ভালোবাসি প্রিয় তোমাকে পর্ব-০৫

0
991

গল্পঃ ভালোবাসি প্রিয় তোমাকে
পর্বঃ ০৫
নিঝুম জামান (ছদ্মনাম)

রিমির কথা শুনে আমি এক লাফ দিয়ে খাট থেকে নেমে গেলাম। মুখ দিয়ে অটোমেটিক বের হয়ে গেল,
‘অসম্ভব!’

তানভীরও রিমির মুখে এইকথা শুনে অবাক হয়ে দৌড়ে চলে গেল নিষান ভাইয়ার কাছে, সবটা জানার
জন্য। তানভীর চলে যেতেই রিমি আমার গলা জড়িয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠল,

‘নিষান ভাইয়ার আম্মু তো তোমাকেই বউ বানানোর জন্য পাগল হয়ে গেছে। তুমি নাকি তাকে অনেক মায়া নিয়ে সেবাযত্ন করেছো। তোমার মাঝে তিনি
তার মেয়ের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়েছেন। তাই তোমাকেই নিষান ভাইয়ার বউ বানাবে।
ও নিরাপু গো, আগে জানলে তো ওই আন্টিকে আমি
দিনরাত সেবাযত্ন করতাম। এখন কি হবে নিরাপু?’

রিমির কথা শুনে আমার বেশ হাসি পেল। আমি কোনো মতে হাসি চেপে বললাম, ‘আরে বোকা, কাদঁছিস কেনো? তুই এখন থেকে সেবাযত্ন করা শুরু কর আন্টির। দেখবি আন্টি তোকেই তার ছেলের বউ বানাতে চাইবে।’
.
রিমিকে সান্ত্বনা দিয়ে রুমের বাইরে যেতেই মা ডাক দিলেন। মায়ের কাছে যেতেই মা আমাকে বললেন,

‘নিরা মা আমার, তোকে একটা কথা বলব। মনোযোগ দিয়ে শুনবি, কথার মাঝখানে কথা বলবি না।’

আমি বাবা আর খালামনির দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লাম।

‘আমরা আসলে তোর সাথে নিষানের বিয়ে দিতে চাই। নিষানের মা তোকে ছেলের বউ বানাতে চায়।
এতো বড় সিদ্ধান্ত তো আমরা একা নিতে পারি না, তোর বিয়ে হবে তোরও তো মতামত আছে, তাই না?
তোর বিয়ের আলাপ-আলোচনা করতেই তোর বাবা এখানে সকাল সকাল এসেছে। আমরা সবাই রাজি,
সব ঠিকঠাক এখন তুই রাজি হলেই বিয়েটা হবে।
তুই কি রাজি মা?

মায়ের কথা শুনে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।
মায়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘সবে মাত্র ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি আম্মু, এখন আমি বিয়ে-শাদি করব না। আমি ছোট মানুষ। আগে এইচএসসি কমপ্লিট করি, অনার্সে ভর্তি হই। তারপর না হয় তোমরা বিয়ের চিন্তা করো..

নিরার কথাগুলো ওর মায়ের পছন্দ হলো না। ‘নিজেকে ছোট বানিয়ে রাখবি না নিরা। আমার তো
এসএসসি পাসের পরে বিয়ে হয়েছিল, তাই বলে কি আমি কলেজে পড়ি নি? আমিও বিয়ের পর এইচএসসি কমপ্লিট করেছি। তাছাড়া অনার্সে ভর্তি হবি তো ছয়মাস পরেই। শুধুমাত্র এইচএসসি পরীক্ষা হওয়ার অপেক্ষা মাত্র। তোর তো ১৮ বছর হয়েছেই। ‘

‘ তোমাদের জামানা আর এই জামানা এক না।
তোমাদের সময় বাল্যবিয়ের হার কত ছিল? আর এখন কত?
ছয়মাস পরে আমি যখন অনার্সে উঠব তখন বিয়ের জন্য ছেলে দেখো। অনার্সে উঠার আগে আমি বিয়ে করব না। নিষান ভাইয়াকে তো না-ই।'(নিরা)

আমার কথা শুনে মা কিছুটা ক্ষেপে গিয়ে আমাকে কিছু বলবেন তার আগেই খালামনি বললেন,

‘আপা তুই থাম। আমি নিরাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলছি। নিরা আম্মু শোনো, নিষানের আম্মা মাঝে মাঝে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার ছোট ছেলের বউ দেখার অনেক সাধ। কিন্তু নিষানেরও তো বিয়ের বয়স হয় নি। কিছুদিন আগে নিষান ইন্জিনিয়ারিং করেছে। নিষান চাকরী খুঁজছে, তাই তিনি নিষানের জন্য বউ দেখছেন, কাউকেই তার মনে ধরে নি। তোকে পছন্দ হয়েছে।
এজন্য তিনি শুভ কাজে দেরী করতে চান না। আর তোকেও পড়াশোনা করাবে, নিষান ছেলেটাকেও আমার যথেষ্ট সার্পোটিভ মনে হয়েছে। দেখতেও যথেষ্ট সুন্দর, আচার ব্যবহারও খুব ভালো। এত ভালো ছেলে আমরা হাতছাড়া করতে চাই না। আর নিষানকে বিয়ে না করার কোনো কারনই আমি দেখছি না।’

‘ আচার-ব্যবহার ভালো দেখলে কই? তিনি তো এক নাম্বারের বদরাগী, তাকে আমার একদমই ভালো লাগে না। তার চেয়ে ভালো হয় খালামনি রিমির সাথে ওনার বিয়ে দাও।’

আমার কথা শুনে মা আমার দিকে তেড়ে এলেন।
‘দেখেছিস সালমা, তুই আমাকে বলিস না আমি এত বড় মেয়েকে কেনো মা’রি? সবসময় মুখে মুখে তর্ক করে।

‘আহ, আপা তুই এত হাইপার হয়ে যাচ্ছিস কেনো?এই বয়সের মেয়েরা তো এমনি হয়, এ বয়সটা আবেগের। তুই ওকে যেকোনো কথা বুঝিয়ে বলবি। তা না করে তুই রেগে যাস,তোর মতোই জেদি তোর মেয়ে।’
এরপর খালামনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘আম্মু, তুমি যে রিমির সাথে বিয়ে দেওয়ার কথা বললে রিমি সবেমাত্র টেনে পড়ে। ওর কি বিয়ের বয়স হয়েছে নাকি?ওতো ছোট মানুষ। আর বড় রেখে কি কেউ ছোটকে বিয়ে দেয়।’

‘হুম, নিষান ভাইয়ার সাথে প্রেম করার জন্য আমাকে ধরেছে সে আবার ছোট মানুষ। (মনে মনে)

খালামনি আবারও বললেন,
‘তুমি রাজি হয়ে যাও, আমরা কথা বলেছি ওনারা শুধু এখন বিয়ে পড়িয়ে রাখবে, তোমার পরীক্ষার
পরে অনুষ্ঠান করব আমরা।’

আমি মুখ ভেংচে উত্তর দিলাম, ‘ আমি কিছু জানি না। শুধু এতটুকু জানি আমি এখন বিয়ে করব না।’
বলে রুম থেকে বেরিয়ে আসলাম। পিছনে খালামনি-আম্মু ডাকছিল আমি ঘুরে তাকাই নি। এখন তাদের প্যানপ্যানানি শোনার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নাই।
.
মুডটাকে রিফ্রেশ করতে ফোনটা হাতে নিয়ে ছাদে
যাচ্ছিলাম ইন্টারনেট ব্যবহার করতে। ঘরে ইন্টারনেট কানেকশন একবারেই লো। কয়েক সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার পর দেখি নিষান ভাইয়া। তিনি হয়ত ছাদ থেকে নামছিলেন। আমাকে নিচুস্বরে ডাক দিলেন, ‘নিরা’

সকালের কাহিনি মনে পড়তেই আমি না দেখার ভান কর পাশ কাটিয়ে চলে যেতে লাগলাম। সে পেছন থেকে আমার হাতটা টেনে ধরল। হঠাৎ টান দেওয়ায় আমি পড়ে যেতে যেতে রেলিং ধরে নিজেকে সামলিয়ে নিলাম।
‘কি সমস্যা আপনার? হুটহাট আমার হাত ধরেন কেন?’

‘তোমার সাথে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে আমার।’

‘আমার আপনার সাথে কোন কথা নেই। আমার হাত ছাড়ুন।’ বলে নিরা ওর হাতটাকে একটা ঝাড়া দিল।কিন্তু নিষান ওর হাতটা ছাড়ল না বরং আর শক্ত করে ধরল।
‘আমার কথা না শুনলে ছাড়ব না।’

‘দেখুন আমি অতটা বেহায়াও নই যে যার হাতে চ’ড় খেয়েছি তার সাথে কথা বলব।’

‘উফ, আগের কথা বাদ। আমি যে তোমার হবু বর সেটা জানো?’

নিরা নাক ফুলিয়ে মুখ আরেকদিকে ঘুরিয়ে বলল,
‘আমি এই বিয়েতে রাজি হই নি। সো আপনি আমার হবু বরও না আমি আপনার হবু বউও না। আপনি কি মানুষ বলুন তো? আপনার সাথে প্রেম করতে রাজি হলাম না বলে সরাসরি আন্টিকে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব
পাঠিয়ে দিলেন?’

‘আমি মাকে কিছুই বলি নি। মায়েরই তোমাকে ভীষণ পছন্দ হয়েছে আমার বউ হিসেবে। ‘
যাইহোক, আজকে কিন্তু বেগুনি থ্রি-পিসে তোমাকে অসম্ভব সুন্দর লেগেছে। পুরো আমার বউয়ের মতো।’

‘মানে? আপনার আরেকটা বউ আছে? ছিঃ মানুষ কি খা’রাপ, এক বউ থাকতে আবার কেউ আরেকটা বিয়ে করতে চায়?’

নিষান চোখ রাঙিয়ে বলল, ‘কথা এত প্যাঁচাও ক্যান?
আমি বোঝাতে চেয়েছি বেগুনি থ্রি পিসে তোমাকে এতই সুন্দর লেগেছে যে মন হচ্ছিল তুমি আমার বিয়ে করা নতুন বউ।’

‘আজাইরা কথা না আমার শুনতে একদম ভালো লাগে না। কি গুরুত্বপূর্ণ কথা যেন বলতে চাইছিলেন সেটা তাড়াতাড়ি বলুন আমার হাত ছাড়ুন। ‘

‘ভালোবাসি নিরা। ভালোবাসি_প্রিয়_তোমাকে।’

নিরা মুখ ভেংচে উত্তর দিল,, ‘ফালতু যত্তসব।’ বলে নিষান ভাইয়ার কাছ থেকে হাত ছুটিয়ে ছাদে না গিয়ে নিচে নেমে গেল। নিচে নামতেই নিরা দেখে রিমি নিষানের
মায়ের পা তেল দিয়ে মালিশ করছে। নিরাকে দেখে
নিষানের মা ডাক দিলেন। নিরা কাছাকাছি যেতেই
নিষানের মা বলে উঠলেন,

‘তোমরা বোনগুলা সত্যিই অনেক ভালো। আমার পা ব্যথা করছে শুনে রিমি সরিষার তেল রসুন দিয়ে
হালকা গরম করে এনে পায়ে মালিশ করে দিচ্ছে।
সন্ধ্যা থেকে আমার সেবাযত্ন করছে, আমাকে শরবত বানিয়ে খাইয়েছে, নিজে থেকে চুল আচঁড়ে দিয়েছে।একমুহূর্তও একা থাকতে দেয় নি। যে বাড়ির বউ হবে সে বাড়ির ঘরের লক্ষ্মী হবে। ওকে পেয়ে
ওর স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি ধন্য হবে।’

আন্টির মুখে রিমির প্রশংসা শুনে আমার হেসে গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা। নিজেকে কোনমতে
সামলে নিলাম। রিমির মা হয়ে খালামনি ধন্য হতে পারল না, আর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা নাকি ধন্য হবে! রিমি নিষান ভাইয়ার আম্মুকে যে
যত্নআত্তি করছে তার দশভাগের একভাগ সেবাও
খালামনির জন্য করেনা। বেচারা আন্টির পোলার
বউ হওয়ার কতকিছু করছে আর আন্টি সেটা না বুঝে অন্যের বাড়ির বউ হওয়ার দোয়া করছে।
রিমির দিকে তাকিয়ে আমি ভ্রু দিয়ে ইশারা করলাম। রিমি আমার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে আছে।
এর মাঝেই আন্টি আমাকে বললেন,

‘নিরা মা, তোমাকে সরাসরি কয়টা কথা জিজ্ঞেস করি। কিছু মনে করো না, তোমাকে নিজের মেয়ের মত ভেবেই জিজ্ঞেস করছি।
তুমি নাকি নিষানকে বিয়ে করতে রাজি হও নি?
তোমার মা আমাকে বললেন। তা রাজি না হওয়ার কারণটা বলবে মা?’

সরাসরি এমন প্রশ্ন শুনে আমি থতমত খেয়ে গেলাম।
আমি তো আর বলতে পারি না আমার খালাতো বোন আপনার ছেলের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে, এসব প্রশ্ন তার সামনে করলে তার কলিজা পো’ড়া গন্ধ পাব আমি। আমি আমতা-আমতা করে উত্তর দিলাম,

‘আন্টি সামনে আমার এইচএসসি পরীক্ষা, তাই এখন বিয়ে করতে চাচ্ছি না। বিয়ে হলে পড়াশোনার বিরাট ক্ষতি হবে। তাছাড়া নিষান ভাইয়া খুব রাগী। আমাকে সেদিন সবার সামনে মেলায় চ’ড় মে’রেছিল।’

আমার কথা শুনে আন্টি জোরে হেসে ফেললেন।
ওনি বললেন, ‘এই সামান্য কারনে তুমি বিয়েতে রাজি নও। এই নিষান এদিকে আয়।’
বলে উনি দরজার দিকে ইশারা করলেন। আমি আন্টির বিপরীত পাশে বসে ছিলাম, মাথা ঘুরিয়ে
দেখলাম নিষান ভাইয়া দরজার সাথে দুহাত ভাঁজ করে দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। এতক্ষণ
নিশ্চিত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের কথা শুনছিল। আন্টি ওনাকে আমার পাশে বসতে বললেন। ব্যাপারটাতে আমি অনেক লজ্জাবোধ করলাম। আন্টি নিষান ভাইয়ার কানটা টেনে ধরে গালটা তার সামনে নিয়ে লহালকা করে একটা থা’প্পড়
দিয়ে আমাকে বলে, ‘ নিরা আম্মু, এবার খুশি হয়েছো? নিষানকে মে’রেছি।’

আন্টির কথা শুনে আমি হাহাহা করে হেসে দিলাম। ছোট বাচ্চারা মাটিতে পড়ে ব্যথা পেলে আমরা
যেমন মাটিকে মে’রে বাচ্চাদের সান্ত্বনা দেই, আন্টির কাহিনিটাও আমার ঠিক তেমনই মনে হলো।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে