আপনার থাকা হবে না কিংবা চলে যাবেন৷ আইন-আদালত যেখানে খুশি যান আমি যাচ্ছি না। বাবা-বোন-ভাই-ভাবী-স্বামী বা মা’কে ছেড়ে। আপনি আমাকে নিজে থেকেই একদিন মেনে নেবেন, আমিও বলে রাখলাম।
– দেখেছ রাহাতের বাবা, কেমন মুখে মুখে কথা বলে। ভদ্রতা, সভ্যতা, বড়দের সম্মান করা কিচ্ছু শেখায় নি বাবা মা।
– আস্তে আস্তে শিখে নেব।
বাবা মাকে থামানোর বৃথা চেষ্টা করছে, বাবা নিজেও জানে তিনি পারবেন না।
– আমি ছোটবেলা থেকে শুধু বাবা আর মাকে দেখে বড় হয়েছি, আমার কোন ভাই বোন ও নেই, আমি একা। মায়ের আদর, বাবার ভালোবাসা কোনটাই কম পাইনি কিন্তু তবুও আমার মনে হতো কেন আমার বোন নেই, কেন ভাই নেই, কেন ভাবী নেই, দাদা-দাদি, চাচা-চাচি অথবা ভাই বোনদের হৈচৈ কেন নেই! বাবা মাকে প্রশ্ন করতাম কেন আমি একা! কিন্তু কোন উওর নেই তাদের কাছে আমিও জানি। তারপর রাহাতকে পেয়ে, রাহাতের মুখে তোমাদের সবার কথা শুনে আমি অপূর্নতাকে পূর্নতায় রূপ দিতে চেয়েছি, এ কি আমার অপরাধ মা?
বলেই আমি কাউকে কিছু না বলে ঘরে চলে গেলাম।
কথাগুলো বলতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিলো, হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল, সবাইকে জড়িয়ে বলতে ইচ্ছে করছিল আমি তোমাদের ছেড়ে যেতে চাই না, খুব ভালোবাসি তোমাদের। ভালোবাসা হতে কতটা সময় লাগে, কতদিন লাগে, কতটা আবেগ-মায়া লাগে আমি জানিনা কিন্তু তোমাদের সবাইকে ছাড়া আমি ভীষণ একা হয়ে যাবো, ভীষণ অসহায় হয়ে যাব। তোমাদের ঘিরে মনের ঘরে একটা সংসার গড়েছি আমি, গড়েছি একটা ভালোবাসার ঘর। এটাকে ভালোবাসা বলে, না আবেগ আমি হয়তো ব্যাখ্যা দিতে পারবো না কিন্তু এরা যে আমার মনের ভেতরের ঘরে আছে এ কথাটা শুধুই মন জানে। কাউকে দেখানোর ক্ষমতা এই আমার যে নেই। কেন শাশুড়ি পারছে না আমাকে মেয়ে করে নিতে, কেন পারছে না আমার মা হতে? আমি জানি আমি মুখে মুখে কথা বলে ভুল করেছি। আমার মা-বাবা সারাজীবন শিখিয়েছে কিভাবে বড়দের সম্মান আর শ্রদ্ধা করতে হয়। পৃথিবীর সব মাকে কিভাবে নিজের মা করে নিতে হয় অথচ আজ নিজের প্রয়োজনেই আমাকে অভদ্রতার শেষ সীমানায় পৌঁছে যেতে হচ্ছে! এ ছাড়া যে আমার আর কোন উপায় নেই। বৃদ্ধাশ্রমে বয়স্ক মা-বাবাকে দেখিয়ে বাবা কেঁদেছিলেন। বলেছিলেন, জানো মা, বউ পেয়ে কোন কোন সন্তান এই মাকে, এই বাবাকে কারাগারে পাঠিয়ে দিয়েছে! সেদিনই আমি শপথ নিয়েছি, যত কিছুই হোক শ্বশুর শাশুড়িকে এতোটুকুও কষ্ট পেতে দেবোনা কোনোদিন।

বাহির থেকে এখন ও শাশুড়ি’মায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে,
– যা কিছুই হয়ে যাক না কেন, ওই মেয়েটাকে আমি বাড়ি থেকে তাড়িয়েই ছাড়ব, মানি না আমি এ বিয়ে। আমার রাহাতকে ভোলাভালা পেয়ে মাথাটা চিবিয়ে খেয়েছে। ওকে আমি এ বাড়িতে কিছুতেই থাকতে দেব না!

কষ্টের পরে সুখ আসে, মেঘের আড়ালে লাল সূর্য হাসে, ব্যর্থতার আড়ালেই সফলতা থাকে আর ঘৃনার আড়ালেই লুকিয়ে থাকে সত্যিকারের ভালোবাসা। একদিন সেই ভালোবাসার সন্ধান আমি ঠিক পাবো৷
এসব ভাবতে ভাবতে রান্নাঘরের দিকে রওনা দিলাম জায়ের হাতে হাতে কিছু সাহায্য করার জন্য, একা একা আর কতো করবে আর সবার নিশ্চয় ক্ষুধা লাগছে, যা সকালে ঘুম থেকে ওঠে, বাপরে বাপ!

সকালের খাওয়া শেষে সবাই নানারকম খোশগল্পে মেতেছে। মন্দ লাগে না মাঝে মাঝে একটুআধটু গল্প শুনতে। হঠাৎ বাহিরে কয়েকজন মহিলার আওয়াজ পাওয়া গেল। তারা অনেকটা চিৎকার করেই বলছে,
– কি গো রাহাতের মা, আছো নাকি?
বলতে বলতে ঘরেই চলে এলো সবাই। কয়েকজন মধ্যবয়স্কা মহিলা, আশেপাশেরই হবে মনে হয়। বাবার কথামতো বসার জন্য চেয়ার এগিয়ে দিলাম, আমার দিকে প্রায় সবাই ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে। কেউ এমন করে চেয়ে থাকলে কেমন যেন অপ্রস্তুত লাগে নিজেকে! মনে হচ্ছে এ জনমে কখনো বউ দেখেনি! শাশুড়ি’মা বসতে বলা ছাড়া একটা কথাও বলেনি তাদের সাথে। মধ্যবয়স্কা মহিলাদের মধ্যে একজন কথাগুলো নিজের মধ্যে চাপাতে না পেরে বলেই উঠলেন,
– শুনলাম তোমার ছেলে নাকি নতুন বউ এনেছে, তা কথাটা কি সত্যি রাহাতের মা? কি যে দিনকাল এলো কে জানে, বড়দের আর কেউ মানইজ্জত দেয়না আজকাল।

এসব যে শাশুড়ি’মাকে রাগানোর জন্য আর হেনস্তা করার জন্য তা হয়তো সবাই বুঝতে পারছে, কিন্তু কি আর করার আছে! শাশুড়ি’মা শুধু মাথা নাড়লেন, মুখে কিচ্ছুটি বললেন না। হয়তো তিনি নিজেও চাননি এভাবে কারো সামনে তার কথা বলার মতো কথাই হারিয়ে যাবে। তাকে এভাবে চুপ করে যেতে হবে। শাশুড়ি’মাকে দেখে খুব খারাপ লাগছে, নিজের মধ্যে অপরাধবোধ প্রবলভাবে জেগে উঠছে। কিন্তু আবার মনের মধ্যে কোথাও যেন কেউ বলছে, এটা তোমার অধিকার। তোমরা দু’জন দু’জনকে ভালোবাসো। এতে কোন অপরাধ নেই, নেই কোন ভুল কিংবা পাপ।

অন্য একজন সুরে সুর মিলিয়ে বললেন,
– তা শুনলাম নাকি মেয়েটা নিজে থেকে এখানে এসেছে, রাহাতের চেহারা কি ভোলাভালা! ও যে এতো বড় একটা কাজ করবে ভাবতেও পারিনি আমরা। আর মেয়ের বাবা-মা’ই বা কেমন, মেয়েটাকে একা ছেড়ে দিল!
অন্যজন সঙ্গে সঙ্গেই বললেন,
– কি আর করবে বলো, ঝুট-ঝামেলা পোহাতে তো আর হলোনা আবার মেয়ের জন্য জামাইও তো আর মন্দ না, তাইনা? তবে রাহাত কিন্তু এটা একদম ঠিক করেনি। আর মেয়েটার কথাই বলি, এভাবেই বিয়ে করতে হতো নইলে কি আর বিয়ে হতো না, না স্বামী – শ্বশুরবাড়ি পেতি না! লাজলজ্জা আজ কোথায় চলে গেছে!

কথাগুলো আমার বুকের ভেতর কাঁটার মতো বিঁধে যাচ্ছিল। মানুষ এভাবে কথা বলতে পারে আমি ভাবতেও পারিনা। আমার জন্য আমার বাবা-মায়েত নামে অচেনা, অজানা লোকজন খারাপ কথা বলছে ভেবেই বুকের ভেতর দুমড়েমুচড়ে শেষ হয়ে যেতে লাগলো। সত্যিই আমি আমার বাবা-মাকে অসম্মানের রাস্তায় এনে দাঁড় করিয়েছি। সব দোষ আমার৷ আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছিল, তোমরা থামো এবার। যা বলার হয় আমাকে বলো কিন্তু আমার বাবা-মায়ের নামে কেউ খারাপ কথা বলোনা। ওরা আমার জীবন, আমার পৃথিবী, আমার সমস্ত সংসার।

আমার আর এসব কথা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনতে ইচ্ছে করছে না। নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালাম কিন্তু রাহাত ওর হাত দিয়ে আমাকে আটকে দিল। কিছু বললাম না, রাহাত জানে আমি বাবা-মা শব্দটাকে কতোটা ভালোবাসি। রাহাত আস্তে করে শুধু বললো,
– বসো।
রাহাতের যতই কথা শোনাই আর যাই করি রাহাতের কথার ওপর কথা বলতে কেন যেন মন সায় দেয় না। চুপচাপ বসে গেলাম। রাহাত একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে আর একবার তার মায়ের দিকে। ঠিক কি করতে চাচ্ছে সে, বুঝতে পারছি না। কিন্তু ওর চোখ মুখ স্পষ্ট জানান দিচ্ছে, আজ ও এমন কিছু করবে যা আগে কখনো করে নি। আমার খুব ভয় করছে। মনে মনে নিজেকে নানান কথা বুঝিয়ে স্বান্তনা দিচ্ছি কিন্তু মন মানছেই না। রাহাতের এমন লাল চোখ এর আগে আমি সত্যিই দেখিনি। এই এতোগুলো বছর ওর সাথে সম্পর্ক ছিল, একটা দিনও ওকে রাগতে দেখিনি আমি৷ আমার জন্য সবসময় ওকেই অপেক্ষা করতে হয়েছে ঘন্টার পর ঘন্টা, তবুও কোন অভিযোগ ছিল না কোনদিন। আমিই সবসময় রাগ করতাম, রেগে লাল হয়ে যেতাম। আর ও দাঁত কেলিয়ে বলতো, তোমাকে রাগলে এতো সুন্দর লাগে জানতাম না! এখন থেকে রোজ রাগাবো তোমায়।
ওর পাগলামি আমাকে ওর থেকে দূরে থাকতেই দিতো না। সহপাঠী কিংবা কাছের কারো সাথে কখনো রাগতে দেখিনি ওকে।
রাহাত দাঁড়িয়ে খুব শান্ত ভাবে বললো, আপনাদের কথা বলা শেষ? কথা বলা শেষ হয়ে থাকলে এখন আসতে পারেন!

শাশুড়ি’মাকে তোয়াক্কা না করে রাহাত হড়হড় করে বলে গেলো কথাগুলো। শান্ত মানুষগুলো একবার জ্বলে উঠলে আগুন ধরে যায়, এ আমি বেশ ভালোই জানি। শাশুড়ি’মায়ের আগুনঝরা চোখ অগ্রাহ্য করে নিজের চোখে আগুন জ্বালাচ্ছে রাহাত৷ আজ সংসারে তুলকালাম কান্ড হবে, ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে!

(চলবে…)
কামরুন নাহার স্মৃতি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে