মৃত্যু পথযাএীর এক ডায়রি

0
649
এই নিয়ে তিনবার স্ট্রোক করলাম । ছেলেটা আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে ঠিকই ; কিন্তু ডাক্তাররা আমাকে হাসপাতালে রাখে নি । বলেছে,”বাড়িতে নিয়ে যান ; আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে যাবেন তিনি ।” কিন্তু আমি জানি আমি আর সুস্থ হবো না । হাত পায়ে বোধ নেই ; প্যারালাইজড হয়ে গেছে । শুধু চোখ দিয়ে দেখতে পারি ; কে কি বলে হালকা শুনতে পারি কিন্তু মুখ দিয়ে কিছুই বলতে পারি না । হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে আমাকে । বিছানায় শুয়ে দেওয়া হল আমাকে । তরল খাবার ছাড়া কিছুই খেতে পারি না । নাকে একটা নল ফিট করে দিয়েছে ডাক্তাররা । সেটা দিয়েই খাবার দেওয়া হয় আমাকে । বিকালের সূর্যে রং ধরেছে । জানালা দিয়ে শেষ বিকালের আলো আমার মুখে এসে পড়ছে । আস্তে আস্তে পশ্চিমে হারিয়ে গেল সূর্যটা । আমার কাছে কেন যেন মনে হল আর কোনদিনও সূর্যটাকে দেখতে পারবো না । সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে ।
আমার নাতি নাতনীরা সবাই বাড়ির উঠানে হৈ-হুল্লোড় করছে । খুব ইচ্ছে করছে ওদের সাথে কথা বলতে । গতবার ওরা যখন ঈদে আসছিলো তখন ওদের সাথে এই সন্ধ্যাবেলাতেই কানামাছি খেলেছিলাম । কিন্তু আজ শত ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও এক চুল নড়তে পারছি না জায়গা থেকে । মাগরিবের আযান দিল । ইশারায় নামাজটা আদায় করে নিলাম । নামাজের পর সবাই আসলো আমার রুমে ; আমাকে দেখতে । সবাই আফসোস করতে লাগলো,”আহারে, কিছুদিন আগেও তো উনি সুস্থ ছিলেন । আর আজ কারো সাথে কথা বলতে পারছেন না, নড়তেও পারছেন না ।” আমার ছোট মেয়েটা আমাকে অনেক ভালোবাসে । আমার হাত ধরে কাদঁতে কাদঁতে বলল,”বাবা, আমাকে মাফ করে দিও ; কত বেয়াদবি করেছি তোমার সাথে ।” ওর কান্না দেখে আমারও কান্না চলে আসলো । খুব বলতে ইচ্ছে করলো,”ধুর পাগলি,তোর কোন বেয়াদবির কথা আমি মনে রেখেছি নাকি ।”
আমার ছেলে, মেয়ে ,নাতি ,নাতনী ছাড়া বাকি সবাই কিছুক্ষণ পর চলে গেল । এশারের আযান হলো । আমি নামাজ পড়ে নিলাম । নামাজের পর সবাই খেতে বসলো । গরুর মাংশ রান্না হয়েছে আজ । এটা আমার সবচেয়ে প্রিয় খাবার । কিন্তু এখন সেটা খাওয়ার মতো কোন সামর্থ্য নেই আমার । নল দিয়ে আমার মুখে খাবার দেওয়া হলো । ঘড়িতে ১০টা বাজলো । সবাই শুয়ে পড়েছে । আমার সাথে আমার বড় মেয়ে আর ছোট মেয়ে ঘুমিয়েছে । জানালা দিয়ে হালকা চাঁদের আলো আসছে । ঝিঁ ঝিঁ পোকারা ডাকছে । একটুও ঘুম আসছে না আমার । বাহির তাকালাম সারিবদ্ধভাবে গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে । সব আমার হাতে লাগানো । ছোটবেলার কথা খুব মনে পড়ছে । অনেক দুষ্ট ছিলাম ছোটবেলায় । দুষ্টামির জন্য বাবার হাতে কত মার খেয়েছি । পড়াশুনায় ভালো ছিলাম বলে স্কুলে, কলেজে সবার প্রিয় ছিলাম । তারপর চাকরি করলাম । বাবা মারা যাওয়ার পর নিজেই সংসারের দায়িত্ব নিলাম । বাবা আমার বিয়েটা দেখে যেতে পারেন নি । পাশের গ্রামের শিউলিকে বিয়ে করলাম । যেমন সুন্দর তেমনই ভদ্র ছিলো আমার বউটা । সংসার জীবন সুখেই কাটছিলো । কিন্তু মা মারা যাওয়ার পর আবার এলোমেলো হয়ে গেল সবকিছু । কিন্তু শিউলি সব সুন্দরভাবে সামলে নিয়েছিলো । বছরখানেক আগে শিউলিও আমাকে ছেড়ে চলে গেল । ওর চিন্তায়ই হয়তো তৃতীয়বার স্ট্রোকটা করলাম ।
চোখটাকে একটু নিচের দিকে নামিয়ে দেখলাম মুখে লম্বা লম্বা সাদা দাঁড়ি । বয়স নেহাৎ কম হয় নি । কিন্তু জীবন নিয়ে এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে টেরই পাই নি কখন জীবনে অন্তিমক্ষণ চলে এসেছে । যখন যৌবন ছিল শরীরে শক্তি ছিল তখন পরকালের জন্য কিছুই করি নি । নামাজ পড়ি নি ঠিক মতো ; রোযা রাখি নি; মসজিদে যাই নি । আর এখন প্রবল ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও কিছু করতে পারছি না । নাকের ডগা খুব চুলকাচ্ছে । কিন্তু আমারতো হাত নাড়ানোর ই সামর্থ্য নেই । অনেক পানি পিপাসা পেয়েছে । আমার অনেক পানি দরকার এখন । কাকে ডাকবো ? আমার পাশেই তো আমার মেয়েটা শুয়ে আছে । কিন্তু ওকে ডাকার মতো একটু ক্ষমতাও নেই আমার । হঠাৎ কে যেন আমার বুকে চেপে বসলো । দম আটকে আসছে আমার ; খুব কষ্ট হচ্ছে ; বুক ফেটে যাচ্ছে । এত ব্যথা, যন্ত্রণা জীবনে কখনও পাই নি । ছোটবেলা থেকে এই পর্যন্ত করা আমার সমস্ত ভালো কাজ, খারাপ কাজ চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে উঠছে । গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল আমার । আমি ছাড়া আর কেউ দেখছে না তো আমার কুকর্ম ? আস্তে আস্তে আমার নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসলো । শেষ নিঃশ্বাস বের হওয়ার অপেক্ষায় আমি । আল্লাহ্ আমাকে আর একবার সুযোগ দেও তোমার সব কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবো । নাহ, আর সহ্যই হচ্ছে না কষ্টটা , এত যন্ত্রণা । শেষ নিঃশ্বাসটা বেরিয়ে গেল আমার । বিছানায় পড়ে রইলো আমার নিথর দেহটা । ( মৃত্যুপথযাত্রী এক ব্যক্তির ডায়েরী )

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে