কাচের আয়না

0
965
“আপনার কপালের কাটাঁ দাগ টা কবের?” হঠাৎ কথাটা শুনেই, অরুণী নিজের অজান্তেই হাত দিয়ে কপালের কাটাঁ দাগ টা ছুঁয়ে দেয়। এক রাশ বিরক্তিকর ভাব নিয়ে ছেলেটার দিকে তাকায় অরুণী। ছেলেটা বাসের হ্যান্ডেল ধরে হেলান দিয়ে অরুণীর দিকে হাসিমাখা মুখে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। যেনো শত বর্ষ অপেক্ষার পর এই চোখে সে তাকাতে পেরেছে। ধূসর রঙের পাঞ্জাবী,আর ময়লা জিন্স সাথে কম দামী একটা কালো চাদর গায়ে জড়িয়ে আছে। পায়ে এক জোড়া স্যান্ডেল যা অনেক জায়গায় ছিড়েঁ যাওয়াতে সেলাই করা হয়েছে। তবুও যেনো ছেলেটার দিকে তাকালে এক রাশ মুগ্ধতা কাজ করে। হয়ত তার স্নিগ্ধকর সেই হাসির জন্যই। অরুণী হাতের বাম পাশ দিয়ে চুল গুলো ছেড়ে দেয় কপালের কাটাঁ দাগে। ছেলেটা আবারো বলে উঠে, “আপনার কানের উল্টো পাশের তিল টাও সুন্দর।” এইবার অরুণীর বিরক্তিভাব যেনো সহস্র গুণ বেড়ে যায়। ছেলেটাকে কিছু বলতে যেয়েও কিছু না বলে চুপ করে যায়। কথা বললেই কথা বাড়বে এতে আরো সমস্যার সৃষ্টি হবে এই ভেবে।
তাই বাসের জানালা দিকে তাকিয়ে থাকে অরুণী। পরের স্টপেই নেমে যাবে এই ভেবে। নেমে যাবার সময়ও ছেলেটা একই ভাবে অরুণীর দিকে তাকিয়ে থাকে যেনো সেই অপেক্ষার প্রহর আজও শেষ হলো না। . “আপনার হাতের কাচেঁর লাল চুড়িগুলো খুব সুন্দর।” অরুণী নিজের হাত দুখানা ওড়নার নিচে গুটিয়ে নিয়ে পেছনে তাকিয়ে সেই হাসিমাখা মুখ খানা দেখতে পায়। গতকাল ছেলেটা যেইভাবে দাঁড়িয়ে ছিলো আজও সেইভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশে তাকিয়ে অরুণী নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে আজও। অরুণীর পাশের সিট টা ফাকাঁ থাকা সত্ত্বেও ছেলেটা দাড়িঁয়ে আছে। অরুণী পরের স্টপে নেমে যায় আজ আর পেছনে ফিরে তাকায় না অরুণী। কিন্তু নেমে রাস্তায় দাড়াঁতেই বাসের জানালায় ছেলেটাকে দেখতে পায় অরুণী। ঠিক সেই সিট টাতে বসেছে যেখানে অরুণী বসে ছিলো। অরুণী বাড়ি ফেরার পথে হাটঁতে হাটঁতে এই চিন্তা করে যে দুইদিনের বিষয়টা কি শুধুই কাকতালীয় ছিলো? নাকি ছেলেটা অরুণীর জন্য অপেক্ষা করতো? আর অপেক্ষা করলেই বা কি? অরুণী তো পছন্দ করার মত কোনো মেয়ে নয়। কপালে কাটা দাগ,মুখে অজস্র ব্রণের দাগ। গায়ের রঙ টাও নাকি ময়লা অরুণীর। আচ্ছা গায়ের রঙ ময়লা হয় কিভাবে? গায়ের রঙ ও যদি দেয়ালের রঙয়ের মতো পরিবর্তন করা যেতো তাহলে হয়ত অরুণীর মা আর আত্মীয়স্বজন দ্বারা এতদিনে তা পরিবর্তন হয়ে যেতো। তবুও যেনো কোনো এক অজানা কারণে অরুণীর ভালো লাগে ছেলেটার কথা ভেবে। কিন্তু ছেলেটা তো একবার ও বলেনি অরুণী সুন্দর তবুও কেনো অরুণীর ভালো লাগছে ছেলেটার কথা ভেবে? আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে অনেকক্ষণ অরুণী। .
“কপালের মাঝে একটা কালো টিপ পড়তে পারেন না? সাথে চোখে গাড় করে কাজল দিবেন খুব মানাবে আপনাকে।” কথাগুলো শুনে আজ যেনো অরুণীর বুকের ধুকপুকুনিটা হাজার গুণ বেড়ে যায়। ছেলেটা আজও ঠাইঁ দাঁড়িয়ে আছে হেলান দিয়ে একই ভাবে। অরুণী কিছু বলতে যেয়েও কিছু বলতে পারে না গলা শুকিয়ে আসে তার। দেখতে দেখতে অরুণীর স্টপ এসে যায়। কিন্তু কেনো যেনো অরুণীর নামতে ইচ্ছে হয় না। মনে হয় আরো ঘন্টাখানিক যদি বসে থাকা যেতো। বার কয়েকবার কিছু বলবে ভেবেও বলা হয় না, নেমে যায় অরুণী বাস থেকে। বাস থেকে নেমেও অরুণী ভাবে, ছেলেটাও যদি হাটঁতো তার পাশে হাত ধরে। কল্পনা করেই অরুণীর মুখে লজ্জামাখা হাসির অবয়ব দেখা যায়। .
আয়নায় দাড়িঁয়ে নিজেকে শেষবারের মতো দেখে নিয়ে বের হয়ে যায় অরুণী। লাল শাড়ি পড়ে বাসে উঠে আগেই ছেলেটাকে খোজেঁ অরুণী। কিন্তু চারপাশে দেখতে পায় না তাকে। অরুণীর চোখে পানি চলে আসে। বাসের শেষ স্টপ না আসা পযন্ত অরুণী বসে থাকে। হয়ত সে আসবে না আজ? হয়তবা আজ সে বাসে উঠতে পারেনি? ছয় পাঁচ ভাবতে ভাবতে অরুণী তার হাতের কাচেঁর চুড়ি গুলো চাপ দিয়ে ভাঙ্গতে থাকে। চোখের গাড় কাজল ও চোখের পানিতে ছড়িয়ে গাল বেয়ে কালো পানি নেমে আসে। কপালের কালো টিপও যেনো কোথায় পড়ে গিয়েছে। রাতের নিয়ন বাতির আলোতে অরুণী এলোমেলো পায়ে হেটেঁ এগিয়ে যাচ্ছে বাড়ির উদ্দ্যেশে। লাল শাড়ির আচঁল মাটি ছুঁয়ে যাচ্ছে অরুণীর। কেনো সে এলোনা আজ? আচ্ছা সে কি ইচ্ছে করেই আসেনি? অরুণী নিজেও ভেবে পাচ্ছে না তার এতটা কেনো কষ্ট লাগছে? সে তো বলেনি সে আসবে? তবুও অরুণীর মনে হচ্ছিলো আর সে সেই ঝাঁঝালো কন্ঠস্বর শুনতে পাবে না,পারবে সেই স্নিগ্ধকর হাসি আর অপেক্ষাকৃত দৃষ্টি দেখতে। রোজ বাস স্টপে দাড়িঁয়ে অরুণী অপেক্ষা করে সেই অজানা নাম না জানা ছেলের জন্য। মধ্যেরাতে কাঁচের আয়নায় তাকিয়ে থাকে যেনো অপর পাশ থেকে হঠাৎ কেউ একজন বলে উঠবে তোমার কাটাঁ দাগ টা কবের? কিছু মানুষ হয়ত দুদিনের পরিচয়ে হৃদয়ে আচঁড় কেটে যায় যা সারাজীবনের পরিচয়েও হয় না। সকল মানুষ এক হয়না।ভিন্নতা মানুষের মধ্যে থাকবেই এটাই স্বাভাবিক প্রকৃতির নিয়ম। “অণুগল্প” “কাঁচের আয়না” লেখা : Onanna Omi

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে