মায়াবন বিহারিনী পর্ব – ০৪

0
961

#মায়াবন বিহারিনী🖤
#৪র্থ পর্ব
#ফাহমিদা চৌধুরী

কে হই ওইলোক তার দুইদিন পর তো আলাদা হয়ে যাবে এইভেবে মায়া নিজেকে সামলে নেই। সেইদিনের মতো আর মায়া রাহিদের আশেপাশে যায়নি। এভাবে কেটে যায় একমাস। ফাবিহা দুইদিন থেকে চলে যায় বাড়িতে।রাহিদ ও মায়াকে বুঝতে শুরু করে দিয়েছে।সে মায়াকে যথেষ্ট সময় দেয়। বদলায়নি শুধু মায়া সে আগের মতোই রাহিদ কে এড়িয়ে চলে কিন্তু রাহিদ মায়ার প্রতি আরো দুর্বল হয়ে পরছে। সেইদিন আশিকের বলা কথাগুলোর পর রাহিদ অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নেয় সে এই সম্পর্ককে আরেকটা সুযোগ দিবে। মায়ার সাথে অনেক অন্যায় হয়েছে আর না। সে এবার নিজেই মায়ার সাথে সারাজীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বর্তমান রাহিদ অফিসে বসে ভাবছে মায়াকে সে সবটা বলবে তাজরির ব্যাপারে, আর কোনো কথা গোপন রাখবে না। মায়াকে কষ্ট দেওয়ার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিবে।অতীত ভুলে নতুন করে মায়ার সাথে সব শুরু করবে। বিয়েটা সে মেনে নিয়েছে এখন শুধু মায়ার কাছে স্বীকার করা বাকি। এবার আর কোনো ভুল বুঝাবুঝি থাকবে না তাদের সম্পর্কে। ভেবেই মুচকি হেসে উঠে রাহিদ। মায়া কি রাহিদকে বুঝবে কথাটা মাথায় আসতেই রাহিদের মন খানিকটা নড়ে উঠে। আবার চিন্তিত হয়ে বসে থাকে। যেকোনো ভাবেই মায়াকে রাহিদ নিজের করে নিবেই। যতই কষ্ট হোকনা কেন। রাহিদ দ্রুত কাজ শেষ করে বেড়িয়ে পরে বাড়ির উদ্দেশ্যে। গাড়ি নিয়ে যাওয়ার সময় কিছু লাল ঠকঠকে গোলাপ এবং চকলেট কিনে নেয়। যাতে মায়ার রাগ ভাঙাতে পারে।
অপরদিকে মায়ার শাশুড়ী মুখ গোমড়া করে বসে আছে। আর মায়ার শশুর তার শাশুড়ীকে বকা দিচ্ছেন। আগেই বলেছিলাম ছেলের এমন ভালো ব্যবহারের কারণটা জানতে কিন্তু তুমি উল্টো মায়াকে বুঝ দিয়ে চলে এলে। (মায়ার শশুর)
সব দোষ কি এখন আমার। আমি তো জিজ্ঞেস করেছিলাম মায়ার কাছ থেকে কিন্তু সে আমায় এই ব্যাপারে কিছুই বলে নি। একপ্রকার এড়িয়ে গেছে ব্যাপারটা। (মায়ার শাশুড়ী)
ব্যাপার টা এড়িয়ে গেছে বলে তুমি আর জোর করে জানতে চাওনি তাই না? (মায়ার শশুর)
মায়া যখন আমার কাছ থেকে ব্যাপার টা এড়িয়ে যাচ্ছে তাই আমি মনে করেছি ওদের মধ্যে সবটিক হয়ে গেছে এই আরকি।(মায়ার শাশুড়ী)
বাহ আজ তোমার এই বোকামির জন্য মেয়েটা কষ্ট নিয়ে চলে গেছে সারাজীবনের জন্য। আর‍ যায়হোক তুমিতো জানতে মায়া কেমন ধরনের মেয়ে। সে নিজের কষ্টের কথা কেউকে মুখ ফোটে বলে না যতই কষ্ট পাক না কেন। (মায়ার শশুর)
হুম খুব বড় ভুল হয়েছে আমাদের দ্বারাই। রাহিদ যেহেতু বিয়েটা করতে চাইনি আমাদের উচিত ছিলো তাকে বিয়েটা না করানোর। কিন্তু এখন তার জন্য মায়ার সাথে ও অনেক বড় অন্যায় হয়েছে। (মায়ার শাশুড়ী)
সব তোমার ওই বেয়াদব ছেলের জন্য হয়েছে। না জানি মেয়েটা এখন কেমন আছে কোন পরিস্থিতিতে আছে, চিন্তিত হয়ে বলছে মায়ার শশুর।
মায়া এখন নিজের রুমে বসে আছে। আজ কেন যেনো চোখের অবাধ্য জলগুলো বেড়িয়ে এসেছে। এতক্ষণে তার চিবুক ভিজে গিয়েছে নোনাজলে। দুপুরের পর মায়া রাহিদের জন্য একটা চিঠি লিখে তার রুমের ছোটো টেবিলের উপর রেখে ব্যাগ নিয়ে বেড়িয়ে পরে।তার শশুর শাশুড়ীর রুমে গিয়ে দেখে তারা বেঘোরে ঘুমোচ্ছে তাই তাদের আর ডাকেনি নিজের গন্তব্য অনুযায়ী পা বাড়ায়। সন্ধ্যার দিকে নিজের বাড়ি পৌছায় মায়া। অনেকদিন পর নিজের মেয়েকে বাড়িতে আসতে দেখে তার মা খুশিতে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে। এরপর মায়া তার বাবার কাছে যায় মায়ার বাবা একমাত্র মেয়েকে দেখে পরম যত্নের সাথে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নেয়।মায়া ও তার বাবার বুকে কিছুক্ষণ চুপটি হয়ে বসে থাকে। বেশকিছু সময় কেটে যাওয়ার পর মেয়েকে নিজ থেকে ছাড়িয়ে বলে যাও অনেকদূর থেকে এসেছো ফ্রেশ হয়ে নাও। আর রাহিদ আসে নি তোমার সাথে? সে কই তাকে দেখছিনা কেন?
মায়ার উদ্দেশ্যে বলে তার বাবা। মায়া তার বাবার কথায় কিছুটা ভড়কে উঠে এরপর শান্ত গলায় বলে বাবা উনার অফিসে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে এইজন্য আসেনি। বাবাকে কিছু বলতে যাবে অমন সময় মায়া আবারো বলে উঠে “বাবা আমি ফ্রেশ হয়ে আসি ”
এইবলে বাবার রুম থেকে বেরিয়ে পরে মায়া। রুমে বসে কথাগুলো ভাবছিলো মায়া। মায়ার এভাবে চলে আসার জন্য খারাপ লাগছে। না জানি তার শশুর শাশুড়ী তাকে কি মনে করে। তাদেরকে বলে আসা উচিৎ ছিল। চোখমুছে মায়া তার মায়ের কাছে চলে গেলো মায়ের সাথে থাকলে কষ্ট টা একটু কমবে।
রাহিদ ঘরে এসে দেখে সবকিছু একদম ঠান্ডা। ড্রইংরুমে কেউ নেই হয়তো সবাই নিজের রুমে। এইভেবে রাহিদ কিচেনে গেলো উদ্দেশ্য মায়াকে রুমে নিয়ে যাওয়ার কিন্তু রান্নাঘরে গিয়ে দেখে কেউ নেই। হয়তো মায়া রুমে আছে তাই রাহিদ দৌড়ে নিজের রুমে চলে যায়। রুমের দরজা খুলে রাহিদ ভেতরে প্রবেশ করে দেখে রুমে কেউ নেই রুম একদম গোছানো। রাহিদ মায়াকে ডাক দেই কোনোসাড়া পায়না তাই রাহিদ ওয়াশরুমে গিয়ে মায়াকে খোঁজে, বারান্দায় গিয়ে দেখে ওখানেও নেই। এবার রাহিদ তার বাবা মায়ের রুমে গিয়ে দেখে তার বাবা মা চিন্তিত হয়ে বসে আছে। সে তার মায়ের কাছে গিয়ে মায়ার কথা জিজ্ঞেস করতেই তার বাবা এসে তার গালে থাপ্পড় বসিয়ে দেই। সে গালে হাত দিয়ে তার বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। তার এখনো বোধগম্য হচ্ছেনা তার বাবা তাকে কেন হঠাৎ এভাবে থাপ্পড় দিলো মায়ার কথা জিজ্ঞেস করাতেই।

রাহিদের বাবা ছেলের দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে। রাহিদ তার বাবাকে শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করে বাবা এভাবে আমায় থাপ্পড় দিলে কেন কি অপরাধ আমার? রাহিদের এমন কথায় তার বাবা আরে ফুসে উঠে যেন, এই বেয়াদব ছেলেকে আরে দুইটা থাপ্পড় দিলে ভালো হতো। তিনি উঠে মায়ার চিঠিটা রাহিদের হাতে দিয়ে বলে দেখো এখানে কি আছে।আমার ভাবতে ও খারাপ লাগে আমি তোমার মতো একটা বেয়াদব ছেলেকে জন্ম দিয়েছি। আজ তোমার জন্য মায়া চলে গেছে। সে আর কখনো ফিরবে না এই বাড়িতে। রাহিদের কাছে তার বাবার কথাটা যেন বজ্রপাতের মতো লাগলো। কি বললো বাবা, মায়া চলে গেছে একেবারের জন্য তাকে ছেড়ে! এইবাড়ি ছেড়ে! কথাটা মনে আসতেই রাহিদ বাকশুন্য হয়ে পরে। তার হাত কাপছে অস্বাভাবিক ভাবে কাপা কাপা হাতে সে চিঠিটা খুললো। খুলেই গোটা গোটা অক্ষরের লিখা ভেসে উঠলো
প্রিয়
চিঠিতে প্রিয় বলে সম্বোধন করলাম এইজন্য, কারন আপনি কখনো আমার অপ্রিয় ছিলেন না। আমাদের সম্পর্কের একমাসের ও বেশি সময় হয়ে গেছে তার সাথে আমাদের ডিভোর্স এর সময় ও ঘনিয়ে এসেছে।তাই আমি চলে যাচ্ছি একেবারে আপনার জীবন এবং বাড়ি থেকে। আমি পারবো না বাবা মায়ের সামনে দাড়াতে তাই এই পথ অবলম্বন করা। যদি কখনো কোনো ভুল হয়ে থাকে তাহলে ক্ষমা করে দিবেন। আর বাবা মা কে বুঝিয়ে আপনার ভালোবাসা কে বিয়ে করে নিবেন। বাবা মাকে দেখে রাখবেন। ভালো থাকবেন।
ইতি
মায়া।
চিঠিটা পরে রাহিদের মুখ থেকে কোনো কথায় বের হচ্ছে না। বুকের ভেতর বড্ড ব্যাথা অনুভব হচ্ছে। বারংবার মনে হচ্ছে মায়া তার জন্য আজ চলে গেছে। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। সে তো এমন চাইনি সে তো মায়ার সাথে নিজের বাকি জিবনটুকু কাটিয়ে দিতে চেয়েছিলো।কিন্তু সেই মায়া তাকে অপরাধী করে চলে গেলো কেন করলো মায়া এমন। তাকে একটাবার বললে কি হতো। রাহিদের বাবা রাহিদকে উদ্দেশ্যে করে বলে এবার বুঝেছো তোমার অপরাধ? আগে যদি এমন হবে জানতাম তাহলে মায়ার মতো মিষ্টি মেয়েকে কখনো তোমার বউ করে আনতাম না। রাহিদ তার বাবার দিকে তাকিয়ে বলে বেশ দোষ যেহেতু আমি করেছি আমিই মায়াকে এই বাড়িতে ফিরিয়ে আনবো। কালকের মধ্যে সবঠিক করে দেবো আমি। দেখো বাবা কালই মায়া এই বাড়িতে ফিরে আসবে। আমি মায়াকে তার প্রাপ্য সম্মান দিয়ে এই বাড়িতে ফিরিয়ে আনবো এই বলে রাহিদ নিজের রুমে চলে গেলো। রুমে গিয়ে দরজা লক করে দিলো। টেবিলের উপর চোখ পরতেই দেখে মায়ার জন্য আনা গোলাপ আর চকলেট। রাহিদ সেগুলো হাতে নিয়ে বিরবিরিয়ে বলে, কেন?
কেন এভাবে ছেড়ে চলে গেলেন মায়াবতী? আমি তো আজ সব ঠিক করতেই এসেছিলাম তবে কেন আমাকে বাবা মায়ের কাছে অপরাধী বানিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। একটাবার ও আমার দিকটা ভাবলেন না, আমি কিভাবে আমার মায়াবতীকে ছেড়ে থাকবো, কিভাবে বলতেই রাহিদের চোখ থেকে দুফোঁটা দুর্বোধ্য অশ্রু ঝরে পরে। রাহিদ নিজের চোখ মুছে শুয়ে পরে আর মোবাইলে মায়ার ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছে যেখানে মায়া বারান্দায় হাত বাড়িয়ে মুখে মিষ্টি হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাহিদ মায়াকে এই অবস্থায় দেখে তার মোবাইলে ছবি তুলে ফেলে মায়ার দৃষ্টি অগোচরে । রাহিদ এখন সেই ছবির দিকে তাকিয়ে আছে আর বলে আমি আপনার ভুল ধারণা ভেঙে আপনাকে আমার কাছে ফিরিয়ে আনবো মায়াবতী, আনবোই। এই বলে চোখ বন্ধ করে নেয় রাহিদ।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে