যেমন শাশুড়ি তেমন বউ (পর্ব -৪)

0
1158

যেমন শাশুড়ি তেমন বউ
(পর্ব -৪)

রাহাতের কথা শেষ না হতেই আরেকজন মধ্যবয়স্ক মহিলা বললেন,
– আচ্ছা এসব দেখে আমাদের ছেলে মেয়ে কি শিখবে! কাল যদি আমাদের কারো ছেলে বা মেয়ে এমন করে তাহলে তার দায়টা কে নেবে শুনি? আর তোমার মতো এমন মানুষের সংসারে কি না এমন অবস্থা।

কিসব মানুষ রে বাবা, যাদের বাড়ি এসেছে তাদেরকেই কিনা অনবরত অপমান করে চলেছে, একটুও মুখে আটকাচ্ছে না! রাহাত কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু আমি ওর হাতটা ধরে নিলাম। ফিসফিসিয়ে বললাম,
– কি লাভ অশান্তি বাড়িয়ে?
– আমি কিছু করলেই অশান্তি। আর ওরা তোমাকে যা খুশি তাই বলছে তার বেলায়!
– বাদ দাও না!

রাহাত আমার কথা পাত্তা দিলো বলে মনে হলো না৷ আবারো শান্ত গলাতেই বললো,
– আচ্ছা আন্টি আমায় দেখে আপনার ছেলেরা কেন এমন করবে, এই শিখিয়েছেন নাকি তাদের, যে যা করবে তাই যেন করে। আর হ্যা মেয়েটা নিজের ইচ্ছেই এ বাড়িতে আসেনি, আমি এনেছি বিয়ে করে, বুঝেছেন আপনারা?

যে ছেলেটা কখনো কারো সামনে কিছু বলতেই পারে না সে কি না আজ আমার হয়ে এতোগুলো কথা বলল! আমার ভীতুরামটা এতো সাহস কোথায় পেলো? আজকের রাহাতকে চিনতে বড্ড অসুবিধা হচ্ছে। মনে হচ্ছে, আমার চেনা লোকটা মূহুর্তে পালটে গেছে।

মধ্যবয়স্কা মহিলাদের একজন শাশুড়ি’কে ইশারা করে বললেন,
– দেখেছো রাহাতের মা রাহাত আজ আমাদের কেমন মুখে মুখে কথা বলল আর তুমি এখনও চুপ করে আছো! নতুন বউ বাড়িতে পা দিতে না দিতেই ছেলের এই অবস্থা, শেষে দেখো তোমাকে না অচল পয়সার মতো দিন কাটাতে হয়!

রাহাত কিছু বলতে যাচ্ছে তখনই আমি ওকে থামিয়ে দিলাম। ও আমাকে আস্তে আস্তে বলল,
– তুমি এদের চেননা, এরা এমনই! অন্যের সংসারের দোষ খুঁজেখুঁজে বেরানোই এদের কাজ, নিজের সংসারে পচন ধরেছে সেদিকে খেয়াল নেই অথচ অন্যের সংসারে কেমন পচন ভাইরাস ছড়াচ্ছে দেখ! কাজকর্ম নেই তো কি আর করবে সারাদিন, অন্যদের নিয়ে গবেষণা ছাড়া!

বাবাকে খুব কমই কথা বলতে দেখি যে কোন বিষয়ে। মা এবার কড়া গলায় বললেন,
– আমার সংসার আমাকেই বুঝে নিতে দাও, আমি তো এখনও আছি। এখনও অচল পয়সা হয়ে যাইনি অথবা সংসার সামলানোর ক্ষমতাটাও হারাইনি। তোমাদের তো আবার আলাদা সংসার, ছেলে – ছেলের বউ আলাদা থাকে, তা নিজের সংসারটা ঠিকমতো গুছিয়ে নিয়েছ তো? নাকি অচল পয়সা হওয়ার আগেই পয়সায় জং ধরিয়েছ!
তা কি মনে করে এসেছিলে তোমরা, তা কিন্তু বলোনি এখনও ; নাকি এসব কথা শোনাতেই এসেছিলে?

একজন আমতা আমতা করে বললেন,
– না না, তা কেনো! আমরা তো নতুন বউ দেখতে এসেছিলাম।

শাশুড়ি’মা চোখ পাকিয়ে রাহাতকে বললেন,
– রাহাত তোর বউকে বল ফ্রিজ থেকে মিষ্টি বের আনতে..

আমি চুপচাপ রান্নাঘরে গেলাম। মিষ্টি হাতে নিয়ে ফিরে ছালাম দিয়ে সবাইকে খেতে দিলাম। সবাই বললেন,
– কি সুন্দর চেহারা! রাহাতের পছন্দ আছে বটে। সুখী হও মা, স্বামী-সংসার নিয়ে ভালো থাকো।
আসি মা..
বলেই সবাই উঠে চলে গেল।

কি মানুষ রে বাবা, একটু আগেই আমার গুষ্টি উদ্ধার করছিল আর এখন কি না কত ভালো ভালো কথা বলছে। অবশ্য যা বাঁশ শাশুড়ি’মা দিয়েছে সময় লাগবে ভুলতে।
রাহাত মুচকি হেসে বলল,
– দেখলে তো কেমন মত পাল্টালো, এসব পাবলিক এমনই। এদের নিয়ে বেশি চাপ নিতে নেই।

বাবা মুচকি হেসে মা’কে বললেন,
– এবার কিন্তু একটা কাজের কাজ করেছো, উফফফ কিভাবে আমাদের সামনে আমাদেরই সম্মান কেঁড়ে নিচ্ছিল!
– তোমার ছেলে সম্মানের কি রেখেছে! আজ কি না ওর জন্য মানুষ বাড়ি বয়ে এসে কথা শুনিয়ে যায়!
– কাজ নেই তাই অন্যের দোষ খোঁজাটা নেশা। কি আর করবে! (রাহাত)
– তুমি চুপ করো, খুব মুখে মুখে কথা বলতে শিখে গেছ, তাইনা? কে শেখাচ্ছে এসব আজকাল, নতুন বউ? তা তোমরা কি সত্যি সত্যিই আমাকে অচল পয়সা ভাবতে শুরু করেছ নাকি?
– কি যে বলো তুমি রাহাতের মা৷ এটা তো তোমারই সংসার, তুমিই সবকিছু!
– একদম আমাকে বোকা বানানোর চেষ্টা করবে না নতুন বউয়ের বাবা, আমি সব বুঝি! ওই মেয়েটা এই বাড়ি থেকে না যাওয়া পর্যন্ত আমি তোমাদের থেকে আলাদা হয়েই থাকব আর ততদিন পর্যন্ত আমাদের মধ্যে কোন সম্পর্ক নেই৷
বলেই দ্রুত চলে গেলেন শাশুড়ি’মা। আমার জন্যই এই সংসারে এতো অশান্তি, মা আর বাবার মধ্যে এরকম ভুলবোঝাবুঝি! আর রাহাতও সবার চোখে কেমন ছোট হয়ে যাচ্ছে। তাহলে কি আমার এ বাড়ি থেকে সত্যিই চলে যাওয়া উচিত! সবার সুন্দর স্বপ্নগুলো দেখতে নেই, কারো কারো সেই স্বপ্ন দেখাটাই অপরাধ। কি করব এবার আমি? চলে যাবো রাহাতকে ছেড়ে, আমার স্বপ্নের এই মানুষগুলোকে ছেড়ে, রাগী মা আর শান্ত বাবাকে ছেড়ে!
ভাবতেও কষ্ট হয়, ভালোবাসা কেন এমন হয়? কষ্ট – যন্ত্রনা – বেদনার আঘাতে ক্ষত বিক্ষত করে দেয় মানুষকে!

আমি ঘরে গিয়ে রাহাতকে প্রশ্ন করলাম,
– আচ্ছা রাহাত, আমি চলে গেলেই তোমরা আবার আগের মতো ভালো থাকবে, তাইনা? মাত্র দুটো দিন আমি এসেছি অথচ দেখ অশান্তি, কলহ আমার পিছুই ছাড়ছে না। আমি চলে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে, তাইনা?
– ধুর পাগলী, কি যে বলো! সমস্যা থেকে পালালেই কি সমস্যা দূর করা যায়? সমস্যার সাথে মোকাবেলা করতে হয়। সব ঠিক হয়ে যাবে ধৈর্য ধরো।
আর হ্যা তোমার ছোট ননদটার বিয়ে কিন্তু প্রায় পাকা, সবটা কিন্তু তোমাকেই সামলাতে হবে দক্ষ হাতে।
– আমি এসব পারি নাকি!
– কেন পারবেনা, ভাবি বলে কথা!
– হুম।

রাহাত অনেকক্ষন হলো বাহিরে বেরিয়েছে, বন্ধু – বান্ধবের সাথে দেখা করতে গেছে হয়তো। কিছুই ভালো লাগছে না আমার, ডাইরিতে কিছু কথা লিখলে মন্দ হয়না। খারাপ সময়ে ওই তো একমাত্র বন্ধু আর নিজেকে খুব ভালো করে জানার চাবিকাঠি। মানুষ সবাইকে ঠকাতে পারে, মিথ্যে বলতে পারে, ছলনা অভিনয়ে ভোলাতে পারে কিন্তু নিজেকে না। ডাইরি একটা স্মৃতির বাক্স, যেখানে যত্নে স্মৃতি তোলা রয় কথামালায়।
পরম বন্ধুর মতোই দুঃখ, না পাওয়া যন্ত্রনার কথা ঠাই দেয় নিজের বুকে। দু’এক লাইন লিখতে বড্ড ইচ্ছে করলো। লিখতে বসে পড়লাম।
” নতুন কোথাও আজ আমি,
নতুন এক ঘর..
নতুন ঘরে সবাই আপন,
আমিই শুধু পর। ”
” তোমার মাঝেই কি হারিয়ে যাচ্ছি পুরোটা,
নাকি পথ আটকাচ্ছে তোমাদের ঐ চাহনিটা!
স্বপ্নগুলোই কি তবে দিচ্ছে পথে বাঁধা ;
ভালোবাসা পাবার লোভ বাড়ছে কি সদা!”
” নিকষকালো আঁধারে আলো খুঁজি রোজ,
অন্ধকার আঁকড়ে ধরে নাও না কেন খোঁজ?”
লিখতে লিখতে মনটা কালো মেঘে ঢেকে গেল, আর লিখতে পারবো না আজ। ডায়রিটা বরং যত্নে তুলে রাখি, কখনো আবার ধুলো মুছতে মুছতে কথা হবে।

ননদিনী নিজের ঘর থেকে চিল্লাতে চিল্লাতে আমাদের ঘরে ঢুকল
– ভাবি, ভাবি, কখন থেকে ডাকছি তোমাকে। তোমার কোন সাড়া শব্দ নেই। কি করছ একা একা ঘরে?
– কই কিছুনা, বলো কি বলবে?
– ভাবি, তুমি কি আমাদের ছেড়ে চলে যাবে?
– কেন? কে বলেছে?
– ছোট্ট ভাইয়া আর বড় ভাইয়া বলছিল।
– আরে না , পাগলী। কই যাবো আমি! কোথাও যাচ্ছি না তোমাদের ছেড়ে।
– তাহলে আমার সাথে লুডু খেলবে? অনেকদিন খেলি না, চলো না ভাবি। প্লিজ…
– আচ্ছা, তুমি যাও আমি আসছি।
রাহাতের ছোট বোন রুমি, দেখতেও ভীষণ ভালো আর মনটা তার চেয়েও ভালো। একদম বাচ্চা মেয়েদের মতো এখনও বায়না করে। কেমন যেন একটা সরলতা আছে ওর মধ্যে যা সবসময় আকৃষ্ট করে ওর দিকে মানুষকে। সবচেয়ে বড় গুন, প্রায় সবসময়ই হাসি লেগে থাকে ওর মুখে, মানুষকে খুব সহজেই আপন করে নিতে পারে মেয়েটা। ওর কথা ভাবতে ভাবতেই ওর ঘরে গেলাম, ও তো লুডু নিয়ে বসে গেছে একদম।
– কি খেলবে?
– ভাবি নাও আমরা সাপ খেলি, খুব মজা হবে সাপের ছোবল আর খেলা।
– আচ্ছা, বের করো৷
একটা কথা আছে না
“অভাগী যেদিকে যায় সাগর শুকিয়ে যায় ”
আমার হয়েছে সেই দশা। আমারও কিছুর প্রয়োজন পড়ে না আর সেটারও আকাল পড়ে না! যেখানে ছয় নয় মাত্র একের দরকার সেখানে একেরই দেখা নেই! অনেক অপেক্ষার পরে একের দেখা মিলল বটে তবে সাপ বাবাজি আমার উপর যা রেগে আছে তা আর কি বলবো, মনে হচ্ছে যেন কোন জন্মের প্রতিশোধ নিচ্ছে! যতই সাপগুলোকে পেরিয়ে যেতে চাচ্ছি ততই ওরা খপাৎ করে ধরে মুখ থেকে সোজা লেজে চালান করে দিচ্ছে! কিসের এতো শত্রুতা আমার সাথে কে জানে! শেষপর্যন্ত সাপগুলো জোট বেঁধে আমাকে হারতে বাধ্য করলো! আর সাহস হলোনা নতুন করে আবার সাপের সাথে যুদ্ধ করার। রুমিকে বললাম, আজ এ পর্যন্তই থাক, পরে আবার খেলব। আচ্ছা এবার বলোতো, তোমার নাকি বিয়ে পাকা প্রায়! কথাটা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে গেল মেয়েটার মুখ, মুখে কিছুই বলতে পারল না। আমিও আর জোড় করলাম না এই বিষয়টা নিয়ে, সব ভালো হলেই ভালো। বিয়েটা হয়তো আমি দেখতেও পাবো না, কার ভাগ্যে কি আছে কে জানে! অবশ্য রাহাতদের আত্নীয়রা প্রায় সবাই জেনেই গেছে আমাদের বিয়ের ব্যাপারটা। এসব কথা বাতাসের আগে ছোটে, একান থেকে ওকান, ওকান থেকে সেকান, সেকান থেকে একান। একজন আরেকজনকে ফিসফিসিয়ে বলে, শেষে বলেও দেয়, কাউকে বলো না যেন আবার! তবুও কথাটা ছড়ায় অনেকটা বাতাসের গতির মত। আর এই অবস্থায় আমি বাড়িতে না থাকলে মা’কে অনেকের মুখোমুখি হতে হবে আর থাকলেও হবে। তবে শাশুড়ি’মা যে কি ঠিক করবেন তা উনিই জানেন।

(চলবে…)
কামরুন নাহার স্মৃতি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে