মনের গহীনে স৷ পর্ব-০৭

0
680

#মনের_গহীনে_সে ❤️
#পর্ব-৭
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
মাঝরাতে সকলের আড়ালে নিজের প্রেয়সীকে একপলক দেখার তীব্র আকাঙ্খায় তার কক্ষে ছুটে যায় আরহাম। মেহেভীন তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আরহাম মেহেভীনের পাশে বসে, মেহেভীনের চুলে পরম যত্নে বিলি কেটে দিচ্ছে মেহেভীন পুনরায় আরহামের হাতখানা শক্ত করে আকড়ে ধরে, যেন ঘুমের মাঝে সে কাউকে শক্ত করে আকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে চাইছে, কিন্তু সে কে? সেই প্রশ্নের উত্তর হয়তো মেহেভীন স্বপ্নে কিংবা বাস্তবে কোথাও সঠিকভাবে পাচ্ছে না। আরহাম মেহেভীনের হাত নিজের বুকে ঠেকিয়ে আনমনে আওড়ায়, ‘ আর কতদিন এইভাবে তোমাকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে রাখবো প্রেয়সী? আমার যে কষ্ট হচ্ছে। আচ্ছা তোমারও কি আমার জন্যে কষ্ট হয়? ‘
ঘুমন্ত মেহেভীনের থেকে কোনরুপ উত্তর না পেয়ে আরহাম দীর্ঘ নি:শ্বাস ফেলে। জানালার থেকে আবছা চাঁদের আলো এসে মেহেভীনের মুখস্রীর সৌন্দর্যকে দ্বিগুনভাবে তুলে ধরছে আরহামের পানে। আরহাম খানিকটা স্মিত হেসে ফের বলতে লাগলো,
‘ আমি বড্ড স্বার্থপর প্রেয়সী, ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও, তোমাকে একপলক দেখার জন্যে নিজের বাড়িতে জোড় করে রেখে দিয়েছি, কিন্তু কি করবো বলো? তোমাকে না দেখে থাকার বেদনা অসহ্যনীয়, তা আমি ক্ষনে ক্ষনে উপলব্ধি করেছি, যখন শুনেছি তুমি নাকি অভ্রকে ভালোবাসে, তোমাদের বিয়েও ঠিক। আমি মেনে নিতে পারি নি। স্বার্থপর হয়ে পরেছিলাম, আমি সত্যিই চাইনি তুমি কোনভাবে কষ্ট পাও, কিন্তু কি করবো বলো?’

আরহাম হয়তো আরো কিছু বলতে চেয়েছিলো কিন্তু পরক্ষনে দমে গেলো। হৃদয়ে জমে থাকা কিছুর কথা যেন পরক্ষনে আবডালে চলে গেলো। ভিতর থেকে কথাগুলো মুখে প্রকাশ পেলো না। নিরব হয়ে গেলো আরহাম।

মায়রা পানি খাওয়ার জন্যে নিজের ঘর ছেড়ে, নীচের দিকে যাচ্ছিলো, কিন্তু মেহেভীনের কক্ষের সদর দরজা খুলে থাকায়, সে উঁকি দিয়ে দেখতে পায়, আরহাম এবং মেহেভীনের ভালোবাসার দৃশ্য। অসহায়ভাবে তাঁকিয়ে থাকলো সে। আখিজোড়া কেমন ভেঁজা লাগছে তার। সে দ্রুত নিজেকে নিয়ন্ত্রন করে নীচের দিকে চলে গেলো। আরিয়ান ড্রইং রুমে বসে কফি খেয়ে, ল্যাপটপ নিয়ে বসে ছিলো। মায়রাকে হন্তদন্ত হয়ে বেড়িয়ে আসতে দেখে, উপরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, ‘ উপর থেকে ছুটতে ছুটতে আসছো কেন? ইজ এভ্রিথিং ওকে? ‘

মায়রা কিছুটা হচকিয়ে যায় আরিয়ানের প্রশ্নে। কন্ঠে মলিনতা এনে উত্তর দেয়, ‘ পানি খেতে এসেছিলাম। বড্ড পানি পান করতে ইচ্ছে করছে। ‘

আরিয়ান তীক্নভাবে মায়রার দিকে তাঁকালো। মায়রা নিজের নজর নিচের দিকে রেখেই রান্নাঘরে চলে যেতে নিলে, আরিয়ানের একটি কথা শুনে থেমে যায়। আরিয়ান পুনরায় সোফায় বসে, মায়রাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলো, ‘নিজেকে ভাইয়ার সত্যিকারের বউ ভেবে ফেলো না আবার, ভুলে যেও না। সবকিছুই নাটক। ‘

আরিয়ার কথায় মায়রা তড়িঘড়ি করে আরিয়ানের কাছে গিয়ে, কন্ঠে কাঠিন্যতা নিয়ে এসে শুধায়,

‘ এইসব কি বলছো? আমি একজন অন-ডিউটি ক্রাইম হাইডেন অফিসার। আমি জানি আমার ডিউটি। আর বাকি করলো এই বিয়ের নাটক টা? এইটা শুধুমাত্র নিজের মিশনকে ফুলফিল করার জন্যে করছি, যেন আমাদের মিশনের জন্যে মেহেভীনের কোন ক্ষতি না হয়, আর কিছুই না। সেইটা তুমিও জানো আরিয়ান। ‘

আরিয়ান হুট করে উচ্চস্বরে হেসে বলে, ‘ ঠাট্টা করছিলাম, আমি জানি তুমি কতটা দায়িত্ববান অফিসার। ‘

‘ এই গভীর রাত মশকরার জন্যে উপযুক্ত সময় নয় বলে, আমি মনে করি। ‘

আরিয়ান হাসি থামিয়ে গম্ভীর ভাবে বসে পরলো। মায়রাও আরিয়ানের পাশে বসে, আরিয়ানের পাশে বসে থাকা আরেক কাপ কফি হাতে নিয়ে, তাতে চুমুক দিয়ে বললো, ‘ এক্সটা কাপে কার জন্যে কফি রেখে দিয়েছিলে? ‘

‘ রাতে ভু/ত ছাড়া আর কে আছে? ভুতের জন্যে বানিয়েছিলাম, খেয়ে ফেললে তুমি। ‘

কিছুটা বিরক্তি নিয়েই বললো আরিয়ান।

‘ কফি খেয়েছি বলে রেগে গেলে? এতো অল্পতে রেগে গেলে এতো সুন্দর চেহারা দিয়ে লাভ হবেনা। জিএফ কেন, বউও জুটবে না। ‘

কথাটি বলে মায়রা খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। আরিয়ান কিছুটা মন খারাপ করে গম্ভীর সুরে বললো, ‘ কলেজের ক্রাশ বয় ছিলাম, ভাব দেখাতে গিয়ে কত সুন্দরী যে ইগনোর মেরেছি তার হিসাব নেই, দেখো আমার কত ফ্রেন্ড বিয়েও করে ফেললো, অথচ আমি এখন পর্যন্ত পিউর সিংগাল। এদিকে মেয়েরা ভাবে আমাকে এক নম্বারের প্লে বয়, জাস্ট ভাবতে পারছো? ‘

মায়রা পুনরায় হেঁসে উঠে। আরিয়ান দ্রুত উঠে মায়রার থেকে কফির কাপ কেড়ে নিয়ে, ‘ আমার কফি আর খেতে হবেনা তোমাকে, ঘরে যাও ফাস্ট। এই ভ্যালেন্টাইনে আমি জিএফ জুটিয়ে দেখাবো। এখন যাও, জাস্ট গো। ‘

মায়রা ফের হাঁসতে হাঁসতে বললো, ‘ আচ্ছা দেখবো আমি, ডক্টর আরিয়ান হাসান তালুকদার আদোও জিএফ জুটাতে পারে কিনা। ‘

____________________
ঘড়িতে তখন ১২টা ছুঁইছুঁই, হাতের পিছনে থাকা সাদা- হলুদ এবং লাল টকটকে গোলাপ ফুলের অপূর্ব বুকে টা নিয়ে আরহাম মেহেভীনের বিছানার পাশে রেখে,মেহেভীনের ললাটে নিজের অধর জোড়া স্পর্শ করে, আনমনে বলে উঠে, ‘ হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন ডে মাই লেডি। ‘

___________________

মেহেভীন ব্যাগ হাতে নিয়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে যাচ্ছিলো, তাদের ভার্সিটিতে ক্লাস শেষে, বসন্তের উৎসব আছে। সবাই শাড়ি পরবে আজ,কিন্তু সে পরবে না। সব বসন্ত যেন অনেক আগেই তার জীবন থেকে বিদায় নিয়েছে। হঠাৎ মেহেভীনের আখিজোড়া যায়, তার বিছানার কিনারে থাকা ফুলের সুন্দর বুকের দিকে। এই বুকেটা কোথা থেকে আসলো? মেহেভীন নানা প্রশ্ন মষ্তিষ্কে রেখে, আনমনে বুকেটা নিজের বুকে ঠেকিয়ে, তীব্র শান্তি অনুভব করলো। অধরে লক্ষ্যনীয় মুচকি মুচকি হাসির ঝলক।
মেহেভীন দেখতে পেলো, বুকেটার মাঝখানে ছোট্ট একটা চিরকুট। সেই চিরকুটে গুটি গুটি অক্ষরে লেখা,

‘ আরো একটি বসন্ত চলে এলো। এই বসন্ত আলাদা, অন্যরকম স্নিগ্ধ, সেই স্নিগ্ধতার কারণ কী তবে তুমি প্রেয়সী? আমার বসন্তের প্রেম তোমাকে নিবেদন করলাম, সামান্য গোলাপ দিয়ে। তুমি সদরে গ্রহণ করলে কৃতার্থ হইবো। দয়া করে আমার আবেদন মঞ্জুর করিয়া, আমার জীবনের বসন্ত হয়ে, আমার মনের গহীনে আজীবন থেকে যাও। হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন্স ডে। ‘
ইতি,
তোমার এক গোপন,প্রেমিক।

আর কিছুই ছিলো না চিরকুটে। মেহেভীন ভরকিয়ে গেলো চিরকুটটি পরে। কার এমন সাহস হলো? আরহামের কড়া দেহরক্ষীদের পেরিয়ে, মেহেভীনের ঘরে এসে এমন প্রেম নিবেদন করতে? মেহেভীনের নানা জল্পনার মাঝে, নীচের থেকে শুনতে পেলো মায়রার হাক। মায়রা হাক ছেড়ে আরহামকে ডেকে বলছে, ‘ আরহাম বেবি কোথায় তুমি? আজকের দিনে ও কি তুমি লেট করবে? কত দেরী হয়ে যাচ্ছে। ‘

মায়রার পরনে বসন্তের হলুদ শাড়ি, আরহাম তড়িঘড়ি করে ঘড়ি পরতে পরতে সিড়ি বেয়ে নেমে এসে, মায়রার কাছে দাঁড়িয়ে, কানে হাত দিয়ে বললো,’ সরি মায়রা ডার্লিং, একটু লেট হয়ে গিয়েছে। চলো, চলো। ‘

আরহাম ও মায়রার সাথে মিলিয়ে বসন্তের হলুদ পাঞ্জাবি পরে যাচ্ছে। আরহামের মা শিরিন বেগম, দুজনকে দেখে নিজের চোখের কাজল দিয়ে, নজর কাটিয়ে বললেন, ‘ কত সুন্দর লাগছে আমার বাচ্ছাদের। কারো নজর না লাগুক। তা এখন তোরা কোথায় যাচ্ছিস?’

মায়রা খুশি হয়ে উত্তর দেয়, ‘ প্রথমে বসন্ত উৎসবে, তারপর আরো অনেক জায়গা আছে, আজকে সারাদিন আমরা ঘুড়বো। বিয়ের পরে, আমাদের প্রথম ভ্যালেন্টাইনস ডে বলে কথা। ‘

মায়রার কথা শুনে, নিজের মুখ ঘুড়িয়ে নীচের দিকে চলে আসে মেহেভীন। আরিয়ান মেহেভীনের পাশে দাঁড়িয়ে বলে,’ তুই আমার সাথে আয়। আমি তোকে ভার্সিটিতে ড্রপ করে, হসপিটালে চলে যাবো। ‘

মেহেভীন কিছু বলার আগেই, আরহাম আরিয়ানকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘ হ্যা তা ভালো হবে, তুই বরং স্টুপিড মেয়েটাকে দিয়ে আয়, যা দিন কাল পরেছে,
আজকের দিনে ভার্সিটির কথা বলে, কোথায় যাবে, কে জানে? পড়াশোনা তো এমনিতেই চান্গে তুলেছে সে। ‘

আরহামের কথা শুনে মেহেভীন কিছুটা অভিমানের সুরে আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ আরিয়ান কাউকে বলে দে, যা করতে যাচ্ছে তাই যেন করে। আমাকে নিয়ে কাউকে ভাবতে হবেনা। আমি যা ইচ্ছে আমি তাই করবো। ‘

কথাটি বলে উপরে চলে যায়। আরহাম স্পষ্ট দেখেছে মেহেভীনের আখিজোড়ায় থাকা ছলছল অশ্রু। আরহাম কিছুক্ষন চেয়ে থেকে, মায়রার হাত ধরে বেড়িয়ে গেলো। মায়রা এবং আরহাম গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে গেলো। মায়রা গাড়িতে উঠেই বললো, ‘ আরহাম আমদের এখুনি অফিসে যেতে হবে, আজকে মনে হয়, কিছু একটা হতে চলেছে। ‘

‘ আমারো তাই মনে হচ্ছে। ‘

আরহামের কথায়, গম্ভীর হয়ে পরে মায়রা। অপরদিকে আরহাম এবং মায়রাকে একসাথে বেড়িয়ে যেতে দেখে, অগোচরে থাকা যুবকটি, সেই মহিলাকে ফোন দিয়ে বলে, ‘ আরহাম, মায়রার সাথে বেড়িয়েছে, আরহাম আদোও চাইছে টা কি? নাটক করছে নাকি সবটাই সত্যি। কিছুই তো বুঝে উঠতে পারছি না ম্যাম।’

অপাশ থেকে উত্তর আসে,
‘ তুমি শুধু নজর রাখতে থাকো, বাকিটা আমি দেখছি।’

_________________

অন্যদিকে অভ্রের মায়ের পার্টিতে যাওয়ার জন্যে একটা সাদা কাতানের শাড়ি পরে, চোখে কালো কাজল করে, মধ্যকালো কালো টিপ পরে নেয় মেহেভীন। নিজেকে খুটিয়ে দেখে নেয়, মন্দ লাগছে না। আচ্ছা মায়রা কি তার থেকেও বেশি সুন্দর? মেহেভীন আরহাম এবং মায়রার বিষয়টি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে, পার্টির উদ্দেশ্যে রওনা দেয় সে, কিন্তু সেখানে কি সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে তার জন্যে?

চলবে কি?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে